আব্বার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী / কাজী মুজাহিদুর রহমান

আব্বার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী

আব্বার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী

বাবা দিবস উপলক্ষে রচনা 

আব্বার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী / কাজী মুজাহিদুর রহমান

 

বছর ঘুরে বাবা দিবস আবার আমাদের মাঝে এসেছে। গত বছর বাবা দিবসে লিখেছিলাম, আব্বার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে কীভাবে চট্টগ্রাম থেকে যশোর এসে পৌঁছেছিলাম। এবার লিখছি ওনার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতে এসে কী কী সমস্যার মুখোমুখি হলাম, তার বর্ণনা । আব্বা ইন্তেকাল করেন ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫। আমরা পরদিন দুপুরে যশোরে এসে পৌঁছিই। এরপর যোহরের নামাজের পর বিমান অফিস মসজিদে জানজার নামাজ শেষে ওনাকে কারবালা গোরস্থানে সমাহিত করা হয়। সেখানে আব্বা ও মা উভয়ের কবরের জন্য একটা জায়গা কেনা হয়েছিল যার নির্দ্ধারিত মূল্য দাফনের আগেই আমরা কর্তৃপক্ষকে পরিশোধ করি। এরপর আমরা আরো চার-পাঁচ দিন বাড়িতে ছিলাম। সেই সময়ের মধ্যে আমি বাঁশের খুটি ও চারিদিকে বেড়া দিয়ে কবরের জায়গাটা ঘিরে, তাতে টিনের ওপর লেখা একটা নামফলক লাগিয়ে দেই। এর পরে চলে যাই কর্মক্ষেত্র চট্টগ্রামে, চাকরিতে যোগদান করতে।

এক বছর পরে, ১৯৯৬ সালে আবার ফেব্রুয়ারি মাস যখন আসল তখন আমি মনস্থির করলাম যশোর যেয়ে ওনার মৃত্যূদিবস পালন করব। সেখানকার মসজিদে দোওয়া ও এতিমখানার ছেলেদের একবেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করব। এজন্য অফিস থেকে তিন দিনের ছুটিও নিলাম। তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অত্যন্ত খারাপ। বাস চলে না। তাই বিমানের টিকেট এমনভাবে কাটলাম যাতে অফিস করে বিকাল চারটার সময় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হতে পারি, আবার ঢাকায় নেমে সংযোগের বিমান ধরে সন্ধ্যার পর যশোরে পৌঁছান যায়। কত দূরের উড়াল পথ, কিন্তু কোন অসুবিধা হলো না। বিমান সিডিউল মত চললো, আমিও যথাসময়ে বাড়িতে পৌঁছালাম। রাতে সিদ্ধান্ত নিলাম, আগামীকাল ১৩ তারিখ সকালে উঠে গোরস্থানে যেয়ে সব কাজ শুরুর আগে কবর জিয়ারত করে, দিনের অন্যান্য নির্ধারিত কাজ আরাম্ভ করব। 

সেই মোতাবেক সকালে গোরস্থানে গেলাম। কিন্তু সেখানে যেয়ে আমার চোখ কপালে উঠলো। আব্বার কবরের চারপাশে গত বছর আমি যে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে রেখে গিয়েছিলাম, তা কেউ দেড় হাত মত সরিয়ে কবরের উপর দিয়ে চলাচলের রাস্তা বের করে, পিছনের কবর পর্যন্ত নিয়ে গেছে। তৎক্ষণাৎ খবর পাঠালাম কেয়ারটেকারকে আসার জন্য। তিনি এসে এর দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করলেন, কিন্তু ভাল একটা বুদ্ধি দিলেন। তাহলো এখনই দেওয়াল দিয়ে কবর পাকা করার ব্যবস্থা করেন। তার কথা মত আমি পাশে ধর্মতলা মোড়ের ইট-বালি-সিমেন্টের দোকানে গেলাম। দোকানের মালিককে আমার আসার কারণটা জানালাম। তাকে কেন জানি আন্তরিক মনে হলো। তিনি আমার সাথে আসলেন, কোন জিনিস কী পরিমান লাগবে, তা দেখতে। তিনি জায়গার মাপ নিয়ে আমাকে বললেন, আপনি এখনই শহরের চৌরাস্তায় যেয়ে দুইজন রাজমিস্ত্রী আর দুইজন যোগালে নিয়ে আসেন। আমি প্রয়োজনীয় সামগ্রী ভ্যান রিকশায় করে এখানে পাঠাচ্ছি। আর মিস্ত্রী এসে পৌঁছালে আমাকে খবর দেবেন, আমি এসে তাদেরকে কাজ বুঝিয়ে দেব। 

আমি রিকশা নিয়ে দ্রুত রওনা হলাম নির্মাণকর্মী আনতে। এই রকম একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি যে হতে পারি, তা আমার ধারণারও অতীত ছিল। নির্ধারিত সব কাজ ভেস্তে গেল। আমি লোক নিয়ে এসে দেখি ভদ্রলোক ফিতা ধরে লে-আউট দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে তিনি বালতি, কোদাল ইত্যাদির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। তিনি মিস্ত্রীদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিলেন। মাটি কতটুকু কাটতে হবে, কোথায় দশ, কোথায় পাঁচ ইঞ্চি গাঁথুনি হবে, উচ্চতা কতটুকু হবে সব খুটিনাটি তাদেরকে বুঝিয়ে কাজ শুরু করালেন। এই রকম একজন লোক পাওয়ার কারণে আমি কাজের বিষয়ে অনেকটা নিশ্চিত হলাম। রোজার সময় বলে দুপুরে খাওয়ার কোন তাড়া ছিল না। কাজ তদারকি করলাম বিকাল পর্যন্ত। এর মাঝে ভদ্রলোক আরো একবার আসলেন। পরের দিন চারজন কর্মীকেই সকাল আটটার মধ্যে কাজে আসতে বললেন। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে মাকে এই অবস্থার কথা জানালাম। তিনি আশ্চর্য হলেন, আত্মীয় স্বজন, প্রতেবেশীরা অনেকেই সেখানে যান, কিন্তু কেউ কখনও বিষয়টা তাকে জানায়নি!

 

পরদিন সকাল আটটা বাজার আগেই আমি গোরস্থানে পৌঁছে গেলাম। নির্মাণকর্মীদের দিয়ে কাজ শুরু করিয়ে  আমি এতিমখানার উদ্দেশ্যে রিকশা নিয়ে রওনা হলাম। কথা ছিল আমি বাজার করে দেব, কিন্তু তা আর হলো না। বাজারের লিস্ট অনুযায়ী তাদেরকে টাকা বুঝিয়ে দিয়ে চলে আসলাম। আমার মনের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা কাজ করছিল যে, আমার অবর্তমানে কেউ যদি এসে কাজের মধ্যে ঝামেলা তৈরী করে। বিশেষ করে যে ব্যক্তি কবরের ওপর দিয়ে  রাস্তা তৈরী করেছিল। এতিমখানায় শুধু বলে আসলাম, আপনাদের সাথে আজ ইফতার করব। একটানা বিকাল পর্যন্ত সেদিনও কাজ করালাম। আর এক দিন করলে কাজ হয়তো শেষ হয়ে যাবে। মানুষ পরিকল্পনাকারী, আর আল্লাহ মহাপরিকল্পনাকারী। তা না হলে দেশের এই বিপর্যস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার মধ্যে আমি সব কাজ ফেলে যশোরে আসার সিদ্ধান্ত নেব কেন? এসেই এই অবস্থার মুখোমুখি হবো কেন? তাৎক্ষণিকভাবে কবর পাকা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া, নির্মাণ সামগ্রী কেনা, লোক যোগাড় করা, এসব কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন লোককে খুঁজে পাওয়া, এই সব কিছুই যেন আমার উপস্থিতির জন্য অপেক্ষা করছিল! আল্লাহর সিদ্ধান্ত কী হবে, সে বিষয়ের মানুষের কোন ধারণা নেই। 

 

পরদিন সকালে কাজ শুরু করিয়ে দিয়ে দোকানের মালিকের সাথে দেখা করে, তাকে একটু কাজের কাছে আসতে অনুরোধ করলাম। ঘন্টাখানেক পরে তিনি আসলেন। তাকে বললাম, আজ সন্ধ্যার ফ্লাইটে আমি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবো। তাই কাজ শেষ করার ব্যাপারে তার সাহায্য চাইলাম। তিনি নিশ্চিতভাবে বললেন, আজকে কাজ শেষ হয়ে যাবে, বাকি থাকবে কিউরিং আর রঙের কাজ। তিনি দায়িত্ব নিয়ে বাকি কাজ করে দিতে রাজী হলেন। বিকাল চারটার সময় আমি তাকে সম্পূর্ণ টাকা বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলাম। রিকশা দাঁড় করিয়ে রেখে ব্যাগটা নিয়ে মা’র কাছ থেকে বিদায় নিলাম। দ্রুত এয়ারপোর্ট এসে চেক ইন করে একেবারে শেষ সময়ে বিমান উঠলাম। কেবিন ক্র সবাইকে ইফতারী পরিবেশন করল। তবে বিমান ছাড়ার পরপর মাগরিবের আযানের সময় হয়ে গেল। আকাশে বিমানের সিটে বসেই ইফতার সেরে নামাজ পড়লাম। শুধু মাত্র সেই রাতটা ঢাকায় থেকে পরদিন খুব সকালে চট্টগ্রাম পৌঁছালাম।

তখনও মোবাইল ফোনের মালিক হতে পারিনি, তাই ল্যান্ড নম্বরে যোগাযোগ করে পরবর্তী কয় দিন কাজের খোঁজ- খবর নিলাম। কিউরিং ঠিকমত হচ্ছে কী না? নামফলক লাগানোর জায়গাটা খালি রাখা হয়েছে কী না? বার্জারের অফ-হোয়াইট কালারের প্লাষ্টিক পেইন্ট দিতে বলেছিলাম, তা দেওয়া হলো কী না? বর্ডারে একটা কনট্রাস্ট কালারের পেইন্ট দিতে বলেছিলাম, তা দেওয়া হলো কী না? যে টাকা দিয়ে এসেছিলাম, তাতে কাজ সম্পন্ন হলো, না আরো টাকা লাগলো? চট্টগ্রামে ফিরে যাওযার পর, শ্বেতপাথরে নামফলক তৈরী করার উদ্যোগ নিলাম। কাজীর দেউড়ি বাজারে সামনে পাথর খোদাই করে লেখার অনেকগুলো দোকান আছে। তার একটাতে অর্ডার দিলাম। আমি পরের বৎসর ঈদের সময় যখন যশোর আসি, তখন পাথরটা খুব যত্ন করে কাপড়ে মুড়িয়ে নিয়ে এসেছিলাম। এক মিস্ত্রীকে দিয়ে তা লাগানোর ব্যবস্থা করলাম। এরপর থেকে প্রতি বৎসর ঈদের সময় আসতে পারি আর না পারি, কাউকে দিয়ে একবার রঙ করানোর ব্যবস্থা করতাম। মন থেকে অনুভব করতাম, তার কবরের প্রতি যত্ন নেওয়া দরকার।

 

একটা বিষয় লক্ষ করলাম, প্রতি বৎসর দেয়ালে ফাংগাস পড়ে রঙ নষ্ট হয়ে যায়। তাই ২০০৬ সালের দিকে এসে প্লাস্টিক পেইন্টের পরিবর্তে এনামেল পেইন্ট দ্বারা রঙ করালাম। কিন্তু তখন আবার আর এক ধরনের সমস্যা দেখা দিল। রঙে চলটা ধরে উঠে যায়। এমতাবস্থায়, স্থায়ী সমাধান হিসাবে কী করা যায়, তা নিয়ে ভাবলাম। টাইলসের কথা মাথায় এলো। কিন্তু একসাথে অনেক টাকা দরকার। তবুও সিন্ধান্ত নিলাম টাইলসই করবো। পরে মিস্ত্রী ডেকে এনে মাপ নিয়ে সিরামিকের ওয়াল টাইলস কিনে দিয়ে, তা লাগানোর কাজ ঠিকায় দিয়ে দিলাম। সেই থেকে এখন পর্যন্ত সাদা টাইলস লাগানো আছে। ২০০৮ সালের শেষে মা যখন মারা যান, মা’র মরদেহ ঢাকা থেকে যশোর নিয়ে এসে আব্বার পাশে নির্ধারিত জায়গায় ওনাকেও সমাহিত করা হয়। ইচ্ছে আছে এই বর্ষাকালেই কবরের ওপর ঘাসের আচ্ছাদন দিয়ে, তার চারপাশে সাদা রঙের ফুল ফোটে, এমন কোন গাছ লাগাবো। ধূলির সৃষ্টি মানুষের কবর উন্মুক্ত থাক, যাতে আল্লাহর প্রেরিত বৃষ্টির পানি ও শীতের শিশির দেহাবশেষকে ধুয়ে পবিত্র রাখতে পারে। একটা ফারসী কবিতার দুইটা লাইন ওনার জন্য উৎসর্গ করছিঃ

 

‘সবুজ ঘাসের আচ্ছাদনে আমার কবর হারিয়ে যাক, 

নিরীহ কারো কবরে ঘাসের গালিচাই সর্বোত্তম আচ্ছাদন’

কাজী মুজাহিদুর রহমান
কাজী মুজাহিদুর রহমান
%d bloggers like this: