জীবনের মোহনায় বাউল বাতাস ৩/ বেগম জাহান আরা

ড. বেগম জাহান আরা

বর্ষাকালে কখনো গাছের গুঁড়িতে বসতাম না আমি। পুকুর তখন কানায় কানায় প্রায় ভরে থাকতো। ভয় লাগতো। সাঁতার জানলে কি হবে? মা বলতেন, পুকুরে কাঁথাবুড়ি থাকে। যখন তখন পুকুরে নামলে সে পা জড়িয়ে ধরে। তখন মানুষ আর সাঁতার দিতে পারে না, ডুবে মরে। পরে বুঝেছি, ওটা ভয় দেখানোর জন্য বলতেন মা। খেলার সঙ্গি সেই গাছও একদিন নিহত হলো নান্নুর বাড়ির আসবাবের জন্য। আরো একটু ঢালে একটা পিঠালু গাছ ছিলো। তার ফল ছিলো ছোটো গোল আলুর মতো। ওগুলো কুড়িয়ে আমরা ঢিলের মতো ব্যাবহার করতাম। বেশ ব্যথা লাগতো যদি গায়ে কেউ মারতো। সে গাছটা এক সময় কেটে জ্বালানি হিসেবে ব্যাবহার করা হয়েছে। ও বেচারার তো কাঠ হয় না, তাই পুড়তে হয়েছে আগুনে।

 

আমাদের বাড়িতে ছিলো মিনি চিড়িয়াখানা। একটা ময়না ছিলো, খুব কথা বলতো। আমাদের নাম ধরে ডাকতো। ভিক্ষুক এলে বলতো, মাফ করো বাবা। পাড়ার ছেলে মেয়েরা দেখতে এলে বলতো, কি চাও? মাঝে মাঝে বড়ো ভাবিকে ডাকতো ‘বৌমা’ বলে। সকালে কখনো ডাকতো, বৌমা ওঠো, নামাজ পড়ো। সবাই অবাক হতো ময়নাটার কথা শুনে। সেজোভাই ওর দেখাশোনা করতো। খাঁচাটা ঝুলানো থাকতো লিচু গাছে। একদিন সেজোভাই ভুলে গিয়েছিলো খাঁচাটা ঝুলাতে। উঠোনের মধ্যেই ছিলো। সেই রাতে বেড়াল ওর পায়ে কামড়ে দেয়। সেখানে পরে ঘা হয়ে যায়। আর তাতেই অবশেষে মারা যায় ময়নাটা। সামনের পুকুর ধারে ওকে কবর দেয়া হয়। সেজোভাইয়ের সে কি কান্না পাখিটার জন্য! আমাদেরও মন খারাপ হয়েছিলো খুব।  

 

একটা টিয়ে পাখিও ছিলো আমাদের। বাড়িতে বাজার এলে ঘাড় ঘুরিয়ে সে লক্ষ করতো। লাল কাঁচামরিচ দেখলেই কিচির মিচির করতো গলা সপ্তমে চড়িয়ে। দিতেই হতো ওকে কয়েকটা লাল কাঁচা মরিচ। ময়নাটাও বলতো, আমাকে দাও, আমাকে দাও। আমরা হাসতাম পাখিদের কান্ড দেখে।

 

ময়ুর ছিলো একটা। আলাদা ঘর ছিলো তার জন্য। মাঝে মাঝে বাইরে ছাড়া হতো। ঘুরে ফিরে আবার চলে আসতো। একদিন আর এলো না। কতো খোঁজা হলো। ঢোল পিটিয়ে পাড়াতে জানান দেয়া হলো। কিন্তু আর পাওয়াই গেলো না ময়ুরটাকে। ওর জন্য খুব আফসোস করেছিলেন বাবা। সবচেয়ে প্রিয় প্রাণি ছিলো বাবার। সংগ্রহ করছিলেন তাঁর একদার চাকরির জায়গা, সম্ভবত ময়নাগুড়ি থেকে।

 

হাঁস ছিলো তিরিশটা। মোরগ মুরগি ছিলো বিশটা।বাড়িতে আমরা অনেক মানুষ। একান্নবর্তি পরিবার। কিনে খেতে হতো না ডিম। রোজ গড়ে দশ বারোটা ডিম পাওয়া যেতো। মাঝে মাঝে রান্না করা হতো ডিমের কালিয়া বা ডিম আলুর দম। সবচেয়ে বেশি কাজে লাগতো নাশতার সময়, আর হঠাৎ অতিথি এলে। সকালে হাঁসের ডিম তোলা নিয়েও আমার, নান্নুর আর সেজোভাইয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো। যে সকালে উঠবে সেই ডিম তুলে আনবে হাঁসের ঘর থেকে। আর মুরগিগুলো ছিলো বেহুদা। ওদের ডিম দেয়ার জায়গা ছিলো ভাঁড়ার ঘর। কোনাকাঞ্চি বা চালের বস্তা কিম্বা পেঁয়াজ রশুন সবজির ডালি। তছ নছ করে দিতো ঘর।

 

আম লিচুর সময় বড়ো বুবুকে আনাতেন বাবা তার শ্বশুরবাড়ি থেকে। দুলাভাই মারা যাওয়ার পর বুবু শ্বশুরবাড়িতেই থাকতেন তিন মেয়ে নিয়ে। উনি এলে আরো মজা হতো। হাঁস মুরগির বাচ্চা ফোটাতেন অনেক। হাঁসের বাচ্চাদের জন্য উঠোনের একদিকে ছোট্ট অর্ধচন্দ্রাকার পুকুর কেটে তাতে হাঁসের বাচ্চাগুলোকে ছেড়ে দিতেন। বাকি অর্ধেক শুকনো। একটা বাঁশের টোপা দিয়ে ঘিরে রাখতেন কাক চিলের ভয়ে। ছোটো ছোটো বাচ্চাগুলো সাঁতার কাটতো কি চমৎকার করে! আহা, সেই দিনগুলো কতো যে আনন্দের ছিলো! 

 

বড়োবু এলে লিচু গাছে বাদুড়  তাড়ানি টিন বাঁধা হতো। খালি কেরোসিনের টিনে বাঁশের আড় দিয়ে তার সাথে একটা বেশ বড়ো ভাঙা ইঁটের টুকরো ঝুলিয়ে দেয়া হতো। তারপর সেই টিন ঝুলানো হতো লিচু গাছের মাঝ বরাবর একটা ডালে। টিনের সাথে একটা নারকেলের দড়ি লম্বা করে টেনে আনা হতো ঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে বুবুর ঘরে। যখনই ঘুম ভাঙতো, বুবু দড়ি ধরে কয়েকবার টান দিতেন। টিনে ঠন ঠন শব্দ হতো। বাদুড় কতোটা পালাতো সেই শব্দে তা বলা অসম্ভব। তবে ব্যাপারটা খুব মজার ছিলো। ঐ টিন বাজানোর জন্য বুবুর কাছে শুতাম মাঝে মাঝে। এখন খুব ভালো করে বুঝি, পেছনের দিন আর ফিরে আসে না। যেমন সব পাখি ফিরতেই পারে না ঘরে। আসে শুধু স্মৃতির ছায়া। ধ্বনি নয়, অস্পষ্ট প্রতিধ্বনিও নয়। মনের চোখে ভেসে ওঠা কুয়াশার মতো ছবি মাত্র।

 

সেজোভাই জিদ করে একটা বেজি কিনেছিলো। পাতলা শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। তাকে রোজ মাংস খেতে দেয়া হতো। একদিন বেজিটা মওলা ভাইয়ের হাতে কামড় দিয়ে চামড়া কেটে নেয়। বাবা সেদিনই বিদায় করেন ওটাকে। বললেন, এটা একেবারে বুনো। পোষ মানবে না কোনোদিন। ছাড়া পেলে হাঁস মুরগি খেয়ে ফেলবে। তোরা হাঁসের বাচ্চা আর পুকুরে নিতে পারবি না। টোপা উলটে দিয়ে ধরে নেবে বাচ্চা।

 

হাঁসের বাচ্চা একটু বড়ো হওয়ার পর সামনের পুকুরেই আমরা ওদের আনতাম। ঐ সময় আমরাও গোসল করে নিতাম। ডুব দিয়ে হাঁসের বাচ্চাদের জন্য তুলে আনতাম শামুক। কখনও ছোটো ছোটো ঝিনুকও পেয়ে যেতাম। বেশ কিছুক্ষণ সাঁতার কাটার পরে বাচ্চাগুলোকে  খাঁচায় তুলে  নিয়ে যেতাম বাড়িতে। তারপরে ওদের ভোজ। একটা ইঁটের ওপর  আর একটা অর্ধেক ইঁট দিয়ে ঝিনুক শামুকগুলো থেঁতলে বাচ্চাদের খেতে দিতাম। কি ভালোবেসে যে খেতো! এক মুহুর্তেই খাওয়া শেষ। ভাইঝি ভাইপো  নেলি শেলি তখন বেশ ছোটো। টুল্টুলে ফুটফুটে বাচ্চা। ঘুরতো আমাদের গায়ে গায়ে। সবটাতে তাদের আনন্দ। আহা,  কি যে এক সুখি পরিবেশে বড়ো হয়েছি আমরা!

 

এই পুকুরের ওপারে হিন্দু পাড়া। লম্বাটে পুকুরের ওপারের একেবারে পুব কোনায় একঘর গোয়ালাও ছিলো।’ আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে থাকতো শিউলির মা। নরেন বৈরাগির বাড়ি। নরেন কিসের যেনো ব্যাবসা করতো। আমরা দেখিনি, বাবার কাছে শুনেছি। হঠাৎ করেই মারা গেলো। বিধবা শিউলির মায়ের সম্পদ বলতে ছোটো একটা খড়ের বাড়ি, আর দুটো ছেলে মেয়ে। ছেলেটা কিছু মিছু করতো, আমি জানতাম না। দেখিওনি তাকে কোনোদিন। শিউলিকে দেখতাম, পুকুরে গোসল করতো, কাপড় কাঁচতো। ফরসা গায়ের রঙ। মাথা ভরা লম্বা কালো কোঁকড়া চুল। দেখতেও খুব সুন্দর ছিলো। ওর মাও খুব সুন্দর ছিলো দেখতে। আমাদের বাড়িতে দুটো কারণে আসতো। এক, কোনো কাজে বাবা ডেকে পাঠালে; দুই, মেয়ের হাঁপানি বাড়লে একটু ওষুধ চাইতে। বৌটা বাবাকে ডাকতো বাবা বলে।

 

এবাড়ি ওবাড়ি টুকটাক কাজ করে কিছু চাল ডাল পেতো। কাঁথা সেলাই করতো। কারো পানি তুলে দিতো। বাবা ওকে দিয়ে কুমড়ো বড়ি বানিয়ে নিতেন। খুব ভালো বানাতো বড়ি। আস্ত মাসকলাইয়ের ডাল কিনে দিতেন বাবা। আর পয়সা দিতেন চালকুমড়ো কেনার জন্য। ডালগুলো ভিজিয়ে রেখে পরের দিন বাঁশের ঝাঁকায় (সরু বাঁশের চাঁছ দিয়ে বোনা ডালি) করে পুকুরে এনে ধুতো। হাত দিয়ে কচলে কচলে কেমন করে যেনো ডালের খোসা ছাড়াতো। তারপর ঝাঁকা পানিতে ডুবালে ডালের খোসাগুলো ভেসে উঠতো।ঝাঁকাটা তখন একটু সরিয়ে নিতো। ভেসে যেতো খোসাগুলো অন্যদিকে। এই ভাবে ডাল ধুতে ধুতে ঝক ঝকে সাদা হয়ে যেতো।

 

সামনের বারান্দার সিঁড়িতে বসে অনেকক্ষণ ধরে ওর কাজের সবটাই আমি দেখতাম। ভালো লাগতো। তারপর বড়ি বানিয়ে শুকিয়ে বাসায় এনে দিতো। তখন তো কেজি-র মাপ ছিলো না। সের হিসেবে কাজ হতো। খুব মনে আছে, বাবা পাঁচ সের ডাল কিনে দিতেন একবারে। বৌটা পাঁচ সের বড়ি নিয়ে আসতো। সের প্রতি মজুরি ছিলো চার আনা। পাঁচ সিকে পয়সার সাথে বাবা ওকে কিছু বড়িও দিতেন। খুশি হতো বৌটা। সত্যি কি দিন ছিলো? কতো অল্পে মানুষ জীবন ধারণ করতো! করতেই হতো। 

 

একদিন সকালে খুব কান্নাকাটির শব্দ পাওয়া গেলো ওদের বাসা থেকে। বাবা সেজো ভাইকে পাঠালেন ঘটনা দেখার জন্য। ভাই এসে বললেন, শিউলি মারা গেছে ভোর রাতে। কি আফসোস বাবার! শোলো বছরের ফুলের মতো মেয়েটা মারা গেলো। হাঁপানি ছিলো ওর। খুব কষ্ট পেতো মেয়েটা। সবই ঠিক আছে। তা বলে মরেই যাবে মেয়েটা? ওষুধ পথ্য কিছুই তো জোটাতে পারেনি ওর মা। কিন্তু ধুঁকে ধুঁকে কি আর মানুষ বাঁচে না? ওষুধ বলতে কবিরাজের দেয়া ধুতরা পাতাই সার ছিলো। মাটির ভাঙা খোলায় শুকনো পাতার একটু গুঁড়ো নিয়ে তার ওপর কাঠ কয়লার এক টুকরো অঙ্গার রাখলে পাতার গুঁড়ো পুড়ে ধোঁয়া বের হতো। সেই ধোঁয়া মুখ দিয়ে নিয়ে নাক দিয়ে ছাড়তো। এই ওষুধের কথা শিউলির মাই বলেছে বাবার কাছে।

 

বাবাও একরকম ধোঁয়া ইনহেল করতেন। তার নাম, ‘হিমরডস এজমা কিওর’। ভাঙা চিনেমাটির পাত্রে একটু পাউডার নিয়ে দিয়াশলাই জেলে আগুন দিতেন। একটু জলে গেলে ধিরে ধিরে ওটা পুড়তো তুষের আগুনের মতো আর ধোঁয়া উঠতো। মুখ দিয়ে বড়ো বড়ো নিশ্বাসে বাবা সেই ধোঁয়া টেনে নিতেন বুকের ভেতর। ছাড়তেন নাক দিয়ে। ভীষণ কাশতেন বাবা ধোঁয়া টানার সময়। মাঝে মাঝে কাশির দমকে এমন নড়তেন যে, হাত থেকে ধোঁয়ার পাত্রটা পড়েও যেতো। আবার ওষুধ নিয়ে আগুন জ্বালাতে হতো। ধোঁয়া যে নিতেই হবে। তবে শ্বাস কষ্ট কমবে কয়েক ঘন্টার জন্য। কি অসম্ভব কষ্টকর একটা অসুখ। ধোঁয়া নেয়া দেখার জন্যও শক্ত নার্ভ প্রয়োজন। যারপর নাই কষ্ট লাগতো আমার।

 

মিয়াভাই, মানে আমাদের বড়ো ভাইয়েরও হাঁপানি হয়েছিলো পরে। তাঁর কষ্টও দেখেছি। তবে আমি তো বালিকা থাকতেই চলে গেলাম স্বামীর বাড়ি।

 

বাবার ওষুধটা ছিলো বিদেশি। দেশি একটা পাওয়া যেতো, সেটা তেমন ভালো ফল দিতো না। শিউলির মা বিদেশি ওষুধ তো কিনে দিতে পারতো না। কখনো দেশিটা কিনে দিতো। আর কোনো দিন খুব বাড়াবাড়ি হলে বৌটা নিজে এসে বাবার কাছ থেকে একটু ওষুধ নিয়ে যেতো। কদিন আগেই বাবা শিউলির জন্য বেশ কিছু পরিমাণ ওষুধ দিয়েছিলেন পুরনো হিমরডস-এর কাঁচের পাত্রে। জান জান করে সেই ওষুধ ব্যবহার করতো মেয়েটা। ওষুধটা শেষও হলো না। ওপারের ডাক এসে গেলো তার। দমের কষ্ট শেষ হয়ে গেলো একেবারে। মরেই বাঁচলো মেয়েটা।

 

আমি তখন বছর নয়েকের  হবো। মাকে বলে গেলাম শিউলিদের বাড়ি। সেই প্রথম এবং শেষ আমার হিন্দুদের শেষকৃত্যের আচার দেখা। শিউলিদের বাড়িতেও সেই প্রথম যাওয়া। দেখলাম, মৃতদেহটা তুলসিতলায় রাখা। ভালো শাড়ি পরিয়ে সাজিয়ে গুজিয়ে শব বহনকারি খাটিয়ার ওপর শোয়ানো হয়েছে শিউলিকে। পায়ে আলতা, নতুন স্যান্ডাল। গলায় ফুলের মালা। কি অপরূপ লাগছিলো ওকে দেখতে, আমি আজো ভুলিনি। কেঁদে জারে জার হয়ে যাচ্ছে ওর বিধবা মা। ছোটো উঠোন। লোকে গিজ গিজ করছে। কাউকেই চিনি না আমি। শিউলির দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। কল্পনাই করতে পারছিলাম না যে, এই সুন্দর পুতুলের মতো দেহটা একটু পরেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। হঠাৎ খুব কান্না পেলো। আমি দৌড়ে বাড়ি চলে এলাম। বাবাকে বললাম, ওকে না পুড়িয়ে কবর দেয় না কেনো বাবা? উত্তর দিলেন না বাবা। মা বললেন, হিন্দুদের কবর দেয়ার নিয়ম নেই। ওরা পোড়ায়।  

 

মনে পড়লো হেম ঘোশষর কথা। শিউলিদের বাড়ির বেশ কয়েক ঘর পুবে তার বাড়ি। রোজ সাড়ে তিন সের করে দুধ দিয়ে যেতো আমাদের বাড়ি। পিতলের বড়ো একটা ঘড়া আর দুধ মাপার জন্য ‘একপোয়া’ দুধ ধরে এমন একটা চক চকে পিতলের গ্লাস নিয়ে আসতো। সকাল দশটার দিকে দুধ না নিয়ে এলে আমরা কতোদিন হেম ঘোষের বাড়িতে গেছি। হেম কাকা বলে আমরা ডাকতাম। তো হেম কাকার দেরি দেখে কখনো ,হেম কাকা হেম কাকা বলে চলে যেতাম একেবারে ওর গোয়াল ঘরের কাছে।

 

হেম কাকার খুব ছোঁয়া ছুঁতের বাতিক ছিলো। বলতো, আহা, করো কি, করো কি, উঠোনে দাঁড়াও বাবারা। গোয়াল ঘরে আসতে নেই তোমাদের।

 

আমরা থেমে যেতাম। কিন্তু সেজো ভাই দুষ্টু ছিলো। সে চলে যেতো গোয়ালঘরে। কাকা অনুনয় বিনয় করে বলতো, আমাকে ছুঁয়ো না বাবা, দুধটা দোয়াতে দাও। এই তো এলাম বলে। কি ছেলে রে বাবা, একটু দেরি সয় না?

 

কোনোদিন সেজো ভাই কথা শুনতো, কোনোদিন শুনতো না। ইচ্ছে করে হেম কাকাকে ছুঁয়ে দিতো। বলতো, কেনো, ছুঁলে কি হয়?

 

-জানিনা বাপু, বাপ দাদা মানতো আমিও মানি। তাছাড়া তোমরা তো জানোই, আমাদের জাতে একটু ছোঁয়া ছুঁত আছে।

-এই যে আমি তোমাকে ছুঁলাম, তোমার কি জাত গেলো কাকা? কোথায় গেলো? বলো খুঁজে এনে দিই।

-সরো দিকি বাপু, দুধটা নিয়ে বার হতে দাও। তোমার সাথে তক্কো করা আমার কাজ নয়। বড়ো দিকদারি করো খোকা। রাস্তা ছাড়ো।

 

এ তো গেলো একরকম জ্বালাতন। পুকুরে গোসলের সময় সেজভাই যদি হেম কাকাকে দেখতো, তাহলে বিপদ হতো হেম কাকার। আগে থেকেই বলতো, এই যে খোকা, ছুঁয়ে দিও না গো। আজ আর নাইতে পারবো না। দুবার নাইলে আমার জ্বর আসে। সেজোভাই তবু এগিয়ে যেতো। কাকা বলতো, আজ কিন্তু নিশ্চয় বাবাকে বলে দেবো। কে শোনে কার কথা? কোনোদিন ছুঁয়েই দিতো। রাম রাম করতে করতে হেম কাকা আবার পুকুরে নামতো। গুনে গুনে সাতটা ডুব দিতো। আমরা হাসতাম। কি বোকা ছিলাম? কাকার কষ্ট  এবং বিপদটা বুঝতেই পারতাম না।

 

মাঝে মাঝে হেমকাকা বলতো, দাঁড়াও, আজ বাবাকে বলে তোমাকে শাস্তি খাওয়াবোই।

-তাহলে আমিও বলে দেবো, কাকা দুধে পানি মেশায়। নিজে চোখে দেখেছি।

-হায় ভগবান, শত্রুও বলতে পারবে না এই কথা।

-আমি নিজের চোখে দেখেছি কাকা, তুমি দুধের বালতিতে পানি নিয়ে গরু দোয়াতে যাও।

-ছি ছি খোকা, এমন কথা বলে না। দুধে পানি দিলে নরকেও জায়গা হবে না আমার। বাছুরডাও মরে যাবে গো। আবারও আমরা হাসতাম।

 

আসল গোয়ালপাড়াটা একটু দূরে। সেখানে বেশ কয়েক ঘর গোয়ালার বাস ছিলো। এখন সে সব এলাকা রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মধ্যে ঢুকে গেছে। নাপিত পট্টির মোড়ে যেতে হলে ফেলু ঘোষের বাসা পড়তো রাস্তার বাঁয়ে। ওর বাসাও বড়ো ছিলো, আর দুধ দই-এর ব্যাবসাও ছিলো বড়ো। লোকে বলতো, ফেলু ঘোষ টাকা পুঁতে রাখে মাটিতে। আমি কোনোদিন ওকে গায়ে জামা পরতে দেখিনি। শীতকালে একটা গেঞ্জিই ছিলো ওর একমাত্র পোশাক। সব সময় ধুতি পরতো। সেটা মস্ত ভুঁড়ির দেখিয়ে নাভির নিচে বাঁধা। আর সেই ধুতি  হাঁটুর নিচে নামতো না কখনো। মাথায় টাক। মুখে কয়েকটা মাত্র পানের রসে লাল হওয়া নড়বড়ে দাঁত। ফোকলাই বলা যায়। হাসতো হে হে করে। ভোলাভালা প্রাণখোলা মানুষ। নান্নু তখন ওর দাঁত গুনতে চেষ্টা করতো। বলতো, আর একটু হাসো না কাকা। কাকা তখন হা হা করে হাসতো। বলতো, বুড়ো হলে দাঁত থাকে বাবা? তুমি বুড়ো হলেও আমার মতন হবে। আশে পাশে পাড়ার ছেলে পেলে থাকলে হেসে গড়িয়ে পড়তো। হেসেছি আমরাও।

 

হায় কাকা, নান্নু বুড়ো হবে কি? ও তো সব কটা দাঁত নিয়েই চলে গেলো ওপারে। মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সে। ওর মতো প্রাণবন্ত একটা মানুষের জন্য পাড়াশুদ্ধ লোক কেঁদেছিলো। তুমি বেঁচে থাকলেও কাঁদতে হায় হায় করে কাকা। আজ এতদিন পরে মনে মনে বলছি, যেখানেই থাকো তুমি কাকা, ও যদি তোমাকে দুঃখ দিয়ে থাকে, তবে ওকে ক্ষমা করে দিও। ও তো ঐরকমই ছিলো।

 

যতোটা মনে আছে, এক টাকায় চার কি পাঁচ সের দুধ পাওয়া যেতো তখন। তো ফেলু ঘোষের কাছে দুধের দাম কয়েক রকম। এক টাকায় চার সের দুধও পাওয়া যেতো, পাঁচ সের, ছয় সের দুধও পাওয়া যেতো। যেমন দাম তেমন দুধ। পানি মেশানোর ব্যাপারে মশহুর ছিলো তার নাম। তেমনি দইয়ের ব্যাবসা। টক দই, মিশটি দই, পাতলা দই, খাসা দই, সব আছে। দইয়ের পাত্রও রকমারি। মাটির বড়ো ভাঁড়, ছোটো ভাঁড়, গোল ভাঁড়, লম্বাটে ভাঁড় সব আছে তার কাছে। ও বলতো ‘ডুঙ্গি’। খানা পিনার চাহিদা থাকলে বড়ো মাটির হাঁড়িতে করেও দই দিতে পারতো সে। ফেলু কাকা বলতো, কোন ডুঙ্গি চাও সেটা বলো, পেয়ে যাবে। ওর বাড়িতে গিয়ে আমরা দুধ দই কিনেছি। বেশ বড়ো ঘরে সারি সারি দইয়ের ভাঁড়। খড়ের বিঁড়ে বানিয়ে সুন্দর করে রাখা। যেটা কিনতে চাই সেটা ও তুলে এনে দেবে। এই নিরামিষ মানুষটাকে হানাদার বাহিনী নাহক মেরে ফেলে যুদ্ধের সময়। ওপার থেকে এসে ফেলু কাকার কথা জেনে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। অনেকে বলেছিলো, পালিয়ে যাও ওপারে কাকা। ওর জবাব ছিলো, আমি তো কারো কিছু করি নি গো। আমাখে মারবে ক্যান? হায়রে কাকা, জালিমদের আবার ‘ক্যান’ লাগে?

 

রাস্তার উল্টো দিকের গোয়ালেরাও দুধ দইয়ের ব্যাবসা করতো।সর জাল দিয়ে ঘি বানাতো কেউ কেউ। আমাদেরকে ঘি দিতো রজনি ঘোষ। একসের খঁটি গাওয়া ঘিয়ের দাম ছিলো আড়াই কি তিন টাকা। ঘি তৈরি করে ছিকার মধ্যে ছোটো এলুমিনিয়মের ডেকচিতে নিয়ে বিক্রি করতে বের হতো। আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়েই বাজারে যেতো রজনি কাকা। বাবা প্রায় বারান্দায় বসে থাকতেন। আর বাবাকে দেখলেই রজনি ঘোষ বলতো, আজকেই ঘি করাছি বাপজান, লিবেন না?

 

বাবা যেদিন বলতেন, আজকে না, সেদিন ও চলে যেতো বাজারের দিকে। আর যেদিন বাবা বলতেন, দেখি তো কেমন ঘ্রাণ উঠেছে তোমার ঘিয়ের। সেদিন ও বুঝে নিতো, বাবা ঘি কিনবেন। বারান্দায় উঠে এসে আমাকে বলতো, খুকি একটা পিরিচ লিয়া আসো, একটুখানি খ্যায়া দেখো।

 

আমি তো সেটাই চাইতাম। পিরিচে ঘি নিয়ে তাতে চিনি দিয়ে খেতে খুব ভালোবাসতাম আমি। বেশ অনেকটা ঘি দিতো রজনি কাকা। সেটা নিয়ে আমি নাচতে নাচতে বাড়ির ভেতরে চলে যেতাম। বড়ো ভাবি বা মায়ের কাছ থেকে একটু চিনি নিয়ে কি আনন্দে চামচ দিয়ে একটু একটু করে খেতাম। আমার একটা প্রিয় খাবার ছিলো এই ঘি চিনি দিয়ে ভাত চটকে মেখে খাওয়া। বেশ বড়ো হয়েও খেয়েছি। এখনও আলু ভর্তা আর ঘি দিয়ে ভাত খেতে ভালোবাসি। সুযোগ পেলে খাইও।

 

কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। চোখ খুলেই দেখি পশ্চিমের ফুল বাগানে রোদ ঝল মল করছে। ঘড়ি দেখলাম। আটটা পঁচিশ। তার মানে ওরা সবাই কাজে বের হয়ে গেছে। ইন্দ্রা গেছে স্কুলে। দেখা হবে সবার সঙ্গে আবার সন্ধেবেলায়। ততোক্ষণ আমি একা। বেশ লাগে কিন্তু একা থাকতে। বই পড়ি, স্মৃতির সাগরে সাঁতার কাটি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পেছনের জীবনটার পাতা খুলে মেলে দেখি। ঘটনার পাতা উল্টাই। যেমন বইয়ের পাতা উল্টানো হয়। বাগানে ঘুরি। কখনো কম্পিউটারে বসি। চিঠি পত্র লিখি। দেখি কার কার চিঠি এসেছে? একটু ফেসবুকে ঘুরে বেড়াই। ভালো মন্দ কিছু রান্না করি। কেটে যায় সময়।

(চলবে)

%d bloggers like this: