জীবনের মোহনায় বাউল বাতাস ৬ / বেগম জাহান আরা

ড. বেগম জাহান আরা

ছয়

আমার মতে, ভালো কাজ করে কতোবার যে এই ধরনের পুরস্কার পেয়েছি, তার সবগুলো মনেও রাখি নি। আর একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। পরিচালক হিসেবে অর্থ মন্ত্রণাল- এ গেলাম। আসলে সেটা ছিলো ইন্টার মিনিস্টেরিয়াল মিটিং। অর্থ তো সব কিছুর সাথে জড়িত। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রী বলেছেন, বসে থেকে শিশু একাডেমির বাজেট বাড়িয়ে নিয়ে আসতে হবে। যখন আমাকে মিটিং-এ বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে হবে, ঠিক তার আগে ডাক পড়লো আমার মন্ত্রীর ঘরে। যদি যাই, তাহলে আমাকে প্রদেয় কাজটা হবে না। আমাকে যে বলা হয়েছিলো, একাডেমির জন্য অর্থ বরাদ্দ দ্বিগুণ করতে চেষ্টা করবেন। দূতকে তাই জানালাম, আপাকে গিয়ে বলেন, আমি দশ মিনিট পরে আসছি। অর্থ বরাদ্দের শুভ সিদ্ধান্তের কথা জানার পর, আমি প্রায় ছুটে গেলাম মন্ত্রী আপার ঘরে।

 

উনি রেগে আছেন। ডাকামাত্র আমি আসিনি। বলতেই পারলাম না যে, আমি তাঁর আদেশই পালন করছিলাম। কথা না বলে উনি উঠে চলে গেলেন বাড়িতে। তখন বেলা আড়াইটা। ওঁর পিএস জানালো, আপনার জাপান যাওয়া হলো না। আপা আপনার দেরি দেখে অন্য একজনকে নমিনেট করে গেলেন। তখনই তাঁর বাড়ি গিয়ে হাতে পায়ে ধরলে হয়তো জাপান যেতে পারতাম। তাহলে সামান্য লাভের জন্য গোপনে গোবরে মুখ ঘঁষে কিছু পাওয়ার গ্লানি কি ভুলতে পারতাম কখনো? বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতাশ বছরের ঋজু শানিত কেরিয়ার সেটা নিতে পারতো না। যাক সব কাজ কি আর সবাই করতে পারে? শিশুদের নিয়ে জাপানে গেলেন একজন ব্যাবসায়ী। বঞ্চনাই পুরস্কার হলো আমার। এখনো ভাবি, শিশু একাডেমির জন্য অর্থ বরাদ্দ না বাড়লে কি হতো আমার? কিছুই হতো না। তবে সফলভাবে দায়িত্ব পালনের আনন্দটা পেতাম না।

 

শিশু একাডেমিতে দায়িত্ব পালনের সময় অনেক জেলা একাডেমি সফর করেছি। বেশ গরিব হালেই চলতো জেলার কাজ কর্ম। ছক কেটে সফরে বের হতাম। পর পর পরিদর্শন করে আসতাম বৃহত্তর জেলার মধ্যেকার সব কয়টা নতুন জেলা । এক একবার পাঁচ ছয় দিন লেগে যেতো। প্রতি জেলাতেই জেলা প্রশাসক এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে মিটিং করেছি। জেলা শিশু একাডেমির সব কাজে তাঁদের সহৃদয় সহযোগিতার আবেদন রাখতাম। প্রতি জেলার শিশু কর্মকর্তারা তাদের অধীনে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বাচ্চাদের নাচ গান আবৃত্তির অনুষ্ঠান দেখাতো। রাজধানীর তুলনায় কতোটুকু আর সুযোগ সুবিধে ওরা পায়? তবু চমৎকার অনুষ্ঠান পরিবেশন করতো। মুগ্ধ হয়ে যেতাম শিশুদের সম্ভাবনা দেখে। কিন্তু অদের জন্য কোনও দিকনির্দেশনা তো নেই সরকারের তরফ থেকে। 

 

সফরকালীন খাওয়া দাওয়ার কথা না বললে অন্যায় হবে। কর্মকর্তাদের বউরা নিজে রান্না করে অশেষ ভালোবাসায় আদর যত্নে খাইয়েছে। সব জেলাতেই এক অবস্থা। কোথাও বা ছাত্রি পেয়ে গেছি। সেখানকার আদর যত্নের কথা বলার ভাষা নেই। এসব প্রাপ্তি কি ফেলনা? কখনও না। মনে রেখেছি আমি।

এমন জেলাতেও গেছি যেখানে শিশু একাডেমির জন্মের পরে কেউ কখনো যায়নি পরিদর্শনে। যারপর নাই সন্তুষ্ট হয়েছে তারা। আমি তো দলেবলে ঘুরতাম না। একা আমি আর আমার ড্রাইভার (আমি বলতাম পাইলট) ইমরান। রাতে কখনো সার্কিট হাউস বা জেলা কর্মকর্তার বাড়িতেই থাকতাম। দু একটা জেলায় হতাশাব্যাঞ্জক চিত্র দেখেছি। অফিস হা হা করে খোলা। দারোয়ান আর একজন অফিস সহকারি বসে আছে। কর্মকর্তা কোথায় গেছে তা বলতে পারে নি।

 

বেশি কাছাকাছি জেলা হলে অন্য জেলার কর্মকর্তাও কখনো আমার সঙ্গে গাড়িতে চলে আসতো পরের জেলা পরিদর্শনের সময়। একটা বিষয় লক্ষ করলাম, দুই একজন ছাড়া কেউ ঢাকায় আসতে চায় না। জেলা ছোটো জায়গা। সেখানে তারা রাজার মতো থাকে। ডি সি-দের সাথে ওঠাবসা করে। স্থানীয় গণ্যমান্য লোক তাদের চেনে, সম্মান করে। থাকা খাওয়ার সাশ্রয় আছে। সবচেয়ে বড়ো কথা, কর্মকর্তারা নিজের জেলাতেই এবং কখনো নিজের বাড়িতেই থাকতে পারে, সেটাও বিষয়। এরাই তো উঠতি মধ্যবিত্ত  সমাজের মানুষ। ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া শেখাচ্ছে সামান্য আয়ের টাকা থেকে। ব্যতিক্রম তো ছিলোই।

 

ঢাকাতে প্রায় অনুষ্ঠান থাকতো একাডেমিতে। কখনো নিজেদের, কখনো অন্যদের। একাডেমির একটা ভালো হল ছিলো। সেটা ভাড়া দেয়া হতো। রাজ্যের অনুষ্ঠান হতো প্রায় প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত নয়টা দশটা পর্যন্ত। একাডেমির নিজস্ব ফটোগ্রাফার ছিলো। সে তার ধান্দা বের করে নিয়েছিলো। ছবি তো তাকে তুলতেই হতো। যথাযথ মানুষের কাছে তা বিক্রিও করতো। আমার কাছে নালিশ এলো। কারণ, এটা বেআইনি। ওকে ডেকে কথা বললাম। হিসেব করে দেখলাম, ওর যা বেতন, তাতে সংসার চলা অসম্ভব। কি আর বিচার করবো? যে মরেই আছে, তাকে মারবো কোথায়? ছাড় দিলাম। তারপর থেকে ও আমার অজস্র ছবি তুলে দিয়েছে। কারণ একাডেমির অনুষ্ঠানগুলোতে  আমাকেই সাধারণত সভাপতিত্ব করতে হতো। রেকর্ড রাখার জন্যই তুলতে হতো ছবি। সেখান থেকে আমাকে ছবি দিতো। না করলেও শুনতো না। 

 

এতো যে কাজ করতাম আর করাতাম তবু কেউ অসন্তুষ্ট হতো না। এটা আমার ভালো লাগতো। জান্নাত ইকবাল আর আতাউর ছিলো আমার ছায়ার মতো। ডাকলেই পাবো। আমার পি এস রফিকও থাকতো। যতক্ষণ না আমি বাড়ি যেতাম, ততোক্ষণ ওরাও যেতো না। সন্ধে হয়ে গেলে কিছু চা নাশতার ব্যবস্থা করতাম। যারা থাকতো, তারা সবাই চা সিঙাড়া খেয়ে খুশি হতো। বিশেষ করে জাতীয় পুরস্কার প্রতিযোগিতার  সময় কাজের অন্ত থাকতোনা। একাডেমির অফিস এলাকায় তখন লোক গিজ গিজ করতো। বাচ্চাদের বাবা মায়েরা আসতো খাবার দাবার নিয়ে। সারাদিন বাথরুম ব্যবহার হচ্ছে। দিনে চার পাঁচবার ফিনাইল দিয়ে সেগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে কিনা, সেদিকে নজর রাখতে হতো। খাবার দাবারের ঠোঙা কাগজের টুকরো একটু পর পর তুলে ফেলতে হতো। বাচ্চাদের শরীর খারাপ হলে ডাক্তার ডাকতে হতো। যেনো বাচ্চা হতো কাজের।

 

%d bloggers like this: