কলমিলতা/ ছন্দা দাশ

কলমিলতা

কলমিলতা/ ছন্দা দাশ

 

মুক্তকেশী স্কুলের সামনে এসে ইন্দ্রাণী একটা গন্ধ পায়। গন্ধেই সে বুঝে গেছে সেলাই দিদিমণি আছে। এ

গন্ধ তার বড়ো চেনা। সব ভালো মানুষের গায়ে নিজস্ব একটা গন্ধ থাকে তা দিয়ে তার চরিত্র প্রকাশ পায়। এসব ভাবনা ইন্দ্রাণীর নিজের। এসব ভাবনার সাথী কাউকে করতে নেই। একাই নিজের ভাবনা নিয়ে চলতে হয়। সেলাই দিদিমণি সবসময় সাদা কাপড় পরেন। এতে তাকে যেন আরও বেশি সুন্দর দেখায়। বীণা বলেছিল দিদিমণির বিয়ের পরদিনই নাকি তাঁর বর মটর সাইকেল একসিডেন্ট করে মারা যায়। তারপর থেকেই উনি সাদা কাপড় পরেন। ইন্দ্রাণী ভাবে, দিদিমণির তো বরের সাথে ভালোবাসাই তৈরি হয়নি তাহলে কেন তিনি তার কথা মনে করে সব আনন্দকে দরজার ওপারে রেখে দিয়েছেন? দিদিমণির এখন সব ভালোবাসা ইন্দ্রাণীদের মতো স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চাগুলেকে ঘিরে। কিন্তু তাতে কি দিদিমণি সব পূর্ণতা পায়? ইন্দ্রাণীর বয়স এখন বারো পেরিয়ে তেরোতে। সে এখন অনেককিছু বোঝে। মা বলে, পাকা। ইন্দ্রাণী এসব কারো কাছ থেকে শোনেনি, বই পড়ে আর মানুষ দেখে দেখে জেনেছে।

এসব কথা ভাবতে ভাবতেই সে দিদিমণির বাসার সামনে এসে পড়েছে। এখন আর সেই গন্ধটা নেই। গেটের মুখের বিশাল স্থলপদ্মের গন্ধে ভরে আছে। পুজোর ঘর থেকে ধূপের গন্ধ আর পুজারীর মন্ত্রোচ্চারণে সকালটা কেমন ভালো লাগায় ইন্দ্রাণী চুপ করে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। দিদিমণির ছোট ভাই অলক সে সময় হাতে গুলতি নিয়ে পাখি মারার জন্য বের হতে গিয়ে ইন্দ্রাণীকে দেখে বললো, এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? অলক ইন্দ্রাণীর সাথেই পড়ে।লেখা পড়ায় বেশ ভালো। তবে কেমন জ্যাঠা জ্যাঠা ভাব। অলককে দেখলে ইন্দ্রাণীর অন্যরকম একটা অনুভূতি কাজ করে। কেমন যেন নিষিদ্ধ এক জানালার অনুচ্চারিত গোপন কথা। ইন্দ্রাণী অলকের দিকে না তাকিয়ে বলে তাতে তোর কি?

অলক বললো, আমার কি হবে? তুই এই সাতসকালে বোকা হাঁদার মতো দাঁড়িয়ে আছিস তাই ভাবলাম

কিছু হয়েছে। ইন্দ্রাণী ইচ্ছে করেই কথা ঘুরাবার জন্য 

বললো,  দিদিমণি কি করছেন অলক?

অলক বললো, তাই বল। তা না শুধু শুধু কথার প্যাঁচ।

দিদির পুজো শেষ হয়েছে এতোক্ষণে।

ইন্দ্রাণী বললো, তবে আমি যাই। বলেই গেট দিয়ে ঢুকতেই দেখে দিদিমণি পুজোর ঘর থেকে বের হয়ে আসছে। চুল খোলা। ভেজা চুল বেয়ে জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে। কী সুন্দর কাঁচা হলুদের মতো গায়ের রং। ইন্দ্রাণীকে দেখে হাসলো। অমনি চারপাশটা কেমন

“কোমল মা “এর সুরে যেন বেজে উঠলো। সংসারে কিছু কিছু মানুষের মতো সেলাই দিদিমণিও তেমনই

যাদের ভাগ্যের কাছে কোনরকম অনুযোগ, অভিমান থাকে না। ইন্দ্রাণীর মাথায় পুজোর ফুল ছুইয়ে দিয়ে একটুকরো সন্দেশে মুখে পুরে দিল। তারপর বললো, তুই আমার ঘরে বোস। আমি পুজোর কাপড় বদলে আসছি।

ইন্দ্রাণী দিদিমণির ঘরে ঢুকেই চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে

নিশ্বাস নেয়। পৃথিবীর সব ভালো মানুষের গায়ে এমন গন্ধ থাকে। তারা যেখানেই যায় সে জায়গাটা মন্দির হয়ে যায়। মন্দির তো আর কিছু নয় কতগুলো সাধু মানুষের সঙ্গ। নইলে পাথরের মূর্তিতে কি সত্যিই ঈশ্বর

আছে? মানুষের মধ্যেই জীবন্ত ঈশ্বরকে কেউ দেখে না।

দিদিমণি ঘরে ঢুকে ইন্দ্রাণীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, কিরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি অত ভাবছিস? ঠিক যেন বট গাছটির মতো! দিদিমণি কাছে এসে দাঁড়ালে আলাদা একটা সম্ভ্রম  জাগে।সে কেন ইন্দ্রাণী

জানে না।

দিদিমণি এখন পুজোর কাপড় পাল্টে নীল পাড়ের সাদা খোলের পাটভাঙা একটা শাড়ি পরেছেন। আর তাতেই যেন তাঁর রূপ ফেটে পড়ছে। ইন্দ্রাণী ভাবছে লাল শাড়িতে দিদিমণিকে ঠিক মা দুর্গার মতো লাগবে। কিন্তু ঠাকুর এতো রূপ দিয়েও কেড়ে নিয়েছে তার আনন্দটুকু। কেমন নিষ্ঠুর মনে হয় হয় তখন তাকে। এসব চিন্তা করতে গিয়ে তার বুকের ভেতর যেন একটা কষ্টের আগুন জ্বলে। এই কষ্ট খিদে পাওয়ার কষ্টের  মতো না, মার খাওয়ার কষ্টের মতোও না। তার চাইতেও বড়ো কষ্ট।

তোর মা কেমন আছে রে ইন্দ্রাণী? অনেকদিন তোদের

ওদিকে যাওয়া হয়নি। মাকে বলিস সামনের রোববারে যাবো।

ইন্দ্রাণী বললো, রোববার  কেন? মা তো আজই পাঠিয়েছে আমাকে তোমাকে ধরে নিয়ে যেতে।

দিদিমণি বললো,  আজ। কিন্তু বলেই আবার বললো

ঠিক আছে। কিন্তু এইবেলা হবে না রে। তুই থাক। দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে সকাল সকাল বের হয়ে যাবো। ইন্দ্রাণী বললো,  মা যদি বকে?

দিদিমণি বললেন, সে নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই

এখন বসে বসে কাল যে স্টিচ শিখিয়েছি তা ঐ কাপড়ে করে দেখা।

বলেই সেলাই বাক্স খুলে ইন্দ্রাণীকে সুঁই, সুতো আর কাপড় বের করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

দিদিমণি এখন রাঁধতে গেলেন নিজের জন্য। একবেলা

খাবেন। তাও নিরামিষ। কিন্তু ইন্দ্রাণীকে খেতে দেবেন

অন্য রান্নাঘরে যেখানে অলকরা খায় মাছ,মাংস দিয়ে। সে দিদিমণির খাটে উঠে বসে বাইরে জানালা দিয়ে দেখে নিম গাছের পাতায় আলোর মাখামাখি। গাছে ছোট ছোট নিমফল। তার গন্ধ এসে লাগছে। তার আর সেলাই করা হয় না। লালচে রঙের গরুর চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবে এমন চোখ কেন মানুষের হয় না।

যে চোখের ভেতর এক পৃথিবীর মায়া।

ইন্দ্রাণী ভাবে, মানুষের মতো নিষ্ঠুর জীব হয়তো পৃথিবীতে দুটি নেই। তা না হলে কী করে এইসব অবোধ প্রাণি হত্যা করে ওরা খায়!সে বড় হলে দিদিমণির মতো শুধু নিরামিষই খাবে। ভাবতে ভাবতে সে কখন দিদিমণির খাটেই ঘুমের অতলে তলিয়ে যায় নিজেই জানে না। ঘুমের মধ্যেই সে স্বপ্ন দেখে অলকের মতোই কোন অস্পষ্ট মুখ। সে তার দিকে এগিয়ে আসছে। ইন্দ্রাণী কোনমতেই পালাতে পারছে না। এক অপ্রতিরোধ্য চুম্বকীয় শক্তি তার সমস্ত শক্তি যেন নিস্তেজ করে রেখেছে। ইন্দ্রাণী ভয় পেয়ে যতই পালাতে চাইছে ততই তার পা যেন আটকে যাচ্ছে। কিছুতেই ছুটতে পারছে না। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসছে। সে খুব জোরে মা বলে ডেকে উঠতেই ঘুম ভেঙে যায়। ধড়মড় করে উঠে বসে। ঘামে তার শরীর ভিজে গেছে । অবসাদে ভরে গেছে মন। এ সে কেমন স্বপ্ন দেখেছে এতক্ষণ। তবে কী তার মধ্যে কিছু একটার জন্ম হচ্ছে? যার পরিচয় তার জানা নেই। অথচ আছে জানার ব্যাকুলতা। সে একটা বদ্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। চাবি তার হাতে। খুলতে তার ভয়। অথচ ভেতরের অজানা রহস্য তাকে আকর্ষণ করছে। নাহ্ এসব ভাবনাকে প্রশ্রয় দেবে না সে। সামনে তার বিশাল পথ। সে খাট থেকে উঠতেই চোখ যায় খাটের লাগোয়া আয়নার দিকে। আয়নায় জানালার বাইরের অনেকখানি দেখা যায়। সাধু পুকুর, পাড়ের সোনালু ফুলের গাছ, খুঁটিতে বাঁধা ছাগলছানা। ঠিক ওখানটাতে দাঁড়িয়ে আছে অলক। দুচোখে  এক পৃথিবীর বিস্ময় নিয়ে আয়নার তাকিয়ে আছে। আয়নায় দেখা যাচ্ছিল ইন্দ্রাণীর ঘুমে থাকা মুখ। ইন্দ্রাণীর ভেতর প্রচণ্ড আলোড়ন। তবে কি অলকের মধ্যেও তার মতো অজানা কিছুর জন্ম হয়েছে ইন্দ্রাণীর জন্য? বড়রা এটাকেই কি বলে প্রেম?

কেমন ভয় ভয় করছে তার আর সেইসাথে তলপেট জুড়ে ব্যথা। দিদিমণি তাকে ডাকতে এসে মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন ও কিরে ইন্দ্রাণী? তোর মুখটা অমন দেখাচ্ছে কেন?এইতো দিব্যি ভালো দেখে গেলাম। জ্বর এলো নাকি। বলেই কপালে হাত দিয়ে ঠাণ্ডা দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, সিজন চেঞ্জ হচ্ছে। এখন একটু সাবধানে থাকতে হয়। খাবি চল। হাত, মুখ ধুয়ে নে।

ইন্দ্রাণীর এতক্ষণ ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করছিল। এই বুঝি ধরা পড়ে গেল। অথচ সে তো কিছু করেনি। তবুও কোথাও যেন সে দিদিমণিকে ফাঁকি দিচ্ছে। অপরাধ বোধের বিষণ্নতা তাকে সহজ হতে

দিচ্ছে না। বড় হতে গেলে না চাইলেও বোধহয় আপনা আপনিই আড়াল এসে যায়। ইন্দ্রাণীর ভালো লাগে না। সকালের নরম আলোটা ইন্দ্রাণীর চোখের সামনে আস্তে আস্তে হলুদ হয়ে আসছে তারপর ক্রমশ ধূসর হতে হতে গাঢ় কালো হয়ে ঢাকা পড়বে।

ইন্দ্রাণীরা যখন আসছিল তখনও রোদ পিঠ বিছিয়ে রেখেছে বড় বড় গাছের মাথায়। কখনও খোলা মাঠের উদোম ধানের উপর। শরৎ যাবো যাবো করছে। রোদের তেজ সুন্দরী নারীর অস্তমিত যৌবনের মতো। এরও আলাদা সৌন্দর্য মনকে নিয়ে যায় আলাদা এক জগতে। সাদা আর বেগুনী ডুরি শাড়ি পরে ওদের পিছে পিছে যে বৌটি যাচ্ছিল দিদিমণি তাকে বললো, কাল একবার আসিস দামিনী। বৌটি মিষ্টি করে হেসে মাথা নাড়লো। তার গজ দাঁতের হাসিতে ইন্দ্রণীর মন ভালো হয়ে গেল।

ইন্দ্রাণীর ইচ্ছে করছিল এই চলার রাস্তা যদি না ফুরাতো। অনন্তকাল যদি সে হাঁটত এই পথে।

 

ছন্দা দাশ 
ছন্দা দাশ
%d bloggers like this: