জীবনানন্দ/ ওয়াহিদ মোস্তফা নিলয়
সরু গলিটি ধরে রাহাত হাঁটছে।বেশ চাপা রাস্তা,পুরো রাস্তা জুড়েই খাল-খন্ডে ভরা,তাতে পানি জমে আছে।ছোটখাট গড়নের রাহাতের গায়ে একটা কমদামি শার্ট,প্যান্টের রং উঠে গেছে আর পায়ে যে চটিটা আছে তাতে দুবার সেলাই পড়েছে।সে হাঁটছে কিন্তু নির্দিষ্ট কোন গন্তব্যে যাওয়া তার উদ্দেশ্য নয়।স্নায়বিক দূর্বলতা কাটানোই তার প্রধান লক্ষ্য।তার স্ত্রী ক্লিনিকে ভর্তি,প্রথম সন্তানের প্রত্যাশায় শুয়ে আছে কেবিনে।
রাহাত হাঁটতে হাঁটতে গলিটার শেষ মাথায় চলে এসেছে।প্রচন্ড রোদে গা থেকে দর দর করে ঘাম ঝরছে।সেই সকাল থেকে সস্তা এই ক্লিনিকের কটু গন্ধভরা করিডরে বসে ছিল সে।তার স্ত্রীকে অনেক আগেই ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কিন্তু দুপুর গড়িয়ে আসছে তবু কোন খোঁজ নেই।দুবার সে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে,প্রতিবারই নার্সদের কর্কশ কন্ঠে তাকে ফিরে আসতে হয়েছে পূর্বের স্থানে।এমন পরিস্থিতি কতক্ষন চলবে সে জানে না,অথচ ক্লিনিকের এই গন্ধ তাকে বিষিয়ে তুলেছিল।তাই টানা দুপুরে সে বেরিয়ে পড়েছে।ক্লিনিকের পাশের সরু গলি দেখেই হাঁটতে শুরু করেছিল আর এখন তো গলিটির শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে আছে।এখান থেকে দুটো রাস্তা বেরিয়ে গেছে;ডানদিকে আর বাঁ”দিকে।সে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে হাঁটতে শুরু করল।অবাক করার মত ব্যাপারটি হলো,তার এখন কোন চিন্তা হচ্ছে না।প্রথম সন্তান কিংবা স্ত্রীর যন্ত্রনাকাতর মুখটিও ভেসে আসছে না কেন জানি।অথচ এই মেয়েটির সাথে ১০ বছর ধরে প্রেম করেছে সে,সবার অমতে বিয়ে করেছে,সবার থেকে দূরে সরে এসেছে শুধু এই মেয়েটির জন্য।এই ছোট শহরটিতে তাদের কেউ নেই,হাসপাতালে যন্ত্রনাকাতর তার স্ত্রীর পাশেও কেউ নেই কিন্তু অদ্ভুতভাবে এই মুহুর্তে তার কিছুই মাথায় আসছে না।অন্য কেউ হলে হয়তো এমন ভাবনাহীনতার জন্য অনুশোচনায় ভুগত।কিন্তু তার মধ্যে কোন অনুশোচনাও নেই বরং রাস্তার পাশে প্যাঁচানো তারগুলো দেখতে তার ভালো লাগছে।
খানিকটা গিয়েই সে রাস্তার পাশে পুরাতন বইয়ের দোকান দেখতে পেল।দোকানের মধ্যে ঢুকে পড়ল সে।দোকানটি খুব একটা বড় নয়,প্রচলিত বই ছাড়া তেমন কিছু একটা নেই।দোকানী এখনও তার উপস্থিতি টের পায়নি,চোখ বন্ধ করে ঝিমুচ্ছে।সে বই দেখতে লাগল।বইয়ের প্রতি তার টান অন্যরকম।মাঝে মাঝে তার মনে হয় এই ত্রিশ বছরের জীবনে সে শুধু একটা জিনিসই ভালোবেসেছে–বই,বিশেষ করে কবিতা।প্রথম যেদিন জীবনানন্দের ‘আট বছর আগে একদিন’ কবিতাটি পড়েছিল সেদিন থেকেই কবিতার প্রতি তার ভালোবাসা জন্মে।কয়েক’শ কবিতা নোটবুকে এখনো পড়ে আছে,একটা কবিতার বই বের করা হয়ে ওঠেনি আজও।ছোট চাকরি,আর্থিক দৈনত্য একবারে পিষে ফেলেছে তাকে তবে সেই যে উদাসীনতা,খেয়ালিপনা সেটি এখনো যায়নি।বিয়ের পর সচরাচর মানুষ ঘরমুখী হয়ে পড়ে তবে তার স্ত্রী এখনো তাকে ঘরুমখী করতে পারেনি সেভাবে। তার ভয়,হয়তো সন্তানটি তাকে আরো ঘরমুখী করে ফেলবে,নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলবে সে।তাই সন্তান নেওয়ার ইচ্ছা তার কোনদিনই ছিল না তবুও নিতে হলো।অনেক সময় অনেক কিছুই আমরা না চাইতেও করে ফেলি।সেটাকে না পারা যায় মন থেকে গ্রহন করতে,না পারা যায় ফেলে দিতে।
পুরাতন বইয়ের স্তুপ ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎ একটা বই সামনে এসে গেল।আবদুল মান্নান সৈয়দের “শুদ্ধতম কবি”। রাহাতের মুখে খানিকটা হাসি ফুটে উঠল।এই বইটি সে বহুদিন ধরে খুঁজছে,পায়নি।কতবার অর্ডার দিয়েছে স্থানীয় লাইব্রেরিতে,প্রতিবারই স্টক আউট কথাটি শুনতে হয়েছে।সে বইটা কিনবে,অবশ্যই কিনবে।সে দোকানিকে দাম জিজ্ঞাসা করল।দোকানদার বোধহয় এতক্ষনে টের পেল তার উপস্থিতি।আধবোঝা অবস্থায় বলল,’দেন যা দিবেন,পুরাতন বই।’সে পকেট থেকে ১০০০ টাকার নোটটি বের করে দিয়ে বইটি নিয়ে বেরিয়ে গেল।দোকানি হতভম্ভ দৃষ্টিতে তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।তার ঘুম কেটে গেছে।জীবনে বহুত বেকুব সে দেখেছে এমন বেকুব দেখেনি।যে বই ২০০ টাকায়ও কেউ নেয় না,৬ মাস ধরে পড়ে আছে,সেই জিনিস ১০০০ টাকায় কেউ নেয়!
রাহাত উত্তেজনায় কাঁপছে।বইটা হাতে নিয়ে রাস্তা ধরে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে এক নির্জন স্থানে বসে পড়ল সে।বইটার উপর ধুলো জমে ছিল।শার্ট দিয়ে ধুলোগুলো মুছে পড়তে শুরু করল।সে ভুলে গেছে তার স্ত্রীর কথা,তার প্রথম সন্তান জন্মানোর কথা,তার মাথায় এখন শুধুই জীবনানন্দ দাশ।
আধার নেমেছে।প্রায় ১০০ পৃষ্ঠা পড়ে ফেলেছে সে।অন্ধকারে আর লেখাগুলো পড়া যাচ্ছে না।সে উঠে দাঁড়াল।ক্ষুধা লাগায় কাছের টং দোকানে গিয়ে একটা পাউরুটি নিয়ে মুখে দিল,চায়ের অর্ডার দিল।পাউরুটি অর্ধেকও ফুরায়নি হঠাৎ মনে পড়ে গেল ক্লিনিকের কথা।’তার স্ত্রী যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছিল,তার কি সন্তান হয়েছে,এতক্ষন সে এখানে বসে আছে কেন?’সে পাউরুটিটা কুকুরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে জোরে জোরে হাঁটতে লাগল।ভাগ্যিস,রাস্তাটা মনে আছে এখনো,তাই পৌঁছাতে তেমন দেরি হলো না তার।সে করিডর দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল।সকালের সেই নার্সগুলোর মধ্যে একজনকে দেখতে পেয়ে ছুটে গেল।কিছু বলার আগেই নার্সটি কর্কশ গলায় বলে উঠল,”আচ্ছা মানুষ তো আপনি মশাই।আপনার স্ত্রীর এত খারাপ অবস্থা আপনি কোথায় ছিলেন বলুন তো।আবার আত্মীয়স্বজনও নেই কেউ।শুনেন,আপনার স্ত্রীর নর্মাল ডেলিভারি হলো না দেখে সিজার করতে হলো।ওদিকে তো আপনি নেই।টাকা পয়সা তো কিছুই পরিশোধ করেননি।যান টাকা পরিশোধ করুন।তার আগে মেয়েকে দেখে আসুক গিয়ে,”বলে ধাই ধাই করে চলে গেল।সে হেঁটে গেল রুমের দিকে।বাচ্চার কান্না শোনা যাচ্ছে।স্ত্রীর পাশে গিয়ে বসল রাহাত।সন্তানের দিকে তাকালো।কোন এক অপার্থিব খুশিতে ভরে গেল তার মন।মনে হলো,মেয়েটি এক জীবন্ত কবিতা—জীবনানন্দের কবিতা।
রিছিপশনে দাঁড়িয়ে আছে রাহাত।হাতে হাসপাতালের বিল।সে টাকা গুনছে,একবার,দুবার,তিনবার কিন্তু টাকার হিসাব মিলছে না।ডান পকেটে ৬০০০ টাকা ছিল।প্রতিবারই হিসাব করে ৫০০০ টাকা হচ্ছে।বাকি ১০০০ টাকা কোথায় সে তা জানে না।বইটি এখনও তার বগলের তলে।
Facebook Comments Sync