কৌতুকপ্রিয় নজরুল / রক্তবীজ ডেস্ক

কৌতুকপ্রিয় নজরুল / রক্তবীজ ডেস্ক

কাজী নজরুল ইসলাম যেমন শিশুর মতো সরল ছিলেন, হো হো করে হাসতেন, তেমনই ছিলেন কৌতুকপ্রিয়।  কৌতুক করতে ভালোবাসতেন। মজার মজার কথা বলতেন। বিভিন্ন আড্ডা, আসর ও আত্মীয় স্বজনের মধ্যে তিনি মজার মজার কথা, কৌতুক বলতেন। আর সবাই তা উপলব্ধি করত।  নজরুলের বলা  তেমনই কিছু মজার কথা উপস্থাপন করা হলো নজরুলের জন্মতিথি উপলক্ষে।

লাখ পেয়ালা চা

নজরুলের বন্ধু শৈলজা ও শৈলেন কথা বলছিলেন কবির শূন্য পকেট অথচ শিশুর মতো সরল মন নিয়ে। সেসব শুনে নজরুল হাসতে হাসতে শৈলেনকে বললেন, ‘তুমি অনেক টাকাই পাবে আমার কাছে, হিসাব করে রেখো। তার আগে দু পেয়ালা চা দাও দেখি।’

শৈলেন অবাক কণ্ঠে বললেন, ‘দু পেয়ালা কেন?’

‘চালাক হতে আমার এখনো দু পেয়ালা বাকি।’ নজরুল আগের মতোই হেসে জবাব দিলেন, ‘লাখ পেয়ালা চা না হলে তো আর চালাক (চা-লাখ) হওয়া যায় না।’

তেঁতুলগাছে দই

কাজী নজরুল ইসলাম খেতে বসেছেন। খাবারের শেষে কবির পাতে সিরাজগঞ্জের বিখ্যাত দই পরিবেশন করা হলো। কবি একটুখানি মুখে দিয়েই অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে পরিবেশকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এটা কী?’

পরিবেশনকারী বলল, ‘দই। খেয়ে দেখেন, খুব ভালো।’

কবি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘ভালো দই কি এখানে তেঁতুলগাছে ধরে?’

‘না, তা হবে কেন?’

‘তার মানে তুমি তেঁতুলগাছ থেকে দই পেড়ে আনোনি?’ কবি বললেন, ‘তাহলে এত টক যে!’

গানের সঙ্গে পান

নজরুলের গানের জলসায় পান থাকবে না, তা হয় না। পান আর গান—এ যেন একে অপরের পরিপূরক। একদিন আসরে বসে গানের ফাঁকে চা-মুড়ি পর্ব সেরে নজরুল পান মুখে দিতে যাবেন, এমন সময় এক

ছোট্ট মেয়ে এসে মিষ্টি হেসে বলল, ‘তুমি এত

পান খাও কেন?’

নজরুল তার কথায় হো হো করে হেসে উঠে ততোধিক মিষ্টি স্বরে বললেন, ‘গান গাই যে!’

আমচোর

গ্রীষ্মের এক দুপুরে পরিবারের সঙ্গে নজরুল গরুর গাড়িতে শিকারপুর যাচ্ছেন। দূরের পথ। তার ওপর বেজায় গরম। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য এক আমবাগানে গাড়ি থামিয়ে সবাই নামলেন। বাগানের আমগুলোতে রং এসেছে দেখে নজরুলের খুব লোভ হলো। কিন্তু এক মহিলা বাগানটা পাহারা দিচ্ছেন। সেটা দেখে বুদ্ধি বের করলেন কবি। মহিলাকে মাসি পাতিয়ে তাঁর সঙ্গে জুড়ে দিলেন গল্প। কৌশলে জেনে নিলেন, তাঁর স্বামী বাগানের মালিকের বাড়িতে পাকা আম পৌঁছে দিতে গেছেন। শুনে নজরুল অবাক হয়ে বললেন, ‘মাসি, আমরা তো সেই বাড়ি থেকেই আসছি। কিন্তু সেখানে তো ও রকম কাউকে দেখলাম না! আমি ও বাড়ির বড়মিয়ার ছোট জামাইয়ের ভাই। আজ চলে যাচ্ছি। বড়মিয়া বললেন, বাগান দিয়ে গেলে আম নিয়ে যেয়ো। তাই তো থামলাম। আচ্ছা মাসি, কোন গাছের আম মিষ্টি বলো তো!’

নজরুলের বলতে দেরি কিন্তু আম পেতে দেরি হলো না। সেই মাসিই সব ব্যবস্থা করে দিলেন।

কত নিচে নামব

কাজী নজরুল তখন গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। একদিন তিনি ওখানে দোতলায় বসে আছেন। এমন সময় এক কমর্চারী এসে বললেন, ‘কাজীদা, ইন্দুদি (সংগীতশিল্পী ইন্দুবালা) আপনাকে নিচে ডাকছেন।’

এ কথা শুনে কবি সকৌতুকে বললেন, ‘আর কত নিচে নামব, ভাই?’

.

বিড়ালের কামড়

যমুনাপারের শহর সিরাজগঞ্জে নিখিলবঙ্গ মুসলিম সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম সম্মেলনের সভাপতি। কবিকে উপলক্ষ করে দুপুরে বাংলোতে খাবারদাবারের ব্যাপক আয়োজন করা হয়েছে। অতিথিরা সবাই খেতে বসেছেন। খাবার পরিবেশনকারী ছেলেটি কবিকে প্রথমে এক টুকরো ইলিশ দিলেন। প্রথম টুকরো শেষ হতেই দ্বিতীয় টুকরো তুলে দেওয়া হলো কবির পাতে। পদ্মার ইলিশ কবি খেতে লাগলেন পরম তৃপ্তিতে। এবার তৃতীয় টুকরো দেওয়ার জন্য ছেলেটি কাছে আসতেই কবি তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, ‘আরে, করছ কী? এত মাছ খেলে শেষকালে আমাকে বিড়ালে কামড়াবে যে!’

..

বড়কুটুম

সুফিয়া কামাল কাজী নজরুল ইসলামকে ডাকতেন দাদু বলে। কবি আবার প্রায়ই সুফিয়া কামালের বাড়ি যেতেন। সেখানে গানের আসর বসত। সে আসরে সাহিত্য অনুরাগী অনেকেই থাকতেন। এ সময় নজরুলের পেছনে গোয়েন্দা লাগে। তাঁদের সঙ্গে মিশে কয়েকজন গোয়েন্দাও আসতেন। একদিন এক ভদ্রলোকের মুখের ওপর নজরুল কবিতা আওড়ালেন, ‘তুমি টিকটিকি জানি ঠিকঠিকই।’

কবিতার ধরন শুনে লোকটি মুখ লাল করে উঠে যেতেই কিশোরী সুফিয়া কামাল অবাক হয়ে বললেন, ‘দাদু। তুমি একে চিনলে কী করে?’

‘গায়ের গন্ধে। বড়কুটুম যে।’ নজরুলের উত্তর।

সম্ভাষণ

কাজী নজরুল ইসলাম একবার ট্রেনে যাচ্ছিলেন। পাশে সমবয়সী এক ভদ্রলোক হঠাৎ তাঁর উদ্দেশে বললেন, ‘এই শালা, তোর কাছে দেশলাই আছে?’

অপরিচিত এক লোকের এমন সম্ভাষণে কবি প্রথমে চমকে উঠলেন, তারপর বিরক্ত। কিন্তু পরক্ষণেই পরিস্থিতি সামলে নিয়ে হেসে পকেট থেকে দেশলাইয়ের বাক্সটা তার মুখের ওপর ছুড়ে দিয়ে বললেন, ‘লে বে শালা।’

ইটের বদলে পাটকেল খেয়ে অপরিচিত ভদ্রলোক হো হো করে হেসে উঠে বললেন, ‘পরিচয়ের একটু পরেই আমরা এই সম্ভাষণেই পৌঁছাতাম। তাই অনেক ভেবে ওখান থেকেই শুরু করেছি। কী, ঠিক করিনি?’

অহল্যা উদ্ধার

সাহিত্যরসিক গজেন ঘোষের বাড়িতে প্রায়ই তুমুল আড্ডা হতো। সে আড্ডায় কাজী নজরুল ইসলামও শরিক হতেন। একদিন হঠাৎ করে বলা-কওয়া নেই, কবি টেবিলের ওপর থেকে বই, অপ্রয়োজনীয় পুরোনো ময়লা কাগজপত্র সরাতে লাগলেন। তাতে ধুলো উড়তে লাগল। কবির কাণ্ড দেখে ঘোষমশাই বিচলিত হলেন, ‘আরে, করছ কী?’

নজরুল গম্ভীরভাবে বললেন, ‘অহল্যা উদ্ধার করছি।’

‘অহল্যা উদ্ধার?’

‘হ্যাঁ, এর কোমল হৃদয় পাষাণ হয়ে গেছে,’ নজরুল বললেন, ‘এর রিডগুলো পর্যন্ত টিপলে নামে না। এই পাষাণীর মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করতেই হবে।’

আসলে টেবিলটি ছিল একটি অর্গ্যান।

( সংগৃহীত)

%d bloggers like this: