জল মাখা জীবন ৬/ আফরোজা পারভীন
ছয়
রহমতকে সাথে নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম সার্ভে করে চলেছে রফিক। প্রতিগ্রামে একরাত করে থাকার কথা। কিন্তু সব গ্রামে থাকা হয় না। অনেক গ্রামেই সম্পন্ন বাড়ি নেই। কোথাও থাকার প্রস্তাব করতে হলে সেখানে অন্তত একটা বৈঠকঘর থাকা দরকার। কিন্তু এমনও দেখা যায়, পর পর দুতিন গ্রামে একটাও বৈঠকঘরওয়ালা গৃহস্থ বাড়ি পাওয়া যায় না। ফলে ঘুরে ফিরে এক গ্রামেই বারবার থাকতে হয়। রফিক হিসাব করে দেখেছে, হাসনহাটির স্কুল ঘরটাতেই সে থাকছে বেশি । যদিও সে দিনে দূর দূরান্তের গ্রামে গিয়ে কাজ করছে। তার কাজের বিষয় “কজেস অব ল্যান্ডলেসনেস।” কাজের মধ্য দিয়ে রফিক বুঝতে পেরেছে, ল্যান্ডলেসনেসের একটা অন্যতম কারণ মামলা। একবার যদি হাওড় এলাকার কাউকে মামলায় ফেলা যায় তাহলে দারোগা পুলিশের পোয়াবারো । আঁখের রস ছিবড়ে নেয়ার মতো একটু একটু করে শুষে নেয় সে রস। সর্বস্ব গ্রাস করে থানা আর পুলিশ। ফলে প্রান্তিক চাষি হয়ে পড়ে ভূমিহীন। এমনিতেও এ এলাকার লোক অলস। বউ পিটানোই তাদের বিলাসিতা। আর বিলাসিতা জুয়াখেলা । অলসতা সীমাহীন। বাড়ি, ঘরের পাশে যে জমিটুকু পতিত পড়ে থাকে সেখানে কিছু শাক সবজি চাষ করা বা সামান্য যা জমি জমা আছে তাতে নিয়মিত খেটে খুটে আবাদ করার মানসিকতা তাদের নেই। রফিক দেখে আর ভাবে, যদিও এ এলাকার জমি একফসলী তবু যদি কৃষকেরা জমির দিকে, চাষাবাদের দিকে নজর দিতো, কিছু না কিছু ফসল তাদের আসতই । তা নয় তারা নির্ভর করে আছে মাছের উপর । আর যখন মাছের আকাল পড়ে তখর রমজান মায়মালদের মতো মহাজনের উপর।
সেদিন পাশের গ্রাম থেকে ফিরছিল রফিক । সাথে ছিল রহমত । এসব বিষয় নিয়ে গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন রফিক। হঠাৎ রহমত হাসতে শুরু করল আর বলল, ল্যাম ল্যাম। রহমতের হাসি আর থামে না। রফিক অবাক হয়ে বলল,
:কি ব্যাপার হাসছ কেন । সেদিনও দেখলাম লোকটাকে দেখে তুমি হাসছ । লোকটা কে?
রহমত কিছুই বলল না। চাপাচাপি করাতে বলল :সে কথা বলা যাবে না । আপনি মাস্টার সাহেব বা দারোগা বাবুর কাছে জেনে নেবেন।
সে রাতে মাস্টার সাহেবের কাছে রহমত শুনল ল্যাম বৃত্তান্ত। মাস্টার সাহেবও বললেন খুবই সঙ্কোচের সাথে। জানা গেল ল্যাম মানে নপুসংক। ল্যামের আসল নাম চাপা পড়ে গেছে “ল্যাম” নামের আড়াালে। সে নাইডগার্ডের কাজ করে। তবে লোকের ধারণা ওটা ওছিলা । সে আসলে রাতে তার বৌ এর সঙ্গ এড়াবার জন্যই পাশের গ্রামে নাইডগার্ডের কাজ করে। ল্যাম থাকে পাশের গ্রামে তার মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে । ল্যামের বিয়াইন মারা গেছে। ল্যামের শ্বশুরই নাকি এই নাইড গার্ডের চাকুরিটা যোগাড় করে দিয়েছে। লোকে বলে বিয়াই এর সাথে ল্যামের বৌ এর অবৈধ সম্পর্ক । এ সম্পর্ক নাকি মেয়ে জামাই সবাই জানে এবং সবাই সম্পর্কটা মেনে নিয়েছে । এ ঘটনা গ্রামে রটনা হওয়াতে সবাই ল্যামকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। তাকে উত্যক্ত করে । দিন কয়েক আগে নাকি রেগে গিয়ে ল্যাম এলাকার কয়েকজন ছেলের বিরুদ্ধে নালিশ করেছিল। পুলিশ সাথে সাথে ওই ছেলেগুলোকে এ্যারেস্ট করে। দিন সাতেক জেলের ভাত খেয়ে দারোগা পুলিশকে মোটা টাকা দিয়ে তবে তারা ছাড়া পেয়েছে। এতে ভীষণ ক্ষেপে গেছে ছেলেগুলো । তারা শাসিয়ে বলেছে, ল্যামকে খুন করবে।
মাস্টার সাহেবের সাথে এসব কথা হওয়ার দিন দুয়েক পর রফিক জানতে পেল, ল্যাম খুন হয়েছে । হাওড়ের ধারে পড়ে আছে তার মৃতদেহ। রফিক রহমতকে বলল,
:যেখানে মৃতদেহ আছে সেখানে আমাকে নিয়ে চলো।
যেতে যেতে মানব জীবনের অনিত্যতার কথা ভাবল রফিক। মাত্র দুদিন আগে লোকটা জীবিত ছিল , তাকে দেখেছে , সে উত্তেজিত হয়েছে। এখন সমস্ত উত্তেজনা সমস্ত ইমোশনেরই সমাপ্তি। কিছুদূর যাবার পর উল্টো দিক থেকে আসা এক লোক রফিককে দেখে দাঁড়ায় । এতাদিনে এলাকার প্রায় সব লোকই রফিককে চেনে। লোকটা বলে,
:কি আশ্চর্য ল্যামের মৃতদেহ দেখতে গিয়ে দেখি নেই। শুনলাম দেহ ভেসে ওঠার একটু পরেই তা উধাও হয়ে যায় ।
রফিক বুঝতে পারে মৃতদেহ উধাও হয়নি, উধাও করা হয়েছে । কে করতে পারে এ কাজ । নিশ্চয়ই এমন কেউ করেছে যার খুনের ব্যাপারে স্বার্থ আছে। কে সে, কে? রফিক বলে , রহমত চলো আমি ল্যামের জামাই বাড়িতে যাবো ।
ল্যামের জামাই বাড়িতে এসেছে রফিক। এ বাড়ির একজন মানুষ যে খুন হয়েছে বাড়ির পরিবেশ দেখে তা বোঝার উপায় নেই । ক্রন্দনের শব্দ নেই , হাহুতাশ নেই । ল্যামের বৌ মেয়ে কোথায়? কেন তাদের চোখে জল নেই, কন্ঠে আর্তি নেই! বরং সব কিছু যেন বড় বেশি চুপচাপ! কি যেন লুকাবার চেষ্টা, নাকি সবই রফিকের মনের ভুল।
বড়ই সমাদরের সাথে রফিককে বসায় ল্যামের বিয়াই। হাত মুখ ধোয়ার পানি আর খাবার দাবার আসে ।
রফিক বলে,
:আমি এখানে খেতে আসিনি। এ বাড়ির একটা মানুষ খুন হয়েছে । আমি সে খুনের ব্যাপারে কথা বলতে এসছি।
ল্যামের বিয়াই বলে ,
:স্যার দারোগা সাহেব আপনাকে স্যার বলে আমি জানি। আপনি দারোগারও বাবা । বলেন কতো টাকা চান?
:মানে! কি বলছেন বুঝতে পারছি না ?
:আমাকে যদি বলতে না চান জামাইকে পাঠিয়ে দিচ্ছি তাকেই বলেন।
জামাই আসে । একই কথা বলে ,
: স্যার আপনি কতো চান?
রফিক শক্ত হয়ে যায় । বলে,
: স্ত্রী পুত্র পুরুষ রমণী সবাইকে ডাকেন। আমি সবার সাথে কথা বলতে চাই।
রফিকের সামনে নতমুখে বসে আছে ল্যামের স্ত্রী কন্যা জামাই আর বেয়াই । রফিক বলল ,
:আমি স্পষ্ট ভাষায় আপাদের কয়েকটা কথা বলতে এসেছি। আমি এখানে টাকার জন্য আসিনি। এসেছি এলাকার লোকের মঙ্গলের জন্য। ল্যাম হত্যা রহস্য আমার কাছে পরিষ্কার। এখন আমি আপনাদের কাছে শুনতে চাই। খুনের দায়ে যে ছেলেগুলোকে ধরা হয়েছে তারা নির্দোষ। আমার ধারণা আপনারা ওদের শাসানির সুযোগ নিয়ে ওদের উপর দোষ চাপিয়ে নিজেদের কাজ গুছিয়ে নিয়েছেন।
কেউ কোন কথা বলে না ।
:কি ব্যাপার আপনারা কথা বলছেন না কেন? ঠিক আছে আপনারা কথা না বললে আমিই বলছি । ল্যামকে আপনারা খুন করেছেন। ল্যামের স্ত্রী আর বিয়াই এর দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করে রফিক । হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে স্ত্রী । বিয়াই বলে ,
:বিশ্বাস করেন আমরা না । খুন করেছে ওই ছেলেগুলো যারা খুনের হুমকি দিয়েছিল। আমরা বরং ল্যামকে সুস্থ করার চেষ্টা করেছিলাম।
:কেন ল্যাম কি অসুস্থ ছিল ?
: ওর পেটে ব্যথা ছিল । আমরা দুজন মাঝি দিয়ে ওকে নৌকায় করে পাঠিয়েছিলাম । ওরা তাকে নামিয়ে দিয়ে এসেছিল হাওড়ের মুখে । সেখান থেকে ও হেঁটে চলে গিয়েছিল ডাক্তার বাড়ির দিকে ।
মাঝি দুজনতে ডাকা হল । এক মাঝি বলল, ল্যামকে নামনো হয়েছে হাওড়ের পূর্ব পাড়ে । অন্যজন বলল, পশ্চিম পাড়ে।
রফিক বলল,
:এক মানুষকে দুই জায়গায় নামায় কি করে? তার মানে আপনারাই তাকে মেরছেন। যদি ভাল চান তো বলে ফেলেন।
হুড়মুড় করে বলতে শুরু করে বিয়াই।
:স্যার আর যাই করেন আমাদের পুলিশে দেবেন না । আমি আর বিয়াইন মিলেই ওকে মেরেছি । বিয়াইন নিজ হাতে বিষ খাইয়েছিলো আর আমি তাকে নৌকা করে পাথারিয়ার হাওড়ে ফেলে আসি । সে তখন বিষের মন্ত্রণালয় মরো মরো । ফেলেছিলাম হাওড়ে। ভেবেছিলাম হাওড়ের বড় বড় বড় ইঁদুর খেয়ে ফেলবে । কিন্তু লাশ ভেসে উঠবে তা ভাবিনি।
:তারপর লাশ ভেসে উঠার পর আবার লাশ গুম করলেন?
:তাই করলাম স্যার। কারণ লাশ কাটাকটি হলে বিষ দিয়ে মারার কথাটা জানাজানি হয়ে যাবে।
রফিক অবাক হয়ে ল্যামের মেয়ের দিকে তাকালো
:আপনি জানতেন এ ঘটনা? আপনি জেনে শুনে এমন ঘটনা ঘটতে দিলেন?
মেয়ে ধীরে ধীরে বলল ,
:আমি স্বামীর ঘর করি। আমার স্বামী শ্বশুর সবাই চাচ্ছিল আব্বা মারা যাক । তাই আমার কিছুই করার ছিল না। আসলে আব্বা এ সংসারে বাড়তি লোক হয়ে উঠেছিল।
এতাক্ষণে মেয়ের চোখে পানি দেখা গেল। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল সে।
রফিক উঠল । ল্যামের স্ত্রী চেপে ধরল তার পা , ল্যামের বিয়াই আর জামাই দুই হাত ।
:স্যার আমাদের বিরুদ্ধে কিছু করবেন না। যতো টাকা লাগে দেব।
:টাকা দিয়ে সব সময় সব কিছু করা যায় না। মাঝে মাঝে টাকার কোন ক্ষমতাই থাকে না। আপনাদের বিরুদ্ধে এ্যাকশান আমাকে নিতেই হবে । আপনারা একজন নিরাপরাধ লোককে খুন করেছেন। তাছাড়া নির্দোষ কতোগুলো ছেলে অহেতুক আটকা পড়ে আছে হাজতে।
রফিক হাঁটতে শুরু করে। নির্দোষ ছেলেগুলোকে বাঁচাতে হবে।
হাঁটতে হাঁটতে তার বার বার মনে পড়ে ল্যামের মেয়ের কথা। মেয়ে বলেছে ল্যাম সংসারের সবার কাছে বাড়তি হয়ে গিয়েছিল। বাড়তি মানে সারপ্লাস। রফিক নিজেও কি সারপ্লাস হয়ে গেছে নিশির জীবনে। নিশির কথা মনে হতেই ভিজে ওঠে রফিকের শুকনো চোখ।
Facebook Comments Sync