আমেনার ছেলে/ আফরোজা পারভীন 

আফরোজা পারভীন

আফরোজা পারভীন

আমেনা বেগমের বুকে বড় ব্যথা । ব্যথায় মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। ডাক্তার দেখিয়েছে । ওষুধের পাশাপাশি ডাক্তার বলেছে, আসল দরকার বুকের দুধ গেলে গেলে বের করে দেয়া। এশবার যদি দুধ জমাট হয়ে যায় তাহলে আর রক্ষা নেই। আমেনা বেগম সেই চেষ্টাই করছে।দুধ গেলে চামচ ভরে ভরে ফেলছে। তা দুধ গেলে বের করা কি চাট্টিখানি কথা। যা কষ্ট হয় তা বলার নয়। এদিকে শরীরে কষ্ট, অন্যদিকে মনে কষ্ট পায় আমেনা বেগম।  এদেশের কতো শিশু মায়ের দুধ না পেয়ে অপুষ্টিতে ভুগছে । আর তার বুকের এমন তরতাজা দুধ ফেলে দিতে হচ্ছে। লাগছে না কোন বাচ্চার কাজে। আজকালের মায়েদের বুকে দুধ তেমন আসেনা। প্রসবকালীন জটিলতার জন্য অনেক মায়ের দুধ নামে না। আবার অনেক মা ফিগার নষ্ট হবার ভয়ে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ায় না। এদিক দিয়ে আজকালের বাচ্চারা বড় হতভাগা। আগের দিনের বাচ্চারা গালে দাঁত ওাার পরও মায়ের দুধ টানতো। দাঁত লেগে বুকে ব্যথা পেতেন। তারপরও বাচ্চাকে দুধ দিতে কার্পণ্য করতেন না। কিন্তু এখনকার মায়েদের বাচ্চা আছে, দুধ নেই। আমেনা বেগমের অঢেল দুধ আছে,বাচ্চা নেই।  

বিয়ের বছর সাতেক পরও যখন বাচ্চা  এলোনা তখন স্বামীর বিয়ে করার জন্য সেকী উৎসাহ। স্বামীর অতি আগ্রহে বাতাস দিয়েছিল শ্বশুর বাড়ির লোকেরা। ফলে আকাক্সক্ষার আগুন জ্বলেছিল দাউ দাউ দাউ দাউ । বাড়িতে ঘটকের আমদানি বেড়েছিল । বাড়িতে বসেই স্বামীর বিয়ের এই তোড়জোড় সইতে হতো আমেনাকে। আর বুকের মাঝে যে দুঃখের দরিয়া ডাক পাড়তো তা বুকেই চেপে রাখতে হতো ,  কান পেতে শুনতে হতো বিয়ে সম্পর্কিত সব আলাপ। কিন্তু স্বামীকেই বা সে দোষ দেবে কি করে। সাত সাতটা বছর তো সে দেখেছে। সাত বছর কি কম সময় । তখন মনের কষ্টে হয়তো পাগল  হয়ে  যেত আমেনা বেগম যদি হাসপাতালে এই নার্সের চাকরিটা না থাকতো। তখন সে চেষ্টা করতো যতো বেশি সময় সম্ভব বাড়ির বাইরে থাকতে । এর মধ্যে হঠাৎ করেই তার মিনস বন্ধ  হল, শুরু হল বমি। পেগনেন্সি টেস্টের রিপোর্ট পজেটিভ আসায় আনন্দে পাগল হয়ে গেল আমেনা। আল্লাহ বুঝি মানুষকে এভাবেই সাহায্য করেন।  স্বামীর বিয়ের দিন তারিখ পাকা। এক ফুৎকারে বিয়ের দিন তারিখ উড়িয়ে  দিলেন স্বামী। স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরলেন গভীর মমতায। তার পর তার জন্য প্রতীক্ষার পালা। এবং প্রতীক্ষার এই সময়টা যেন পাথরের ভার। নড়ানো যায়না, সরানো যায়না। অবশেষে সব প্রতীক্ষার শেষ হল । সে এল। স্বামীর আনন্দ দেখে কে। আমেনার শরীরটা যেন  তুলোর বল। সেই  ছোট্ট শরীরটাকে নিয়ে স্বামীর সেকী মাতামাতি। কিন্তু মাত্র দিন কয়েকের ব্যাপার । একসকালে আমেনার কোরেল উপরই মারা গেল শিশুটা। প্রসবকালে কী সব জটিলতা হয়েছিল। মাথায় চোট লেগেছিল নিদারুণ ।  যে কদিন বেঁচে ছিল ধুঁকে ধুঁকেই বেঁচে ছিল। তারপর হঠাৎ করেই সব শেষ হয়ে গেল। আর সেই সাথে শেষ হয়ে গেল আমেনার সব স্বপ্ন্ । মা হয়েও মা ডাক শুনতে পেলনা সে । স্বামীও ফিরে  এলো স্বমূর্তিতে। শ্বশুর বাড়ির লোকের নিত্য কটুক্তির মাঝে দুঃসহ হয়ে উঠল আমেনার জীবন।  বাচ্চা মারা যাবার পর পনের দিনও সময় দিলোনা স্বামী। ঢাক ঢোল পিটিয়ে বিয়ে করে ঘরে তুলল সতীন। যে শয্যা ছিল তার আর স্বামীর  সেই শয্যাতেই  জায়গা হল নতুন বৌএর। আমেনার জন্য বরাদ্দ হল পাশের একটা ঘর। আমেনার আঁচলের চাবি তাৎক্ষণিকভাবে স্থানাšতরিত হলো  নতুন বৌএর আঁচলে । আর সেই রাতেই ঘর ছাড়ল আমেনা। লুকিয়ে নয়। স্বামীকে বলল, এক বাড়িতে দুই বউ থাকলে ভাল দেখায় না, নানান অশান্তি হতে পারে । তার থেকে আমি হোস্টেলে চলে যাই। স্বামী যেন স্বস্তিতর শ্বাস ফেলল । সব চেয়ে বেশি আনন্দ ফুটে উঠল নতুন বৌ-এর মুখে। 

সেই থেকে এই নার্সেস হোস্টেলেই বসবাস আমেনার। কিন্তু শরীরটা তার মোটেও ভাল  যাচ্ছেনা।বুকে হড় হুড়  করে দুধ নামছে দিনরাত । টিপে বাটি ভরে ভরে ফেলছে আমেনা । কিন্তু যতো ফেলে ততোই যেন বাড়ে।বুকের দুধের কষ্টে মৃত বাচ্চাটার কথা বলতে, ভাবতে ভুলে যায় আমেনা।

এর মধ্যে সেদিন হঠাৎ করেই হাসপাতালে হৈ চৈ । কাকে সর্বাঙ্গ ঠোকরানো মৃতপ্রায় একটা বাচ্চাকে একজন ভর্তি করল হাসপাতালের এমাজেন্সিতে। সদ্য প্রসূত বাচ্চা।  মুখের শরীরের অনেক জায়গাতেই মাংস নেই। ভাগ্য ভাল  যে চোখ দুটো ঠুকরে তুলে নেয়নি কাক। এ বাচ্চা বাঁচবে কি করে! যে লোকটি বাচ্চাটাকে ভর্তি করতে  এসেছে সেও বাচ্চার কেউ না। সকাল বেলা বাজার সদাই করতে যাবার সময় একটা মাঠের মাঝে বালুচাপা অবস্থায় তিনি বাচ্চাটাকে দেখতে পান। তিনি হঠাৎ অবাক হয়ে দেখেন ঝাঁকে ঝাঁকে কাক এসে একটা জায়গার বালু সরিয়ে কি যেন খুঁজছে আর ঠোক্কর দিয়ে দ্রুত উড়ে গিয়ে গাছে বসছে। ভদ্রলোকের কৌতূহল হয় । কি আছে ওই বালুর নিচে যে কাকেরা ওভাবে দলে দলে আসছে। ওখানে তো কোন ডাস্টাবিন নেই যে ডাস্টবিনে খাবার খোঁজার জন্য কাক আসবে । তিনি দ্রুত হাঁটেন। একটা লাঠি ছুঁড়ে দেন কাকের ঝাঁকের দিকে। উড়ে যায় কাকের দল।  কাছে  এসে দেখেন  বালুর স্তূপের নিচ থেকে বেরিয়ে আছে একটা সদ্যজাত শিশুর শরীরের অনেকখানি। কাসেম দ্রুত বালু সরিয়ে বাচ্চাটাকে বুকে তুলে নেন । তারপর নিজের গা থেকে শার্ট খুলে নিয়ে তাতে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ছোটেন হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে। এমার্জেন্সির ডাক্তাররা কাকের ঠোকরে এমন ভয়াবহ ক্ষতের পেসেন্ট আর দেখেননি। তাছাড়া পেসেন্ট সদ্যপ্রসূত।  একে এ্যাডমিশান দেয়াও বিপদজনক। ওর ট্রিটমেন্টের নির্দিষ্ট  কোন পন্থা নেই। ওর শরীরের খোয়া যাওয়া মাংস ভরাট হতে লাগবে অনেকদিন। তাছাড়া ওর হৃপিন্ডের যে অবস্থা যে কোন মুহূর্তে বেরিয়ে যাবে প্রাণবায়ু। কিন্তু মনে যাইই থাকুক মুখে তো আর প্রকাশ করতে পারেনা ডাক্তার। তাই বাধ্য হয় শিশুটির এ্যাডমিশান নিতে। কাসেম শিশুটিকে ভর্তি করে দিয়ে চলে যায় । আসছি বলে আর আসে না। আসবেই বা কি করে। সে একজন দিন মজুর। এই শিশুর পেছনে সময় দিলে তার চলবে কি করে। এমনিতেই আজের দিনের কাজটা তার মার গেল । ডাক্তার এসে এ্যাটেনডেন্ট কাউকে না পেয়ে বিরক্ত। এ শিশুর ওষুধপত্র লাগবে। হসপিটালে এসব ওসুধ নেই। তাছাড়া এর পরিচর্যাও তো দরকার। প্রস্রাব করছে, পায়খানা করছে । সার্বক্ষণিক ওর পাশে একজন থাকা দরকার। ডাক্তার চেঁচিয়ে বলল ,এ রোগির লোক কে ?  আমি কাকে ইন্সট্রাকশান দেব?

পাশের বেডে কাজ করছিল আমেনা। দ্রুত এগিয়ে গেল সে । 

স্যার আমি । 

আপনি মানে ! কি বলরছেন আপনি? 

ঠিকই বলছি। ওকে যিনি ভর্তি করেছেন তিনি আমার আত্মীয় । ওনার অনেক কাজ আছে । মাঝে মাঝে  এসে দেখে যাবেন । তবে আমি আমার ডিউটির ফাঁকে ফাঁকে সার্বক্ষণিকভাবে ওকে দেখব। 

এখন আর আমেনার বুকের দুধের কোন কষ্ট নেই। কোন এক মা কোন প্রাণে তার সদ্যোজাত শিশুটিকে বালুচাপা দিয়ে জীবšত মারতে চেয়েছিল , কোন এক মহামানব তাকে  বালুর স্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার করল আর এক সদ্য সন্তানহারা মা তাকে অপার মমতায় বুকে তুলে  নিল । 

আমেনা তার ডিউটির ফাঁকে ফাঁকে ছুটে আসে বাচ্চাটার পাশে।  বাচ্চাটা ধীরে ধীরে সুস্থ  হয়ে উঠছে । আমেনা তার জন্য কিনেছে বেশ বড় কোল বালিশ, মাথার বালিশ ,  রঙিন মশারি । কাপড় জামা কিনেছে অনেক। এক একদিন এক একসেট কাপড় বদলায় আর কপালে টিপ এঁকে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় । আমেনার বুকের অফুরন্ত দুধ পেয়ে বাচ্চাটার শরীরও বেশ হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠছে । ওর ক্ষত স্থানগুলো  একটু একটু করে ভরাট হচ্ছে । তবে এখনও অনেকদিন লাগবে। আমেনা তাই ওকে কোলে নেয় অনেক সতর্কতায় , অনেক যত্নে । 

ছেলেটার নামও রেখেছে আমেনা, সুমন। ওয়ার্ডের সবাই এখন ওকে ডাকে সুমন সুমন ।সুমন পিটি পিটি করে তাকায় । ঈদে অনেকগুলো জামা পেয়েছে সুমন। অন্যান্য বেডের পেসেন্টরা দিয়েছে । আমেনা মাঝে মাঝে ওকে কোলে নিয়ে ছড়া কাটে,গান গায় । মুখে কথার তুবড়ি ছুটায়। বুঝলি সুমন আমি হলাম তোর মা। মাকে পছন্দ হয়না? আর ওইযে ডাক্তার সাহেব  

যে প্রতিদিন তোর বুকে স্টেথোস্কোপ ধরে সে হচ্ছে   তোর মামা। আর এই যে ওয়ার্ডের পেসেন্টরা এরা তোর মামা খালা। তবে শোন সবাই কিন্তু তোর মামা খালা না। ওই যে ওইবেডের চাচামিয়া ও হল তোর নানা।  আর ওই বেডের খালাম্মা হচ্ছে তোর নানি। বুঝেছিস হাঁদারাম? কি হল এখনও বুঝিসনি? আরে হাঁদা তুই কি তোর মা আমেনার মতোই গাধা।  এ কথা মুনে ফিক করে হেসে দেয় সুমন। আর সে হাসি দেখে বিশ্ব ভুলে যায় 

আমেনা। দেখেছ , তোমরা দেখেছ ও কেমন করে হাসে। দেখছ খালা ওর চোখের পাঁপড়িগুলো কেমন বড় বড়, দেখেছ আপা ওর চুলগুলো কী কুঁচ কুঁচে! 

যাকে খালা আর যাকে আপা বলা হলো তারা দুজনই ঝুঁকে পড়ল সুমনের মুখের উপর। তাইতো, সত্যিই তাই। সুমনের চোখগুলো সত্যিই বড় আর ভাস ভাসা। চোখের পাঁপড়িগুলো খুব বড় আর  জমাট। 

কখনও কখনও সুমনকে কোলে নিয়ে পাউডার মাখাতে মাখাতে গল্প করে আমেনা , বুঝলি সুমন তোদের একটা বাড়ি আছে । সে বাড়িতে তোর বাপ থাকে। কিন্তু সে বাড়িতে তোর মা, এই আমেনা বেগম এখন আর থাকেনা। সে বাড়িতে তোর মার এখন আর জায়গা নেই। তবে তুই যদি সময়মতো আমার কোলে আসতি তাহলে হয়তো সে  বাড়িতে আমার জায়গা হতো। বলতে বলতে আমেনা উদাস হয়ে যায়।  তার মনে পড়ে ফেলে আসা সংসারের কথা,প্রেমময় স্বামীর কথা, সেই ছোট্ট নিকোন উঠোনটার কথা। তার স্বামী হয়তো তাকে ভালোবাসেনি। কিন্তু সেতো তাকে বুক উজাড় করে ভালবেসেছিল। তার সন্তানটা মারা গেল।  সেকি আমেনার অপরাধ? তার  সেজন্য  এতোবছরের জীবন সাথীকে অগ্রাহ্য করে আর একটা বিয়ে করতে হবে।  এ কেমন মানুষ আর এ তার কেমনধারা বিচার। আমেনা বেগমের বুকের মাঝে ঢেউ এর পর ঢেউ আছড়ে আছড়ে পড়ে। চোখ ভেদ করে পানির প্লাবন তেড়ে আসতে চায়। আমেনা অনেক কষ্টে নিজেকে নিবৃত করে । এটা হাসপাতালের ওয়ার্ড, তার নিজের ঘর বাড়িনয়। এখানে কাঁদলে সবাই ছুটে আসবে। ব্জানতে চাইবে আমেনা  কেন কাঁদছে। অনেক প্রশ্নের জন্ম হবে। তার চেয়ে ভাল মনের দুঃখ বুকে পুষে রেখে  নীলকণ্ঠ হওয়া । ভাবতে ভাবতে সুমনকে বুকে চেপে ধরে আমেনা। আর ওকে বুকে চেপে ধরে হু হু করে কাঁদতে থাকে। এবার শত চেষ্টাতেও নিজেকে থামাতে পারেনা। আশেপাশের বেডের রোগিরা অনেকেই ঘুরে শোয়।যারা একটু সুস্থ তারা ছুটে আসে আমেনা বেগমের কাছে 

: কি হয়েছে , এভাবে কাঁদছেন কেন ? 

: না ভাবছি এই একরত্তি শিশুটার কথা। কি দুর্ভাগা ও । কেমন মায়ের গর্ভে ওর জন্ম যে জন্মের সাথে সাথে ওকে মেরে ফেলার জন্য বালুচাপা দেয়। আপনারা  কি বুঝতে পেরেছেন ও  কতো দুর্ভাগা?

: হয়তো ও কারো জারজ সন্তান। নাহলে ওভাবে ওকে বালুচাপা দেবে কেন। হয়তো ওর বাপ মায়ের কোন দোষ ছিল না, সমাজের ভয়েই..। 

: খবরদার খবরদার বলছি ওকে জারজ বলবে না। জন্মের দোষ ক্রটি ওর নয়। ওর জন্মদাতা জন্মদাত্রী কি করেছে আমি জানিনা তবে ও নিষ্পাপ এক আদমমিশু । আর কি বিচার আপনাদের। আপনারা  বলছেন ওর বাবা মায়ের কোন দোষ নেই, সমাজের ভয়ে করেছে । তাহলে দোষ যেন ওই একরত্তি দুধের শিশুটার। বাহ বাহ চমৎকার বিচার আপনাদের।  

আমেনার  কণ্ঠস্বর ছিল কিঞ্চিৎ উত্তেজিত। সেই উত্তেজিত স্বর শুনে পাশের ওয়ার্ড থেকে ছুটে আসে ডিউটি ডাক্তার। 

: কি ব্যাপার, ব্যাপার কি সিস্টার। এখানে কিসের এতো হৈচৈ। বেশ কয়েকটা ক্রিটিকাল রোগি রয়েছে এখানে। চীৎকার চেঁচামেচিতে তাদের ক্ষতি হতে পারে। আপনি সিস্টার আপনাকেও কি আমার এসব কথা শেখাতে হবে। বলতে বলতে আমেনার দিকে চোখ  যায় 

: সিস্টার আপনি এখনও ওই শিশুটাকে নিয়েই আছেন। এমন ভাব আপনি শিশুটাকে নিয়ে করছেন যেন আপনি ওর  মা। সিস্টার আপনাকে মনে রাখতে হবে এই ওয়ার্ডের সব 

পেসেন্টের দায়িত্ব আপনার। শুধু ওই একটা শিশুর না। আপনার শিশুটিকে নিয়ে মাতামাতির ফলে অন্য পেসেন্টদের প্রতি অবহেলা হচ্ছে।  কারো সময়  মতো টেম্পারেচার দেখা হচ্ছেনা, কেউ  সময়মতো ওষুধ, স্যালাইন কিংবা অক্সিজেন পাচ্ছে না। সেদিন ২৯ নম্বর বেডের পেসেন্টের শ্বসকষ্ট হল । তাৎক্ষণিকভাবে অক্সিজেন দেয়া দরকার ছিল। আপনাকে বলেও ওরা সময়মতো সার্ভিস পায়নি । আপনি তখন বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াতে ব্যস্ত ছিলেন।

: কিন্তু আমিতো অক্সিজেন দিয়েছিলাম।

:দিয়েছিলেন তবে পনের বিশ মিনিট পর। বাচ্চাটাকে দুধ খাইয়ে ধীরে সুস্থে । পেসেন্টের ভাগ্য ভাল আর আপনার জোর বরাত তাই এ যাত্রা পেসেন্ট সামলে উঠেছে। নইলে ওদিনই আপনার চাকুরি খতম হয়ে যেত। বুঝলেন সিস্টার আপনার এসব কাজ নিয়ে অনেক প্রবলেম হচ্ছে । অনেক কমপ্লেন আপনার বিরুদ্ধে। আমি আপনার ভাল চাই তাই বলে ফেললাম সরাসরি। একটু বুঝে শুনে চলবেন।  তাছাড়া পরের ছেলে । যার ছেলে সে নিয়ে যাবে অথবা জায়গা হবে কোন অনাথ আশ্রমে । শুধু শুধু ওর সাথে নিজেকে মায়ায় জড়িয়ে লাভ কি! 

: না না ও কোথাও যাবে না । ও কোন অনাথ আশ্রমে যাবে না

: যে বুঝেও বুঝতে চায়না তাকে বোঝাবে কে। গজগজ করে চলে গেলেন ডাক্তার। 

ডাক্তার যে শুধু কথার কথা বলেছিল তা নয়। পরদিন হাসপাতালের পরিচালক ডেকে পাঠালেন আমেনাকে । দু এক কথার পর সরাসরি বললেন

 : তোমাকে রোগীদের ব্যাপারে আরও যত্নশীল হতে হবে। শুধুমাত্র এটা পেসেন্টের কেয়ার নিতে গিয়ে অন্য পেসেন্টদের অবহেলা করা কোন সেবিকার ধর্ম নয় । তোমার ওয়ার্ডই আমি চেঞ্জ  করে দিতাম  কিন্তু ওই শিশুটা তোমার বুকের দুধ খায় বলে সেটা করলাম না। এনিওয়ে তুমি একটু বুঝে শুনে কাজ করো।  তোমার বিরুদ্ধে অনেক কমপ্লেন। তোমার প্রিভিয়াস রিপোর্ট খুব ভাল বলে তোমার বিরুদ্ধে আপাতত কোন এ্যাকশানে গেলাম না।

আমেনা বুঝে পায় না কে তার বিরুদ্ধে কমপ্লেন করেছে । মুখে তো সবাই বাচ্চাটার প্রতি সহানুভূতিশীল।বাচ্চাটাকে আদরও করে সবাই । অথচ ভেতরে ভেতরে কে এমন মীরজাফরের কাজ করছে! 

আমেনা সত্যিই কিছুটা সতর্ক হয়ে যায় । এ চাকরিটা না থাকলে তাকে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হতো । তাছাড়া এখন আর সে একা না। হাসপাতার কর্তৃপক্ষকে বলে যেভাবেই হোক সুমনকে সে নিজের কাছে নিয়ে যাবে, নিজের স্নেহ মমতা দিয়ে মাতৃস্নেহে ওকে বড় করবে।  

সুমন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। ওর রিলিজ হওয়ার আর তেমন দেরি নেই। হাসপাতালের নিয়ম অনুযায়ী ওকে কোন অনাথ আশ্রমে দেয়ার কথাবার্তা চলছে। কিন্তু আমেনা পরিচারকের বাচ্চাটাকে তার কাছে হস্তান্তর করার জন্য পরিচালকের কাছে দরখাস্ত করেছে। দরখাস্তে সে তার নিজের সন্তানের অকালমৃত্যু, তার বুকে দুধের ঢল নামা  এবং সেজন্য তার কষ্টের কথাও উল্লেখ করেছে। সাথে  একথাও লিখেছে যে, একটা সদ্যজাত শিশুর জন্য মায়ের দুধ খুবই প্রয়োজন । এ দুধের কোন বিকল্প  নেই। এক মা তার বুকের অফুরান দুধ নিয়ে যন্ত্রণায় কাতরোক্তি করবে আর এক শিশু দুধের অভাবে কাঁদবে এটা মানবতা বিরোধী । 

আমেনার দরখাস্ত কর্তৃপক্ষের হৃদয় স্পর্শ করেছে । তারা নীতিগত ভাবে একমত হয়েছে বাচ্চাটা আমেনাকে দেবার জন্য । তবে সমাজসেবা অধিদপ্তরের সাথে কিছু ফর্মালিটিস আছে । সেটা সম্পন্ন করেই বাচ্চাটাকে দেয়া হবে।  সব কিছু  ঠিকঠাক মতো চললে দু একদিনের মধ্যেই বাচ্চাটাকে পরিপূর্ণভাবে পাবার কথা। আমেনা তাই আবেগাপ্লুত ,রোমাঞ্চিত। সেই বিকেলে তাই আমেনা সুমনের সারা গায়ে পাউডার মাখাল  , চোখে কাজল পরালো,  চুমুর পর চুমুতে  ভরে দিল  পুরোটা শরীর। কিন্তু বিকেলটা যে এমন শক্র হয়ে এসেছে কে জানত। বিকেল শেষ হবার আগেই এক প্রভাবশালী সংসদ সদস্য  এসে হাজির।  সাথে বাচ্চার জন্য অনেক জামা কাপড় আর খাবার দাবার। মহামান্যের  আগমণ ঘটেছে তাই সাথে সাথে ছুটে  এলো  পরিচালক আর অন্যান্য ডাক্তাররা। সংসদ সদস্য উচ্চস্বরে জানালেন বাচ্চাটার খবর খবরের কাগজে জেনে তিনি ওকে নিতে ছুটে এসছেন। ওকে তিনি নিতে চান এবং নিজের সন্তান পরিচয়ে মানুষ করতে চান। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যেন তাকে সহযোগিতা করেন। ওয়ার্ডের রোগীরা ধন্য ধন্য করতে থাকে ।  পরিচালক সাহেব গদ গদ হয়ে বলেন 

: আপনি ওই অনাথ বাচ্চাটাকে নিয়ে নিজের সন্তানের পরিচয়ে মানুষ করতে চান এতো খুবই ভালো কথা । তবে সমাজসেবা অধিদপ্তরের সাথে কিছু ফর্মালিটিস 

:ও নিয়ে ভাববেন না,  ওমব আমি মিটিয়ে নেব।  

স্থির হল দুদিন পর  এসে উনি বাচ্চাটাকে নিয়ে যাবেন। সবার মুখে হাসি।  ডাক্তারদের ব্যবহারে তোষামুদি,  শুধু আমেনার চোখে জল । সে বেডের পাশে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে হঠাৎ করে তার দিকে চোখ যায় সংসদ সদস্যের 

: আপনি কাঁদছেন কেন । এনি প্রবলেম? 

পরিচালক কি যেন বলতে যায় । কিন্তু তার আগেই  ফোঁফাতে ফোঁফাতে আমেনা বলে, আমি ওর দুধ মা । একদিনের বাচ্চার মুখে নিপল তুলে দিয়েছিলাম,  আজ ও দুাু মাসের। হাতজোড় করে আমেনা। আপনার পাঁচটি সন্তান আছে,  আমার একটিও নেই। অথচ আমার বুকভরা দুধ আছে। আপনারা তো নির্বাচিত হবার জন্য,  ভোট পাবার জন্য অনেককে অনেক প্রতিশ্র“তি দেন, অনেক কিছু দেন, আমার শুধু একটাই চাওয়া,  আমার সন্তানটাকে নেবেন না। আমেনার ফোঁফানি কান্নায় পৌঁছায়। আমেনা হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে । ওর সাথে কাঁদে ওয়ার্ডের সব রোগী । সংসদ সদস্য চোখে বিষাদ মেখে পরিচালককে বলেন, 

 : শিশুটির যে মা আছে  একথা আমাকে বলা উচিত ছিল । সরি..

সংসদ  সদস্য  বেরিয়ে যান। অবেলায়  হঠাৎ করে  রোদ ঝলমলিয়ে ওঠে  । আর ওই ছোট্ট শিশু তার গুটি গুটি আঙ্গুল  দিয়ে পেচিয়ে ধরে আমেনার শাড়ির আঁচল    

 

 
%d bloggers like this: