জীবনের মোহনায় বাউল বাতাস/ বেগম জাহান আরা
এক
ঠোঁটের ওপর আলতো একটা চুমুতে ঘুম ভেঙে গেলো। ভাবলাম ইন্দ্রার কাজ। চোখ খুলে দেখলাম কেউ নেই ঘরে। তবে কি স্বপ্ন? মনে মনে আজ রাতে কি এই রকম একটা কিছু চেয়েছিলাম? কি বোকা আমি, এখনও সুকুমার বাসনা আমাকে বিহবল করে! বোকা বানায়! যাক, উঠে বসলাম। সেপ্টেম্বরের তেরো তারিখ আজ। আমার জন্মদিন। পালিত হচ্ছে হামবুর্গে। পূর্ণ হলো আটাত্তর বছর। পৌনে এক শতাব্দির ওপর পথ চলেছি। কম কথা নয়। ঘুঘু ডাকা ছায়ায় ঢাকা দিন আজ হবে কিনা জানি না। তবে ঝকঝকে সকাল। সূর্য ধাওয়া করেছে উষা দেবিকে। সে পালাচ্ছে। সূর্য তাকে ধরতে পারেনি কোনোদিন। ঠিক মানুষও এমনি করে ধাওয়া করে নিজের স্বপ্নক। কয়টাকে আর ধরতে পারে? তবু তাড়া করে যায় নিরন্তর। আহা, কি সুন্দর হালকা রঙধনু রঙ এসে রাঙিয়ে দিলো আমার জানালার কাঁচ। তাহলে এসেই গেলো আকাশে বরুন মহারাজ। নামলাম বিছানা থেকে। বড্ড ছোটো মনে হলো আজ ব্রাহ্মমুহূর্তকে।
জন্মদিনে এতো আয়োজন, এতো উপহার, দেশ বিদেশ থেকে এতো শুভেচ্ছা আর কখনো পাইনি। খুব ভোর বেলায় ছেলে রংকু, বউমা এলগিন আর তাদের মেয়ে ইন্দ্রা মিলে আমাকে নিয়ে গেলো খাবার ঘরে। এলগিন বেশ বড়ো একটা গাজরের কেক বানিয়ে তাতে টপিং করেছিলো খুব সুন্দর করে। খাবার টেবিলে এতো শুভেচ্ছা! একগাদা উপহারের মোড়ক। বড়ো ফুলদানিতে বিশাল মিশ্র রঙের নয়নাভিরাম গোলাপের তোড়া। ওরা তিনটে মোমবাতি জালালো। তারপর ‘হ্যাপি বার্থ ডে’ গান গাইলো হাতে তালি দিয়ে। মনে হলো ওপর থেকে সুগন্ধি ঐশি হাওয়া নেমে এলো ঘরে। সুবাসে ভরে গেলো ঘর। কি আনন্দ! কি সুখ! দুচোখ ভিজে উঠলো খুশির আবেগে। দোয়া করতে গিয়ে কেঁপে গেলো গলা। টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা পড়লোই ঝরে। কোনো বাধা মানলো না।
একে একে প্যাকেট খোলা হলো। রংকুর প্যাকেটে গাঢ় নেভি ব্লু রঙের একটা ফুলহাতা পাতলা জ্যাকেট। শীতের দেশে সব সময় পরে থাকার জন্য খুব প্রয়োজন। এলগিনের প্যাকেটে একটা উলের ফুলহাতা পুলোভার, একটা পুলোভার বোনার মতো উল আর দুটো নভেল। একটার লেখক খালেদ হোসাইনি, বই-এর নাম ‘দি মাউন্টেনস ইকোড’। আর একটা লেখকের নাম, হারপার লি, বই-এর নাম ‘টু কিল এ মকিংবার্ড’। ইন্দ্রা দিলো ফুল, আর একটা চমৎকার কার্ড।
পূবের জানালা দিয়ে রোদ হেসে ঢুকে পড়েছে ঘরে। রোদের আলো যে এতো পবিত্র হয়, এতো আরামদায়ক হয়, এতো ভালোবাসার সুবাসে ম ম করে, তা কোনোদিন জানিনি। কোথাও একটা বেড়াতে যাওয়ার কথা হয়েছিলো। কিন্তু আমার পায়ের ব্যাথার জন্য বাদ দেয়া হয়েছে সেটা। পোলাও রোস্ট রান্না করবে রংকু। সে আবার জবর রাঁধুনি। রাঁধে উত্তম। ও বেশ পছন্দ করে রাঁধতে। রোজ নয়, মাঝে মাঝে। এটা একটা বিনোদন ওর। হামবুর্গের অনেকেই জানে কথাটা। সবাই সুখ্যাতিও করে তার রান্নার।
কিছু পরে ফোন করলো মেজো নাতি প্রকাশ, ওর বউ নিম্মি এবং তাদের মেয়ে নন্দিনি। ওরা নাকি রাত বারোটায় ফোন করেছিলো, আমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। তাই ধরতে পারিনি। দুঃখিত হলাম। হামবুর্গ থেকে ফোন করলো একমাত্র পৌত্র ডানিয়েল আর তার বউ নাতালিয়া। ঢাকা থেকে একমাত্র নাতনি পিংকি, তার বর আর তাদের ছেলে সাকিফও কথা বললো। ব্রাইটন থেকে ফোন করলো ভাইপো শেলি আর তার বউ এনা। বেইজিং থেকে ফোন করলো আমার বড়ো নাতি সাইফ, ওর বউ হেমা আর তাদের ছেলে রুপ। নবজাতক কন্যা প্রমার উঁ আঁ শোনালো। আমার একমাত্র ছোটো ভাই চন্দন আর তার বউ ফোন করলো ঢাকা থেকে। বেশ অনেকক্ষণ কথা বললো চন্দন।
ফেসবুকের প্রায় পঞ্চাশ জন দেশ বিদেশের বন্ধু ছাত্র ছাত্রি পরিচিত জন, প্রিয়জন উইশ করেছে। সুন্দর সুন্দর মেসেজ দিয়েছে। কামনা করেছে আমার স্বাস্থ্য আর আয়ু। পুরনো বন্ধুদের কেউ কেউ অবাক হয়েছে আমার বয়স জেনে। কতো রকম ছবি এবং ফুলেল কার্ড পোস্ট করেছে ছাত্র ছাত্রি এবং প্রিয়জনেরা। বলতে গেলে আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম আনন্দে সুখে আর গৌরবে। জীবনের প্রায় শেষ প্রহরে আমার জন্য এতো বিপুল ভালোবাসা আর সম্মান পাওনা ছিলো তা কল্পনাও করতে পারিনি। পূর্ণ হয়ে উঠেছে জীবন পাত্র। আর যেনো কিছু নেয়ার জায়গা নেই। কলসি ভরে পানিতে টইটুম্বুর হলে যেমন আর পানি দেয়ার জায়গা থাকে না, প্রায় তেমনি। এরপর তো উপচে পড়ে যাবে পাত্র ছাড়িয়ে। যেমন যায় মানুষের জীবন এই পৃথিবী ছাড়িয়ে অন্য কোথাও। সুখের ভারে বুকের ভেতর হঠাৎই কেমন হা হা করে ওঠে। তবে কি সব ছাড়িয়ে যাওয়ার সময় হয়ে এলো তারও? হয়তো, হয়তো না। এটা গোপন থাকে বলেই আমরা বেঁচে থাকি আনন্দে। একটা ফোনের আশা করেছিলাম সারাটা দিন। এলো না। অবিশ্বাস্য। তবু সত্যি। আমার জন্মদিনের কথা ওর তো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এটা ঠিক যে, ও ভুলে গেছে। নইলে অবশ্যই হ্যালো বলতো একবার। এতো কিছুর পরেও মনের মধ্যে খচ খচ করে। অভিমান হয়। রাগ করতে ইচ্ছে হয় না। ওর সাথে আমার সম্পর্ক বেশি দিনের নয়। অথচ মনে হয়, কতো কালের আত্মার সম্পর্ক। দেখা হলো, চোখে চোখে মিললো, কথা বললাম, হাসলাম, ওর বাসায় লাঞ্চ খেলাম। একই দিনে হলো সব। ক্লিক করলো সব ক্ষেত্রে। কি আরামদায়ক একটা সম্পর্কের সৌধ গড়ে উঠলো একদিনে। বহুদিন পাশাপাশি হাঁটলেও এমন আত্মিকতা খুব কমই হয়। আমার ক্ষেত্রে সেটা আরো প্রযোজ্য। তারপর থেকে প্রতিদিন ফোনে কথা হয়। অজস্র কথা বলি আমরা, কিন্তু পরে কিছুই আর মনে থাকে না। খাজুরে আলাপ আর কি। বলার আনন্দেই কথা বলা। এ কি সবার সাথে হয়?
রাতে ঘুমোতে গেলাম। ক্লান্ত ছিলাম তবু ঘুম এলো না। ওর কথাই ভাবছিলাম। ওর সাথে আমার দেখা না হতেও তো পারতো। বয়সের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও বন্ধু হয়ে গেলাম। ও বললো, ‘মাতাজি’ বলে ডাকবে। গররাজি হওয়ার কিছু নেই। ভালোই তো। রেডি মেইড একটা দামি মানুষ, বন্ধু এবং মেয়ে পেয়ে গেলাম।
সম্পুরক সম্পর্কের স্বস্তিই আলাদা। দুজন দুজনের ঘাটতি পুরনের জন্য এক পা বাড়িয়েই থাকি। অজান্তেই একটা লম্বা শ্বাস বেরিয়ে এলো বুকের গভীর থেকে। তবু রাগ হচ্ছে। কেনো হচ্ছে, তা বুঝতে পারে না সে। এই কি জীবনের নিয়ম? সুখ দুঃখ আসে যায় কি এমনি করেই? কারোই কিছু বলা বা করার থাকে না?
ঘুম এলোই না কিছুতে। প্রায় ঘন্টা খানেক এপাশ ওপাশ করে বিরক্ত হয়ে গেলাম। এদেশে তো গাড়ি চলাচলের শব্দ পাওয়া যায় না। চারদিক শুনশান। অলস নির্ঘুম প্রহর। মনটাকে ছুটি দিলাম। কি অনায়াসে সে চলে গেলো শৈশবের শহরে। স্মৃতিগুলো এলো মেলোভাবে মনে পড়তে লাগলো। সবগুলোই আসে পাশে ঘোরে। পদ্মা তীরের মানুষ আমি। কতো স্মৃতি তাকে নিয়ে। বড়ো হওয়ার পরে কতো সুখ দুঃখের কথা তাকেই তো বলেছি। ঘন্টার পর ঘন্টা দেখেছি পদ্মার উথাল পাথাল ঢেউ। বয়ে যাওয়া বোবা ঢেউ-এর ভাষা বুঝতে চেষ্টা করেছি। কেনো যে ছল ছল করা ঘোলা পানির চঞ্চল উদ্দাম স্রোত দেখতে এতো ভালো লাগতো তাও ব্যাখ্যা করতে পারি নি কোনোদিন। শুধু ভালোলাগা আর আনন্দে মন ভরে যাওয়া বুঝতাম।
মনে পড়ে, একবার শ্রাবণ মাসে তালাইমারির দিকে পদ্মার বাঁধে চিকন চিকন কয়েকটা ফাটল দেখা গিয়েছিলো। আতঙ্ক দেখা দিলো শহরে। কারণ বাঁধ ভেঙে গেলে কয়েক মিনিটের মধ্যে রাজশাহী শহর তলিয়ে যাবে পদ্মার পানিতে। বাঁধের চেয়ে শহর কয়েক ফুট নিচে। ভাগ্যিস ব্রিটিশরা পদ্মায় বাঁধ দিয়েছিলো। বাবার কাছে শুনেছি প্রমত্ত পদ্মার কথা। বর্ষায় ভরা নদীর উন্মাতাল ভয়ঙ্কর গর্জন শুনে নাকি শহরের লোক রাতে ভয় পেতো। কখন না জানি রাক্ষুসি পদ্মা হুড় মুড় করে এসে পড়ে ঘাড়ের ওপর। শহরটা ছুঁয়ে ছুঁয়েই তো বয়ে গেছে পদ্মা। অথবা বলা যায়, পদ্মার তীর ছুঁয়ে ছুঁয়েই বেড়ে উঠেছে রাজশাহী শহর।
পদ্মার দুকুলপ্লাবী পানি আমিও দেখেছি।বাবার সাথে বাঁধের ওপর দিয়ে হাঁটার সময় দেখেছি সে কি তোড় পানির!ঢেউগুলো যেনো গুমরে গুমরে উথলে উঠতো। ঘোলা পানির ওপর দিয়ে বড়ো নৌকো, ছোটো নৌকো নিশ্চিন্তে যাওয়া আসা করতো। নৌকোয় বসে দুলে দুলে লোকে নামাজ পড়তো। কোলের ওপর রেহেল পেতে টুপি পরা এক দাড়িওয়ালা লোককে কোরান শরিফ পড়তেও দেখেছি। ভয়ে আমার বুকটা দুর দুর করে উঠতো। বাবাকে বলতাম, নৌকোয় নামাজ পড়তে এবং কোরান শরিফ পড়তে উনাদের ভয় লাগে না বাবা? কি সাহস? নৌকো যেভাবে দুলছে, মনে হয় কাত হয়ে পড়ে ডুবে যাবে এখনি। আমার ভয়ের প্রশ্ন শুনে হাসতেন বাবা।
পদ্মার ধারে যাওয়ার জন্য আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডান ও বাঁয়ের দুটো বাঁক নেয়ার পর সোজা উত্তরের রাস্তায় পড়তে হয়। নাপিত পট্টির মোড়ে পৌঁছুলে ডানদিকে কোর্ট বরাবর বড়ো পাকা রাস্তা ধরে কিছুদূর গিয়ে আবার বাঁয়ে মোড় নিতাম আমরা। তারপর কিছুদূর সোজা। সেই রাস্তার ডানে দেখা যেতো রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলের উঁচু প্রাচীর। তার সংলগ্ন কিছু জমিতে সবজি বাগান। কয়েদিরাই বাগানে কাজ করতো। কি সার দিতো কে জানে, ওখানকার পালং শাকের মতো বড়ো আর পুষ্ট পাতা আর কোথাও আমি দেখিনি কখনো। তেমনি বড়ো ফুলকপি আর বাঁধাকপি। এক একটার ওজন হতো চার পাঁচ সের (তখন কেজির মাপ ছিলো না)। আমার এক জেলার চাচার বদৌলতে ওখানকার সবজি আমরা কিছু খেয়েছিও। খেতেও খুব ভালো।
একই রাস্তার বাম দিকে ছেলেদের হাই মাদ্রাসা। বিশাল এলাকা জুড়ে প্রাচীর দেয়া। ভেতরে খেলার মাঠ এবং বড়ো একটা পুকুর। ছেলেদের থাকার হোস্টেলও ছিলো। আর একটু সোজা এগোলে ডানে একটা রাস্তা চলে গেছে ম্যাজিস্ট্রেট, আইজি, ডিভিশনাল কমিশনার, জজ সাহেবদের বাঙলোর দিকে। সাহেব সুবোরা মনের মতো করে তাদের বাঙলো বানিয়েছিলো। প্রাণভরে পদ্মার হাওয়া খেতো। বাঁধ থেকে রাস্তাটা প্রায় তিন চার ফুট নিচুতে।
বাঁধে ওঠার ঠিক আগে বাম দিকে নিপাট লাল ইঁটের দালান, জেলা পোস্ট অফিস। সেটাও বাঁধ থেকে তিন চার ফুট নিচে।আমরা ডানে বাঁয়ে না গিয়ে সোজা গিয়ে দৌড়ে উঠতাম উঁচু পদ্মার বাঁধে। সিঁড়ি ছিলো, বাবা উঠতেন। বাঁধের ওপর বেশ কয়েকটা লোহার বেঞ্চ পাতা। ক্লান্ত পথিক বা সৌখিন ভ্রমনকারির জন্য। বাঁধটাই চওড়া। মানুষের হাঁটার জন্য। কোনো রকম গাড়ি সেখানে চলতে পারবে না। সাইকেলও না। মানুষ মানতোও সে নিয়ম।
সাধারণত আমি আর আমার সোয়া এক বছরের বড়ো ভাই নান্নু বাবার সাথে পদ্মার ধারে বেড়াতে যেতাম মাঝে মাঝে। অনেক লোক বাঁধের ওপর হাঁটাহাঁটি করতো। নদীর স্বাস্থ্য কর বাতাস বাবাও খুব পছন্দ করতেন। তখনই দেখেছি, ভরা পদ্মার কি অপরূপ রূপ! বেঞ্চের পরে ঢালু হয়ে নেমে গেছে বাঁধ। ছলাত ছলাত করে পানি এসে আছড়ে পড়তো বাঁধের গায়ে। ছলকে উঠতো পানি। খুব ভালো লাগতো দেখতে। কখনও গায়েও এসে পড়তো পানি। নদীর ওপারে ছায়ার মতো দেখা যেতো গাছ পালা। বাবা বলেছিলেন, ঐ পারে হলো মুর্শিদাবাদ। নবাব সিরাজুদ্দৌলার রাজ্য ছিলো এক কালে। মাঝে মাঝে নবাবের গল্প করতেন বাবা। খুব সুন্দর করে বলতেন পলাশির যুদ্ধের গল্প, মির জাফরের বিশ্বাস ঘাতকতার গল্প। ঘসেটি বেগমের গল্প, আলেয়ার গল্প। আজও সে সব কথা ছবি হয়ে আছে মনের মধ্যে অমলিন।
(চলবে)________
_____
Facebook Comments Sync