একুশের ভাবনা – সৈয়দ জিয়াউল হক

একুশের ভাবনা - সৈয়দ জিয়াউল হক

ভাষার জন্য বাঙালির জীবন দেয়ার ঐতিহাসিক ঘটনার ৬৫ বছর পূর্ণ হবে এ বছর ২১ ফেব্রুয়ারি। মূলত বাংলাকে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের দাবীতেই ছিল এই আন্দোলন। কিন্তু একুশের চেতনা ছিল এই ভাষার দাবীর বাইরেও অনেক দূর বিস্তৃত। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহ যখন ঘোষণা করেছিলেন যে, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা,’ তখন এদেশের মানুষ সঙ্গে সঙ্গে তার মুখের উপর ‘না’ বলে দিয়েছিল । এর পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী যতবার এ দেশের মানুষের উপর অন্যায় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে ততবারই তাদের ‘না’ বলে দেয়া হয়েছে। অবশেষে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীদের চূড়ান্তভাবে ‘না’ বলে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। একুশ তাই দ্রোহের প্রতীক। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের, প্রতিরোধের এবং প্রতিশোধের প্রতীক। একটু পিছন ফিরে আমাদের হিসেব মিলানো প্রয়োজন। কি ছিল ভাষা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য এবং তার কতটুকুই বা অর্জিত হয়েছে? প্রতি বছর আমরা একটি স্লোগান উচ্চারণ করি, ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু কর।’ এর দ্বারা আমরা আসলে কি বুঝতে চাই? আমরা কি বুঝে বা আন্তরিকভাবে এই স্লোগান দিয়ে থাকি? আসলে মোটা দাগে বলতে গেলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দুটি উদ্দেশ্য ছিল, সরকারি কাজে বাংলা ভাষার প্রচলন এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে ব্যবহার। পাকিস্তান আমলে বিভিন্ন সভা সমিতিতে দাবী তোলা হত ‘উচ্চ শিক্ষায় বাঙলা ভাষা প্রচলন কর।’ বর্তমানে সরকারী কাজে বাংলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলার বর্তমানে অবস্থান কি?
আমাদের সংবিধানে সকল নাগরিকের জন্য একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলা হলেও আমাদের দেশে পাকিস্তান আমল থেকে প্রধানত তিন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে। বাংলা মাধ্যম, ইংরেজী মাধ্যম এবং মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। বাংলা মাধ্যম ছিল শিক্ষার মূল ধারা। পাকিস্তান আমলে এই বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার মান ছিল যথেষ্ট উন্নত। আমাদের দেশের বড় বড় বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, প্রশাসক এদের সকলেই ছিলেন এই মূলধারায় শিক্ষিত। ধনী পরিবারের অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী ছেলেমেয়েরা সাধারণত ইংরেজী মাধ্যমে পড়াশুনা করত। বলা বাহুল্য তখন ইংরেজী মাধ্যমে পড়াশুনা করা ছাত্র-ছাত্রীদের তুলনায় বাংলা মাধ্যমে পড়াশুনা করা ছাত্র-ছাত্রীদের শুধু বিষয়জ্ঞানই নয়, ইংরেজী ভাষায় দক্ষতাও ছিল অনেক বেশি। আর মাদ্রাসায় পড়াশুনা করা অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীই ছিল দরিদ্র পরিবার থেকে আগত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলা মাধ্যম অর্থাৎ মূল ধারার শিক্ষা ব্যবস্থার ক্রমশ অবনতি হতে থাকে। ফলে ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলের ব্যাপক প্রসার ঘটতে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশে যতগুলো ইংরেজী মাধ্যমের স্কুল আছে পাকিস্তান আমলে তার একশত ভাগের একভাগও ছিল না। এখন আর শুধু উচ্চবিত্ত নয়, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারও এই ইংরেজী মাধ্যমের দিকে ঝুকছেন। ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলগুলোর উপর সরকারের তেমন কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এখানকার ছেলে মেয়েদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। কোন কোন স্কুলে বাংলায় কথা বলাও নিষিদ্ধ। সবচেয়ে ক্ষোভের বিষয় হচ্ছে, মূলধারার শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরো উন্নত করার পরিবর্তে এই ধারাকে দ্বিধাবিভক্ত করে এর মধ্যে একটি ইংরেজী ভার্সন চালু করা হয়েছে যা একুশের চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। অথচ এবিষয়ে এদেশের বুদ্ধিজীবিদের মধ্য থেকে কোনরূপ প্রতিবাদ জানানো হয়নি-আন্দোলনতো দূরের কথা। তাছাড়া ভুলে ভরা যে সকল পাঠ্য-পুস্তক কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে তাতে আমরা শুধু ক্ষুব্ধই নই, বরং শংকিতও। যারা পাঠ্য-পুস্তকে এ ধরনের অসংখ্য ভুলের জন্য দায়ী তারা ক্ষমার অযোগ্য। যুদ্ধাপরাধীদের মত এসকল শিক্ষাপরাধীদেরও কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হোক-এবারের শহীদ দিবসে এটাই আমাদের প্রত্যাশা। কারণ এভাবে চলতে থাকলে একসময় কোন অভিভাবকই তাদের সন্তানদের বাংলা মাধ্যমে শিক্ষাদান করবেন না। বাংলা ভাষা শুধু কবিতা, উপন্যাস, গান আর নাটকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে আর থাকবে না। আর শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষা যদি পরিত্যক্ত হয় তবে রাষ্ট্রভাষা হিসেবেও বাংলার অস্তিত্ব হুমকীর সম্মুখীন হবে।

%d bloggers like this: