হিংসার যন্ত্রণায় গ্রাম ছেড়ে সাধু জীবন গ্রহণ – লিয়াকত হোসেন খোকন
১৯৯৩ সালের কথা – ফৈজাবাদ শহর দেখে এলাম অযোধ্যায়। আগেই জানতাম, অযোধ্যা রামের জন্মভূমি। হোটেলের নাম লক্ষ্মণ – সেখানে উঠেছিলাম।
পরদিন সকাল ১১ টায় এলাম এক মন্দিরে – অবশ্য অযোধ্যা মন্দিরের শহর। মন্দির প্রাঙ্গণে যেতেই এক বৃদ্ধ সাধু বাবা এগিয়ে এলেন।
তাঁর জিজ্ঞাসা, আপনি কি পূর্ব বাংলার?
অবাক হলাম বাংলা ভাষায় তাঁর কথা শুনে – আবার কিনা পূর্ব বাংলা…… নিশ্চয়ই সাধুবাবা আমাদের পূর্ববঙ্গের বাসিন্দা হবেন। কথায় কথায় সব বেরিয়ে এলো, তিনি পূর্ব বাংলার ঝালকাঠি জেলার বাসিন্দা।
বহু দিন পরে তিনি দেশের মানুষ পেয়ে আমাকে কি যেন কি করবেন – এই নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বুকে আলিঙ্গন করে বার বার কেমন যেন হয়ে পড়লেন।
তিনি কথায় কথায় জানালেন, এখন আমার বয়স বিরাশি বছর। গৃহত্যাগ যখন করেছিলাম তখন আমার মনে হয় বয়স বছর উনিশ।
আমার বাঙালি দেহ। ঝালাকাঠির এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে আমার জন্ম। সাধে কি আর ঝালকাঠি ছেড়েছি – সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণ ছাড়াও প্রতিবেশী মানুষের হিংসা – বিদ্বেষ – মিথ্যাচার – পরশ্রীকাতর – মমতাহীন জীবন আমাকে এতটা ব্যথিত করে তুলেছিল আর সেই কারণেই দেশ ছেড়ে কত জায়গা হয়ে অবশেষে এলাম অযোধ্যায়। আমি এই সাধু জীবনে সুখ শান্তি পেয়েছি – আমি দশনামীগিরি সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী। মূল আস্তানা হরিদ্বারে তবে আমি খুব কমই যাই সেখানে। যখন মন চায় তখন উত্তরাখন্ডের বিভিন্ন তীর্থে ঘুরে বেড়াই।
অযোধ্যায় আছেন কত দিন? এখানে তো আপনার কোন ডেরা নেই। রাতে থাকেন কোথায়?
উত্তরে সাধু জানালেন,
এখানে আছি বছর খানেক।
রাতে এই মন্দির প্রাঙ্গণেই পড়ে থাকি। ভগবানের কৃপায় প্রতিদিন খাবার কিছু জুটে যায়। এইভাবে চলছি, এখন এভাবেই চলে আমার।
হিংসা – বিদ্বেষ কে না করেছে যে দিকে তাকাই দেখি মানুষ আর মানুষ নেই। এখানে আছি , ভাল আছি সুখে আছি, নিরাপদে আছি। নেই কোন দাঙ্গা হাঙ্গামা।
আমি বললাম, বাঙালি লোভী ও হিংসুটে হওয়ার কারণ কী?
সাধুবাবা কি যেন ভাবলেন।
আসলে কি জানিস, মানুষের অভিশাপে যারা স্বর্গচ্যুত হয়ে আজব দেশে এসে জন্মগ্রহণ করে – মানুষের মত জন্ম নিয়েও তারা কিন্তু সেই আঘাতের কথা ভুলতে পারে নি। আত্মবিস্মৃত হতে পারেনি। তাই অভিনয়ের নেশায় মাতিয়ে নিয়ে মানুষকে এরা নাস্তানাবুদ করেই পায় সব চেয়ে বেশী আনন্দ। এই ইতিহাস তোরা ভুলে গেলেও ভালো মানুষরা কখনও ভোলে না। সেই ইতিহাস সব মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয় – এমন কি আজব দেশেরও সব মানুষ জানে না। বিশেষ করে আজব দেশ আবিস্কৃত হবার পর আজব দেশে যারা আমাদের মধ্য থেকে উপনিবেশ স্থাপন করেছে।
শুনে রাখ, যুগ যুগান্তর ধরে যে দেবকল্প ঋষি এই গান্ধর্ব বেদের লোক – পুরাণ খন্ড পরম যত্নে সংরক্ষণ করেছিলেন – তা ধ্বংস করেছিল সুলতান মাহমুদ। গজনীর অধিপতি সুলতান মাহমুদের সপ্তদশবার ভারতবর্ষ আক্রমণ ও লুটতরাজের ইতিহাস আজও অন্তত আমি ভুলিনি। শোন তাহলে – সুলতান মাহমুদ ৩৬১ হিজরির ১০ ই মহরম রাত্রিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আমীর উল গাজী নাসিরুদ্দিন। সুলতান মাহমুদের জন্মের কিছুকাল পূর্বে তিনি স্বপ্ন দেখেন যে, ” প্রকোষ্ঠাভ্যন্তরস্থ অগ্ন্যাধার হতে একটি প্রকান্ড বৃক্ষ অতি সত্বর বেড়ে উঠলো। পরিশেষে বৃক্ষটি গগন মন্ডল ভেদ করে এত উচ্চে উঠলো যে, তার ছায়া সমস্ত পৃথিবীকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেললো। ”
নিদ্রাভঙ্গের সঙ্গে সঙ্গেই পরিচারিকা এসে খবর দিল, বেগম সাহেবা এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। সুলতান মাহমুদ যেদিন জন্মগ্রহণ করেন সেদিন রাতেই সিন্ধু তীরবর্তী পুরুষপুরের দেবমন্দির অকস্মাৎ ভূমিসাৎ হয়। জানিস, ইতিহাস কি বলে – গজনী অধিপতি পুত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সেদিন বিরাট আশার কথাই ঘোষণা করেছিলেন আর সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশ মেতে উঠেছিল উৎসবে। রূপসীদের বিলোল কটাক্ষে আর নৃত্য চপল পদধ্বনিতে গজনীর অধিবাসীদের অনেকেই তখন আত্মবিস্মৃত ঘটেছিল। এমন কী সুন্দরীর সঙ্গে সুরার প্লাবন শেষ পর্যন্ত সিন্ধুনদের তীরে নিয়ে তাদের হাজির করেছিল। তীরে গড়াগড়ি খেতে খেতে অনেকে গড়িয়ে পড়েছিল সিন্ধুর নীল লবনাম্বু রাশির মাঝে – আর তরঙ্গ মালার তালে তালে ছুটে চলেছিল…….. ।
বাকীটা বললাম না, একটু বুঝে নে।
সাধুবাবা, এবার হাতটা স্পর্শ করে বললেন, দেখ দেখ দেখ রে চাহিয়া চারিদিকে পাপে ভরে গেছে – পৃথিবীর শ্রী ও সুখ শান্তি নষ্ট করে হাহাকারে ভরিয়ে দিয়েছে ওরা। একটু ভেবে দেখ, সবই বুঝবি!
বললাম, সুলতান মাহমুদের শেষমেশ কি হয়েছিল?
সাধুবাবা একটু ভেবে –
অন্যায়ের অন্ধকারে যখন পৃথিবী বিভীষিকায় ভরে
উঠবে – তখনই সুলতান মাহমুদের কাল পূর্ণ হবে এবং মৃত্যু মুখে পতিত হবেন এবং তাই-ই ঘটেছিল শেষ পর্যন্ত।
বল, ভালোটা কে! সুলতান মাহমুদের মত কতজনের ভারতবর্ষের সোনা রূপো আর রূপকুমারীদের নানান লোভনীয় কথা তাদেরকে লোভাতুর করে তুলেছিল।
আমরা কেন স্বার্থপর, লুটপাট, দখলবাজ, ধর্ষক, দুর্নীতিবাজ , চৌর্যবৃত্তিতে পারদর্শী হলাম। কেন করছি, দাঙ্গা – ফ্যাসাদ?
আমার এ প্রশ্নটা শুনে সাধুবাবা হো – হো করে হেসে উঠলেন।
আরে ব্যাটা, তুই একটু ভাবতে থাক সবই চোখের পাতায় ভাসবে।
শোন, সুলতান মাহমুদ একবার নয়, বারবার সপ্তদশবার ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন তিনি। প্রত্যেকবারই ধনদৌলতের সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরী মেয়েদের ধরে নিয়ে গেছেন তিনি দেশে। পুরুষদেরও বাদ দেননি। বহু রাজা – সৈন্যাধ্যক্ষ সেনানী ও পূজারী থেকে শুরু করে সাধারণের মধ্য থেকেও কাতারে কাতারে লোক ধরে নিয়ে গেছেন তিনি নিজের দেশে – এদেরকে ক্রিতদাস করে রেখেছিলেন তিনি তার দেশে। সুলতান মাহমুদ কী আর তখন বুঝতে পেরেছিলেন যে, এদের রক্তে মিশে অদূর ভবিষ্যতে তার দেশবাসীকে শংকর জাতিতে পরিণত করবে বাংলা পর্যন্ত? তাহলে কী তা করতেন?
এরপর সাধুবাবা গুণগুণ করে গেয়ে উঠলেন ঃ
” মনরে চল চল চল –
পথের সম্বল মন হরি বল।
মনোরথ, যাও রথে
ত্যাজ্য করি ন্যায্য পথে।
কেন ভ্রম পথে পথে
এখন চল ব্রজের পথে
পেয়ে সুপথ ভুলো না পথে
এখন চলো ব্রজের পথে।
হবে পথের জয়
পেতে হবে সবাইকে তাই পথের পরিচয়।
পরদিন হঠাৎ সাধুবাবা হোটেলে এসে উপস্থিত। তিনি সরাসরি বললেন, নাস্তা এনে খাওয়া।
নাস্তার অডার দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম – শুনেছি, সাধুসন্ন্যাসীরা গুহায়ও নাকি বসবাস করে।
মৃদু হেসে সাধুবাবা বললেন, আমিও একসময় গুহায় ছিলাম। সেটা ছিল কালিম্পং শহরের নিকটবর্তী পর্বত গুহায় আমি ভগবান হংস দেবতার আরাধনাতেই রত ছিলাম তখন । আমার দীর্ঘদিনের সাধনা সার্থক করতে একসান্ধ্য -মুহূর্তে আমায় সাক্ষাৎ দিতে আবির্ভাব হলেন ভগবান হংসদেবতা। হংসবাহনের ওপর বিষ্ণু মূর্তিতে তিনি আমার সাক্ষাৎ দান করে নির্দেশ দিলেন ঃ
বৎস, তোমার কঠোর সাধনায় আমি তুষ্ট। তোমার সর্ব মনস্কামনা পূর্ণ হবে। সমগ্র গন্ধর্ব বেদই তোমার করায়ত্ব হবে। তুমি লোকালয়ের দিকে গমন করো। মহামুনি গান্ধবাচার্য তোমায় বেদ শিক্ষা দিয়ে ধরাধামে গান্ধর্ব বেদ প্রচারের উপদেশ – নির্দেশ দেবেন। তুমি তার কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করো। যখন স্মরণ করবে অন্তর দৃষ্টিতে বর্তমান মূর্তিতেই তুমি আমার দর্শন পাবে।
এরপরে বিগলিত অশ্রুতে নতজানু হয়ে প্রণাম করতেই ভগবান হংস দেবতা অন্তর্হিত হলেন।
রুটি ও সবজি মুখে নিয়ে খেতে খেতে বললেন, চায়ের কথা বলেছিস তো…..
জ্বি।
সেই যে দেখা দিল…… তারপর এক অপূর্ব আবেশে আমার দেহমন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো। ধীরে ধীরে প্রকৃতস্থ হয়ে কালক্ষেপ করা সমীচীন নয় বলে মনে করে কমন্ডলু নিয়ে লোকালয় অভিমুখে ধাবিত হলাম।
চা এসে গেল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সাধুবাবা এদিক – ওদিক তাকিয়ে নিলেন একটু।
সাধুবাবা বললেন,
পথচলতি সাধুদের দেখবি, সবসময়ই কোনও না কোনও তীর্থে অবস্থান করে তাঁরা। বেটা, মন থেকে সব সাধুরা সবকিছু ছাড়তে পারে কিনা জানি না, তবে সব ছাড়তে পারুক বা না পারুক, ঈশ্বরের নামে বা উপরওয়ালা অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার নামে পড়ে থাকার ফল তো একটা আছেই আছে। সারাজীবনে অনেকটা পথই তো চললাম। এই চলার পথে দেখছি, প্রায়
সব ‘ রমতা ‘ সাধুদের মৃত্যু হয় অতি সামান্য রোগে ভুগে। রমতা সাধু দীর্ঘকাল ভুগে ভুগে মারা গেছে এমনটা তুই পাবি না। আমি নিজেও দেখিনি কখনও। ভগবানের কত দোয়া। শোন, তুই মুসলিম সর্বদা আল্লাহ তায়ালাকে ডাকবি – দেখবি ভাল থাকবি। সময় করে একবার আজমীর শরীফ থেকে ঘুরে আয় – দেখবি মনটা পবিত্রতায় ভরে উঠবেই উঠবে।
বললাম, আজ তো চলে যাচ্ছি –
আমার দিকে তাকিয়ে সাধুবাবা বললেন, বেটা, দেশে গিয়ে সবসময় ধৈর্যটা ধরবি। মানুষের সাংসারিক ও মানসিক শান্তির অন্তরায় হলো ধৈর্যের অভাব। ধৈর্যের অভাব মানুষের মৃত্যুকে পর্যন্ত আলিঙ্গন করতে পারে, আবার তুই যদি তোর ধর্মের পথে সঠিকভাবে থাকিস বা চলিস তাহলে আল্লাহতায়ালা তোর জীবনে শান্তি দিতে পারবে না, তা কি কখনও হয়?
ঝোলা থেকে কল্কেটা বের করে হোটেলের ছেলেটাকে আগুন ধরিয়ে দিতে বললেন সাধুবাবা।
বের করলেন গাঁজাও। সাজালেন বেশ পরিপাটি করে। কল্কেটা মুখে ধরে আগুনটা ধরিয়ে দিয়ে দিল ছেলেটি।
প্রথমে ফুকফুক করে পরে বেশ জব্বর একটা টান দিলেন।
জিজ্ঞেস করলেন, মৃত্যু বাস করে কোথায় বলতে পারিস?
মাথা নেড়ে বললাম, জানি না। সাধুবাবা বললেন, মনের মৃত্যু বাস করে ক্রোধে। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, ক্রোধ করবি না কখনও।
বিদায় নেবার পালা। সাধুবাবা বুকে বুক রেখে –
সব সময় মনে করবি সবার উপরে মানুষ সত্য। তাহলে সুখ পাবি শান্তি পাবি। সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রাখবি।
লিয়াকত হোসেন খোকন
Facebook Comments Sync