করোনার সুফল-কুফল/ ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান

নজরুল ইসলাম খান

ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান

মানুষ যখন আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের সীমালঙ্ঘন করে তখন আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে বিপদ-আপদ আর ক্ষুদা-দারিদ্র্য দিয়ে পরীক্ষায় ফেলেন। যাতে বান্দা আবার তার পথে ফিরে আসে। আল্লাহ চান বান্দা যেন আনন্দ-বেদনা সর্বাবস্থায় তার কাছে নতি স্বীকার করে। আল্লাহ ছাড়া যে দ্বিতীয় কোনো ইলাহ নেই তার প্রমাণ দিতে আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে বান্দাদের বিপদ-মুসিবত দিয়ে পরীক্ষা করেছেন। যারা আল্লাহর প্রকৃত বান্দা, ঈমানের দিক থেকে শক্তিশালী তারা এসব বিপদের মুহূর্তে আল্লাহর উপর আস্থায় অবিচল থাকে। আর যারা ঈমানের দিক থেকে দুর্বল তারা ভেঙ্গে পড়ে সময়ের সাথে সাথে। বাংলাদেশে করোনা সনাক্ত হওয়ার পূর্ব থেকেই আমি এদেশের মানুষের জীবনাচার নিয়ে খুবই বিরক্ত ছিলাম। আল্লাহর কাছে এর সমাধানের জন্য মনে মনে প্রার্থনা করতাম। কিন্তু জানতাম না আল্লাহ কিভাবে এর সমাধান করবেন। করোনা আসার পর আমার প্রথমেই মনে হলো আল্লাহ মনে হয় আমার সেই প্রার্থনাটা কবুল করেছেন। করোনায় সবাই যখন উদ্বিগ্ন আমিও এর বাইরে নই। এর ক্ষতির পরিমাণ ভয়াবহ। দৃশ্য অদৃশ্যমান অনেক ক্ষতির মুখামুখি আমরা। তারপরেও আমার কেন যেন বারবার মনে হয়, করোনার কুফলের সাথে আমাদের জীবনে কিছু সুফলও বয়ে আনছে। শুনতে হয়তো ভালো লাগছে না, তবে গভীরভাবে চিন্তা করলে করোনার অনেক ইতিবাচক সুদুরপ্রসারী সুফলও আছে। যা আমাদের জীবনকে দারুণভাবে প্রভাবিত করছে।

করোনা সনাক্ত হওয়ার সাথে সাথে অনেক মানুষ নিজের জীবনের সকল পাপকর্ম সামনে নিয়ে এসেছে। ন্যায়-অন্যায়ের জন্য মানুষের কাছে যেমন ক্ষমা প্রার্থনা করেছে তেমনি মানুষ মহান মাবুদের কাছেও কান্না-রোনাজারির মাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে। বিগত দিনের ক্ষমা প্রার্থনা আর করোনার সময়ে ক্ষমা প্রার্থনার মাঝে পার্থক্য ছিল একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আমরা ধরেই নিয়েছি আমরা যে কোন মুহূর্তে করোনায় আক্রান্ত হতে পারি। যেহেতু এর তেমন কোনো চিকিৎসা নাই তাই আক্রান্ত হওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু। সবার মধ্যে এক ধরনের মানসিক প্রস্তুতিও ছিল। মানসিক প্রস্তুতির কারণে বিগত দিনের ঈমানের সাথে করোনাকালীন ঈমানের বিস্তর পার্থক্য লক্ষ করা গেছে। মানুষের আচার-আচারণ, কথা-বার্তা, দান-খয়রাত সব ক্ষেত্রেই একটা ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ করছি। বিশেষ করে সোস্যাল মিডিয়ার যেসব নারী প্রতিনিয়ত অর্ধনগ্ন ছবি পোস্ট করতো তারাও এখন হিজাব পরিহিত ছবি পোস্ট দিচ্ছে। যাদের টাইম লাইনের পুরোটা খঁুজলেও আল্লাহ-খোদার নাম খুঁজে পাওয়া যেত না, তারাও একটু পরপর কুরআন হাদিসের ওয়াজ-নসিহত পোস্ট দিচ্ছে। আমি একজন নারীর টাইমলাইনে এমন একটা পোস্ট দেখে খুবই অবাক হয়েছি। যারা এতদিন ফেসবুক তো দূরে থাক মুখেও আল্লাহ-খোদার নাম নেয়নি তারা দেখি এখন ইসলামের বড়ো প্রবক্তা। বিষয়টা ইতিবাচক হিসেবেই আমি দেখতে চাই। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে ততই মানুষের মধ্যে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। হয়তো বেশি সময় লাগবে না আগের অবস্থায় ফিরে যেতে। আমি এতেও আশাবাদী। কারণ করোনা সময়কালীন তাদের মধ্যে যে উঁচুমানের মুসলিম হওয়ার প্রাকটিস ছিল তা সহসাই হয়তো হারিয়ে যাবে না। এসব মানুষ যদি আবারো পুরনো অবস্থায় ফিরে যায় তবুও তাদের প্রাত্যহিক জীবনে একটা প্রমাণ রেখে গেল যা তার প্রকৃত ঈমানের পরিচয় বহন করবে। বাস্তব জীবন আর সোস্যাল মিডিয়ার সূত্র ধরে মানুষজন তার জীবনাচারকে একটু হলেও স্মরণ করিয়ে দিতে পারবে। এর মাধ্যমে হলেও মহান প্রভুকে তারা শতভাগ কখনোই ভুলে যেতে পারবে না বলে আমি বিশ্বাস করতে চাই। একটা ইতিবাচক পরিবর্তন তাদের জীবনে আসবেই। অন্তত এ কথা সবার জানা হয়ে গেল এবং প্রমাণ হয়ে গেল সীমালঙ্ঘন করলে আল্লাহর আযাব আসতে সময় লাগে না।

বিগত ৭০-৮০ বছরেও যারা এমন পরিস্থিতির শিকার হননি তাদের ঈমানের দৃঢ়তা বাড়বে বৈ কমবে না আশা করতে চাই। যুবক শ্রেণীর মধ্যে একটা শিক্ষা বিরাজ করবে সব সময়ে এমনটাই বিশ্বাস রাখতে চাই। কারণ তারা খুব কাছ থেকে মৃত্যুর মিছিল দেখছে। শত রকমের সতর্কতার পরেও করোনায় মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। ধন-সম্পদ প্রতিপত্তি ক্ষমতা কোনো কিছুই যে কাজে আসছে তা এদেশের যুব সমাজ খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করছে। এসব কারণে এদের ঈমানী শক্তি হবে অন্যরকম। খাজা বাবা আর ভন্ড পীর ফকিরদের মিথ্যা গল্প বলে তাদেরকে আর প্রতারিত করা যাবে না বলে আমার বিশ্বাস। মানুষ পুঁথিগত বিদ্যার চেয়েও বাস্তব জীবন থেকে বেশি শেখে, তাই করোনা এ শিক্ষাটাই আমাদের দিয়ে যাচ্ছে। 

রাসুল (সা) বলেছেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। এই বক্তব্য যে বাস্তব জীবনের জন্য প্রাসঙ্গিক তা মানুষ বোধহয় ভুলতেই বসেছিল। করোনায় মানুষ যখন এই বাস্তবতার মুখামুখি হলো তখন তাদের মধ্যে হাত ধোয়ার বা পরিষ্কার থাকার প্রতি একধরনের ভালোবাসা জাগ্রত হলো। অনেকটা অভ্যাসে পরিণত হবে আগামী দিনগুলোতে। মানুষ যদি এই অভ্যাসে একবার অভ্যস্ত হয়ে যায় তবে এদেশে অসুখ-বিসুখের কারণে মৃত্যুর হার যে কমে যাবে তা বলতে আর দ্বিধা নেই। আশা করছি এক্ষেত্রে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে এবং এর সুফল এদেশের মানুষ যুগ-যুগ ভোগ করতে পারবে। রাসুলের (সা) হাদিসের এই বক্তব্য যদি মানুষের জীবনে একবার জড়িয়ে যায় তবে তা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। অনাগত অনেক ধরনের রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব হবে। 

আর একটি সুফল হলো সহমর্মিতা। কিছুদিন আগেও মানুষ-মানুষে মারামারি, খুনাখুনির উৎসব চলেছে এদেশে। খবরের কাগজের পাতা উল্টালেই রক্তাক্ত ছবি দেখেছি প্রতিদিন। কিন্তু করোনায় এই চিত্র পরিবর্তিত হয়ে মানুষের নীতিতে এক ধরনের ভালোবাসা এবং পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা লক্ষ করা যাচ্ছে। নেতিবাচক দিক যে ছিল না, তা নয়। তারপরেও অনেক ইতিবাচক দিক প্রত্যক্ষ করেছে এদেশের জনগণ। যা মাত্র কিছুদিন আগেও কেউ আশা করতে পারেনি। অসভ্যতার এই মাত্রা এত তাড়াতাড়ি কমবে তা কেউ ভাবেনি। সারাদেশে অন্যায়-অত্যাচার থেকে শুরু করে নেতিবাচক কাজ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে মানুষ। অনেক ইতিবাচক জননন্দিত কাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে এই করোনা সংকটকালে। এসব কাজের একটা সুদূর প্রসারী ফল এদেশের মানুষ ভোগ করবে আশা করি। 

যারা প্রচুর অর্থ বিত্তের মানুষ তারাও দুহাতে বিলিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে মানবিক ও নাগরিক মূল্যবোধের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। ভয়কে জয় করে অনেক মানুষ করোনা রোগীর সেবায় নিজেকে স্বেচ্ছায় বিলিয়ে দিয়েছেন যা খুবই ইতিবাচক এবং আশাব্যঞ্জক। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে সকল মানুষ এক উচ্চতর মানবিক মূল্যবোধের ভীত তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ধর্মবর্ণ গোত্রের সব ধরনের দম্ভ ভুলে গিয়ে এক আল্লাহর আদেশ পালনে মানুষ একাকার হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করেছে। কারণ সবাই ভেবেছে এমন ভালো কাজ করার সুযোগ জীবনে দ্বিতীয়বার নাও আসতে পারে।

করোনাকালীন সময়ে মানুষ দীর্ঘদিন লকডাউনে থাকার সুযোগ পেয়েছে। এই সময়ে মানুষ নিজ পরিবার পরিজনের সাথে সময় কাটিয়েছে। যন্ত্রের মতো জীবন থেকে বেরিয়ে সৌহার্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। যা ইতোপূর্বে মানুষের মধ্যে হারিয়ে যেতে বসেছিল। গতির সাথে পাল্লা দেওয়া জীবন থেকে করোনা মানুষকে মুক্তি দিয়েছে অনেকদিন। পারিবারিক বন্ধনের যে ভীত তৈরি হলো তা পারস্পরিক জীবনে সুফল বয়ে আনবে সন্দেহাতীতভাবে। একজন আরেক জনের কল্যাণে এগিয়ে আসার সাহস ও শক্তি যুগিয়েছে এই করোনা। বিপরীত চিত্র যে নাই তা আমি বলছি না। আমি নেতিবাচক পরিবর্তনগুলো ভুলে যেতে চাই এবং আশা করি এ পরিবর্তনগুলো জীবন-জীবিকার সংগ্রামে জড়িত হয়েও মানুষ সহসাই ভুলে যাবে না। এসব গুণাবলি মানুষের জীবনে অব্যাহত রাখতে পারলে আমাদের পারিবারিক জীবনের দৈন্য অনেকাংশে হ্রাস পাবে। তৈরি হবে একটি অনিন্দ্য সুন্দর পারিবারিক গল্পের পটভূমি। এভাবে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে আমাদের জীবনে যা করোনার সুফল হিসেবে বিবেচনা করা যায়। 

এছাড়াও বিশ্ব ধরিত্রির পরিবেশে একটা দারুণ পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে গোটা পৃথিবীতে। অনেকটা সময় এর সুফল ভোগ করার সুযোগ পাবে এই পৃথিবীর মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী।

করোনার সামগ্রিক কুফল বিবেচনা করলে বড় কুফল হলো- আমাদের অর্থনীতিতে বড়ো একটা ধাক্কা লেগেছে। যা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে যাবে। এদেশের মানুষের মধ্যে প্রচুর আবেগ আছে। তবে আমি আশা করি, এদেশের মানুষ যদি একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় তবে জীবনের চাকা ঘোরাতে খুব বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু এই সময়ের জন্য দরকার হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিরতা এবং চ্যালেঞ্জিং নেতৃত্ব। এ বিষয়ে নজর দিতে পারলে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা সম্ভব হবে এবং ভাগ্যোন্নয়নে দ্রুত পরিবর্তন আসবে।

করোনার আগে মানুষের মধ্যে একটা তীব্র গতি ছিল। করোনায় সব হারিয়ে এই গতিবেগ আরো কত তীব্র হবে এই নিয়ে আমার যথেষ্ট চিন্তার কারণ আছে। এই সংকটে যারা বেঁচে যাবে তারা শুধু নিজের জন্য বাঁচবে না তারা এই জাতিকেও বাঁচাবে বলে বিশ্বাস করতে চাই। তাই জীবনের গতির তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই। শুরুতেই একধরনের হানাহানি, লড়াই বেঁধে যেতে পারে। এটা হবে অর্থনৈতিক মুক্তির লড়াই, বেঁচে থাকার লড়াই।

%d bloggers like this: