ধাওয়া – ২ / শাহানাজ শাহীন
ধারাবাহিক উপন্যাস
ধাওয়া – ২ / শাহানাজ শাহীন
ছেলেবেলায় আমি যা চাইতাম, তা হলো সুহাসিনীর কাছ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে । আমি এটাই চাইতাম , সে আমাকে একা থাকতে দিক ।
এই দুঃসহ সময় শুরু হয় যখন আমরা নিজেদের বাড়িতে এসে উঠি সেদিন থেকে ।
আমি তখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠেছি মাত্র ।
আমার জীবনে শুরু হল এক অস্বস্তিকর অধ্যায় । একদিকে সুহাসিনীর যন্ত্রণা,
অন্যদিকে শহরের শেষ মাথায় তৈরি এই বাড়িটি । আমার গ্রাম্য ভৌতিক সামাজিক জীবন ।
বাবা কায়দা করে আমাকে মায়ের সাথে কাজের বাহানা করে ট্রাক থেকে নামিয়ে দিলেন ।
কিন্তু কোনোকিছুই সুহাসিনীকে থামাতে পারল না । যখন সে আমার হাত ধরল আমি প্রায় বলতে যাচ্ছিলাম তাকে, ভাগ এখান থেকে মেয়ে ?
আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এক অচেনা মেয়ে আমার হাত ধরে রেখেছে ।
কি করে আমি যে এই বিচ্ছিরি অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলাম ! অবশেষে ঐ সাত বছর বয়সে আমার যা করা সম্ভব ছিল আমি তাই করেছিলাম ।
সুহাসিনীর হাত থেকে আমার হাত জোর করে ছাড়িয়ে নিলাম ।
যাইহোক, আমার সমস্যা এখন বহু দূরে অতিক্রম করে এসেছি । নতুন স্কুলে সুহাসিনীর মতো কেউ আর যন্ত্রণা করবে না । কিছুক্ষণের মধ্যে আমি শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করলাম । আজ আমার প্রথম ক্লাস ।
মেঘ? তূমি এখানে । সুহাসিনী আনন্দে দিশেহারা । সে দৌড়ে এসে আমাকে ঝাপটে ধরল ।
আমি আগের মতোই নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম ।
স্বাভাবিকভাবেই স্কুল তো আর নির্জন অরণ্য নয় যে সেখানে কেউ থাকবে না ।
পুরো ক্লাসের ছাত্রছাত্রিরা হাসছে, মজা করছে আমাকে নিয়ে । আমি যখন টিফিন বিরতিতে শ্রেণিকক্ষ থেকে বের হলাম আমার এক সহপাঠী এসে বললো, এই মেঘ তোমার বান্ধবী কই ?
আমার তখন মনে হচ্ছিল জীবনে এক ছাপ লাগিয়ে দিয়ে গেল সুহাসিনী মেয়েটি ।
টিফিন শেষে পাঠ শুরু হলো । আমার পাশে বসা মৃদুল ফিস ফিস করে আমাকে জিজ্ঞেস করল,
মেঘ তুমি কি তাকে বিয়ে করবে?
ছুটির পর আমি স্কুলের মাঠে খেলছিলাম ।
সুহাসিনী আমার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে ।
তার তিন বান্ধবী আমাদের নিয়ে গান বাধল,
” মেঘ আর সুহাসিনী
তারা করে কানাকানি
আমরা তা সকলে জানি “
এই জায়গায় আমার প্রথম কয়েকটা বছর ছিল মারাত্নক ভয়াবহ !
কিন্তু অবশেষে যখন আমি দশম শ্রেণিতে উঠলাম আমি চিন্তা করে একটি উপায় বের করলাম ।
আমি একটি পরিকল্পনা করলাম ।
আমার সহপাঠী সারা তার সাথে। আমি তাঁর কাছে সাহায্য চাইলাম সুহাসিনীর যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পেতে । তাকে বিস্তারিত জানালাম । সারা খুব চমৎকার ও বন্ধুসুলভ একটি মেয়ে । তার মিষ্টি হাসি, ঘনচুল আমাকে মুগ্ধ করে ।
সুহাসিনী আমার পিছনে পিছনে আসছে ।
সারাও ছিল কাছাকাছি ।
আমি সারাকে ডাকলাম ।
সারা দাঁড়া । কি খবর তোর?
আহ, খুব ভালো । তোর ?
হুম । ভালো । চল ক্যান্টিনে গিয়ে বসি ।
চল ।
সারা তুই কানে দুল পরিস না?
দুলের কথা যেহেতু আসল, তাহলে কানের গল্প শোন । শুরুতে আমার মা কিছুতেই আমার কান ফোঁটা করতে দিবে না । আমি চাপাচাপি করতে শুরু করলাম ।
মা কান ফুড়ালে কি সমস্যা?
তোমাকে বড়দের মতো লাগবে।
মার ধারণা আমাকে দেখতে বড়দের মতো লাগবে । এখন দুল পরার বয়স নয় ।
খালাম্মা ঠিকই বলেছেন । চল তুই আর আমি হাঁটি । সুহাসিনী দেখুক আমাদের । তারপর দেখবি ও আর আমার পিছু নেবে না । আমার প্রতি তাঁর উৎসাহের মরণ হবে । হাঁটবি আমার সাথে ?
শর্ত আছে। টিফিন খাওয়াবি ?
আচ্ছা যা খাবি।
কিন্তু আমার মনে হয় না তাতে কিছু লাভ হবে ।
তবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারিস ।
সারা হলো গল্পবাজ মেয়ে। গল্প শুরু করলে আর শেষ হতে চায় না।
জানিস মিনির মাও নাকি মিনিকে কান ফুড়াতে দিতে চায় না ।
আহ্ সুহাসিনী !
হাত ধর । হাত ধর আমার ।
আমি সারার হাত ধরে হাঁটছি ।
সুহাসিনী দেখল কিনা জানি না ।
সুহাসিনী লাইব্রেরিতে । আমি দেখেছি ।
আমরা লাইব্রেরির সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম ।
আমি খুব চাইছিলাম সুহাসিনী দেখুক আমাদের ।
আহ্ খোদা, সে দেখল আমাদের ।
কি শান্তি ! সারা মিনির কান ফুড়ানোর গল্প বলেই যাচ্ছে । আমার বিশ্রি লাগছিল । কিন্তু কিছু করার নেই ।
বিশ্রি মেয়েলি গল্প আজ শুনতে হবে । সুহাসিনীর দখলমুক্ত হতে, সারার সাথে বন্ধুত্ব করা ছাড়া উপায় কি!
এই সারা তুই বিজ্ঞান প্র্যাকটিকাল ক্লাসে কি করছিস? আমি চেষ্টা করছি সারার সাথে বন্ধুত্ব
পাকাপোক্ত করতে । যাতে মেকি ভাব না লাগে ।
ভাবছি শ্যাম্পু বেশি ব্যবহারে চুলের কি ক্ষতি করে ।
বাহ্, সেটা হলে তো খুবই আকর্ষণীয় হবে ।
শোন সুহাসিনীকে বলিস, উদারতা দেখানো মানে পছন্দ করা নয় ।
আমি পা ধুতে ধুতে সারাকে বলছিলাম কথাগুলো । আমার পিঠে মৃদু ছোঁয়া । পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি সুহাসিনী আমার পিছনে । আমি মৃদু হাসলাম তার দিকে তাকিয়ে ।
কিন্তু সুহাসিনীর মুখে কোনো হাসি নেই ।
সে ধুম করে আমার গালে এক চড় মেরে বসল।
আমি প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম ।
চড় খেয়ে আমি হতবাক !
সে চড় মেরে হন হন করে চলে গেল ।
আমি ভাবছি, সে কাজটি মোটেও ভালো করল না ।
আমি ক্লাসে আসলাম । সুহাসিনী ঠিক আমার পিছনের সিটে বসেছে । সুহাসিনী তার একই চরিত্রে অবিচল আছে । সারার সাথে আমার বন্ধুত্বে এতটুকু বদলায়নি । সে নিশ্চয়ই এখন পিছনে বসে চেয়ে আছে আমার দিকে । আমার একমাত্র সান্ত্বনা ছিল হয়তো আগামী বছরটি হতে পারে ভিন্ন রকম ।
মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ হবে । আমি সেরা কলেজের জন্য আবেদন করবো । যেখানে সুহাসিনীর সুযোগ থাকবে না ভর্তি হবার। এবং অবশেষে সুহাসিনীর যন্ত্রণার হাত থেকে আমি রক্ষা পাবো । এবং এই এক তরফা সম্পর্কের ইতি ঘটবে ।
Facebook Comments Sync