জল মাখা জীবন (দুই)/ আফরোজা পারভীন 

আফরোজা পারভীন

আফরোজা পারভীন

জল মাখা জীবন (ধারাবাহিক উপন্যাস) 

গ্রামের সুনশান  নির্জনতা এখন নেই। অথচ থাকবার কথা। শেষরাতে ঘুম বেশি হয়। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষের চোখে ঘুম ঝেঁপে আসে। কিন্তু ঘুমাতে পারেনি মথুর, ঘুমায়নি ধলা, কার্তিক, গদা, বিজন। রাতজেগে মাছ ধরেছে ওরা। কদিন ধরে জালে মাছ ভাল পড়ছে না। মাছ কম পড়া মানে পেটে ভাত কম পড়া। তাই আজ সারারাত মাছ ধরেছে ওরা। প্রথম রাতে আকাশে কিছু তারা ছিল।  সে তারার আলোয় ছোট নৌকায় কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বেলে ছিপ ফেলে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেছে ওরা। পাশাপাশি তিনটে নৌকায় ছয়জন লোক অথচ যেন মানুষের চিহ্নমাত্র নেই। মাঝরাতে ঘুটঘুটি অন্ধকার ছেয়ে ধরেছিল চারদিক। শেষরাতের দিকে  একটি দুটি করে তারা জেগে উঠেছিল আকাশে। মেঘ সরে গিয়েছিল। তখনও ঠায় বসেছিল মানুষগুলি। মাঝে মাঝে ছিপে টান পড়ছিল। সুতা খুলে যাচ্ছিল ছড় ছড় করে। হ্যাচকা টান দিয়ে ছিপ তুলে ফেলেছিল মাছ শিকারীরা। জালও ফেলেছে ওরা নির্দিষ্ট কিছু চকে যেখানে মাছের ঝাঁক পড়ে। জায়গাগুলো সবার চেনা। চারও পেতেছিল। যাকে বলে সবরকমের চেষ্টা করা। মাছ ভালই পেয়েছে ওরা। মন তাই সবারই খোস। অনেক রাতে গামছার খুট থেকে মুড়ি গুড় বের করে চিবিয়ে ঢকঢক করে গিলে নিয়েছিল ওরা। বিজন ছেলেটাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে হাত নেড়ে কাছে ডেকেছিল মথুর। নিঃশব্দে কাছে এসেছিল বিজন। মুঠো ভরে ওর হাতে মুড়ি তুলে দিয়েছিল। গুড়ের কিছুটা দিয়েছিল চিবিয়ে ভেঙ্গে। ছেলেটাকে মথুরের খুব পছন্দ । বাপ মা মরা ছেলে। আছে এক জ্যাঠার কাছে। জ্যাঠা ওকে বড্ড খাটায়। দিনরাত মাছ ধরে মথুর। মাছ বেঁচা পুরো টাকাটা তুলে দেয়  জ্যাঠার হাতে। হাত খরচার দুটো একটা টাকাও ওকে দেয় না জ্যাঠা। একদিন বিজনের খুব শখ হয়েছিল তরতাজা পোনা মাছের ঝোল খেতে। দুখানা মাছ নিয়ে গিয়েছিল বাড়িতে। তা দেখে জেঠির সেকি রাগ। চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিল, 

: বাপ মারে খেয়ে মন ভরেনি।  সাধ হযেছে পোনা খাবার। খা পোনা খা, তোর নিজের মাথা খা। 

মাছ রেঁধেছিল বটে কিন্তু বিজনের পাতে তার সামান্যই পড়েছিল। গালাগালির পুরোটাই খেতে হয়েছিল বিজনকে। যারা মাছ খায় তারা  গাল খায় না । নিজ হাতে তাদের মাছ ধরতেও হয় না।   জেঠির ছেলে মেয়েদের ভাগ্যকে সেদিন হিংসে হয়েছিল বিজনের। 

মাঝে মাঝে মথুরের কাছে নিজের কষ্টের কথা বলে বিজন। তবে ছেলেটা বড় পেট চাপা।  খুব একটা বলে না। ওকে অনেক বুদ্ধি পরামর্শ দিয়েছে মথুর। বলেছে তুই একা মানুষ। ওরা তোর কেউ না। আপনজন হলে তোকে কি এতো কষ্ট দিতো বল। রোজগারের টাকার পুরোটা ওদের হাতে দিবি না। জমা করে রাখবি । আর আসছে ফাল্গুনে একটা বিয়ে কর।  বিযে হলে দেখবি দুনিয়াটা কতো সুখের, স্বর্গের মতো। তখন তোর শরীর স্বাস্থ্যের দেখাশুনা খোঁজ খবর নেয়ার একটা লোক হবে। আজ না হয় একা আছিস, চিরদিন তো থাকবি না। কি বলিস কানে কথা গেল?

কথা বলে না বিজন। লজ্জায় মুখটা সিঁদুরে মেঘের মতো লাল হয়। সেদিকে তাকিয়ে স্বপ্ন বাসা বাঁধে মথুরের মনে। মেয়ে ইন্দুমতি বড় হয়েছে। বিয়ের যুগ্যি হয়েছে। মেয়েটার রকম সকম যেন কেমন। সারাক্ষণ ছটফট করে। তা দেখে গা ছমছম করে মথুরের। সেদিন তারামনিও বলছিল, 

:হ্যাগা ইন্দুর ভাবসাব যেন কেমন। কেমন যেন উড়াল উড়াল । ঘরে দুদন্ডও তিষ্টোতে চায় না। খালি ঘাটে যাবার বায়না। এক পানি সাতবার আনতে চায়। সেদিন খেয়াল করে দেখলাম ঘড়ার পানি এদিক ওদিক চেয়ে আলগোছে ঢেলে ফেলল। তারপর এসে আমাকে বলল খাওয়ার জল ফুরাইছে, নিয়ে আসি মা। আমি কিছু বললাম না।  নজরে নজরে রাখছি ছুঁড়িকে। ভাবগতিক তেমন ভাল দেখছিনে। তুমি ওর একটা বিয়ের জোগাড় দেখ। সেয়ানা মেয়ে মানে আগুন নিয়ে বসবাস। গোখরো সাপ নিয়ে  ঘর গেরস্থি। ভালয় ভালয় পার করো বাপু। 

সেই থেকে বিজনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে মথুর। তারামনিকে বলেছে স্বপ্নের কথা। তারামনিরও বড় পছন্দ বিজনকে। কিন্তু ওর অবস্থা বড় খারাপ। আছে জ্যেঠার আশ্রয়ে। বিয়ে করে বউকে খাওযাবে কি। তাতে ইন্দুমতির সাধ আহ্লাদের বাড় বাড়তি। অল্পে  মন ওঠে না। গায়ে বাসনা সাবান  চাই, পরণে লাল ডুরে শাড়ি চাই। তাও আবার খারে কাঁচা হওয়া চাই, মুখ ভরা পান চাই, পা ভরা আলতা চাই, হাত ভরা চুড়ি চাই। এতসব বিজন জুটাবে কেমন করে। মথুর অবশ্য তারামনির এ চিন্তা এক ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। মেয়েমানুষের যেমন বুদ্ধি। আরে পুরুষের  শরীরটাই আসল। খাটবে খাবে। ভাবনা কি। আমারই বা কি ছিল বিয়ের সময় বল । তোমারে শাড়ি গয়না দিতে পারিনি ঠিকই কিন্তু না খাইয়ে তো রাখিনি।  এতো আর জমিদারী না যে বছর বছর  বসে খাবে আর নিলামে উঠবে। যার কিছু নেই তার খোয়া যাবার ভয় নেই। 

স্বামীর জোরালো কথায় একমত হয়েছে তারামনি। সত্যিইতো স্বামীতো তাকে ভালই রেখেছে। বাপের ঘরে একবেলা জুটলে আর এক বেলা খাবার জুটতো না। সে তুলনায এখন স্বর্গে আছে। তাছাড়া কৈবর্ত পরিবারে কার গায়েই বা গয়না আছে।  মনে মনে সেও বিজনকে জামাই ঠিক করে রেখেছে। বাড়িতে যেদিন দুটো ভাল মন্দ রান্না হয় স্বামীকে চুপিচুপি বলে, 

: হ্যাগা  আজকে আসবার কালে বিজনকে সাথে নিয়ে এসো। দুটো ভাম মন্দ রাঁধবো। একপাত খেয়ে যাবে। বেচারার মা নেই। 

বিজন এলে তুলে রাখা কাসার  ঘটিটা বের করে তারামনি। ঝকঝকে করে মাজে। ভাতের থালাটা হাতে  দিয়ে  ইন্দুকে পাঠায় সামনে। কিন্তু মেয়ের কি সেদিকে মন আছে!  তুই এখন বড় হয়েছিস, বিয়ের যুগ্যি। তোর তো বোঝা উচিত কেন তোরে বারবার বিযের যুগ্যি ছেলের সামনে পাঠাই।  বিজনের মন বুঝতে পেরেছে তারামনি। ও ঠারে ঠোরে ইন্দুকে দেখে। দেখে যেন চোখ ফেরাতে পারে না, আঁশ মেটে না। ছেলের যখন পছন্দ আর ভাবনা কি । ইন্দুই দেখতে ময়লা, ছোট গোরী বেশ ফরসা। তাইতো ওর নাম গোরী। ওকে নিয়ে তেমন ভাবনা নেই। আজও ইন্দু  স্বামীকে বলেছে বিজনকে সাথে নিয়ে আসাতে। যদিও তিনদিন ধরে জালে মাছ পড়ছে না। ঘরে টাকা আসছে না। তবু ভালমন্দ রেঁধেছে তারামনি। আজ জামাইষষ্ঠি জামাই হয়নি তাতে কি!  হবে তো।  তাই মথুরকে বলেছে, আসার সময় বিজনকে সাথে নিয়ে এসো। দুটো খেয়ে যাবে।  

: পেটে ভাত নেই হঠাৎ !  ব্যাপার কি?

: আজ জামাইষষ্টি। তাই

:জামাইষষ্টি তাতে কি? বলেই হো হো করে হেসে ওঠে মথুর। 

: আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি। আমার বউ ও যেমন । গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল। । ঠিক আছে নিয়ে আসবো। তবে  বউ আজ ফিরতে ফিরতে তো রাত ভোর হয়ে যাবে। 

:তা হোক।

বিজনকে বাড়িতে যাওয়ার কথাটা বলা হয়নি। বিজন কখনই  না  করে না। দুটো ভাল মন্দ খাওয়ার সাথে বাড়তি কিছু  পায়।  বয়স গেছে বটে তবে বুঝতে ভুল হয না মথুরের। যেমন বোঝে তারামনি। মথুর বিজনের পিঠে হাত রেখে বলে,

: তোর জন্য বড় কষ্ট হয় বাবা। তোর জেঠি কি গামছায় বেঁধে দুটো মুড়ি গুড়ে দিতে পারে না। আর তোকেও বলি, ওরা না দিক তুইতো রুজি করিস।  দুটো মুড়ি গুড় কিনে নৌকায উঠতে পারিসনে। যাকগে শোন তোর কাকি যেতে বলেছে আমার সাথে। এক পাত খাবি।

: কেন কাকা?

: আজ জামাইষষ্টি। 

বলব না বলব না করেও বলে ফেলে মথুর। কি যেন বলতে যায় বিজন। পরক্ষণে টকটকে লাল হয়ে ওঠে   ওর মুখ। মুড়ি চিবাতে চিবাতে বিষম খায়। মথুর তাড়াতাড়ি জলের ঘটি  এগিয়ে দেয়। ঢকঢক করে জল খায় বিজন। তাতেও ঢেকুর কমে না। চোখে পানি এসে যায় বিজনের।  কিন্তু মুখে হাসি। হাসি মথুরের মুখেও। ছেলেটা একেবারে পোলাপান। তার ইন্দুমতিও তো পোলাপান একটা। দুটিতে মানাবে বেশ। আর ভাবার সময় পায় না মথুর। ছিপে টান পড়েছে। প্রাণপণে টানে মথুর। তাকে পেছন থেকে টানে বিজন। 

হাই ভগবান বড় মাছ পড়েছে ছিপে। ছিপটা যেন ভেঙ্গে না  যায়, মাছ যেন ছুটে না যায়। মথুর টানে, তাকে টানে বিজন।  পানিতে পড়তে উপক্রম দুজন সর্বশক্তি দিয়ে টেনে তোলে ছিপ । ছিপের আগায় বিশাল এক টগটকে রুই। ছিপ খুলে ছুটে গিয়ে পড়ে হাওড়ের পাড়ে। মুখে উল্লাস ধ্বনি তুলে লাফ দেয় বিজন। গালের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দড়ি বেঁধে ফেলে। তারপর ঝুঁড়ি চাপা দেয়।  উৎফল্ল­ মথুর বলে, 

:তোর কপাল বড় ভাল বাবা , তুই সাথে থাকলি বড় বড় মাছ ধরা পড়ে জালে।  বড়শি গেলে বড় মাছ। এই দেখ না গত তিনদিন তুই আসিসনি আমার জালে চুনোপুটি ছাড়া কিছু পড়েনি । আর আসা বাদ দিস না বাছা।

: বাদ তো দিই নাই কাকা। অসুখ হয়েছিল । হাড় কাঁপানো জ্বর। এক একবার এমন জ্বর হচ্ছিল মনে হয় ভূমিকম্প হচ্ছে সারা শরীর জুড়ে । সেই গেল সনের ভূমিকম্পের মতো। তিনদিন তিনরাত কোনদিক দিয়ে যে পার হলো বুঝিনি।

: হু  হু  অসুখের আর দোষ কি । না শরীরের যত্ন না মনের। এইতো বয়স এই বয়সে শরীরের যত্ন  না হলি সারাডা জীবনের জন্যি শরীরের কাম শ্যাষ। সেইজন্যইতো বলি বাবা একখান বিয়ে কর।

বিজন হাসে। কিছু বলে না। মথুর চোখের সামনে আড় করে ডান হাত তুলে আকাশের দিকে তাকায়।

: চল বাবা যাই। পূব আকাশ ফরসা হইছে। একটু পরেই সূূর্যদেব দেখা দেবেন। চল যাই পথও তো কম না। তোর কাকী হযতো জাইগে বসে রইছে। আর ইন্দুও হয়তো ঘুমাইনি।

বিজন  নৌকা শক্ত করে খুটি পুতে বাঁধে । মথুর  জাল ঝেড়ে কাঁধে তোলে। জালে লেগে আছে দুচারেেট কুঁচো মাছ ট্যারা পুঁটি এসব। ট্যাংরা মাছ জাল থেকে ছাড়ানো বড় শক্ত। কাঁটা দিয়ে জালে আটকে বসে থাকে। অনেক সময় জাল ছিঁড়ে যায় মাছ খুলতে গিয়ে। সাবধানে মাছ ছাড়ায় মথুর, তারপর কাঁধে ফেলে।  বড়শি দুগাছি হাতে তুলে নেয়। বিজন ঝুড়ি মাথায় নিয়ে নৌকা থেকে নামে। খালি পা দুজনেরই । জেলেদের মধ্যে টায়ার কাটা স্যান্ডেলের খুব চল। নাম অক্ষয়।  বিজনের আছে একজোড়া। কিন্তু জেলে মানুষ সে । স্যান্ডেল দিয়ে কি করবে। পরণের কাপড়ও মাটি কাদায় মাখামাখি। এ অবস্থায় ইন্দুর সামনে যাবে কি করে? এনে মনে সামান্য রাগ হয় বিজনের। মথুর কাকাটা যেন কেমন। আগে বললে ক্ষতি কি ছিল! চলতে চলতে গতি কমিয়ে আনে বিজন । বলে,

: কাকা এতরাতে আর যাবো না।  সবাই ঘুমায় রইছে। কাল সকালে বরং যাবো।

: নারে বাবা তোরে না নিয়ে গেলে তোর কাকি লঙ্কাকান্ড বাঁধাবেনে। বার বার বলে দেছে। তাছাড়া সকালে সময় পাবি না। বাড়িতে যেয়ে দুটো খেয়ে দুদন্ড জিড়োয়ে দুজনে চলে যাব বাজারে। সকাল সকাল মাছ বেঁচতি পারলি ভাল পযসা আসবে হাতে। বাজারে মাছের চালান বেশি হওযার আগেই বেঁচে ফেলতি হবে ভাল দামে। হাতে পয়সা কড়ি নেই, বড় টানাটানি।

বিজন  কথা বলে না। নিঃশব্দে হাঁটে। কি আর করা । এই ময়লা কাপড়েই তাকে যেতে হবে ইন্দুর সামনে। মেয়েটা বড় সৌখিন আর যেন কেমন। ভাল করে তাকায় না তার দিকে। অবশ্য তার সয় সস্পত্তি কিছু নেই। কিন্তু এই গেরামে সবার অবস্থাইতো তার মতো। ইন্দুর বাবারও। ভাবতে ভাবতে মন খারাপ হযে যায় বিজনের। মার দুগাছা রূপোর চুড়ি আর চওড়া একখান বিছে হার ছিল। বড় হিসেবি ছিল তাঁর মা আর বড় সৌখিন। অভাবের সংসারে দু চার পয়সা করে জমিয়ে গয়না কখানা বানিয়েছিল গায়ের নিতাই স্যাকরার কাছ থেকে। সে গয়না এখন জেঠির গলায় জেঠির হাতে। গয়না কখানা পেলে ইন্দু  নিশ্চয়ই তারে তুচ্ছ করতি পারতো না। এ গেরামে কজনেরই বা রূপোর গয়না আছে।  পেতলের পয়সা গলিয়ে কোন কোন বউ ঝি দু একগাছা চুড়ি বানিয়েছে । গয়না গাটি  আছে  মহাজনের বাড়িতে, তাদের বউঝিদের শরীরে।  তাদের কথা আলাদা। আর হয়তো কিছু আছে রমজান মায়মালের বাড়িতে।  সে হালের বড়লোক। কিন্তু  সে গয়না  দেখা যায় না। কারণ তার বউ মরছে। ঘরে আছে সতালো বোন , অকালে বিধবা। গয়নাপাতি থাকলেও গায়ে দেয় না সে। এই অবস্থায় দুগাছা রূপোর চুড়ি আর একছড়া হার যদি থাকতো ইন্দু  নিশ্চয়ই তারে তুচ্ছ করতে পারত না। মনে মনে ঠিক করে বিজন  কাকীর কাছে গয়নাগুলো  চাইতে হবে।

: কি এত ভাবতিছ বাবা? মথুর প্রশ্ন করে । 

মথুরের প্রশ্ন যেন গ্রামের সুনশান  নির্জনতা চিরে ফেলে। মনে হয় বোমা ফাটার মতো জোরালো আওয়াজ তোলে কথাগুলো। এখন ওরা গ্রামের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে । চারদিকে নাক ডাকার শব্দ। ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা গান। রাস্তার দুধারের বাঁশঝাঁড়ের পেছনে জোনাক জ্বলছে আর নিবছে। মথুরের বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে ওরা। উঠোনে দাঁড়িয়ে মথুর ডাকে 

: ইন্দু , মা জননী

ঝাঁপ ঝুলে যায়। তারামণি বেরিয়ে আসে হাতে নিভু নিভু কুপি। সারারাত কোরোসিন খুঁইয়ে ওর এখন শেষ অবস্থা। বিজনকে দেখে প্রসন্ন হয়ে ওঠে তারামণির মুখ। 

: আইছ বাবা। খুব ভাল করিছ। অনেকদিন আসো না এদিকে। কইরে ইন্দু  এধারে দুখোন পিঁড়ে পাইতে দে। কি হলো তোরে কি মরার ঘুম পেয়ে বসল। 

চোখ ডলতে ডলতে বেরিয়ে আসে ইন্দু । কাপড় চোপড় অনেকটাই বেসামাল। 

: কি হলো এতো হল্লা করছ কেন। বিজনের দিকে চোখ যায়। কথা শেষ হয় না। কপালে একের পর এক কুঞ্চন রেখা পড়তে থাকে। সেদিকে খেয়াল করে না তারামনি। 

: কিরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছিস কেন। ছেলেটা দাঁড়ায়ে রয়েছে। যা পিঁড়ে পেতে দে। আর শোন কুপিতে কেরোসিন নেই, খানিকটা কেরোসিন ঢেলে আন। আমি এদিকে হাত মুখ ধোয়ার জল দি। মাটি কাদায় একেবারে মাখামাখি।  এই নে কুপি । 

তারামমির হাত থেকে কুপি নেয় ইন্দু।  সাথে সাথে হাত থেকে ছিটকে পড়ে যায় কুপি। কাঁচের দোয়াতের অবশিষ্ট  কোরোসিনটুকু ঢেলে পড়ে বারান্দার মাটি ভিজিয়ে দেয়। তারামনি সরোষে বলে ওঠে, কি অলুক্ষুণ মেয়েরে বাবা। যা তাড়াতাড়ি তেল আন। 

আড়চোখে বিজনের দিকে তাকিয়ে চোখে আগুন নিয়ে দ্রুত চলে যায় ইন্দু। নিভন্ত  কুপির মতোই দপ করে নিয়ে যায় বিজন। ইন্দু  এমন করে কেন? 

(চলবে) 

%d bloggers like this: