চন্দনের গন্ধ/ আফরোজা অদিতি

চন্দনের গন্ধ 14,15

চন্দনের গন্ধ/ আফরোজা অদিতি

পর্ব ১০

 

সকালের প্রশান্ত হাওয়ায় বারান্দায় বসে চা খেল চুপচাপ। উঠানের এককোণে দুটি শালিক মুখোমুখি। একের ঠোঁটে মাঝেমাঝে আর একের ঠোঁট মিলছে। এই প্রকৃতিতে ওরা খুব সুখি। শালিক দুটির দিকে তাকিয়ে হাসলো তিসু। তিমিরকে ডেকে দেখাল।

বলল, ‘ কাছে এস, কানে কানে কথা বলি একটা।’

‘বল।’ তিমির দুষ্টুমি করে মাথা এগিয়ে দেয়। ‘বল, বল গো সখি বল।’

‘তুমি বাবা হবে গো প্রাণনাথ; এই কথা শুনে কেমন লাগছে?’ তিসু কানে কানে ফিসফিস করে বলে।

‘আগে তুমি বল। তোমার মা হতে পেরে কেমন লাগছে?’ তিমিরের কথা শুনে লজ্জায় রাঙা হয়ে যায় তিসু।

‘ভালো লাগছে। কিন্তু…।’ কথা শেষ করে না তিসু।

‘আবার কিন্তু কেন?’

‘না, কিছু না। তোমার কথা বল।’ বলে তিসু তাকিয়ে থাকে স্বামীর মুখের দিকে।

‘আমার খুব আনন্দ হচ্ছে! কী আনন্দ যে আমার এই ঘরের বাতাসে ছড়িয়ে আছে তা বলে বোঝাতে পারব না তোমাকে! আমার মনে হচ্ছে নিউমার্কেট, গাউসিয়া, মৌচাক, হকার্স, ফুটপাত যেখানে যত মার্কেট আছে সব খুঁজে যত ভালো কাপড়-জামা-খেলনা আছে সব কিনে

নিয়ে আসি।’ তিমির মনের আনন্দে কথা বলে চলে। আনন্দে ও খেয়ালই করে না তিসুর মুখে অন্যরকম এক বিষণ্নতা খেলা করছে। আনন্দ উজ্জ্বল এক শরতের আকাশে একখন্ড কালো মেঘের ছায়া তাড়িত করছে তিসুকে!

তিসুর পাঁচমাস চলছে। ডাক্তার বলেছে ওর শরীরে কোন অসুবিধা নেই। চারমাস পর্যন্ত খুব ভয়ে ভয়ে ছিল তিমির আর বাড়ির সকলে। তিসুকে এই কয়মাস খুব চোখে চোখে রেখেছে তিমির আর মা। অফিসে যাওয়ার আগে মাকে বলে গিয়েছে যেন চোখে চোখে রাখে তিসুকে; ও যেন

কোনভাবেই লাইব্রেরিতে যেতে না পারে। এই কয়েকমাস বেশ ভালো চলছিল। নয়ন ছিল, দেখভাল নয়ন করেছে। কিন্তু নয়নের বিয়ের দিন স্থির হয়েছে কয়েক মাস আগে। তিসুর শরীর খারাপের জন্য

পিছিয়ে ছিল বিয়ে। এখন বিয়ের আয়োজন চলছে। শ্বশুরকে রাজী করাতে পারেনি তিসু। শাশুড়িকে বলেও কোন লাভ হয়নি। তিসুর শরীর ভালো ছিল। এই কয়েকমাস কোন অসুবিধা হয়নি।

নয়নের বিয়ের দিন ঘটল ঘটনা। শ্বশুরের পছন্দ করা পাত্রের সঙ্গেই কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল নয়ন। নয়ন চলে গেছে, তিসুর মন ভালো নেই; নয়নের জন্য কিছু করতে না পারার কষ্ট কিছুতেই তিসুর মন

থেকে যাচ্ছে না! ক্লান্ত তিমির বিছানায় গা এলিয়ে দিতে না দিতেই ঘুমিয়ে বেহুঁশ; একেবারে কাদার তাল! এখান থেকে ওখানে তুলে ফেললেও কোন সাড় পাওয়া যাবে না এমন অবস্থা।

কিন্তু ঘুম নেই তিসুর চোখে। কষ্টে থাকলে ঘুম আসে না! ঘুম না আসলেই চন্দনের গন্ধ আর বাঁশির সুর শুনতে পায়। এখনও পাচ্ছে! মন কেমন করা চন্দনের মিষ্টি গন্ধ আর বাঁশির একটানা সুরের ইন্দ্রজালে পায়ে পায়ে লাইব্রেরির দিকে এগিয়ে যায় তিসু। সেদিনের পর থেকে আর লাইব্রেরিতে আসেনি, আসতে পারেনি তিসু। অনেকদিন পরে এল লাইব্রেরিতে! ঘরে ঢুকে পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ায় দেয়ালের ঐ ছবিটির সামনে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে।

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে তিসুকে না পেয়ে ওয়াসরূমে গেছে ভেবে ওর জন্য অপেক্ষা করে তিমির। কিন্তু  প্রায় ১৫ মিনিট পার হয়ে যায় আসছে না দেখে ওর খোঁজে লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখে কাঁদছে তিসু! তিমির ভাবল, নয়নের জন্য ওর মন খারাপ। ওরা তো দুইজন হরিহর আত্মা ছিল। তিমির এগিয়ে যায়। জিজ্ঞেস করে, ‘কাঁদছ কেন? কাঁদে না সোনা।’ বলে ওর কাঁদে হাত দিতেই চেতনা হারিয়ে ওর হাতে ওপর এলিয়ে পড়ে তিসু। ওকে তুলে চেয়ারে বসিয়ে তিমির ডাকে মাকে। তিসুর চেতনা তাড়াতাড়িই ফিরে আসে আজ। কিন্তু চেতনা ফিরলেও গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় তিসু।

মাকে আজকের ঘটনাসহ সব ঘটনা খুলে বলে তিমির। মা খুব চিন্তিত হয়। বলে, ‘এসব কথা আগে বলিসনি কেন?’

‘ভেবেছি ঠিক হয়ে যাবে মা। কিন্তু দিন দিন বেড়েই চলছে।’

‘থাক আর চিন্তা করিস না। দেখি কী করতে পারি। ওকে ঘরে নিয়ে যা।’ মা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে আসে।

পরদিন শাশুড়ির দেয়া তাবিজ তিসুর গলায় শোভা পায়। দ্বিধা করেনি কোন! বাঁকি কয়েকমাস ভালো গেল, কোন অসুবিধা হলো না! অসুবিধা কিছু ঘটলো না তা তাবিজের গুনে নাকি তিসুর ইচ্ছার ফলে তা তিসু ছাড়া আর কেউ জানে না, জানতে পারলো না! বাড়ির সকলে খুশি

যে কোন অঘটন আর ঘটছে না, এই তাবিজের গুনেই! তিসুর একটি মেয়ে হলো। সকলে খুব খুশি। কিন্তু মেয়ের যখন নাম রাখা হলো তখন কেউ খুশি হতে পারলো না। তিসু মেয়েকে প্রথমদিন কোলে নিয়েই ওর নাম রাখলো উর্মি। এই নাম রাখা নিয়ে একচোট কথা কাটাকাটি

হয়ে গেল স্বামীর সঙ্গে। তিসু স্বামীকে বলল, ‘দেখ উর্মি রেখেছি তোমাদের কথা মনে করে, নাহলে আমি তো কৃষ্ণা রাখতাম।’ তিমির এই কথা শুনে রেগে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তারপর থেকে

কথা বন্ধ করেছিল সাতদিন। শাশুড়িও মুখ ভার করে ছিল, ঠিক কথা বন্ধ করেনি আবার কথা বলেওনি।

একদিন সকালে তিসু মেয়ের কাপড় রোদে শুকাতে দিচ্ছিল আর শ্বশুর নাতনি কোলে রোদে বসেছিল।

শাশুড়ি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে স্বামীকে দিয়ে নাতনিকে বারান্দাতে শুইয়ে দিয়ে কাছে বসে থাকে। স্বামী-স্ত্রী টুকটাক কথা বলছে। একসময় তিসুর শাশুড়ি ওর শ্বশুরকে বলে, ‘বল তো কেন ওর নাম উর্মি রাখল। একটা ইসলামি নাম রাখবে তা না কোথা থেকে বেছে বেছে একখান

হিন্দুয়ানি নাম রাখছে।’

‘আহা, নামে কী আসে যায় বল তো। তাছাড়া ওর মেয়ে ওর পছন্দের নাম রেখেছে তাতে কি এল গেল।’

 শ্বশুরের কথায় শাশুড়ি কান্নাভেজা কন্ঠে বলে,‘মেয়ে কি ওর একার, আমাদের কেউ না।’

‘নাতনি হয়েছে, খুশি থাকবে তোমরা তা না নাম নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করতে বসেছ! নামে কী আসে যায় বল তো।’

‘কী জানি বাপু। ওসব বুঝি-টুঝি না।’ তিসুর শাশুড়ি মুখ ঝামটা দেয়।

‘দেখ তুমি আবার কী শুরু বরলে বল তো। তুমি তো কাজ ছাড়া থাক না তবু এত কথা তোমার মাথায় ঘুরপাক খায় কি করে, বুঝি না বাপু। সংসারে প্রথম মেয়ে হলো লক্ষী! আমাদের সংসারে মেয়ে হয়েছে মানে লক্ষী এসেছে। এসব নিয়ে আর কথা বল না। কখন মেয়েটা শুনবে, কষ্ট পাবে।’

বাবা আর কোন কথা বলে না।

সেই দিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরে তিসুর হাতে একটা লিস্ট ধরিয়ে দেয় তিমির।

‘এটা কি?’

‘খুলে দেখ। দেখলেই বুঝতে পারবে!’ তিসু কাগজের ভাঁজ খুলে দেখে মেয়েদের নামের লিস্ট। প্রায় ৫০ টা নাম আছে লেখা তাতে। তিসু নামগুলো পড়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।

‘এটা তো দেখি মেয়েদের নাম। এটা দিয়ে কী হবে?’

‘এটা থেকে বেছে একটা নাম রাখ।’ কাটকাট কথা বলে তিমির।

‘নাম তো রেখেছি, আবার কেন?’

‘ঐ নাম আমার পছন্দ নয়! আমার পছন্দ মতো নাম রাখ।’

‘কেন পছন্দ নয় আমার দেয়া নাম তাই! তাহলে, তুমি রাখ।’ তিসু রাগ না করে হেসে হেসে বলে।

‘তুমি মাইন্ড করো না। সে জন্য নয়।’

‘তা হলে আপত্তি কেন?’

‘ঐ নামটাতে ইসলামী নামের চিহ্ন নেই তাই।’

‘নামের আবার হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান চিহ্ন থাকে নাকি। যে নামে ডাকতে সুবিধা,মিষ্টি লাগে শুনতে, একটু ছোট হয় সেই নামই রাখা দরকার। তাছাড়া, আকিকা দিয়ে ইসলামী নাম রেখে দিয়ো।’

তিসুর এই কথায় তিমির চিৎকার করে ওঠে। রাগ করে। বলে, ‘তাহলে তুমি নাম পাল্টাবে না।’

‘না’। ছোটো করে উত্তর দিয়ে স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তিসু। তিমির কিছু না বলে মুখ নিচু করে বসে থাকে।

সেই থেকে দুজনের মাঝে একটা শক্ত দেয়াল উঠে আছে। উর্মির বয়স এখন দুই বছর। এই দুই বছরে সেদিনের সেই দেয়াল আরো শক্ত-মজবুত হয়েছে। তিসু এখন খুব কম কথা বলে। রাগারাগি করে না। যদি কোন কিছু বলে তিমির তার উত্তরও ঠান্ডা কথাতেই দেয় তিসু। তিমির এই দুই বছর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করেছে তিসুর আচরণ স্বাভাবিক তবুও কোথায় যেন অস্বাভাবিকতা লুকিয়ে আছে, যেটা হাজারলক্ষ বার চেষ্টা করেও ধরতে পারছে না তিসু!

আফরোজা অদিতি
আফরোজা অদিতি
%d bloggers like this: