জীবনের মোহনায় বাউল বাতাস ৮/ বেগম জাহান আরা

জীবনের মোহনায় বাউল বাতাস ৮/ বেগম জাহান আরা

জীবনের মোহনায় বাউল বাতাস/ বেগম জাহান আরা

পর্ব-৮

মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। জান্নাতের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় এতো কথা মনে পড়লো। ওর একমাত্র ছেলে আমাকে ডাকতো ‘ডেরেকটার দিদি’ বলে। জান্নাত মেয়েটা  বড্ড লক্ষ্মী ছিলো। তেমনি ইকবাল আর আতাউর। ওদের কর্মদক্ষতা আর কাজের প্রতি ভালোবাসা অন্যের জন্য অনুকরণীয়। জেলা একাডেমিরও অনেক অফিসারকে পেয়েছি খুব গুণের মানুষ হিসেবে। এক কথায় পুরো শিশু একাডেমির সবাই, যাদের নাম এখন বলতে পারছিনা, তাদের কথা মনে রেখেই বলছি, এতো আন্তরিক ভালবাসা পাওয়াও দুর্লভ ঘটনা। তাই বার বার বলছি কথাটা। আমি এই প্রবাসে তোমাদের উদ্দেশ্য করেই বলছি, কতোটুকু জানো তোমরা আমাকে? আমি জানি না। আমি কিন্তু ভালোবাসি তোমাদের সবাইকে। স্মৃতির বাউল বাতাসে মিশে আছো তোমরা। মনে রখবো সব আমৃত্যু।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটে শিক্ষক হিসেবে কাজে যোগ দিই ১৯৭৫ সালে। এতোক্ষণ তো আমার নামই বলি নি। কারণ আপনারা চেনেন আমাকে ‘অয়নাংশ’ উপন্যাসের ‘মনীরা’ হিসেবে। ওটা ছিলো কল্পিত নাম। আমার আসল বা অফিসিয়াল নাম, বেগম জাহান আরা। চাকরির জায়গায় কেউ ডাকে জাহান বলে, কেউ ডাকে আরা, কেউ ডাকে ম্যাডাম। বাবা ডাকতেন বেগম বলে। এখন আমি ব্যবহার করবো ‘জাহান’ নামটা। মানে ‘বেগম জাহান আরা’ এখন থেকে শুধু জাহান। এই নামেই জীবনের গল্প বলে যাবো আমি। এই ছোট্ট নামটা আমার বিদেশি ছাত্রদেরও খুব পছন্দ। সহজে মনে রাখতে পারে বলেই হয়তো। আমার প্রিয়জনেরা জাহানকে আরও সংক্ষিপ্ত করে নিতো কখনও। পরে বলবো সেটা।

 

ছেলের বাসায় কালকের পার্টিতেও দেখলাম জাহান নামটা ‘ইয়াহান’ নামে  উচ্চারিত হচ্ছে। কিছু আসে যায় না। আমার তো সংকর পরিবার। সয়ে বয়ে নিতে হয়। কাজটা কিন্তু মোটেও কঠিন নয়। আমি নিজেকে সামলে রাখি। সবাই আমার মনের মতো হবে, তাই বা কেনো? আমাকেও মাঝে মাঝে ওদের মনের মতো হতে হবে বই কি। সংকর পরিবারে আমার তাই সমস্যা হয় না বললেই চলে। পার্টিতে যখন বোতল আর পাতলা সুদৃশ্য গ্লাসের ঠুন ঠান শব্দ শুনি, তখন অন্য দিকে যাই আমি। বড়ো বাড়ি। তার ওপর বাগানে তাঁবু টাঙানো হয়। লোকজন চলে যায় ওদিকেও। আমি সবই দেখি আবার কিছুই দেখি না। বেশিক্ষণ থাকিও না পার্টিতে।  

 

আমার নিজের ঘর আছে। সুইটের মতো। ঘরের সাথে একটা বসার ঘর। শোয়ার ঘরের চেয়ে বড়ো। সেখানে পড়ার টেবিল, পুব দিকে দেয়াল বরাবর কাঠের আলমারি কাপড় চোপড় রাখার জন্য। পশ্চিম আর দক্ষিণ দিকের দেয়াল ঘেঁষা দুটো কাঠের চেস্ট অব ড্রয়ারস। পশ্চিম দিকে একটা বড়ো জানালা। জানালার ভেতরের কার্নিশে কয়েকটা ছোটো ছোটো পট প্ল্যান্ট। একটা পটে অর্কিড। তাতে একবার ফুল ফুটলে থাকে তিন চার মাস। যেনো ছবি। এবার বদলে দিয়েছে পটটা। হাল্কা বেগুনি ফুল ফুটেছে চারটা। আরও তিনটে ফুটি ফুটি করছে। শুধু চোখ জুড়োয় না, মনও জুড়িয়ে যায় আমার। দক্ষিণে বড়ো কাঁচের দরজা। দিনের বেলায় খুলে রাখি। তবে ঠান্ডা পড়লে একেবারেই খুলি না। রোদ দেখলে দরজার ওপর দিকে একটু ফাঁক করে দিই। ঘরে টিভিও আছে। এটাচড বাথও আছে। ঘরের মধ্যেই পশ্চিম দিক চেপে সুদৃশ্য হাতলওয়ালা কুশনে সাজানো মোটা মোটা দুটো চেয়ার এবং একটা ছোটো টেবিল। এই ঘরে তিনটে হিটার। আমার পায়ের কাছে  হিটারটা খুব আরামদায়ক।

 

পার্টিতে অনেক খাবার দাবার ছিলো। প্লেটে কিছু খাবার নিয়ে আমি নিজের ঘরে চলে আসি। ওরাও বাঁচে। পানাহারের পার্টিতে কতোই গেছি। কতো তামাসাও দেখেছি। এরা তামাশা করে না। উপভোগ করে খানাপিনা। সবাই তো সন্তানতুল্য। তাই বাড়ির পার্টিতে আমি নিজেকে একটু লুকিয়ে রাখি। নইলে হয়তো ওদের আনন্দে ঘাটতি পড়তে পারে।

 

মনে আছে একবার কোনো এক দূতাবাসের পার্টিতে বোতল-পানি খেতে খেতে এক নবীন যুবক বমি শুরু করলো। যুবকের বাবাকে আমি ভালো করে চিনি। তিনি ছিলেন অন্য প্রান্তে। আমি ডেকে বললাম, ছেলেটার কাছে যান। ও বমি করছে। উনি বললেন, পোলাপানের আর হুঁশ হইলো না। মনে লয়, খাইছে বেশি।

 

ঐ ভদ্রলোকের টাকা হয়েছে কিভাবে তা আমি জানতাম। ছেলেকে নিউজিল্যান্ড পাঠালেন পড়াশোনা করতে। তখন উঠতি ধনীদের ছেলেদের, মেয়েদের নয়, বিদেশে পড়তে না পাঠলে প্রেস্টিজ থাকে না। তো সেই ছেলে এক বছরের মধ্যে গভীর প্রেম জমিয়ে ফেলেছে এক সংকর ললনার সাথে। শিকেয় তুলে রেখেছে লেখাপড়া। খবর পেয়ে বাবা গেলেন ছেলের কাছে। একটি মাত্র ছেলে। তাঁর অগাধ সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকার। একটু পানাহার তো শিখতেই পারে। বাবাও তো পানাহারে সৌখিন মানুষ। দেশি বিদেশি বোতল ঘরে সাজানো থাকে। স্ট্যাটাস সিম্বল হিসেবে না, উঠতি ধনী বন্ধুরা এলে কাজে লাগে।

 

বাবাকে দেখে ছেলে খুব খুশি। সরাসরি বললো, রিটার সাথে আমার বিয়েটা দিয়ে বাড়ি যেতে হবে বাবা। ওকে আমি ভালোবাসি। ওকে ছাড়া আমি বাঁচবোনা। বাবার বুক ছাঁত করে ওঠে। একমাত্র ছেলে বলে কি? এখনই বিয়ে?

 

বাবা ভাবলেন, বিয়ে দিলে ছেলের মন উচাটন ভাব চলে যাবে। হবু পুত্রবধু ওখানে এ-লেভেলে পড়ছে। সেই তাকে টেনে নেবে লেখাপড়ার জগতে। রিটার সাথে কথা বলে বেশ চালাক মনে হলো তাঁর।

 

বহু টাকা (ভদ্রলোকের ভাষায়, ডলার) খরচ করে ধুম ধামের সাথে বিয়ে দিলেন ছেলের। এই রকম একটা কিছু হতে পারে  অনুমান করে উনি সোনার গয়নাও কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। ওখানে কুটুমদের উপহার দিয়েছেন প্রচুর। খানা পিনা হয়েছে প্রচুর। সেই আনন্দ উৎসবের ভিডিও নিয়ে এসেছিলেন দেশে। সে ভিডিও দেখেওছি আমরা।

 

এক বছরের মধ্যে ছিঁড়ে গেলো ভালোবাসা। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলো ডিপ্রেশনের রোগি হয়ে। স্বাস্থ্য গেলো। বউ গেলো। কিন্তু পানাহার তো গেলো না। বাপ বেটায় বসেও কখনও সামান্য পান চলে। বাবা ছেলের আবার বিয়ে দিতে চাইলেন। তাঁর ধারণা, বউ পেলে ছেলে ঠিক হয়ে যাবে। মুশকিল হলো, বউ পাওয়া যাচ্ছে না। তখন বলতে শুরু করলেন, ওটা তো বিয়ে হয় নি, এনগেজমেন্ট হয়েছিলো।

 

বন্ধু মানুষ। আমাকে মাঝে মাঝে দুঃখের কথা বলতেন। ছেলেও আমাকেও অনায়াসে ঐ কথা বললো। বন্ধু ভুলেই গেছেন যে আমি তাঁর ছেলের বিয়ের ভিডিও দেখেছি। মানুষের মুখের ওপর থাবড়া মেরে কথা বলতে পছন্দ করি না। কিন্তু পারলাম না সেদিন। বলেই ফেললাম, আপনি যে ছেলের বিয়ের ভিডিও দেখালেন?

 

একটুও অপ্রস্তুত হলেন না। বললেন, বিদেশের বিয়ে আবার বিয়ে নাকি ভাই? এখানে যে বিয়ে দেবো, তার ধুমধাম হবে আসল বিয়ের মতো। আমি তো হতবাক। কোনো নাটকেও এমন সংলাপ শুনিনি কখনও।

 

ছেলেও পাগল হয়ে গেছে বিয়ের জন্য। সে নিজেই একদিন আমাকে বললো, চার কোটি টাকা আমার ব্যাংকে, চারতলা একটা বাড়ি আমার নিজের, তবু একটা বউ পাবো না, এটা একটা কথা হলো আন্টি? বললাম, তাই তো। এমন তো হবার কথা নয়।

 

সেই কোটিপতির কোটিপতি ছেলে পার্টিতে গিয়ে পান করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। বাবা তাকে জড়িয়ে ধরে কোনো মতে গাড়িতে তুলে বাড়ি চলে গেলেন। আমার কষ্ট লাগলো দেখে। মানুষ তো বোঝেনা, টাকার গাছে সব সময় ভালো ফল ধরে না। ধান্দাবাজির টাকায় কতো জনের হায় নিঃশ্বাস থাকে। কতো মানুষের অশ্রু, বেদনা, হাহাকার, অভিশাপ থাকে। সেগুলো পরিবার পরিজন এবং সম্পদের ওপর ঘুরতে থাকে কালো ছায়া ফেলে। অনেকে বিশ্বাস করে, অনেকে করে না। আমি করি। তাই তো ধান্দাবাজির পথ মাড়াতে পারিনি কোনোদিন।

 

ওরকম বমি ছমি করার ঘটনা এখানে কি ঘটে? জানি না। তবে ঠান্ডার দেশে একটু পানাহারের প্রয়োজন হয়। বাইরে, মানে পানশালায় কি হয় জানি না, বাড়িতে পার্টি থাকলে অত্যন্ত সৌজন্যের সাথে পান করে সবাই। মেয়েরা আরো সংযত। বাঙালি মেয়েরাও গ্লাস তুলে নেয় আলতো হাতে। কথাই আছে, যস্মিন দেশে যদাচার।

এলগিন এলো ঘরে, মা তোমার কিছু লাগবে? 

– এখনও না মা।

– তোমার প্লেটে তো কিছুই নেই। খাবার ঘরে চলো না। ওরা সবাই বাগানের তাঁবুতে গেছে।

– ঠিক আছে আসছি। আমি এবার একটু বিরিয়ানি নেবো।

– জানো মা, তোমার বানানো প্যাটিস, মিট বল আর সাজানো সেদ্ধ ডিমের আইটেমের কিছুই নেই।

– তাই? খুব খুশি হলাম।

– তুমি না থাকলে পার্টিতে এতো ভ্যারাইটির ফিঙ্গার ফুড কিছুতেই দেয়া যেতো না।

আমি হাসি। খুশি হই। বলি, খেতে কেমন হয়েছিলো সব?

– ওয়ন্ডারফুল। প্যাটিসের তো তুলনাই হয় না। আর তোমার বানানো মিট বল, সেটা তো আর বলতে হবে না।

– হয়েছে হয়েছে মা, তুমি খেয়েছো কি না?

– খাবো না মানে? আর ডিমের ডেকোরেশনটাও এক্সেলেন্ট হয়েছিলো। ওটাই তো শেষ হলো সবচেয়ে প্রথমে। আশিটা পিস কে যে কেমন করে নিলো, দেখাই গেলো না। তুমি নিয়েছো তো মা?

– নারে পাগল, আমি সকালেই একটা ডিম খেয়েছি না?

– আছে শুধু কয়েকটা প্যাটিস। এখনও ডেসার্ট ওদের জন্য সারপ্রাইজ। সত্যি মা। একা হাতে এতো কাজ করলে কেমন করে? 

– তোমার গাজরের সুপটা খুব খুব ভলো হয়েছে মা, আমি দুবার নিয়েছি।

– তাই? এলগিনের মুখ আনন্দের হাসিতে ভরে গেলো।

– সবাই সুপের প্রশংসা করেছে। তাছাড়া দেখলেনা, প্রায় এক ড্রাম সুপ এখন তলায় পড়ে আছে।

– আমি যাই মা, তুমি গিয়ে বিরিয়ানি নিয়ে এসো।

 

শেফ ডিশে বিরিয়ানি রাখা আছে। নিচে ল্যাম্প জ্বলছে। চমৎকার খোশবু বের হচ্ছে। রান্না করেছে আমার ছেলে রংকু। খুব ভালো বিরিয়ানি রান্না করে ও। আমি হামবুর্গে থাকলে ওর এসিস্টেন্ট হয়ে যাই। মা ছেলে দুজনে রান্না করাটা কি যে মজার! ঢাকার পাকা বাবুর্চিদের মতো ভাব ভঙ্গি দেখিয়ে রান্না করে। আর ও তো মশলার রাজা। কি মশলা নেই ওর কাছে? যৈত্রি জায়ফল, শাহজিরে জাফরান, গোলাপ জল, কেওড়া জল, বাদাম পেশতা কিসমিস, গরম মশলা, বাংলাদেশের ঘি, নারকেলের দুধ, সব জোগানোই থাকে। আখনির পানি করলাম। বেরেশতা করে রেখেছিলাম আগের দিন। ধনে পাতা, পুদিনা পাতা মিহি করে কেটে দিলাম। একটা পিরিচে রাখলাম কাঁচা মরিচ। আমার ছেলে যেদিকেই তাকায়, সব হাতের কাছে দেখে। সেও খুশি।

 

বিরিয়ানি নিয়ে আবার আমার ঘরে এসে দেখি, দুটো বাচ্চা, পুতুল ভালুক নিয়ে বসে বসে গল্প করছে হিটারের কাছে। অতিথিদের কারো বাচ্চা হবে এরা।

 

ওদের গল্প শুনে আমি অবাক। একটা বাচ্চা বলছে, বাসায় লোকজন দাওয়াত করলেই নাকি পার্টি হয় না। যেমন ইন্দ্রাদের বাসায় আজ পার্টি আছে।  

-গত সপ্তায় আমাদের বাসায়ও পার্টি ছিলো, লালচে চুলের বেবিটা বলে।

– না, তোমরা দাওয়াত দিয়েছিলে সবাইকে। আমরাও তো গেলাম।

– মানেটা কি হলো? লালচে চুল ঝাঁকিয়ে ও প্রশ্ন করে।

– পার্টি আর দাওয়াতের মধ্যে পার্থক্য আছে পারিসা, মা বলেছেন।

– জীবনে এই প্রথম শুনলাম কিটি।

– দাওয়াত হলো শুধু খাওয়া দাওয়া। বড়োদের মতো করে বলে কিটি।

– আর পার্টি মানে? খাওয়া দাওয়া থাকবে না? পারিসা তাকায় কিটির দিকে।

– দূর, তা কেনো হবে? পার্টিতে ওয়াইন থাকতেই হয়। দাওয়াতে থাকে না।

– তো সেটাও তো খাওয়াই, তাই না?

– ও তুই বুঝবি না।

– কেনো বুঝবো না?

– তোদের আসল দেশ তো ইশ্বরগঞ্জে। ইউরোপের পার্টি কেমন, তা জানবি কি করে? এসেছিস কেবল, আস্তে আস্তে বুঝবি।

– ইশ্বরগঞ্জ এখন জেলা। পারিসাও কম যায় না। সে বলে,আমাদের ওখানে কতো বড়ো বড়ো অনুষ্ঠান হয়, কতো লোকে একসঙ্গে খায় দায়, জানিস? তুই তো ওসব দেখিস নি। ওয়াইন না থাকলে কি হবে? আমরা তো আজকাল বড়ো দাওয়াতকে পার্টিই বলি।

– হি হি হি তোর সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। মন খারাপ করে পারিসা উঠে গেলো।

আমি অবাক হলাম ওদের বুদ্ধি দেখে। আমিই তো জানতাম না যে, দাওয়াত আর পার্টির মধ্যে বড়ো একটা পার্থক্য আছে, আর সেটা ওইটুকু মেয়ে কিটিও জানে। কথাটা কি সত্যি? এই জন্য এলগিন কোনো পার্টিতে নেয় না ইন্দ্রাকে। বলে, বড়ো হোক, এদেশের কালচার তো জানবেই। একার সংসার। মেয়েকে ফেলে পার্টিতে যেতে পারে না। আমি থাকলে ইন্দ্রা আমার কাছে থাকে।

 

একটু পরে এলগিন তার এক বন্ধুকে নিয়ে আমার ঘরে এলো। আমাকে দেখারই তার ইচ্ছে। বাংলাদেশের মেয়ে, শাড়ি পরি বারোমাস। কয়েকটা ভাষায় কথা বলি, খালেদ হুসাইনির বই পড়তে ভালোবাসি। নিজে গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ লিখি। ভাষা বিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি করেছি, উচ্চারণ বানান নিয়ে গবেষণা করি। তার ওপর কম্পিউটার ব্যবহার করি, ফেস বুকে সারফিং করি। অথচ বয়স আটাত্তর। বুঝতে পারি, এই সবই তাকে কৌতুহলী করেছে। নইলে তৃতীয় বিশ্বের এক বয়সি মহিলাকে দেখার কি আছে?

 

জিন্স পরনে। হাত কাটা টপস। গভীর গলার জন্য শরীর দেখা যায়। কড়া মেক আপ। যত্নের সঙ্গে চুল আউলা করে রাখা। লাল টুকটুকে ঠোঁটে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে বললো, হ্যালো, ইশ বিন মারিয়া। গুটেন আবেন্দ।

– গুটেন আবেন্দ মারিয়া। ইশ বিন মামা।

– হাবেন জি কাইনে নামে?( তোমার কোনও নাম নেই)

– তোখ? ইশ বিন বেগম জাহান আরা।

– মাইন গট! জো গ্রোসএ নামে (ও আল্লাহ, এত্ত বড়ো নাম)?

– বেসার, মামা, ইয়া? ক্লাইনে নামে ইস্ত ইমা গুট (ছোটো নাম সব সময় ভালো)।

দুজনেই হাসলাম। গল্প করলো, ওর নিজেরই ব্যবসা আছে। ওর বয়ফ্রেন্ডের সাথেই ব্যবসা করে। এই বছর রিয়াল স্টেটের ব্যবসা শুরু করবে।

হঠাৎই প্রশ্ন করলো, ফেস বুকে তোমার কতোজন বন্ধু আছে? বিদেশি কেউ নেই?

– খুব বেশি বন্ধু নেই। সবাই প্রায় আত্মীয় নাহয় স্টুডেন্ট। তবে বিদেশি বন্ধুও আছে কয়েকজন।

– রোজ বসো ফেস বুকে?

– রোজ। তবে আজ বসবো না। আমি হাসি। মারিয়া বললো, হাসছো কেনো?

– তোমার এরিয়া অব ইন্টারেস্ট দেখে।

– তুমি একটা গ্রেট লেডি ডিয়ার।

– কেনো? কেনো একথা বলছো?

– জীবনটা ধরে রেখেছো। সিক্রেট কি?

হেসে বলি, কাজের মধ্যে থাকা। কোনো অসৎ চিন্তা না করা।

– কাজ তো আমরাও করি। তুমি তো এখন ছুটোছুটি করো না।

– বলো করতে পারি না। বসে বসে লেখালেখি করি।

– বোর লাগে না?

– লেখার সময় একরকম ডিভিনিটি অনুভব করি। সেই আনন্দ সৃজনশীল মানুষ ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না। বোর লাগার প্রশ্নই ওঠে না।

– হ্যাটস অফ মামা। তুমি ভালো থাকো। ভালো লাগলো তোমার সাথে কথা বলে।

– আমারও। ভালো থাকো তুমিও। এবার মন দিয়ে খাও।

 

বেশ রাত হলো পার্টি শেষ হতে। আমি শুয়ে পড়লাম। একবার ভেবেছিলাম, নতুন বিদেশি বন্ধুর সাথে একবার হ্যালো করি। কিন্তু সেটা তো হবে না। আমাকে অনলাইনে দেখলেই টুং টাং করে চ্যাটে আসতে চাইবে অন্যেরা। কেউ বা স্কাইপে-তে কল দিয়েই বসবে। সবসময় স্কাইপে কথা বলতে ভালোও লাগে না। সবাই গল্প করতে চায়। শেষে বলে কয়ে কথা ছাড়তে হয়।

বেগম জাহান আরা
বেগম জাহান আরা