কবি মোহিতলাল মজুমদার/ কাজী মুজাহিদুর রহমান 

কবি মোহিতলাল মজুমদার/ কাজী মুজাহিদুর রহমান

কবি মোহিতলাল মজুমদার/ কাজী মুজাহিদুর রহমান 

 

ছেলেবেলায় দেখেছি আমাদের বাড়ির বইয়ের তাকে বড় সাইজের একটা কবিতার বই ছিল। কবিতার বই না বলে এটাকে কাব্যগ্রন্থ বলা সঠিক। আমার বড় ভাই ষাটের দশকে যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজে পড়ার সময় সাহিত্য প্রতিযোগিতায় বইটি পুরস্কার হিসাবে পেয়েছিলেন। বইটির নাম ছিল ‘স্মরগরল’ আর কবির নাম ছিল মোহিতলাল মজুমদার। ঐ ছড়া পড়ার বয়সে এই বইয়ের কোন কবিতা পড়ার মত যোগ্যতা আমার ছিল না, অর্থ বুঝাতো অনেক দূরের কথা। শুধু দুই-একবার পাতা উল্টে দেখেছি কবির একটা আবক্ষ ছবি, আর নিচে তাঁর স্বাক্ষর। তবে সেই সময় এই কবি সম্পর্কে জানার খুব একটা সুযোগ ছিল না।  কেননা ভৌগলিক অর্থে তিনি আমাদের দেশের কোন কবি ছিলেন না কিংবা আমাদের স্কুল বা কলেজের বাংলা পাঠ্যবইতে তাঁর কোন কবিতা অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তবে অনেক পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় জেনেছিলাম প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে তিনি অধ্যপনার চাকরি পেয়েছিলেন। তার আগে তিনি ছিলেন ক্যালকাটা হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। অবশ্য কম বেতন পেতেন বলে সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে মেট্রোপলিটন হাই স্কুলের মেইন সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেছিলেন। এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরে ১৯২৮ সালের ঘটনা। এখানে তিনি একটানা ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন। এরকম আর একটা ঘটনা হয়েছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। আবুল ফজল সাহেব ছিলেন হাই স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। তাঁকে পূর্ণ অধ্যাপক পদমর্যাদায় ভিসি হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। 

 

তবে আমার আজকের লেখার বিষয়বস্তু এটা নয়। কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে কবি মোহিতলাল মজুমদারের সম্পর্কের উত্থান ও পতন নিয়ে এই লেখা। কবি নজরুল করাচী সেনানিবাসে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টে থাকা অবস্থয় ডাকযোগে পাঠানো তাঁর কিছু লেখা কলকাতার বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, সাওগাত ও প্রবাসী পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এরপর বৃটিশ সরকার বাঙালি পল্টন ভেঙ্গে দিলে ১৯২০ সালে কবি কলকাতায় ফিরে আসেন। তারপর বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির মাসিক পত্রিকা ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। নজরুল তাতে লেখার জন্য সম্মত হন। তিনি তাঁর উপন্যাস ‘বাঁধন-হারা’ ধারাবাহিকভাবে সেখানে ছাপতে দেন। এর বাইরে প্রতি সংখ্যার জন্য নিয়মিত সেখানে গল্প, গান ও কবিতা লিখতেন। নজরুলের বিখ্যাত কবিতা কোরবানী, মোহররম, খেয়া-পারের তরণী, বাদল প্রাতের শরাব এখানেই প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলি পড়ে কবি মোহিতলাল মজুমদার এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন যে মোসলেম ভারতের সম্পাদককে একটা চিঠি দিয়ে নিজের সে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। সেই চিঠি ঐ পত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছিল। সেখান থেকে একাংশ উল্লেখ করার মত-“যাহা আমাকে সর্বাপেক্ষা বিস্মিত ও আশান্বিত করিয়াছে, তাহা আপনার পত্রিকার সর্ব-শ্রেষ্ঠ কবি হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম সাহেবের কবিতা। বহু দিন কবিতা পড়িয়া এত আনন্দ পাই নাই, এমন প্রসংশার আবেগ অনুভব করি নাই। বাঙলা ভাষা যে এই কবির প্রাণের ভাষা হইতে পারিয়াছে, তাহার প্রতিভা সুন্দরী ও শক্তিশালিনী_এক কথায় সাহিত্য-সৃষ্টির প্রেরণা ও তাঁহার মনোগৃহে সত্যই জন্ম লাভ করিয়াছে, তাহার নিঃসংশয় প্রমাণ তাঁহার ভাব, ভাষা ও ছন্দ। আমি এই অবসরে তাহাকে বাঙ্গলার স্বারস্বত মন্ডপে স্বাগত সম্ভাষণ জানাইতেছি”। (কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা, মুজফফর আহমদ, পৃষ্ঠা ১৫৬-১৫৭) 

 

কিন্তু উভয়ের মধ্যে কোন পূর্ব-পরিচয় ছিলনা এবং বয়সের দিক দিয়ে মোহিতলাল ছিলেন এগারো বছরের বড়। তাঁর মত একজন স্বনামধন্য সাহিত্য সমালোচক যদি নজরুলের লেখার মূল্যায়ন ও প্রশংসা করেন, তাহলে তিনি দ্রুত সাহিত্যিক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করতে পারবেন। তাই বন্ধু ও খুব কাছের সাহিত্যানুরাগীদের তাগিদে নজরুল ইসলাম একদিন তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে যান। তবে প্রথম সাক্ষাতটা নজরুলের জন্য খুব একটা সুখকর ছিল না। ব্রাক্ষ্ম বিদ্বেষী মোহিতলাল নজরুল ইসলামকে সামনে পেয়ে প্রশংসায় ভাসিয়েছিলেন। একই সাথে ওয়াদা করিয়ে নিয়েছিলেন প্রবাসী পত্রিকায় কোন লেখা না দেওয়ার জন্য। তবুও এই সাক্ষাতের পর থেকে দুই জনের সম্পর্ক গাড় হতে শুরু করে। মোহিতলাল মজুমদার নতুন কোন কবিতা লিখলে নজরুলকে শোনাতে আসতেন। আবার নজরুলও তাঁর নতুন কবিতা-গল্প তাঁকে শোনাতেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯২০ সালে একদিন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে পুরাতন মানসী পত্রিকা থেকে মোহিতলাল তাঁর লেখা গদ্য ‘আমি’ পাঠ করে  নজরুলসহ উপস্থিত সকলকে শুনিয়েছিলেন।  কিন্তু উভয়ের মধ্যে এই সম্পর্কের গাড়ত্ব খুব একটা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। নজরুল অচিরেই বুঝতে পারলেন মোহিতলাল তাঁর সাথে অভিভাবকসুলভ আচরণ করছেন। কার সাথে মিশবেন, কোন পত্রিকায় লেখা দেবেন, কোন অনুষ্ঠানে যাবেন ইত্যাদি বিষয়ে উপদেশ-নিষেধের বেড়াজাল স্বাধীনচেতা নজরুল মেনে নেননি। ফলে তাঁর সাথে দূরত্ব তৈরি হয়। মোহিতলালও বিষয়টা আঁচ করতে পেরে আসা-যাওয়া কমিয়ে দেন। তবে দেখা সাক্ষাত যা মাঝে মধ্যে হতো তাতে আন্তরিকতার অভাব ছিল। এরপর নজরুলের জীবনে কুমিল্লা অধ্যায় ঘটে যায়। সেটা অন্য প্রসঙ্গ। ১৯২১ সালে নজরুল ও তাঁর অকৃত্রিম বন্ধু কমরেড মুজাফফর কলকাতার ৩/৪/সি, তালতলা রোডের দোতলা বাড়ির নীচতলার পূর্ব দিকের একটা কক্ষে ভাড়া থাকতেন (বাড়িটি এখনও আছে এবং এখন এটি একটি হেরিটেজ)। ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে কমরেড মুজফফর রাতে ঘুমিয়ে পড়ার পর কোন এক সময় উঠে নজরুল তাঁর বিখ্যাত বিদ্রোহী কবিতাটি লিখেছিলেন। সে সময দুই জনের এক জনেরও ফাউন্টেন পেন ছিলনা। দোয়াতের কালিতে বারবার কলমের নিব চুবিয়ে লিখতে হতো। তাই একমনে লিখে যাওয়ার জন্য নজরুল পেন্সিল দিয়ে কবিতাটি লিখেছিলেন। পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর বন্ধু কমরেড মুজাফফরকে সর্বপ্রথম কবিতাটি শোনান। বিদ্রোহী কবিতাটি প্রথমে বিজলী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ব্যাপক চাহিদার কারণে বিজলী কর্তৃপক্ষকে এক সপ্তাহে দুই বার পত্রিকা ছাপতে হয়েছিল। পরে মোসলেম ভারতসহ অন্যান্য পত্রিকায় বিদ্রোহী কবিতা মুদ্রিত হয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জনপ্রিয়তার কারণে কবির নামের আগে বিদ্রোহী তকমা বসে যায় এবং রাতারাতি তিনি বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কবি হয়ে যান। তাঁর আগে অন্য কোন কবি এই ধরনের উদ্দীপনামূলক কোন কবিতা লেখেননি, তাঁর পরেও লেখেননি। কিন্তু এক জায়গায় গোল বাধে। বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পরে কবি মোহিতলাল মজুমদার প্রচার করতে লাগলেন যে নজরুল তাঁর ‘আমি’ লেখার ভাব নিয়ে বিদ্রোহী কবিতা লিখেছেন, কিন্তু কোন অনুমতি নেননি। অর্থাৎ তিনি ‘আমি’ লেখার ‘ভাব চুরি’ করেছেন। এটা বেশ জোরেশোরেই তাঁর অনুসারীদের দ্বারা প্রচারিত হতে লাগলো। অথচ এক বছরেরও বেশি সময় আগে মাত্র একবার গদ্য আকারে লিখিত ‘আমি’ নজরুল শুনেছিলেন। এই ঘটনায় উভয়ের সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়।

 

বিষয়টা যদি আমরা আমরা নিরপেক্ষ ভাবে বিশ্লেষণ করতে চাই, তাহলে দেখব গদ্য আকারে লিখিত মোহিতলালের লেখাটি কেমন ছিল-

 

আমি বিরাট। আমি ভূধরের ন্যায় উচ্চ, সাগরের ন্যায় গভীর, নভো-নীলিমার ন্যায় সর্ব্বব্যাপী। চন্দ্র আমারই মৌলিশোভা, ছায়াপথ আমার ললাটিকা…..(প্রথম প্যারা) 

 

আমি ক্ষুদ্র। প্রতুষের শিশিরকণা আমার মুক ও মুকুর, সাগর-গর্ভের শুক্তিমুক্তা আমার অভিজ্ঞান…..(দ্বিতীয় প্যারা)

 

আমি সুন্দর। শিশুর মত আমার ওষ্ঠাধর, রমণীর মত আমার কটাক্ষ, পুরুষের মত আমার ললাট, বাল্মীকির মত আমার হৃদয়,…..(তৃতীয় প্যারা)

 

আমি ভীষণ, অমানিশীথের সমুদ্র, শ্মশ্মানের চিতাগ্নি, সৃষ্টি-নেপথ্যের ছিন্ন মস্তা, কালবৈশাখীর বজ্রাগ্নি, হত্যাকারীর স্বপ্নবিভীষিকা,…..(চতুর্থ প্যারা)

 

আমি মধুর_জননীর প্রথম পুত্রমুখচুম্বনের মত, তৃষিত বনভূমির উপর নববরষার পুষ্পকোমল ধারাস্পর্শের মত…..(পঞ্চম প্যারা)।

 

পক্ষান্তরে বিদ্রোহী কবিতার শুরুর কিছু পঙক্তিমালা-

বল বীর_বল উন্নত মম শির! শির নেহারি’ আমারি, নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির! 

 

আমি     চিরদুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, 

আমি    সাইক্লোন, আমি ধ্বংস, আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বী। 

আমি     দুর্বার, আমি ভেঙ্গে করি সব চুরমার। 

 

এখানে এটা পরিষ্কার উভয়েই আমি’র পরে গুন-বাচক বিশেষণ শব্দ ব্যবহার করেছেন। একজন লিখেছেন গদ্যে, অপরজন কবিতায়। লেখক মাত্রই জানেন কবিতার আঙ্গিক কত কঠিন। সেখানে শব্দ, ছন্দ, অন্ত মিল ইত্যাদি নানা কাঠামোর মধ্যে থাকতে হয়। নজরুলের চিন্তার মধ্যে হয়তো ‘আমি’ থাকলেও এই বিষয় নিয়ে তিনি যে কবিতা লেখেন তা ছিল মৌলিক। নজরুলের সৃষ্টিশীলতা নিয়ে কারো কোন সন্দেহের অবকাশ থাকার কথা নয়। তথাপি তাঁকে ভাব চুরির অপবাদ দেওয়া নিতান্তই অপরাধ। এ প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দিতে চাই। নজরুলের ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্যের তীব্র সমালোচক ছিলেন কবি গোলাম মোস্তফা। তিনি পদ্মা নদীর উপর প্রবন্ধ লিখেছিলেন, আর নজরুল লিখেছিলেন পদ্মা নদীর উপর গান। কিন্তু গোলাম মোস্তফা কোন সময়ই নজরুলের বিরুদ্ধে ভাব চুরির অভিযোগ আনেননি। দুই জন যার যার মত করে সৃষ্টি করেছেন। একই কথা ডি এল রায় ও রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাঁরা একই বিষয় নিয়ে কবিতা গান লিখলেও কেউ কারোর বিরুদ্ধে ভাব চুরির অভিযোগ আনেননি।

কাজী মুজাহিদুর রহমান
%d bloggers like this: