করোনাকালের ঈদ/ শারমিনা পারভিন 

লকডাউনে এবারের ঈদ কেমনভাবে কাটাবো ভাবছি। যদিও গত ২০২০ সালে লকডাউনে আমরা  ১টি ঈদুল ফিতর ও ১টি ঈদুল আযহা পার করেছি। 

 

কেমন ছিল আমাদের সে ঈদ দুটি বা কেমনভাবে পার করেছি আমরা আমাদের এই ঈদ দু’টিকে!

 

তার আগে একবার  ফিরে দেখি সেকালের ঈদ আর একালের ঈদ। তখন আমাদের ছেলেবেলা।   সেকালের ঈদের সকালে আমরা গোসল করে নতুন জামা জুতো পরে ভাইদের সাথে ঈদগাহ-এ চলে যেতাম। আব্বা ভাইরা নামাজ পড়তো। আমরা বাইরে অন্য সব ছোটদের সাথে মজা করতাম। ঈদের দিনে সবার আগে মা সেমাই রান্না করতেন। সবাই সেমাই জর্দা, ফিরনী, পায়েস খেয়ে রওনা দিতো। প্রত্যেকের হাতে থাকতো একটা করে জায়নামাজ। দাদারা, আব্বা যখন নামাজ পড়তেন আমরা মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও ঈদগাহে যেতাম। কারণ ছোট ছিলাম। ঈদগাহ মাঠে বেলুন, হরেক রকমের চুড়ি ফিতা, খাবার জিনিস বিশেষ করে কদমা, পাপড়, হাওয়াই মিঠাই, গজা (ঢাকায় যেটাকে সুরালী বলে) কটকটি কিনে আনতাম। নামাজ শেষ হলে সবাই সবার সাথে কোলাকুলি করতো। তারপর সবাই দলবেঁধে পাড়ার সবার বাড়িতে যেত।  এটা একটা রেওয়াজ ছিল। যারা বাড়ির বাইরে থাকতো তারা সবাই ঈদের ছুটিতে বাড়ি যেত; বাড়ির মুরব্বীদের সাথে দেখা করতো। মফস্বল শহরের এটা ছিল একটা বিরাট আন্তরিকতা। তারপর সবাই নামাজ পড়ে কবরস্থানে গিয়ে নিজের মৃত বাবা-মা, আত্মীয়  স্বজনের জন্য দোয়া প্রার্থনা করতো। 

 

তখন ঈদের জামার ব্যাপারে একটা লুকোচুরি ভাব ছিল। কেউ নতুন জামা বানালে কাউকে দেখাতো না। আমরা দুবোন সব সময় জামা লুকিয়ে রাখতাম। এমনকি যে দর্জির দোকানে জামা বানাতাম সে দোকান থেকে টুকরো কাপড়গুলো নিয়ে আসতাম পাছে কেউ জেনে যায়। আমার বড়দা, আপা আমাদের দু’বোনকে সব সময় ব্রোকেড, মকমল, সার্টিনের জামা বানিয়ে দিতেন। বড়দা বিভিন্ন ধরণের নিত্য নতুন জামার কাপড় নিয়ে আসতেন। তখন প্রত্যেকে প্রত্যেকের বাড়িতে যেত। সারা বছর এই দিনটার জন্য সবাই মুখিয়ে থাকতো। সবাই রিক্সাভ্যান বা যার গাড়ি আছে তা নিয়ে দল বেঁধে বেড়াতে যেত। বিকাল হলে নৌকা ভ্রমণে বের হতো। স্কুল মাঠে ঈদ মেলা হতো। 

 

সারাদিন মাইকে  বাজতো, ‘‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ

আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন

আসমানে তাগিদ…………

 

বাসায় বাসায় সেমাই জর্দা পায়েস খাওয়া যেন এক মহোৎসব!

 

সেকালের ঈদের আর একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল রকমারি মেলা ।ফুটবল , ক্রিকেট  টুর্নামেন্ট,, নৌকা বাইচ হোত। ছোট মফস্বল শহরে নতুন সিনেমা মুক্তি পেতো। সিনেমা হলে মানুষের ঢল নেমে যেত। সেকালের ঈদে আর একটি অন্যতম রেওয়াজ ছিল সেলামী দেয়া ও পাওয়া। বড়রা ছোটদের সেলামী দিত, আর ছোটরা পেত। ছোটরা বড়দের দেখামাত্রই দৌড়ে গিয়ে সালাম করতো। ছোটরা একটা ব্যাগ নিয়ে ঘুরতো আর সারাদিন হিসেব করতো কত টাকা হলো।  কী যে মজা ছিল এই সেলামী দেয়া এবং নেয়ার মধ্যে! ছোটরা সারাবছর অপেক্ষা করেতা কখন ঈদ আসবে আর সেলামী পাবে। যারা বাড়ির বাইরে থাকতো বা প্রবাসে থাকতো তারা ঈদ সামনে করে বাড়ি আসতো। এ সময়টা প্রতিটি বাড়িতে একটা আনন্দ উৎসব লেগে যেত। আসলে ছোটবেলা বা সেকালের ঈদের কথা কখনও ভোলা যায় না। ঈদ মানেই ছেলেবেলার ঈদ। 

 

আর এখন যান্ত্রিক জীবনে ঈদ নেই বললেই চলে। শহুরে জীবনযাত্রায় যে যার মতন। পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থেকেও নেই কোন যোগাযোগ। নেই কোন সামাজিকতা। অথচ সেকালে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান কোন পার্থক্য ছিল না। একই ঐক্যে বাঁধা ছিল সবাই। ‘‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’’ এই নিয়মে বাঁধা ছিল সবাই। 

 

একালের ঈদে খুব বেশি হলে একটা দিন সবাই মা-বাবা, ভাই-বোন নিয়ে একবেলা খায়। আত্মীয় স্বজনের বাসায় বা বন্ধু বান্ধবের বাসায় যোগাযোগ খুবই কম। যে যার মতন করে ঈদগাহ যায়, নামাজ পড়ে চলে আসে। বেশি হলে হয়ত আত্মীয় স্ব¦জনের কবরস্থানে গিয়ে দোয়া করে। বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্ব¦জনের সাথে দেখা হলে কুশল বিনিময় করে কোলাকুলি করে। তবে ছোটদের মধ্যে এখনও সেলামীর বিষয়টা রয়ে গেছে। ওরা এখনও ব্যাগ নিয়ে ঘোরে, সেলামী আদায় করে, সারাদিন টাকারও হিসেব করে। 

 

এখন আসি লকডাউনে ঈদ-এ। গত বছরের দুটো ঈদ শুয়ে বসে কেটেছে সবার। কেউ কোথাও বের হয়নি। নেই কোন কোলাকুলি। নেই কোন বেলুন, হাওয়াই মিঠাই, চটপটি, ফুচকা। ছেলেমেয়েদের সেলামীও জোটেনি। টাকায়ও করোনা ভীতি। 

 

একটা ফানি ভিডিও দেখলাম।  সেখানে সেলামী হাতে নিচ্ছে না, বিকাশ করে পাঠিয়ে দিচ্ছে।  তবে এ বছর দৃশ্যপট একটু ভিন্ন। এবার শপিংমল খুলে দেয়া হয়েছে। ফলে উপচে পড়া ভীড়। ক্রেতারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। করোনাকে কেউ আর ভয় করছে না। জীবন যায় যাক, তবু ঈদ করতে হবে। পোশাক কিনছে এবং এদের দেখে মনে হচ্ছে এরা সবাই করোনাকে জয় করেছে। সবাই করোনা জয়ী। রাস্তাঘাট ভীষণ জ্যামে ভরা। আরও একটি ভিডিও দেখলাম । একজন মহিলা শপিংমল খুলে দিয়েছে শুনে আনন্দে ডিগবাজি খাচ্ছে। বোঝেন অবস্থা! একজন মধ্যবয়সী মহিলার যদি এ অবস্থা হয়-তাহলে অল্পবয়সী বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কী অবস্থা হবে?

 

ফলে এবার লকডাউনে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ঈদ হবে বোঝা যাচ্ছে। জাগো বাঙালি জাগো। জয়তু লকডাউন! জয়তু করোনা!  জয়তু ঈদুল ফিতর! বাঙালিকে কোনোভাবে আটকে রাখা যাবে না। সামনে আসছে মহা অশনীসংকেত। 

 

থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে

দেখবো এবার করোনাকে। 

 

কার এতোবড় সাহস বাঙালিকে রুখবে!

শারমিনা পারভিন
শারমিনা পারভিন
%d bloggers like this: