লেখক হয়ে ওঠার গল্প / /ড. শাহনাজ পারভীন

ড. শাহনাজ পারভীন

 

 

 নিজেকে আড়াল অথবা প্রকাশ,

 না বলা কথা সব বলতে

 কঠিন, সহজ কিংবা বন্ধুর 

 গহীন পথের দিকে চলতে…

 

  কেন লিখি, এ প্রশ্নের মুখোমুখি আজীবন, আমি আর আমরা সবাই। আমরা সবাই বলতে লিখিয়ে বন্ধুরা সব। যে কোন কথা প্রসঙ্গেই অনিবার্য প্রশ্নটা এসে যায় যেন? প্রশ্নটা শুনবার পরই ভাবতে বসি, নাকি প্রশ্নটা শুনবার আগেই ভাবনায় চলে আসে সে হিসেব মেলে না এখন। তবে ভাবছি দীর্ঘদিন, সে কথাটা মানি। পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ হচ্ছে নিজস্ব ভাবনার সাথে লেখাটা এগিয়ে নেয়া। শত চেষ্টা এবং সাধনায় লেখাটা তৈরি করা খুব সহজ বিষয় নয়। এ প্রসঙ্গে আঁদ্রে জিদ বলেছিলেন, ‘লিখি, কারণ, না লিখলে হাত ব্যথা করে।’ গার্সিয়া মার্কেজ বলেছিলেন, ‘লিখি, যাতে আমার বন্ধুরা আমাকে আরো একটু বেশি ভালবাসে।’ এর চেয়ে একটু গভীর ভাবে উত্তর দিয়েছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেছিলেন, লেখা ছাড়া অন্য কোন উপায়ে যেসব কথা জানানো যায় না সেই কথাগুলি জানাবার জন্য লিখি।’ আমাদের যাপিত জীবনে এমন অনেক ঘটে যাওয়া ঘটনা যা আমাদের মনোভূমিকে চিন্তামগ্ন করে বার বার মনোজগতকে ওলোট পালোট করে, খুব সহজেই তা থেকে আমরা মুক্তি পাই না। কখনো কখনো মনে হয়, এ ঘটনাটা অন্য আরো কাউকে জানানো দরকার, সেটাকে বাঁচিয়ে রেখে অন্য সকলকেও জানান দিতেই আমরা লেখার অক্ষরকেই বেছে নেই। অথবা যে ঘটনাটা মনের অজান্তেই একটা সুক্ষ্ম ঢেউ তুলল সেটাই হয়ত অনুরণণিত হয়ে হাজার প্রাণের দ্বারে দ্বারে কষাঘাত করুক-এই ভাবনা থেকেও লিখি। যদি ফারসী কবি ফেরদৌসী রচিত মহাকাব্য ‘শাহনামা’এবং তাঁর রচনার কারণ লৈখিক অক্ষরে লেখা না থাকত তাহলে আমরা ঐতিহাসিক এই ঘটনা রটনা এবং গযনীর সুলতান মাহমুদের নাম শতাব্দীর পর শতাব্দী জানতে পারতাম বলে সন্দেহ ছিল। 

   কখন লিখতে বসি? সংসার জীবনের হাজারো ঝামেলাকে মাথায় নিয়ে পথ চলতে হয় সারাক্ষণ। নিরন্তর নিজের সাথে যুদ্ধ করে চলি। কখনো বাঘ কখনো সিংহ কিংবা নেহায়েত কোন জাল কাটা ইঁদুরও সাজানো ভাবনাগুলোকে নস্যাৎ করে দেয় মুহূর্তেই। সাজানো বাগানগুলো তছনছ হয়ে যায় এক নিমিষে। জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ব্যক্তিত্ব এবং সমস্ত সৌন্দর্যকে মিশিয়ে দিতে চায় অহেতুক নিতান্ত মাটির ধুলোয়। বনের সিংহটা হঠাৎই বুনো ইঁদুরের কাছে নাকাল হয়ে ওঠে। তারপর? তারপর একদিন…দুইদিন…এক দুই  তিন। হাঁটি হাঁটি পা পা… বেজে ওঠে ঝনাৎ। লেখনির কলম যেন নড়ে চড়ে ওঠে…হুংকার ছাড়ে- গর্জন করে মুর্হুমূর্হু। হয়ত তাতে এ সমাজের বদলায় না কিছুই কিন্তু ভেতরটা তো শান্ত হয়। আবার হেসে ওঠা যায়। বদলায় না, তাই বা বলি কি করে? বদলায়ই তো। এই বদল করবার জন্যই তো লিখে যাওয়া। হেসে ওঠা। এই দু’হাত দিয়ে চোখ মুছে জীবনের স্রোতে নিজেকে নতুন করে মিশিয়ে ফেলবার নানামুখী প্রচেষ্টার জন্যই এই লিখে যাওয়া। জীবনের বহুমুখী ব্যাখ্যাকে সরল অংকের মত মিলিয়ে দেবার জন্যই এই নিরন্তর প্রচেষ্টা।

  

যাপিত জীবনের নানামুখী কান্না হাসির ফোয়ারা ফোটাতেই লেখক লিখে যান তার কথামালা। সে তার নিজের কথা লেখে তার দেখে যাওয়া অন্যের কথা লেখে। কারণ একজন কবি কি তার ব্যক্তিগত জীবন ছাড়া কিংবা তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছাড়া আদৌ কিছু লিখে যেতে পারেন? আমার তো মনে হয় তিনি সারা জীবন তার জীবন ঘনিষ্ঠ লেখাই লিখে যান। যদি এমনও হয় যে, তিনি কোন প্রাগৈতিহাসিক  বিষয় বা কাল নিয়ে লিখছেন, কিন্তু তখনও তাকে স্শরীরে তার দেখার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সেখানে উপস্থিত থেকেই লিখতে হয়। কারণ তার নিজস্ব অভিজ্ঞতা তার নিজস্ব চিন্তা চেতনা এবং জীবন দিয়েই উপলব্ধি করতে হয় এবং সত্যিকারের বাস্তব লেখা হচ্ছে তার উপর লেখকের সুনিপুণ অভিজ্ঞতা থাকা, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ এবং বিচার বিশ্লেষণ করা। এজন্যই আমরা দেখি, যে লেখকের জীবন যত বর্ণাঢ্য তার সাহিত্যকর্মও তত ঋদ্ধ। তাই লেখকের সত্যিকার সাহিত্য বুঝতে হলে তার জীবনকেও জানতে হবে বৈকি?

 

   ফরিদপুর জেলার শেষ প্রান্তে কামারখালীর মধুমতির তীরে বেড়ে ওঠা। মধুমতির স্বচ্ছ জল দীর্ঘ বালুচর আমাকে টানতো। অবারিত স্বচ্ছ আকাশ নদীর নীল জলে মিশে যাওয়া নিজেকে কখন যেন কবি হতে সাহায্য করে। শৈশবে মায়ের মৃত্যুর কারণে জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখবার সুযোগ হয়েছে। লেখক হয়ে ওঠার আর একটি  কারণ হল ছোটবেলায় চোখের সামনে ঘটে যাওয়া মায়ের মৃত্যু। কারণ এটি এমন একটা সাবজেক্ট যা পৃথিবীর কারো সাথেই শেয়ার করে শান্তি পাওয়া যেত না। বুকের মধ্যে পুষে রাখা আগুন একসময় দেখলাম কলমের ডগা দিয়ে বের হলেই শান্তি, স্বস্তি। পৃথিবীর অন্য কোন কিছু যা আমাকে শান্ত করতে পারত না, তা শুধু পারত আমার লেখা আমার পড়া। যতটুকু সময় লেখার মধ্যে পড়ার মধ্যে ডুবে থাকতাম ততটুকু সময় ভুলে থাকতাম, ভালো থাকতাম। তাই বলব মায়ের মৃত্যুই আমাকে পড়িয়ে বানিয়েছে, লেখিয়ে বানিয়েছে। অবশ্য পড়ার অভ্যাসটা গড়ে দিয়েছিলেন মাই। মায়ের মুখে জল পড়ে পাতা নড়ে, আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি, থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে দেখবো এবার জগৎটাকে, আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে ইত্যাদি ছড়াগুলোর মনোমুগ্ধ আবৃত্তি শুনতে শুনতে ভালবেসে ফেলেছিলাম অন্য ছড়াগুলোকেও। সাত ভাই চম্পা, ডালিম কুমারের গল্পে কেমন সত্যি সত্যি ঘোড়ায় ছুটতাম টগবগ টগবগ। খোলা তালোয়ার হাতে দেখতে পাচ্ছি সমস্ত দৈত্যকে কিভাবে কচুকাটা করে ঘুমন্ত রাজকুমারিকে জিয়ন কাঠির ছোঁয়ায় তাকে বাঁচিয়ে তুলে উদ্ধার করছে।  একটি সময় তৈরি হলো যখন আর মায়ের কাজের ফাঁকের ঐ ছড়াগুলো আমার তৃপ্তি মেটাতে পারত না তখন নিজে নিজেই পড়া শুরু করি মায়ের নিজস্ব লাইব্রেরী থেকে। 

 

   এক ফাঁকে বলে রাখি আমার মা ও ছিলেন স্বভাব কবি। তিনি নিজে নিজেই ছড়া আওড়াতেন লিখতেন, প্রচুর পড়তেন। ঘুম পাড়াতে যেয়ে তাঁর কত কবিতায় সুর হয়ে আমাদের ঘুম পাড়িয়ে দিত। সব মিলিয়ে বাসায় একটি কবি কবি আবহাওয়া বিরাজ করত সব সময়। তার কাছ থেকেই এই পাঠের রাজ্যের চাবি পেয়েছি, উৎসাহ পেয়েছি। 

  কবি ফররূখ আহমদ ছিলেন আমার মামা। সেজো চাচী আম্মার ভাই। চাচীআম্মা এবং আম্মার কাছে খুব ছোট বেলা থেকেই কবি মামার গল্প শুনেছি অনেক, তার লেখা ছড়া কবিতা বইয়ের পাতায় পড়ছি এবং ফররুখ মামার ছোট ভাই মুকুট মামার কাছে বাসায় প্রাইভেট পড়ছি, মামার কাছে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কবি মামার গল্প শুনছি আর কখন যেন মনের অজান্তেই মনের মধ্যে মিলকরণের দরজা খুলছি।  পরবর্তীতে বড় ভাই, শিক্ষক মামী, এবং বিয়ের পরে হাজব্যান্ড আমাকে উৎসাহ উদ্দীপনা দিয়েছেন।        

 

 আসলে সাহিত্য আর সমাজ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সাহিত্য সমাজের কথা বলে। সাহিত্য সমাজের দর্পণ। যা দেখি তা তো এ সমাজেরই, যা লিখি তাও তো এখান থেকেই আসে। যে কোন মৌলিক লেখকের কাছে তার লেখাটাই গুরুত্বপূর্ণ। সে লেখনিতে মায়া এবং মাধুর্যের পাশাপাশি দায়বদ্ধতাও থাকতে হবে। সামাজিক সমস্যা এবং তার সমাধানও আশা করতে পারেন একজন পাঠক। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে প্রতিটি লেখনির মধ্যে শেকড়ের টান, সামাজিকতা, ঘনীভূত রহস্য এবং এক ধরনের স্বর্গীয় আনন্দনানুভূতি থাকাটা খুবই জরুরী। এই বিষয়টাই সাহিত্যের সাথে পাঠককে আটকে রাখে চিরকাল।  

 

অনেকে বলেন, মানুষ ভাবে এক আর হয় আর এক। এটা হয়ত কখনো কখনো ঠিক হয়, কখনো হয় না। তো খুব ছোটবেলা থেকে আমি যে স্বপ্ন দেখেছি আমি তা হতে পেরেছি। মনে পড়ে খুব ছোটবেলায় নিজে নিজে ঘরে দরজা দিয়ে টিচার সাজতাম। বড় দিদিমনির মত কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হাতে বেত নিয়ে সামনে কল্পিত এক দঙ্গল ছাত্র বানিয়ে তাদেরকে পড়া মুখস্ত করাতাম, শাসন করতাম, আদর করতাম। এখনো এই সুখস্মৃতিটুকু মনে এলেই অনেক মজা পাই, হাসি। এর একটি কারণ ছিল। আমার পাশের বাড়ির রহিমা আপা গার্লস স্কুলের টিচার ছিলেন। যখন আমি প্রাইমারীর ছাত্রী তখন রোজ আপার স্কুলে যাবার সময়টাতে আমার ঘরের দক্ষিণ পাশে রাস্তার দিকের জানালাটা খুলে দিতাম। দেখতাম রোজ রহিমা আপা মাড় দেওয়া কড়কড়ে স্ত্রি করা শাড়ি পরে মুখে বিজয়ের হাসি ঝুলিয়ে চমৎকার একটা গাম্ভীর্যে ধীর লয়ে একটা মৃদৃ মন্দ ছন্দের তালে স্কুলে যাচ্ছেন। কি যে ভাল লাগত আমার। আপার ছোট বেলার একটা ডাক নাম ছিল (দুলু) সেটি তখন আর আমার মাথায় আসত না। তখন তাকে গার্লস স্কুলের রহিমা আপাই মনে হত। কিছুপরে যখন হাই সেকশানে আপার ছাত্রী হলাম তখন ক্লাসে আপার মুখের প্রমিত ভাষা এবং সভ্য ব্যবহার আমাকে আকৃষ্ট করল। আপা আমার ভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলেন। আমি রাত দিন তার মত হতে চাই। সেটি পরিপূর্ণ হল যখন আমরা বাসায় শীতের রৌদ্রেও আপার সামনে চেয়ারে বসতাম না। এটা আমি বড় আপাদের কাছ থেকে শিখেছিলাম। তারাও আপার ছাত্রী ছিল। এই ছাত্রী এবং শিক্ষক যোজন যোজন ব্যবধানÑ এই অনুভূতিগুলো আসলে কখনো লেখা হইনি। এইসব সু²াতিসু² অনুভ’তিগুলো কখন যেন চিন্তার রাজ্যের পটভ’মিতে দাঁড়িয়ে আমাকে টিচার হবার অনুপ্রেরণা জাগিয়ে দিয়েছিল। আরো কত স্বপ্নই হয়তো পুরণ হয় নি। কিন্তু যেটুকু হয়েছে সেইটুকুও কম কিছু নয়। তবে আমি অবশ্যই এ নিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি না। 

 

ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন সময়ে বিয়ে হয়ে যায় যশোর জেলা বারান্দীপাড়ায়। অন্য জেলা, অন্য সংস্কৃতি, রক্ষণশীল পরিবারের বড় বউ। নানান অসঙ্গতির সাথে রাত দিন মেলবন্ধনের অক্লান্ত চেষ্টা। ঐ সময় আমি গভীর ভাবে উপলব্ধি করি রক্ষণশীল পরিবারের পুত্রবধু হয়ে লেখাপড়া চালানোর সংগ্রাম সহ্য করে লেখালেখি কি সম্ভব? তাই আমাকে এখন যে কোন একটি বিষয় বেছে নিতে হবে। পরিবারের বড় বউ হিসেবে সংসারের দায়িত্ব ছিল আমার উপর। এই অবস্থায় লেখাপড়া লেখালেখি সংসার স্বামী সন্তান সাহিত্য চর্চা এক সাথে সম্ভব নয়। অথচ লেখাটা শুরু করেছিলাম চতুর্থ শ্রেণি থেকেই। এর মধ্যেই টুকরো টুকরো কিছু লেখা ছাপা হলে তার চাপ আমার জন্য সহনশীল ছিল না। বাধ্য হয়ে ঐ একমাত্র বিলাসিতা ডায়েরীর কাছে আত্মসমর্পন করিÑ ‘যদি কখনো লেখাপড়া শেষ করে শক্ত ভিতের উপর দাড়াতে পারি তো লিখব তখন।’ কাব্যিক যন্ত্রণা প্রসব বেদনার চেয়েও অধিক কষ্টের। এই যন্ত্রণাময় কষ্টকে স্বীকার করে আমি আমার চ্যালেঞ্জ ঠিক রেখেছি, কথা রেখেছি। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ দশ বছর আমি লিখিনি। ডায়েরিটা সযতেœ আগলে রেখেছি, অবসরে খুলে পড়েছি আর নিজেকে প্রস্তুত করেছি। নির্ধারিত পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি নানামুখী পড়াশুনায় নিজেকে ব্যস্ত  রেখেছি। এরই মধ্যে দুটি মেয়ের জন্ম আমাকে মায়ের মৃত্যূর কথা তার অনুপস্থিতির কথা কিছুটা হলেও ভুলিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করে ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর যখন প্রথম নওয়াপাড়া মহিলা কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করি, সেদিন বিকেলেই লিখলামÑ‘যা খুশি তাই করতে পারি’ শিরোনামের কবিতাটি। 

প্রথমে ছড়া কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু হলেও এক সময় দেখলাম গভীর জীবনবোধ, মননশীল চিন্তাধারা, দেশপ্রেম, সামাজিক দায়বদ্ধতা, মানবিক চাহিদার সাথে সাথে অনেক কথাই কবিতায় বলা যায় না। কবিতা এসব নীতিকথা শ্লোগান কল্পনাশ্রয়ী বাস্তব জীবনবোধ এড়িয়ে চলে। তার জন্য চাই বৃহত্তর পটভ’মি, তাই হৃদয়ের কথা জীবনের কথা উন্মুক্তভাবে বলবার জন্য গল্প এবং এক সময় দেখলাম ছোট গল্পেরও একটা সীমারেখা আছে, সীমাবদ্ধতা আছে। তখন বেছে নিলাম উপন্যাসের বিশাল প্লাটফর্ম, প্রবন্ধের সত্যাশ্রয়ী পটভূমি, দায়বদ্ধতা। সবশেষে গবেষণার মত ঋদ্ধ দার্শনিক চুলচেরা বিশ্লেষণাত্মক লেখালেখিতেও নিজেকে সম্পৃক্ত করেছি। তবে জানি না, সত্যিকারের একজন লেখক হয়ে ওঠার মত যোগ্যতা অর্জন করেছি কিনা?

এখনো কে আমাকে তাড়া করে ফেরে জীবনের শ্রেষ্ঠ লেখাটি লিখে নেবার জন্য। আমার নির্বাচিত কবিতা থেকে অনেকেই আমাকে পাঠ করে শোনায়, আমার উপন্যাাস ‘সুখপাখিদের হসপিটাল’ যেটাকে অটোবায়োগ্রাফিক্যালও বলতে পারেনÑসেখান থেকে কিংবা  শাহনাজ পারভীনের ত্রয়ী উপন্যাস থেকে প্রায়ই উদ্বৃতি শুনতে পাইÑ ‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’ অথচ শাহনাজ আপনি কিভাবে এত কঠিন কথা এত সহজে বলে ফেলেছেন? স্যালুট আপনাকে ইত্যাদি… ইত্যাদি।

 

 সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে দৈনিক পাতার কলামগুলো কখনো কখনো পাঠকের হৃদয় ছুয়ে গেলে তাদের কাছ থেকেও প্রতিক্রিয়ায় ধন্য হই। তারপরও মনে হয় কিছুই হলো না আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না। তাই আমি নিরন্তর কি যেন খুঁজে বেড়াই কি যেন হাতরাই। কে যেন আমাকে তাড়া করে ফেরে। জানি না, তার সন্ধান পাব কি পাব না। কিশোরীদের জন্য বড় কিছু করবার পরিকল্পনা রয়েছে দীর্ঘদিন। কারণ বর্তমান সমাজে তারা বড় নিগৃহীত, তারা বড় অসহায়। ঘর থেকেই তাদের প্রব না শুরু হয়, শিক্ষক, অভিভাবক, আত্মীয়, অনাত্মীয় কারো কাছেই তারা নিরাপদ নয়। তাদের নিয়ে কিছু কাজ করছি, করব আগামীতেও। লিখতে চাই নারীদেরকে নিয়েও। কারণ এ সমাজ তাদেরকেও স্বস্তি দেয় না, শান্তি দেয় না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যখন তারা বিজয়ী হয় তখন হেরে যাওয়া এ সমাজ তাদের শাড়ির আঁচল ধরে টানতে চায়। আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলিÑ নদী দিয়ে মরাও ভেসে যায় রণতরীও ভেসে যায়। তাতে নদীর কিছু যায় আসে না। নদী নদীই থাকে। লিখব তাদেরকে নিয়েও। লিখব সমাজকে নিয়ে। এই ঘুনে ধরা সমাজটা ফুলে ভরা সমাজে ভাসাতে চাই, হাসাতে চাই। ভালো থাকতে চাই, ভালো রাখতে চাই।  

 

পৃথিবীটা অনেক সুন্দর এবং একই সাথে একটি চরম অসুন্দর বিষাদময় জায়গা। যারা জয় করতে পারেন, আর যারা জয় করতে পারেন নাÑ বিভাজনটা ওখানেই।  নিজস্ব ভূবন তৈরি করতে হবে। ঘড়ি ধরে রুটিন তৈরি করে সময়টা কাজে লাগাতে হবে।  যে সময়টা যাচ্ছে সেটা একেবারেই যাচ্ছে। ওকে আর ফিরে পাব না কখনোই। অতএব তাকে সুতোয় গাঁথতে হবে, ধারণ করতে হবে। হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না কিছুতেই। তাই বলি, জীবনের নানামুখী যন্ত্রণার সফল পরিসমাপ্তি ঘটানোর জন্যই হয়ত বা অন্য কিছু না হয়ে শেষ পর্যন্ত লেখক হয়েছি এবং প্রসব বেদনার চেয়েও অধিক কষ্টের কাব্যিক যন্ত্রণাকে সভ্যভাবে প্রশমনের জন্য আমাকে লিখতেই হয়, লিখে যেতে হচ্ছে।

%d bloggers like this: