কদমগুচ্ছ/ওয়াহিদ মোস্তফা নিলয়

কদমগুচ্ছ

কদমগুচ্ছ

কদমগুচ্ছ/ওয়াহিদ মোস্তফা নিলয়

 

শুক্রবারের সকাল। আমি একটা সাদা পাঞ্জাবি পড়ে শহুরে রাস্তায় হাঁটছি। শুক্রবার দিনটা বাকি দিনগুলো থেকে কেন জানি বেশ আলাদা। বিশেষত,সকাল এবং মধ্য দুপুরে কেমন যেন উদাসীন উদাসীন লাগে, মনে হয় চারপাশের সবকিছু যেন স্থির হয়ে আছে। আমি যে রাস্তা ধরে হাঁটছি তার একদম শেষ মাথায় একটা কদম গাছ দেখা যাচ্ছে। গাছটি বোধহয় কোন বাড়ির আঙিনায়। আমি দ্রুত পায়ে বাড়িটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। শহরে সাধারণত কদম গাছ দেখা যায় না। শহরের মানুষ গাছের পরিবর্তে দালান তুলতে ভালোবাসে। এই বাড়িটা সে তুলনায় ব্যতিক্রম। সাদামাটা একটা বিল্ডিং এর সামনে খানিকটা উঠান। সেখানে মাঝারি আকৃতির দুটো কদম গাছ আর সদ্য লাগানো কতগুলো ফুলের চারা মাথা বের করে আছে। বোঝা যাচ্ছে, এই বাড়িটির মালিক বেশ রুচিসম্পন্ন ব্যক্তি। ঋতু পরিবর্তনের আভাস তিনি স্বচক্ষে অবলোকন করতে চান। মানুষটিকে দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছে আমার। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বাড়িটির দরজা খোলা। সেটি দিয়েই এতক্ষণ ধরে বাড়ির পরিবেশটা দেখছিলাম কিন্তু হুট করে তো আর ঢুকে পড়া যায় না। তবু লোভ সামলাতে না পেরে সাহস নিয়ে আমি দরজার কাছে গেলাম। এক পা ফেলতেই পেছন থেকে কার যেন ডাক শুনতে পেলাম। ইউটার্ন নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলাম মোটাসোটা এক লোক পান চিবতে চিবতে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। লোকটি ঠিক আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “কারে চান?” “না,মানে বাড়ির মালিকের সাথে একটু দেখা করতাম। আসলে আমার কিছু কদম ফুল লাগত। “লোকটি কুৎসিত হাসি হেসে বলল,”কদম ফুল! কদম ফুল নেওয়ার জন্য কেউ এমনে কারো বাড়ি ঢোকে! আপনি ভাই আমারে অবাক করলেন। তা কারে দিবেন, প্রেমিকারে? “আমি আমতা আমতা করে বললাম,”না,মানে,কাউরে দিব না। কদম আমার ভালো লাগে।” “বুঝি ভাই,আপনাদের মত উঠতি যুবকরা প্রেমিকার জন্য কত কিছু করে। ওই নাইনে থাকতে কার যেন একখান কবিতা হুনছিলাম, প্রেমিকারে নাকি ১০৮টা নীল পদ্মা আইনা দিব। হেহেহে,কি সব কথা। যাই হোক,ভাইজান,আপনি কদম নিতে আইছেন,প্রেমিকারে দিবেন,ভালো কথা,বিকালে আহেন। ১০৮ টা কদম নিয়ে যাবেন,”বলে লোকটি খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগল। আমি কিছুটা লজ্জায় পড়ে গেলাম। লোকটির কল্পনাশক্তি ভালো, তিলকে তাল করার ক্ষমতা আছে। “ভাই,মানে বাসার মালিকের সাথে একটু কথা বলিয়ে দেওয়া যায় না?একটু কথা বলার ইচ্ছা ছিল আর কি”, আমি বোকার মত আবারো বললাম। লোকটি পকেটে হাত দিল। একটা নেতিয়ে পড়া গোল্ডলিফ বের করে ঠোঁটে লাগাল। তারপর বুক পকেটে হাত দিয়ে লাইটার বের করতে করতে বললেন,”ভাই,বাসার মালিক এখানে নেই। এই বাড়িটা ভাঙা হবে। বড় একটা বিল্ডিং করা হবে। আমার কোম্পানি এই কাজটি করছে।আজ বিকালে কদম গাছদুটো কাটা হবে। এজন্যই আপনারে বিকালে আসতে বললাম। “লোকটি সিগারেট জ্বালালো। তার গলার স্বরে গাম্ভীর্য এসেছে। বুঝলাম,থাকাটা আর ঠিক হবে না। তাকে ধন্যবাদ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম।

টং দোকানের সামনে এসে দাঁঠিয়েছি। এক রিকসাচালক রিকসা থামিয়ে বসে আছে। হাতে কম দামী সিগারেট। লোকটি সিগারেট টানতে টানতে গাচ্ছে,

             “আমার সখীর নয়ন দুইটা বাঁকা

             কালো কেশে বান্ধা আছে কদমেরই তোড়া”

আমি সিগারেট জ্বালালাম।ধোঁয়া উড়ছে, সেদিকে আমার খেয়াল নেই। আমার প্রচন্ড খারাপ লাগছে, দুটো কদম গাছের জন্য, আমার সত্যিই খারাপ লাগছে!

ওয়াহিদ মোস্তফা নিলয়
ওয়াহিদ মোস্তফা নিলয়