‘কবচকুণ্ডল’: নাসরীন জাহানের অনন্য কাব্যোপন্যাস আলোচনা / খাতুনে জান্নাত

‘কবচকুণ্ডল’: নাসরীন জাহানের অনন্য কাব্যোপন্যাস আলোচনা

‘কবচকুণ্ডল’: নাসরীন জাহানের অনন্য কাব্যোপন্যাস আলোচনা

বই আলোচনা

‘কবচকুণ্ডল’: নাসরীন জাহানের অনন্য কাব্যোপন্যাস আলোচনা / খাতুনে জান্নাত

নাসরীন জাহান বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য, বিদগ্ধ সাহিত্যিক। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক সাহিত্যের বিভিন্ন মাধ্যমেই কাজ করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। খ্যাতিমান হয়েছেন। পুরস্কৃত হয়েছেন। আমার কাছেও তাঁর লেখা অতিপ্রিয়। গল্প ও উপন্যাসের ব্যাপ্তি গভীর ও পাঠমুগ্ধ । মনকে আলোড়িত করে। চিন্তার জগৎ উন্মোচিত ও প্রসারিত করে।

তিনি উপন্যাসের পরতে পরতে কবিতার বুনন করেন। আলঙ্কারিক বাণী সহযোগে কাহিনিকে করে তোলেন মোহময়, কাব্যময়। জীবন ভেঙে ভেঙে তৈরি করেন পিরামিড। তা থেকে বিচ্ছুরিত হয় আলো। তাঁর বর্ণনা সহজ সরল নয়। জীবনের গভীরতম প্রদেশে প্রবেশ করে নৈর্ব্যক্তিক জাগরণ ঘটান বর্ণনার রক্তিম আলেয়ানে। আধুনিক চিত্রের মতোই তার বর্ণনা ও ভাব মিশ্র রঙের বিন্যাসে বিন্যস্ত। সব কথা বলেও কিছু কথা রয়ে যায়, গভীর অনুভব দিয়ে বুঝে নিতে হয়। অনুভূতির কোষে কোষে সজীব সঞ্চালন ঘটাতে সক্ষম হয়। প্রতিদিনের সাধারণ ঘটনা প্রকৃতির নিবিড় ঘন অবয়বে মিলেমিশে এক ঘনঘোর বা আবেশে মিশে পাঠকের বোধ ও মননকে শাণিত করে তুলতে সক্ষম হয়। পাঠক পাঠে আরও আগ্রহী ও চিন্তাশীল হয়ে উঠেন বিধৃত অনন্য আখ্যানে। তাঁর বুননের কৌশল বোদ্ধা পাঠকের মুগ্ধতার অবগুণ্ঠন খোলে, চমৎকৃত করে।

উড়ুক্কু, ঈশ্বরের বাম হাত, ক্রুশকাঠে কন্যা আগেই পড়া ছিল। সম্প্রতি তাঁর ‘কবচকুণ্ডল’ উপন্যাস পড়ে মুগ্ধ হয়েছি ও বইটি নিয়ে লিখতে মনস্থির করেছি। কবচকুন্ডল–অর্থ কুন্তীপুত্র কর্ণের সহজাত অভেদ্য বর্ম ও কর্ণভূষণ। কর্ণ ছিলেন সূর্যদেব ও কুন্তীর সন্তান এবং সেই সূত্রে পাণ্ডবদের বড় ভাই। কিন্তু ভাগ্যচক্রে তিনি কৌরব রাজকুমার দুর্যোধনের ঘনিষ্ঠতম মিত্রে পরিণত হন এবং ফলশ্রুতিতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি কৌরবদের পক্ষে নিজ ভাই পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। বইটির নামের মধ্যে দিয়ে লেখক উপন্যাসে বর্ণিত প্রধান চরিত্র নওশীনের জীবনের গতিপথ চিহ্নিত করেছেন। তার আপনজনেরাই তার জীবনকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। মানসিকভাবে তার অবস্থান ওদের বিপরীতে অথবা জীবনের কঠিন আবর্ত থেকে বাঁচার জন্য সংগ্রামে পরাজিত হয়ে মেনে নেওয়াকে কবচকুণ্ডল বলেছেন। কান তুই বধির হ- বর্মে ঢেকে থাক, চোখ দেখিস না আবিলতা, মুখ চুপ থাক– ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে রাখ। মন শান্ত হ, সংসার সংসার খেলি।

গ্রামের সংকটময়, পর্যুদস্ত জীবন পেরিয়ে মুক্ত ও মুক্তির শ্বাসে এগুতে চাওয়া জীবন পাকে পাকে বিধ্বস্ত হয়ে আটকে থাকে উল্টোরথে। কাঁটা ও বেদনার ক্ষরণে কাটতে কাটতে বিক্ষত হতে থাকে সময়ের কাঁচিতে। ধোঁকা, প্রবঞ্চনা, প্রতারণা বেঁধে ফেলে প্রাণ। মেধাবী নওশীন চেয়েছিল মুক্তপ্রাণ লেখক হয়ে জীবনের আলোআঁধারি খেলায় আলো জ্বালাতে। সুদীপ্ত নামের সংস্কৃতিবান ছেলের সাথে মন বিনিময় হয় নানা ঘটনা ও আবেগের প্রবহমান স্রোতে। গ্রাম ও শহরের অনেক পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। সুদীপ্ত সে লেখা সংগ্রহ করে তাকে দেখাতো। এভাবেই দুটো ধর্মের মানুষের মধ্যে ভালোবাসার বীজ রোপিত হয়। শাহেদ নামের এক স্বপ্রাণ বন্ধু ও সুদীপ্তকে নিয়ে তার সময় সাহিত্যের নাওয়ে মিষ্টি পাল বাইছিল। কাঙ্ক্ষিত জীবন হাতের মুঠোয় পেয়ে প্রকৃতির ছন্দে-আনন্দে সহজিয়া গান গেয়ে উঠছিল রাগে-অনুরাগে। সাথে যোগ হলো লালন। যে তার মামি সুমাইয়ার দ্বিতীয় স্বামী। লালন তাকে পড়ার বই দিল। প্রাচীন ইতিহাস, রামায়ন, মহাভারত ও পুরাণ কাহিনি পাঠ করে করে অতীত ও ভবিষ্যতের মেলবন্ধন তৈরি করছিল বর্তমানের শিল্প সময়ের। সে সময় একপ্রাণ করে সুদীপ্ত ও নওশীনকে। কিন্তু প্রেমের অতি-ঘোর যতি টেনে দেয় সম্পর্কের। দুজনের পারস্পরিক অতি আকর্ষণে শরীর অদম্য হয়ে যায়। করে ফেলে ভুল। সে ভুল ফুল হয়ে উঠতে পারেনি বন্ধু শফিউলের কারণে। শফিউল শাহেদের বন্ধু। সে হিসাবে নওশীনেরও বন্ধু। তার কুটচালের কাছে হেরে যায় নওশীন মায়ের মদদে। শফিউল তাকে ভালোবাসেনি,, তার মতো একটি মেয়ে সংসারের জন্য উপযুক্ত। এ ধারণার বশবর্তী হয়ে নওশীনকে পেতে চেয়েছে। তার সাজানো জালে সাগরে ভাসমান মীনের মতোই ধরা পড়ে নওশীন। সুদীপ্তের সাথে ভালোবাসা ও দৈহিক মিলনে জন্ম  নেওয়া মুনিয়া নামের মিষ্টি ও মায়াবী মুখের কন্যা যাকে অতি আদরের হারানো বোন বুলবুলি মনে করেছিল। সে বেড়ে উঠে শফিউলের মেয়ে পরিচয়ে। আজীবন এক ভয়, বিভীষিকা, আর আতঙ্কে পার করা সময়ে বেড়েওঠা সে কন্যা অটিজম আক্রান্ত। নওশীনের ভাবনায় এ কন্যাটিকে সমাজ কাকের ঘরে কোকিলের বাচ্চা হিসাবে উল্লেখ করবে। বইয়ের ফ্ল্যাপে দেখলাম প্রকাশকের লেখা ‘প্রেমিক সুদীপ্ত নওশীনের সত্তায় প্রেমজ ভ্রূণ ছেড়ে বলেছিল, আমার জন্য একটু অপেক্ষা কর।’ প্রকাশকের এ ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে বলাটা জরুরি যে, কাক কোকিলের কাহিনি এ নয় মোটেই। কেননা মা একটা সন্তানের মূল সত্তা। আর পুরুষ কোন ভ্রূণ বহন করে না। সে শুক্রাণু বহন করে মাত্র। শুক্রাণু কখনোই ভ্রূণ নয়! এখনো বহু মানুষ মানে যে, সন্তান পিতার কাছ থেকে আসে, পুরুষ বীজ বহন করে। তাই তো এ সমাজ পুরুষের। যদিও তারা বিজ্ঞান পড়ে, পাশ করে। সমাজ মেনে নেয়  বলে আয়করা পুরুষকে সংসারের মূল সত্তা ধরা হয়। আয় করেও নারী পরিবারের কেন্দ্রে স্থাপিত হয় না। এটা সামাজিক ও রাষ্ট্রের সমস্যা। মানবিক অর্থে নয়। হিন্দু মুসলমানের রক্ত মিশে সন্তান অটিস্টিক হয় না। যেকোনো কারণে অটিস্টিক হতে পারে। যদিও কি কারণে অটিস্টিক হয় তা নিয়েও বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতের ভিন্নতা রয়েছে। লেখকের এ অন্তর্দৃষ্টি অভিন্ন। সামাজিক মানুষের অজ্ঞানতা ঝাড়ফুঁক, তাবিজ, কবজ এখনো অষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে মানুষকে। এখনো আধুনিক ডাক্তার ফেলে মানুষ ঝাড়ফুঁকে দৌড়ায় অথবা ডাক্তারাও আধুনিক নয়। বেশিরভাগ ডাক্তার বিবর্তন মেনে নেয় না।  অনেক ডাক্তারকেও দেখা যায় ঝাড়ফুঁকে বিশ্বাস রাখতে। ঈশ্বর ও ভাগ্যের হাতে জীবন ছেড়ে দিতে। জটিল কোনো রোগ দেখলে ঝাড়ফুঁক ও দোয়া নিতে পীর বাড়ি দৌড়াতে।

নাসরীন জাহান প্রগতির পথে চলা দীপ্তিময় লেখক। নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী জন। তিনি মানেন নারীর স্বনির্ভরতা জীবনকে মুক্ত করে পুরুষের প্রতাপ ও প্রকৃতির কাছে মাথানত না করতে। তিনি মর্মর শব্দের কষ্টিপাথরে কাহিনির ভিত গড়েন। কাহিনির ভেতরে প্রবেশ করে মন হারিয়ে যায় দুঃখ যন্ত্রণা, প্রেম আর বোধের গভীরে। কাহিনির টান টান চিত্রায়নে মন খুঁজে বেড়ায় সমস্যার সমাধান। নিরবচ্ছিন্ন প্রকৃতির উদ্দাম স্থাপত্যেও মন হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। মনের পাড় ভাঙে, বিবেক জেগে উঠে। আহা এ সমাজ নারীর জন্য আরেকটু কম শৃঙ্খলিত হলে কি হত? এ উপন্যাসে স্বপ্নচারী নারী নওশীন পিতার মতো সাংস্কৃতিক হলেও পুরুষের চক্রান্তের কাছে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়েছে। তার শিক্ষা, সাহিত্য পাঠ ও লেখা, তার প্রেম, তার কর্ম কোনোকিছু তার সম্মান ও স্বাধীন সত্তার সহায়ক হয়নি। সে আয় করেও দাপুটে নয়, আয় না করেও সংসারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। সে যেন জড়। জীবের পিছু পিছু অনুসরণ করে চলা কোন বস্তু। তার ক্রোধ, অভিমান, জাগরণ নীরবে, নিভৃতে। সাধারণ নারীদের মতোই সম্পূর্ণরূপে পরাভূত হয়েছে। নিজেকে লুকোতে লুকোতে মিথ্যাকেই আশ্রয় করে জীবন পরিচালনা করেছে। ভয় আর আতঙ্ক আর মানসিক বদ্ধতা তার সঙ্গী হয়েছে। সন্তানকে সুস্থ করতে গিয়ে ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবজে আস্থা নিয়েছে। সেখানেও সে পরাজিত, অপমানিত, লাঞ্ছিত জন। শেষমেশ স্বামীর অবৈধ মেলামেশাও মেনে নিয়েছে। তবুও স্বামী থাকুক, মাথার উপর ছায়া থাকুক। দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাইলেও শেষমেশ দেখে নওশীন জীবন ভাঙার সাহস ও শক্তি কিছুই তার আয়ত্তে নাই। এরকম মানসিকতা ছায়া ও স্বস্তি কোনটাই দেয় না জীবনে। নওশীনের ভাবনায় লেখকের চমৎকৃত করা বেদনাঘন বর্ণনা–‘অবসাদে নুয়ে পড়ে। রাত জাগরণের ধকল দেহ আর বইতে পারছে না…চোখ দুটো জ্বালা জ্বালা করলে দু’পাপড়িকে কষে বাঁধে…পাক খেয়ে ওঠে এক নারীদেহ…যেন নেচে ওঠে আদমের সাপ’ তার চোখের হাজার মায়াতে নওশীনের কুচিকুচি ভয়…আটপৌরে শাড়িতে পেঁচানো শরীর, শত গ্রাম্য অবয়বের মাঝেও কোথাও নওশীনের পরাজয়…তার দেহের সাথে মিশে যাচ্ছে আরেকটা দেহ…নওশীন নিজেকে ছেড়ে দিয়ে দেখছিল দৃশ্যটা– কী নাম সেই নারীর? হরিণীয়া…। কিন্তু সাথে সাথেই পুরুষটির ছায়া মূর্ত হতেই লাফ দিয়ে উঠে বসে সে…টিভি স্ক্রিনের পারিবারিক অতি নাটকীয় ড্রামাতে আশ্রয় খুঁজেও নিস্তার হয় না।’ তাই নওশীন একা হলেই শূন্য হয়ে পড়ে। শিকড়বিহীন হয়ে পড়ে।

নওশীনের দুটো মেয়ের মধ্যে আরেকটির নাম মৌটুসী। সে তেজোদীপ্ত, সুস্থ, স্বাভাবিক মেধাবী। অধিকার সচেতন। সে হয়তো আগামীর আলো। সে মাকে অত্যাচার করা পিতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায় সদম্ভে। প্রশ্নবিদ্ধ করে সমাজকে। দুটো দেহ এক হলেও মনের মিল কেন হয় না? প্রেমহীন সন্তানের ভবিষ্যৎ কোথায় দাঁড়ায়! কিন্তু সেও তার বাবার সংসার বহির্ভূত প্রেম মেনে নেয় অথবা লেখক পরোক্ষভাবে বলতে চান সংসারের বাইরেও মানুষের নিজস্ব জীবন থাকুক। তাহলে নওশীনের ক্ষেত্রে নয় কেন? সুদীপ্তকে হারিয়ে শূন্য জীবন  টেনে টেনে সে কাৎরাচ্ছে! শাহেদের কাছে দুঃখ রুয়ে আসে। শাহেদও বইছে মালতির সাথে প্রেমহীন পরিতাপের জীবন। যদিও মালতি তাকে ভালোবাসে! শেষমেশ সংসার ও সন্তান ঠিক রাখতে ভালোবাসার মানুষ সুদীপ্তের সাথে দেখাও করে না নওশীন। যদি সবাই জেনে যায়, যদি মেয়েহারা সুদীপ্ত মুনিয়াকে চেয়ে বসে নওশীনের কাছে! সেখানেও সে দুর্বল, নত, ন্যুব্জ। ক্যানসার আক্রান্ত সুদীপ্ত নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। সুদীপ্তের মৃত্যু তাকে ক্ষতবিক্ষত, চিকৃত করে। ভেতরে রোদন নিয়েও সে হাপ ছেড়ে বাঁচে। তার সাজানো সংসারকে সাগরের ঢেউ উন্মাতাল করবে না। লেখকের ভাষায়-

‘উলকাঁটা দিয়ে সোয়েটার বুনতে বুনতে অনেক খুলেছে, মাকড়সার মতো অধ্যবসায়ের লড়াইয়ে অনেকবার প্রাসাদের ওপর উঠতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে খেয়ে পড়েছে, এখন এই নিস্তরঙ্গ জীবনে স্থবিরতা আর একঘেয়েমিতে যতই বমি উঠতে থাকুক গলায় জাগতিক বিন্যস্ততার গড়ে ওঠা জীবনে যে আশঙ্কা ঘাই দিয়ে উঠছে সেই যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার শক্তি সাহস কিছুই আর তার নেই।’

লেখকের এ গ্রন্থে বেশিরভাগ নারী সংগ্রামী। নওশীনের মা, সুমাইয়া, বড় পা, ভিন্ন- মূল চরিত্রের বেশিরভাগ নারী জীবনস্পৃহ ও কর্মজীবি। আত্মসম্মান বোধ সম্পন্ন। তবে প্রতিটি চরিত্রের ভেতরে রক্তক্ষরণ চলমান। কখনো দৃশ্যমান, কখনো অদৃশ্য। লালনের স্ত্রী সুমাইয়া প্রথম স্বামীর যৌন অক্ষমতা ও শারীরিক পীড়নে বেরিয়ে এসে লালনকে বিয়ে করার পর মনে হলো সে ভালোবাসে তার আগের স্বামীকে। লালন তাকে ভালোবাসলেও সে নওশীনের প্রতি আসক্ত হয়। প্রেমহীন জীবন গড়াতে থাকে সংসার নামক আবেষ্টনীর ভেতরে। অথবা পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ। সামাজিক, পারিবারিক উপেক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠা অটিস্টিক কিশোরী চমৎকার অনুভূতি ও প্রতিভাধর। নীলটুনটুনি পাখির জীবন নিয়ে গল্প লিখে মানবিক বোধের। সে দেখেছে স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিকের প্রভেদ! মানুষ একটু ভিন্ন হয়ে গেলেই তাকে এ সমাজ গ্রহণ করতে চায় না। তার প্রতি এ সমাজ, সংসার, শিক্ষালয়ের অবজ্ঞা, অবহেলাও তাকে দমাতে পারে না। সংগ্রাম ও কাজের নিবিষ্টতা তাকে সম্মানিত করে। তার প্রতি সার্চ লাইটের আলো তীব্র হয়। মূলতঃ পুরো উপন্যাস তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। তার প্রতি তথা সমাজের এ শ্রেণির মানুষের প্রতি লেখকের চরম মমতা ও শ্রদ্ধা রচিত হয়েছে এ আখ্যানে। লেখকের ভাষায়-

‘নীল নীহারিকায় শিশিরে ভেজা তুলো তুলো মেঘ ফেণা হয়ে উড়ছে, ধীরে গিয়ে তার মায়াবী হাত পেতে দিল। সামনে একটা বুলবুলি ঘর বানাচ্ছে… মুনিয়াকে বিস্মিত করে দিয়ে আরেকটা বুলবুলি ওর পেতে রাখা হাতের তালুতে নিঃশব্দে এসে বসল।’

অটিস্টিক শিশুরা হিংসা, দ্বেষ, বিভাজনের ঊর্ধ্বে থাকে। তারা প্রকৃতি-প্রিয় হয়। তাদের ভাষা প্রকৃতির ভাষা। এ সমাজের বেশিরভাগ সুস্থ মানুষেরা প্রতারণা, প্রবঞ্চনার ফাঁদ পেতে অন্যকে রক্তাক্ত করে। কাউকে দমন না করলে কেউ বড় হতে পারে না। এই যেন শাশ্বত রূপে ধরা দেয়। 

এ উপন্যাসে প্রকৃতি এসেছে নানারূপ মাদকতায়। কখনো বর্ষার মাতাল রূপময় ছন্দে। বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ উদযাপনে। শরতের মিষ্টি কোমল স্পর্শে। কখনো শীতের হাড়কাঁপানো ভয়ের পর রোদ পোহাবার সাংসারিক কলকাকলিতে। ঝড়ের তোলপাড়ে প্রকৃতির ভয়াবহ রূপ। কখনোবা শহুরে গলির ডুবে যাওয়া ময়লার আবর্তন। গ্রামের ঘন বন, বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, প্রকৃতির শোভা। রাতের আঁধার ভেদ করে রেলগাড়ীর ঝকাঝক শব্দে বিভোর গ্রামের চঞ্চলতা বা প্রেমাস্পদের জন্য প্রতীক্ষারত স্বপ্নাতুর কিশোরীর উচ্ছ্বাস। জোনাকির আলো। যদিও কখনো তা আগুন হয়ে জ্বলে। বৃক্ষকে সন্তান মনে-করা নওশীনের হাহাকারে ও ওসমানী উদ্যানের শত শত বৃক্ষের মরে যাওয়া উল্লেখের সাথে লেখকের প্রকৃতি প্রেমের দৃষ্টান্তও দৃশ্যমান হয়। মানুষগুলো সংযোগহীন। বেশিরভাগ আত্মমগ্ন। নিজস্ব ইচ্ছা ও অন্যের অধীনতাকে ভালোবাসে। হয়তো এটাই জীবন। কারও ইচ্ছের অধীন নয়। প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলছে তো চলছেই। প্রকৃতিকে মুঠুতে পুরার ক্ষমতা কেউ কেউ ঠিকই রাখে!

পরিশেষে, বলা যায় শৈল্পিক নারী জীবনের মনোদৈহিক সূক্ষ্ম হাহাকারের চিত্র উপন্যাস ‘কবচকুণ্ডল’। লেখক নাসরীন জাহানকে অনিঃশেষ ধন্যবাদ। এমন ভাবনার খোরাক-সমৃদ্ধ উপন্যাস উপহারের জন্য। আশাকরি তিনি এখন জীবনের অভিজ্ঞতা অর্জনে আরও নান্দনিক, শিল্পসমৃদ্ধ, অলঙ্কারের কারুকাজ মণ্ডিত নতুন লেখায় প্রাণীত করবেন বাঙালি ও বিশ্ব সাহিত্যিক ও পাঠক কুলকে।

খাতুনে জান্নাত
খাতুনে জান্নাত