জেমস জয়েসের ইউলিসিস ও ব্লুম দিবস / আফরোজা পারভীন

জেমস জয়েসের ইউলিসিস ও ব্লুম দিবস

জেমস জয়েসের ইউলিসিস ও ব্লুম দিবস

ব্লুম ডে উপলক্ষে বিশেষ রচনা

জেমস জয়েসের ইউলিসিস ও ব্লুম দিবস/ আফরোজা পারভীন

 

(জেমস অগাস্টিন অ্যালওসিয়াস জয়েস (২ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮২ – ১৩ জানুয়ারি, ১৯৪১।  একজন আইরিশ লেখক এবং কবি। তিনি বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকের আভা-গার্ড এবং আধুনিকতা আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন। তার অন্যান্য প্রধান কাজের মধ্যে রয়েছে গল্প সংকলন ডাবলিনারস (১৯১৪) এবং এবং উপন্যাস আ পোর্টেট অব দ্য আর্টিস্ট এস অ্যা ইয়াং ম্যান (১৯১৬) এবং ফিনেগ্যানস ওয়েক (১৯৩৯))।

 

১৬ জুন পালিত হয় ব্লুম দিবস। কে এই ব্লুম? কোথায় কোন দেশে তার বাস, কি তার কীর্তি যার জন্য পালিত হয় গোটা একটি দিবস! না, তিনি কোন বাস্তবের মানুষ নন, একজন কালজয়ী লেখকের  তৈরি কাল্পনিক চরিত্র। আর চরিত্রটি গেঁথে গেল বিশ্বব্যাপী মানুষের হৃদয়ে । তাই তার জন্য এই মর্যাদাদান একটি দিনকে ঘিরে। 

ব্যাপারটা সত্যিই অদ্ভুত! এই যান্ত্রিক দুনিয়ার মানুষ যেখানে একে অপরকে ভালবাসে না, সেখানে একজন কাল্পনিক মানুষের জন্য এত ভালবাসা, এত নিবেদন! তাহলে নিশ্চয়ই সেই কাল্পনিক চরিত্রে এমন কিছু আছে যা ঐন্দ্রজালিক জাদু ছড়িয়েছে বিশ্বময়। 

ইউলিসিস বিশাল এক গ্রন্থ। কোন কোন সংস্করণের  দৈর্ঘ্য হাজার পৃষ্ঠার উপরে । বছরের পর বছর ধরে সাহিত্য বিশারদরা বইটির চুলচেঁরা বিশ্লেষণ করে যাচ্ছেন। বইটি সাহিত্যাঙ্গনে প্রচুর বিতর্কেরও জন্ম দিয়েছে।

ঐতিহাসিকভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে, উপন্যাসটি যখন প্রকাশিত হয় তখনই নানা ভাব  বৈচিত্রে  সাহিত্যবিশ্বে সূচনাপর্বের আধুনিকতার বিস্তার ও প্রসারণ ঘটছিল। কিন্তু বইটি প্রকাশের পর আধুনিকতা পেয়ে গেল সম্পূর্ণ ভিন্ন মাত্রা। ইউলিসিস প্রথম ধারাবাহিকভাবে মার্কিন সাহিত্য সাময়িকী ‘দ্য লিটল রিভিউ’তে মার্চ ১৯১৮ থেকে ডিসেম্বর ১৯২০ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯২২ সালে প্যারি থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।  প্রকাশের সাথে সাথে, সমগ্র ইউরোপে যেভাবে উপন্যাসটি আলোড়ন তোলে, সমাদৃত হয় তাকে এককথায় বলা যায় অভূতপূর্ব। তখন থেকেই ইউলিসিসকে ইংরেজি ভাষায় লেখা বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বলে গণ্য করে থাকেন  অধিকাংশ সাহিত্য সমালোচক।

 বিশশতকের শুরুতে যে আধুনিকতার উন্মেষ, নতুন কাল ও পটভূমিতে নতুন সংবেদনা নিয়ে যে-সাহিত্য রচিত হচ্ছিল, ইউলিসিস হয়ে উঠলো সেই সব লেখালেখির শীর্ষরচনা। এই উপন্যাসের মধ্য দিয়েই জেমস জয়েস বিশ্বসাহিত্যে বিপ্লবের সূচনা ঘটান; এটি শুধু আর আইরিশ সাহিত্য হয়ে থাকলো না। জয়েস ইঙ্গ-ফরাসি সাহিত্যভুবনে সমকালের সবচেয়ে খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলেন। 

উপন্যাসটি আঠারোটি বিভিন্ন উপশিরোনামে (অংশে) বিভক্ত। উপন্যাসটি আকারেও বেশ বড়;  পৃষ্ঠা সংখ্যা সাড়ে ছ’শোর ওপরে। শুধু আকারের দিক থেকে নয়, যাদের হোমারের ওডেসি  পড়া নেই, কিংবা স্মৃতিতে ধরা নেই এর সম্পূর্ণ কাহিনি, তাদের পক্ষে উপন্যাসটি বুঝে ওঠা নিঃসন্দেহে অসম্ভব। কেননা ওডেসির আঠারটি চরিত্রের নামানুসারে জয়েস পরিচ্ছেদগুলোর নামকরণ করেছেন। ওডেসিই হয়ে উঠেছে এই উপন্যাস সৃষ্টির উৎস। এভাবে ব্যাখ্যা করলে একে ওডেসির-ই পুনঃসৃজন বা নতুন সৃষ্টি বলা যায়। হোমারীয় মহাকাব্যিক চরিত্রের উপন্যাসটি ১৯২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ডে অশ্লীলতার দায়ে নিষিদ্ধ হয়। 

 

বিংশ শতকের শুরুতে আধুনিকতাবাদ নামে এক নতুন সাহিত্যধারার সৃষ্টি হয়।  ইউলিসিস ছিলেন এই ধরার পুরোধা একজন।  বিরতিহীন  চৈতন্যবর্ণনার অনবদ্য প্রয়োগ আছে উপন্যাসটিতে।  এ ছাড়াও লেখকের  অভিনব গদ্যশৈলী, গদ্য নিয়ে বিচিত্র সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা, কুশলী চরিত্রায়ন এবং ঘন রসবোধ বইটিকে আলাদা মাত্রা  দিয়েছে। তবে বইটি যথেষ্ট দুরূহপাঠ্য তাতে কোন সন্দেহ নেই। 

১৯৯৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত প্রকাশক মডার্ন লাইব্রেরী শতাব্দীর সেরা ১০০টি ইংরেজি উপন্যাসের তালিকা প্রণয়ন করে। ইউলিসিস তালিকার শীর্ষে স্থান পায়।

আগেই বলেছি, মাত্র একটি দিনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে ইউলিসিস-এর কাহিনি। দিনটি ১৯০৪ সালের ১৬ জুন। এ দিনে একজন সাধারণ নাগরিক লেওপোল্ড ব্লুম ঘুরে বেড়ান নানা কাজে  ডাবলিন শহরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।  

উপন্যাসে জেমস জয়েস ১৬ জুন দিনটিকে স্মরণীয় হিসেবে উলে­খ করেছেন। উপন্যাসের মতো তার ব্যক্তিগত জীবনেও এই দিনটির বিশেষ তাৎপর্য আছে। এই তারিখে জেমস নোরা বারনাকলের প্রেমে পড়েন। তার বয়স তখন মাত্র ২৩। স্বল্পশিক্ষিত নোরা ছিলেন হোটেল পরিচারিকা। নোরা জয়েসের ঘনিষ্ঠ ছিলেন কিন্তু তিনি একজন পাদ্রীকে বিয়ে করতে মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। তখন জেমস তাকে ‘কমন-ল’ ওয়াইফ হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯০৪ সালে জেমস জয়েস নোরাকে নিয়ে ইউরোপে পাড়ি জমান। উদ্দেশ্য চাকরি। পরে ১৯৩১ সালে মেয়ে লুসিয়ার জোরাজুরিতে জয়েস ও নোরার বিয়ে হয়।

যাক সে কথা। ব্লুম ঘুরে বেড়ান নানা কাজে। তার চরিত্রে অনেক ত্রুটি । একজন অসফল প্রান্তিক মানুষ তিনি। জয়েস পাতার  পর পাতা  জুড়ে এই ব্লুমের কথাই বলে গেছেন;  তুলে ধরেছেন তার খুঁটিনাটি, দুর্বলতা আর ত্রুটিবিচ্যুতি।

এই মানুষ অসফল ছিল নানান দিক থেকে। তার মধ্যে প্রধান একটি দিক স্ত্রী সংক্রান্ত।   স্ত্রীর সঙ্গে প্রায় কুড়ি বছর ধরে কখনই পরিপূর্ণ সফল যৌনজীবন যাপন করেনি সে না। ফলে উপন্যাসের ঘটনাকালের দিনটিতেই পরকীয়া প্রেমে নিমজ্জিত থাকে ব্লুম । ছিলেন  আত্মরতিতে লিপ্ত  মানুষ । তার মুখ ছিল বিবর্ণ, বিধুর, ধূসর।

এই যে একটি মানুষ যে পরিপূর্ণ অর্থে স্বাভাবিক মানুষ নয়,তার জন্য ছিল  লেখকের গভীর সংবেদনশীলতা। গভীর মমত্ববোধ, সমীহা, সহানুভূতি এবং সমমর্মিতা নিয়ে  একটি অতি স্পর্শকাতর চরিত্র হিসেবে উপস্থাপন করেছেন তিনি।

 ব্লুমেরও আছে নানান  মানবিক  বৈশিষ্ট্য। সে  একজন সংবেদনশীল, সহনশীল মানুষ; বিভিন্ন বিষয়ে তার গভীর আগ্রহ, কৌতূহল, মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল।  একজন নির্বিবাদী ভালো মানুষ। একদিনের ঘটনাই কাহিনিকে ঘিরে। কিন্তু এই একদিনে সারাটাক্ষণ তার মন ছিল খুবই সক্রিয়।  সে যেসব মানুষের সংস্পর্শে এসেছে তাদের ব্যাপারে তার গভীর কৌতূহল আর  সহানুভূতি । সে প্রত্যেককে নিরীক্ষণ করছে সহানুভুতির সাথে।  তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। আবেগ ও ভালোবাসা ঘিরে রেখেছে ব্লুমের মনটাকে। তবে তার এই মানবিবোধ বা ক্রিয়াকর্ম সংগঠিত হয়েছে ছোট ছোট নানা ঘটনা ও বিষয়কে ঘিরে। একদিকে সে যেমন বাসনাসক্ত, অনুভূতিপ্রবণ মানুষ, অন্যদিকে তেমনি বিরূপ পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ হতেও জানে।

ইহুদি হবার কারণে বন্ধুদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ এক প্রান্তিক মানুষ সে। কথায় ও আচরণে অনেকটাই সহজ-সরল-গ্রাম্য।  একজন ভালো মানুষ কিন্তু নিখুঁত মানুষ নয়। তবে  উপন্যাসে উপস্থিত অন্যান্য ডাবলিনবাসীর তুলনায় চরিত্র হিসেবে অনেক উজ্জ্বল সে।

উপন্যাসের আছে ডাবলিন শহরের বিস্তারিত, বিস্তৃত, খুঁটিনাটি  বিবরণ। এর রাজপথ, অলিগলি, দালানকোঠা, শব্দ, দৃশ্য, বাসিন্দা আর তাদের ভিন্ন ভিন্ন স্থানিক ভাষা (একই শহরের মধ্যে নানা  বৈচিত্র্য), স্বর, ভঙ্গি । জয়েস প্রবেশ করেছেন একেবারে নগরের কেন্দ্রে, জনমানুষের গভীরে। তিনি ওপর থেকে নয়, সবকিছু দেখেছেন ভেতরে প্রবেশ করে। মানুষ যে মানুষের জন্য তার সমবেদনার হাত প্রসারিত করে দিতে পারে, ম্যানহোলে আকস্মিকভাবে পতিত দূষিত গ্যাসে দমবন্ধ একজন মানুষের উদ্ধার পাওয়ার ঘটনা থেকেও তা বোঝা যায়।

ইউলিসিস-এ তিনি আমাদের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যাপ্ত করে দিয়েছেন।  প্রথাগতভাবে মনে করা হয় শুধু উঁচুমাত্রার পরিশীলিত শিল্পই সংস্কৃতি, সেই ধারণা যথার্থ  যে সত্য নয় এ উপন্যাস পাঠে তা বোঝা যায় । ছোট ছোট বস্তুপুঞ্জ, অপাংক্তেয় সংগীত, রসালো টুকরো ঘটনা, যার দ্বারা আমরা পরিবেষ্টিত কিংবা মজ্জমান থাকি সেসবও হয়ে উঠতে পারে সংস্কৃতির অংশ। ডাবলিনের দোকানপাট, শুঁড়িখানা, চার্চ ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে উপন্যাসটি লেখা। সেই সঙ্গে ইউলিসিস-এর বর্ণনারীতিতে ঢুকিয়ে দিয়েছেন জনপ্রিয় গান, বিজ্ঞাপনের ভাষা, ক্রিস্টমাসের সময়ে সংঘটিত মুকাভিনয়ের রীতি। আমাদের জীবন যে কত চিত্ররূপময়, শব্দ ও ভাষার ঐশ্বর্য্যে উজ্জ্বল, ন্যারেটিভ ও নানা ধরনের ইমেজের মধ্য দিয়ে এই যে সংস্কৃতি আমরা নির্মাণ ও বহন করে চলি,  ধৈর্য্য আর অভিনিবেশ সহকারে ইউলিসিস না পড়লে তা বোঝা যাবে না। জয়েস দেখিয়ে দেন সংস্কৃতি মানেই পরিশীলিত সংস্কৃতি নয়, নয় যাদুঘরে স্থান পাওয়া ভবিষ্যতের কোনো মৃত ডিসকোর্স বা সৃষ্টিশীল নিদর্শন, বরং আমাদের প্রতিদিনের পরিবেশ, চলমান মানুষজন ও তাদের জীবনপ্রবাহই হচ্ছে সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এদিক থেকে বিবেচনা করলে, ইউলিসিস-এ নিম্নবর্গীয় (সাবঅল্টার্ন) সংস্কৃতির চমৎকার উপস্থাপন ঘটেছে নিঃসন্দেহে।  গবেষকেরা জনপ্রিয় সংস্কৃতিকেই মনে করছেন প্রকৃত সংস্কৃতি।  জয়েস ঠিকই বুঝেছিলেন যে জনসংস্কৃতিই হচ্ছে প্রকৃত সংস্কৃতি।

 যে-কোনো পাঠকের কাছেই এর নামটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় বলে বিবেচিত হয়ে থাকে, ইউলিসিস। সমগ্র উপন্যাসটির ঘটনাকাল মাত্র একদিনের– ১৯০৪ সালের ১৬ জুন। আগেই বলেছি, এখানে ঘটেছে সাধারণ কিছু মানুষের সাধারণ কিছু ঘটনার আবর্তন। এই নামকরণ, বলা বাহুল্য, বেশ দুঃসাহসী এক নির্বাচন। দুঃসাহসী এই কারণে যে, আগেই বলেছি, হোমারীয় এক মহাকাব্যিক চরিত্রের অনুকরণে এর নামায়ন হয়েছে। প্রাচীন ঐতিহ্যের পূর্বস্মৃতি যেন নতুন কালের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপিত হয়েছে এই উপন্যাসে। জয়েসের সমকালীন প্রখ্যাত কবি, অনেকেই যার হাত ধরে আধুনিক কবিতার উন্মেষ ঘটেছিল বলে মনে করেন, সেই টি এস এলিয়ট একে ‘ পৌরাণিক পদ্ধতি’ (মিথিক্যাল মেথড) বলে চিহ্নিত করেছেন। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে বর্তমানের সাধারণ ডাবলিনবাসীদের অতীতের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে সমান্তরালভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে ধারণা করেছেন তিনি। সেই সঙ্গে সাধারণ পৌরাণিক চরিত্র ইউলিসিস, টেলিমাকাস, পেনিলোপ অথবা হ্যামলেট, রাণী গারত্রুদ এবং ডন জিয়োভান্নির সমান্তরালে সৃষ্টি করা হয়েছে ডাবলিনের সাধারণ আইরিশ চরিত্রদের। কিন্তু ডাবলিনের চরিত্রগুলোর কেউ-ই বীর নয়, সাধারণ চরিত্রই – পৌরাণিক শৌর্য্য-বীর্যের দ্যুতি আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দেয় না। জয়েস বরং যে কাজটি করেছেন তা হলো পৌরাণিক চরিত্রের অনুষঙ্গে মানবিক মহিমার যে দ্যুতি আর বিচ্যুতি ঘটেছে, সেদিকটির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। ডাবলিনের সাধারণ চরিত্রগুলো পেয়ে গেছে সময়হীন মাত্রা। উপন্যাসটিও হয়ে উঠেছে চিরায়ত রচনা।

ইউলিসিস-এর  চমৎকার ভাষাশৈলী ও প্রকরণ। ভাষিক সাফল্যের দিক থেকে বিবেচনা করলে ইংরেজি ভাষায় লেখা সাহিত্যের শীর্ষরচনা এটি। প্রতিভার যে নান্দন্দিক প্রকাশ এখানে ঘটেছে তা তুলনাহীন বলা যায়। ইংরেজি ভাষায় লেখা সাহিত্যে যে স্পেন্সার, মিলটন, শেক্সপিয়রের পাশাপাশি উচ্চারিত হয় জয়েসের নাম তা এই ইউলিসিস-এর সূত্রে। শুধু পরিমিতিবোধ বা নানা শব্দের বিচিত্র ব্যবহার নয়, যে- কোনো ধরনের যে- কোনো বিষয়কে জয়েস যে নিখুঁত ভাষায় ফুটিয়ে তুলতে পারতেন, এই উপন্যাসের মধ্য দিয়ে জয়েসের সেই প্রতিভাকে ছুঁয়ে দেওয়া যায়। উপন্যাসটির ভাষাশৈলীতে, সমালোচকের মতে জয়েজ অন্তত চার ধরণের বর্ণনারীতির ব্যবহার ঘটিয়েছেন : বহুল ব্যবহৃত তৃতীয় পুরুষের স্বর, অন্তর্গত স্বর, মুখের বুলি বা বাগ্বিধি, আর আছে মাইকেল সিডেলের কথায় ‘চতুর্থ স্বরে’র ব্যবহার।

ফলে বর্ণনীয় প্রতিটি অনুসৃত পরিস্থিতি, অর্থাৎ কৌতুক কিংবা বিষাদ, নৈঃশব্দ্য কিংবা কলরোল, চোখে দেখা জগত কিংবা অন্তর্জগত সবকিছুকেই তিনি যথাযথ  শৈলীসহযোগে উপস্থিত করেছেন। এরই সূত্র ধরে জয়েস আবার ব্যবহার করেছেন চেতনাপ্রবাহরীতি (স্ট্রিম অফ কনসাসনেস), এই রীতিটিও উত্তরকালের লেখকেরা কী কবিতায়, কী কথাসাহিত্যে চরিত্রের মনোজগতকে ফুটিয়ে তোলার কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন। জয়েসই আধুনিক মানুষ যে বাইরের জগতের তুলনায় নিজের মনোগহনেই নিমজ্জিত হতে ভালোবাসে, নিজেকেই নানাভাবে দেখতে চায়, ইউলিসিস-এর মাধ্যমে সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন সেই মনোবাস্তবময় জগতের। জয়েসের  শৈলীগত  বৈচিত্রও এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ভাষার সৌকর্য্যে যারা মুগ্ধ হন, ভাষানিরীক্ষাকে যারা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, জয়েসের রচনা তাদের কাছে যে সমাদৃত হবে, সেকথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। জনজীবন ও ব্যক্তিজীবন, শরীর ও মন সমীকৃত হয়ে যে উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়, ইউলিসিস-এর আগে সেকথা কেউ ভাবেননি। 

তবে এই উপন্যাসের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে নাগরিক বুলি ও ভাষার জীবন্ত ব্যবহার। চরিত্রগুলো একারণেই মনে হয় যেন চোখের সামনে অভিনয় করে চলেছে, তারা যেন এই পৃথিবীরই স্পর্শময় সাধারণ বাসিন্দা। জয়েসের আগে কেউ এভাবে স্থানিক সংলাপের ওপর নির্ভর করে এমন বাস্তবোচিত চরিত্রের উপস্থাপন ঘটাননি, যেমনটা আমরা লক্ষ করি ইউলিসিস-এ। 

ইউলিসিস-এর আরেকটি  বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আধুনিক সাহিত্যের শীর্ষআখ্যান বা উপন্যাস হিসেবে এর সর্বজনীন স্বীকৃতি। শিল্পের জন্য শিল্প বলে যারা সাহিত্যকে চিহ্নিত করতে বা চর্চা করতে শুরু করেছিলেন, ইউলিসিস-এর সূত্রে তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন যে প্রকৃত শিল্পসম্মত রচনা অনন্য হয়ে উঠবার মধ্য দিয়ে নিজেই নিজের দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। অর্থাৎ প্রতিটি সাহিত্যসৃষ্টি হচ্ছে নতুন ও অভূতপূর্ব, রচনাটি নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী। ইউলিসিসকে সহজেই এই ধরনের মহান সাহিত্য হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, যা এককথায় তুলনাহীন।

 ব্লুমকে এভাবে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলায় এর স্রষ্টা জেমস জয়েসকেও উপেক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। কী জীবনে কী উপন্যাসে যত সাধারণই হোক, তাঁর দৃষ্টি দিয়ে আমরা অন্য এক অনালোকিত পৃথিবীকে দেখতে পাই, পরিচিত হই আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা সাধারণ সংবেদনশীল মানবিক চরিত্রের সঙ্গে। ইউলিসিস এভাবেই ব্লুমের সূত্রে অসাধারণ একটি উপন্যাস হয়ে উঠেছে।

 তবে একেবারেই কী ত্রুটিহীন এই রচনা? অন্তত তিনটি দিক থেকে এর কিছুটা হলেও বিচ্যুতি ঘটেছে। প্রথমত, এর কোনো সুনির্দিষ্ট গল্পকাঠামো নেই। দ্বিতীয়ত, ভাষা বা  শৈলীর দিক থেকে কিছুটা হলেও অতিরিক্ততা আছে। তৃতীয়ত, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তিক নিয়ন্ত্রণের অভাবে এর কোনো কোনো বর্ণনীয় অংশ দুর্বোধ্য থেকে গেছে, কিংবা কোনো কোনো চরিত্র ভীষণ জমকালো হয়ে উঠেছে।তবে এখানেই শেষ নয়, উপন্যাসটি আবার কোথাও কোথাও হয়ে উঠেছে আত্মজৈবনিক। নিজের জীবনকেই তিনি উপন্যাসে মিশিয়ে দিয়ে রচনা করেছেন আধুনিক এপিক।

এভাবেই উপন্যাসটিকে চিহ্নিত করা যায় নতুন ধরনের ভাষাশৈলী আর আধুনিক ব্যক্তিমানুষের ক্ষয়িষ্ণু, ভঙ্গুর, মানবিক অস্তিত্ব অন্বেষার ইতিবৃত্ত হিসেবে। স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশের পরপরই বিশ্ব জুড়ে দারুণ সমাদৃত হয়েছিল। এমনকি এখনও দেশে দেশে জয়েস, বিশেষ করে ইউলিসিস নিয়ে পাঠকের উৎসাহ অনিঃশেষ। এর বিষয়বস্তু,  শৈলী, প্রকরণভঙ্গি, ভাষা, চরিত্রায়ণ, প্রতিপাদ্য ও পরিবেশচিত্রণ এককথায় অনন্য। এসব কারণেই  বৈশ্বিক স্তরে উপন্যাস হিসেবে এর গুরুত্ব ও প্রভাব একেবারে শিখরস্পর্শী। ভাষার এই বাধা পেরিয়ে যেতে পারলে উপন্যাসটির শ্রেষ্ঠত্বের মহিমা যে- কোনো বোদ্ধা পাঠককে মুগ্ধ করার জন্যে যথেষ্ট।

আফরোজা পারভীন
আফরোজা পারভীন