কবি দৃষ্টি কবিতায়/ প্রণব মজুমদার
কবি দৃষ্টি কবিতায়/ প্রণব মজুমদার
কবিতা নিয়ে কত কথা। সমালোচনাও আছে ঢের। কবিতা নির্মাণ নিয়ে প্রশ্ন। রচিত কবিতা নিয়ে বিতর্কও থাকে। কোনটা কবিতা, কোনটা নয় এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে মত থাকে। বিষয়টি নিয়ে কখনো উত্তরও মেলে না। সংশয় থেকেই যায়।
সাহিত্যের প্রাচীনতম শাখা হচ্ছে কবিতা। কবিতার জনপ্রিয় হবার পিছনে অনেক কারণ বিদ্যমান। কাঠামোর অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র আকার, ছন্দ, শব্দসজ্জা এবং সুরেলা বাক্য গতি। দীর্ঘ ৪৩ বছরের সাহিত্য অনুশীলনের পরিভ্রমণে কবিতার শাখাকে আমার মনে হয়েছে বেশ কঠিনতম মাধ্যম। অল্প কথার বিশাল ক্ষেত্র বা বিষয়! প্রকাণ্ড ভাব ও দর্শন। ভাবনা ও লেখায় এখনও কবিতাকে বুঝে ওঠতে পারি না। ক্ষুদ্র জ্ঞানে বলি, আমার কাছে আলাদা করে ভাবা মানেই কবিতা। এ ভাবনার মধ্যে বোধের চমৎকারিত্ব থাকে। পদাবলির শরীরে সন্নিবেশিত শব্দমালা আমাকে ঘোরের মধ্যে রাখে। দর্শনের পথে হাঁটায়। সীমিত বা স্বল্প শব্দাবলির মননের বিশাল ক্যানভাস হচ্ছে কবিতা। শব্দ হচ্ছে ব্রক্ষ্ম ! আরাধনা। আত্মার আনন্দ। মনের গভীরে প্রোথিত আরাধ্য সেই শব্দমালাকে আমি কবিতা ভাবি।
বাংলা কবিতার আদি নিদর্শন চর্যাপদ। ভাষাবিদ ডঃ শহীদুল্লাহর মতে, চর্যাপদের রচনা কাল অষ্টম শতক। প্রজ্ঞাবান প্রাবন্ধিক সুকুমার সেন বলেন দশম থেকে দ্বাদশ। তাই ধরে নেয়া যায়, অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকে চর্যাপদ রচিত। এর আগে কোন বাংলা কবিতার নিদর্শন নেই।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস মূলত বাংলা কবিতা। অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকে কবিতার জন্ম হলেও আধুনিক যুগ থেকেই কবিতা নিয়ে গবেষণা ও সংজ্ঞার বিশ্লেষণ। এ গবেষণা থেকেই কবিতার রীতি তৈরি হয়। সে বিতর্ক এখনও চলছে। কবিতার সংজ্ঞা নিয়ে বিশ্ব কবিদের নানা মত এবং আলাদা আলাদা বাণী কবিতাকে অধিক জনপ্রিয় করে তুলেছে। যা সাহিত্যের অন্য শাখায় দেখা যায় না। কবির দৃষ্টি কবিতায়।
কবিতা প্রসঙ্গে জগৎখ্যাত বিদেশী কবিরা কে কী বলেছেন? ৩৫৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণকারী ইটালীর কবি সেইন্ট অগাষ্টিনের মতে কবিতা হচ্ছে একটি রহস্যময় অজানা কিছু যা আমরা জানি না। কবিতা সম্পর্কে গ্রীক কবি এবং বিশ্বখ্যাত দার্শনিক এরিস্টটল বলেছেন, কবিতা দর্শনের চেয়েও বেশি এবং ইতিহাসের চেয়েও বড়। ইংরেজ কবি পার্সি বিশি শেলী বলেন মানুষের পরিতৃপ্তির বিষয় হলো কবিতা। কবিতা তখনই সার্থক হয় যখন কবি মনের পরিতৃপ্তিতে পূর্ণতা আসে। ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক কবি জন কীটসের দৃষ্টিতে একমাত্র ঝংকারে নয়, কবিতা মুগ্ধ করে তার সূ² অপরিমেয় বিন্যাসে। ইংরেজি সাহিত্যের আরেক নামকরা কবি স্যামুয়েল জনসন। তিনি কবিতাকে শিল্প ভাবতেন। তাঁর মতে কবিতা হচ্ছে ছন্দময় গঠন। এমন একটি শিল্প মাধ্যম যা আনন্দের সঙ্গে সত্যকে প্রকাশ করে। আর সে প্রকাশ করার জন্য কল্পনার প্রয়োজন হয়। ইংরেজ কবি স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজের মতে, সর্বোকৃষ্ট শব্দ সর্বোকৃষ্টভাবে সাজানোকে কবিতা বলে। কবিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে মার্কিন কবি রবার্ট লী ফ্রষ্ট বলেছেন, কবিতা শব্দের অভিনয়। রক্তকে কালিতে রূপান্তরের যন্ত্রণা হচ্ছে কবিতা এমন কথা বলেছেন মার্কিন কবি টি. এস. এলিয়ট। ব্রিটিশ কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডস ওয়ার্থ বলেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন কবিতা হলো সকল জ্ঞানের প্রাণবায়ু এবং পরিশোধিত সঞ্জীবনী। তা সমস্ত প্রজ্ঞার শ্বাস প্রশ্বস আর সূ² আত্মা। মার্কিন সাহিত্য সমালোচক, লেখক, সম্পাদক ও কবি এডগার এরান পয়ি বলেছেন, কবিতা হলো সৌন্দর্য্যরে ছন্দময় সৃষ্টি।
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের শুরু ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। আজও সেই যুগেই আমরা পরিভ্রমণ করছি। কবিতার সংজ্ঞা নিরূপিত করেছেন বাঙালি কবিরা নানাভাবে। তাঁদের বহুমুখী ব্যাখ্যায় কবিতা হয়ে উঠেছে অনন্য সাহিত্য মাধ্যম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের সব রচনা সম্পর্কেই মন্তব্য করেছেন। কি গান, কবিতা, নাটক, গল্প বা উপন্যাস। কবিতার বিষয়ে তাঁর ভাবনা ছিলো বেশ সহজ ও সরাসরি। বিশ্বকবি বলেন, ‘কবিতার ক্ষেত্রে কথার সঙ্গে ভাবের সম্বন্ধ বিচার করি। ভাবই মুখ্য। কবিতার কথা ভাবের আশ্রয়-স্বরূপ। মানুষের মনের আবেগ ও অনুভূতির প্রকাশ হলো কবিতা।’ আধুনিক কবিতার জনপ্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা বিষয়ক ভাবনাটি ছিলো এ রকম, কবির মনে প্রাগকল্পিত হয়ে কবিতার কলঙ্ককে যদি দেহ দিতে চায় কিংবা সেই দেহকে দিতে চায় আভা, তাহলে কবিতা সৃষ্টি হয় না, পদ্য লিখিত হয় মাত্র, ঠিক বলতে গেলে পদ্যের আকারে সিদ্ধান্ত, মতবাদ ও চিন্তার প্রক্রিয়া পাওয়া যায় শুধু। কাজেই চিন্তা ও সিদ্ধান্ত, প্রশ্ন ও মতবাদ প্রকৃত কবিতার ভিতর সুন্দরীর কটাক্ষের পেছনে শিরা, উপশিরা ও রক্তের কণিকার মতো লুকিয়ে থাকে যেন। লুকিয়ে থাকে কিন্তু নিবিষ্ট পাঠক সে সংস্থা অনুভব করে; বুঝতে পারে যে তারা সংগতির ভেতর রয়েছে, অসংস্থিত হয়ে পীড়া দিচ্ছে না। পঞ্চপান্ডবদের আরেক কবি বুদ্ধদেব বসু আরও বলেন, কবিতা জটিল কিছু নয়, বোঝার বিষয়ও নয়। একে অনুভব করতে হয়। দু’ বাংলার শক্তিমান কবি আল মাহমুদ এ সংজ্ঞায় বলেছেন, তুলনার সাদৃশ্য আনতে যে সাহসের প্রয়োজন হয় তাই কবিতা। বাংলার জনপ্রিয় আধুনিক কবি শামসুর রাহমানের মতে, কবিতা আসলে বোধের ব্যাপার। দেশের খ্যাতিমান সব্যসাচী সাহিত্যিক ও কবি সৈয়দ শামসুল হক কবিতার সংজ্ঞায় বলেছেন, সর্বোত্তম ভাবের সর্বোত্তম শব্দের সর্বোত্তম প্রকাশ। বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক এবং কবি হুমায়ুন আজাদের ভাবনা হলো- যা পুরোপুরি বুঝে ওঠে না, বুকে, ওষ্ঠে, হৃৎপিন্ডে, রক্তে ও মেধায় সম্পূর্ণ হয় না এবং রহস্য থেকেই যায় তাই কবিতা। সত্য বিচ্যুতি না ঘটিয়ে জীবনের সব মুহূর্তের স্বাক্ষর লিপিবদ্ধ করার নামই কবিতা। কবিতাকেন্দ্রিক এমন সংজ্ঞা কবি সিকান্দর আবু জাফরের। কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, যে লেখাটি সমকালের স্মৃতি বা ম্বপ্নকে তুলে আনতে সক্ষম এবং একই সঙ্গে সমকালকে অতিক্রমের যোগ্যতা রাখে তাই কবিতা।
কবিতা যারা লিখেন, আমরা তাদের কবি বলি। আবার এটা নিয়েও বিতর্ক আছে। অনেকে বলেন কবিতার মতো অন্ত্যমিলে কিছু লিখলেই সেটা কবিতা হয়ে ওঠে না। সুতরাং প্রত্যেককে কবি বলা যায় না। যারা কবিতা লিখেন, তাদের কাছে প্রশ্ন রাখা হলে কবিতার কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা পাওয়া যায় না। এর কারণ কবিতাকে কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা বা ছকে বেঁধে রাখা যায় না। সে জন্যই আলোচ্য প্রবন্ধে বিদেশী এবং দেশী বিখ্যাত কবিদের নানা মত কবিতাকে শিল্পের অভিধায় যুক্ত করেছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপে কবিতা আমাদের সামনে আসে। কবিতাকে কোনো রীতি ও শৃঙ্খলায় আবদ্ধ করে রাখা যায়নি, যদিও কবিতা লেখার হরেক রকম রীতি আছে। বিভিন্ন আদল ও ছন্দে কবিতার রীতি থাকবে। লেখায় কবি যিনি রীতি জানেন তিনি সে নিয়মকে ভাঙবেন এটাও স্বাভাবিক কাব্য প্রকৃতি। রীতি ভাঙচুর এবং কবির নিমগ্ন দৃষ্টি কবিতাকে শাণিত করবে।
কবিতা নিয়ে কবিদের অনেক মন্তব্য ও সংজ্ঞা। ভাবনার উপাদানগুলো অসীম। বিতর্ক আছে এবং থাকবেই। নানা মতের নানা জন। সেটা সাহিত্যের জনপ্রিয় শাখা কবিতার ক্ষেত্রেও।
Facebook Comments Sync