মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস / মুহাম্মদ আস্রাফুল আলম সোহেল 

 মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস

 মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস

  মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস 

—–  মুহাম্মদ আস্রাফুল আলম সোহেল 

প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের আছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস ৷ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শাসন, নানা ঘটনা-প্রবাহ, রাজনৈতিক উত্থান-পতন, সুখ-দুঃখ এবং হাসি-কান্নার পাশাপাশি এখানে রয়েছে এক মর্মান্তিক রক্তপাতের ইতিহাস! আমি সেদিকে বিস্তারিত আলোচনায় যাব না ৷ তবে এখানে বাঙালি জাতিরও আছে হাজার বছরের এক সুপ্রাচীন ইতিহাস ৷ ঐতিহাসিক ধারাবহিকতা আর দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, উত্থান-পতন, ঘাত-প্রতিঘাত, সুখ-দুঃখ এবং হাসি-কান্নার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশরা (১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ০৩রা জুন পরিকল্পনা বা Mountbatten পরিকল্পনা অনুসারে) ধর্মীয় দর্শনের ভ্রান্ত ‘দ্বিজাতি তত্ত্বের’ উপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত বঙ্গ প্রদেশকে British Commonwealth এর অন্তর্গত ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ই আগস্ট ভারত নামে দুটি পৃথক স্বাধীন অধিরাজ্য (Dominion) সৃষ্টি করে ভারতবর্ষকে বিভক্তের মধ্য দিয়ে (দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গ / Partition of India) ক্ষমতা হস্তান্তর করেন । এর ফলে ব্রিটিশ ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ রাজ (Crown) শাসনের অবসান ঘটে । পরবর্তীকালে অনেক ঘটনা প্রবাহ ও নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি তার নিজের অধিকার রক্ষায় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর দাম্ভিকতা, প্রভাব, স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব, শোষণ, নির্যাতন এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল যাবৎ আন্দোলন-লড়াই করে যান ৷  বিশেষ করে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি, এক ব্যক্তির এক ভোট, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার আন্দোলন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ, ৫৪ এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন বিজয় ও সরকার গঠন, ৬২ এর আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও শিক্ষার অধিকার আন্দোলন (গণবিরোধী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার কারণে), ৬৬ এর বাঙালির স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার সনদ ‘৬ দফা’ আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন, ৭১ এর বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়াসহ ইতিহাসের নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ তথাপি ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন এ রাজনৈতিক সংগঠনটি পরবর্তীতে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে নাম পরিবর্তিত হয়ে আজ অবধি ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ পরিচয় বহন করে চলছে । সে এক কণ্টকাকীর্ণ ইতিহাস ৷ তবুও সংক্ষিপ্তভাবে উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক, কালজয়ী ও জ্বালাময়ী ভাষণে বাঙালির স্বাধীনতার সতর্ক-কৌশলে ঘোষণা দেয়ার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয় । ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হওয়ার পরও পাকিস্তানি সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে টালবাহানা শুরু করে । এতে করে এক জটিল রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় ৷ ঐ পরিস্থিতি নিরসনের প্রক্রিয়া চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানে তথাপি বাঙালির উপর সামরিক আক্রমণ শুরু করার নির্দেশ দেন । সে মোতাবেক, সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খান আক্রমণ চালানোর জন্য মেজর জেনারেল খাদেম হোসেন রাজাকে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছিলেন । এ সামরিক অভিযানের মূল লক্ষ্যই ছিল স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, ছাত্র নেতৃবৃন্দ, বাঙালি বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও স্বাধীনতাকামী সচেতন নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যা করে আন্দোলনরত নিরস্ত্র বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের কণ্ঠকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়া ৷ তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কুখ্যাত Operation Search Light নামক সামরিক অভিযানের মাধ্যমে পূ্র্ব পাকিস্তানে পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়াবহতম গণহত্যা সংঘটিত করে । এটি ছিল মানব ইতিহাসের অন্যতম বর্বর, নিষ্ঠুরতম এবং কলংকজনক গণহত্যার একটি রাত ৷ বাঙালি জাতির জীবনে এক মর্মান্তিক এবং কলঙ্কময় অধ্যায় ৷ বৃহত্তম গণহত্যাটি পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল জঘন্যতম দৃষ্টান্ত । অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পকিস্তানি সেনাবাহিনী সে কালোরাতে বাংলার মাটিতে যে গণহত্যা চালিয়েছিল তা এক নৃশংস গণহত্যা ৷ তারা জ্বালিয়ে দেন ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট ইত্যাদি এবং লুটতরাজ ও ধ্বংস করেন বিভিন্ন স্থাপনা । পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সে রাতে ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে পাক হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক, কামান, মেশিনগান নিয়ে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালিয়ে প্রায় ৯০ হাজার নিরস্ত্র-নিরহ ঘুমন্ত বাঙালিকে হত্যা করে ৷ পশ্চিম পাকিস্তান শাসক-শ্রেণি কর্তৃক সেনাবাহিনীর প্রতি Operation Search Light সফল করতে পূর্ব পাকিস্তানে একযোগে হামলা পরিচালনা করার নির্দেশ ছিল ৷ দুটি কমান্ডের অধীন ভাগ করা হয় পূর্ব পাকিস্তানকে ৷ মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি খানের অধীন ছিল ঢাকা শহর Operation পরিচালনা করার দায়িত্ব ৷ তিনি ব্রিগেডিয়ার জেহানজেব আরবাব এবং তার ৫৭ পদাতিক ডিভিশনকে ঢাকায় গণহত্যা পরিচলনা করার দায়িত্ব দেন ৷ অন্যান্য অঞ্চলগুলোতে হত্যাযজ্ঞের দায়িত্বভার ছিল মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার উপর ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণের প্রধান উদ্দেশ্যে ৩২ পাঞ্জাবের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালিত হয় । পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এ রাও ফরমান আলি খানই পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ৷ তিনিই শান্তি কমিটি ও আলবদর বাহিনী গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন । দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার ৷ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর একটি বহর ট্যাংক, সাঁজোয়া গাড়ি ও ট্রাকভর্তি সৈন্য নিয়ে রাতের অন্ধকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ইকবাল হল ও জগন্নাথ হল ছিল প্রধান লক্ষ্যস্থল), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্রীদের ছাত্রাবাস রোকেয়া হল, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) কেন্দ্রে অবস্থিত কালী মন্দির, Hotel Intercontinental (বর্তমানে রূপসী বাংলা), পুরান ঢাকার রাজারবাগ Police Lines, পিলখানায় অবস্থিত East Pakistan Rifles এর সদর দপ্তর, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, জাতীয় প্রেস ক্লাব, সাপ্তাহিক পিপল পত্রিকা কার্যালয়, নীলক্ষেত, বাংলামোটর, চামেলীবাগসহ বিভিন্ন স্থানে এবং রাজধানী ঢাকার বাইরে রংপুর, সৈয়দপুর, কুমিল্লা, যশোর, সিলেট, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীর সারদা পুলিশ প্রশিক্ষণ একাডেমীসহ অসংখ্য জায়গায় হত্যা, নারকীয় তাণ্ডব ও পৈচাশিকতার মাধ্যমে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালায় ৷ জগন্নাথ হলে চলে সবচেয়ে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ৷ আরো কিছু বাহিনী আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দকে হত্যা বা ধরপাকড় করতে গেলে অধিকাংশ নেতাই পালিয়ে গিয়ে জীবন রক্ষা পান । বৃদ্ধ, শিশু, নারী, পুরুষ, রিক্সাচালক, ছাত্র, শিক্ষক, বাগানের মালী, কর্মচারী, সাংবাদিক, পাহারাদার, পুলিশ, মধুর কেন্টিনের মালিক মধুসূধনের পরিবারের সদস্যদেরসহ নিরীহ জনগনকে তারা নির্বিচারে হত্যা করেন ৷ সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক ডঃ গোবিন্দ চন্দ্র দেব, জগন্নাথ হলের প্রভোষ্ট পণ্ডিত জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ডঃ মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক ফজলুর রহমান, ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক আবদুল মুক্তাদির, গণিত বিভাগের অধ্যাপক আ র খান খাদিম, অধ্যাপক শরাফত আলীসহ অসংখ্য শিক্ষক-ছাত্রকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি চালিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে সেখানেই গণকবর খুড়ে দ্রুত মাটি চাপা দেয়া হয় । পুরনো ঢাকার হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক গণহত্যা চালানো হয় । এদিকে অন্য একটি সামরিক বহর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করার উদ্দেশে ধানমন্ডির ৩২নং সড়কে অবস্থিত তার বাসভবনের দিকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে যায় । পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে অবরুদ্ধ করে রাখেন ৷ সু-জলা, সু-ফলা, শস্য, মৎস্য, চির সবুজ, নদীমাতৃক, অপার সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যময় সোনার বাংলার মানুষের প্রাণপুরুষ শেখ মুজিব দোতলায় একটি ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন । যে মহান নেতার একমাত্র বিলাসিতা ছিল বিখ্যাত পাইপে এক শীতল স্বাদযুক্ত প্রিয় সুগন্ধময় এরিনমোর তামাক (Erinmore Pipe Tobacco) দিয়ে ধূমপান করা এবং দার্জিলিং চা । গ্রেফতার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে ২৬শে মার্চ (আনুমানিক রাত ১২টা ২০ মিনিটে) প্রথম প্রহরে এক তার বার্তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন: “This may be my last message: from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.” ৷ সমগ্র বাঙালির রক্তে আর চেতনায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে প্রতিরোধের দুর্বার স্পৃহা ৷ স্বাধীনতার দীপ্ত আকাঙক্ষা ৷ দেশমাতৃকাকে রক্ষা করতে বাংলার দামাল সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা রুখে দাঁড়ায় পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে । শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ । দীর্ঘকাল যাবৎ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী দ্বারা শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মুক্তির মহামন্ত্রে অনুপ্রাণিত এবং উজ্জীবিত হয়ে জীবনবাজি রেখে প্রাণপণ লড়াই করে যান ৷ উল্লেখ্য, ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা এবং জাতীয় দিবস ৷ বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়ের দিন ৷ পরাধীনতার শিকল ভাঙ্গার দিন ৷ রক্তে লেখা গৌরবোজ্জ্বল দিন ৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করে প্রথমে রাখা হয় রাজধানীতে নির্মাণাধীন তৎকালীন National Assembly Building (বর্তমানে শের-এ-বাংলানগর) এ । সেখান থেকে তাকে সরিয়ে নেয়া হয় ক্যান্টনমেন্টের আদমজী কলেজে এবং পরবর্তীতে Flagstaff House এ । তিন দিন পর শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী অবস্থায় বিমানে করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালি কারাগারে এবং সেখানে তাকে আলাদাভাবে বন্দী করে রাখা হয় । মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে গোটা পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) হয়ে উঠেছিল বধ্যভূমি । ১৩ই জুন ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানি সাংবাদিক নেভিল অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস ঢাকা ও কুমিল্লা সফর করে নৃসংশতার ভয়াবহতা ও প্রতিকূল পরিস্থিতি দেখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন এবং এ বিষয়ে লন্ডনের The Sunday Times পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন লিখেন ৷ পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষ পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে সরব হয়ে উঠেন । পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে তৈরি হয় এক বিশাল জনমত । এ গণহত্যা বন্ধের লক্ষ্যে, বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে নৃশংসতার ফলে সাহায্যের উদ্দেশে এবং সমর্থনে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সচেতনতা, তহবিল সংগ্রহ ও ত্রাণ প্রচেষ্টা বাড়াতে পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত পপ সঙ্গীতশিল্পী, গীতিকার, বেজ গিটার বাদক George Harrison এবং ভারতীয় সেতার বাদক পণ্ডিত রবি শংকর ”The Concert for Bangladesh” আয়োজন করেন । আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ফরাসি দার্শনিক, ঔপন্যাসিক ও রাজনীতিক আঁদ্রে মালরো (André Malraux) পূর্ব পাকিস্তানের সমর্থনে ”আন্তর্জাতিক ব্রিগেড” গঠনের ঘোষণা দেন । এছাড়া প্যারিস, লন্ডন ও বিশ্বের অন্যান্য শহরে পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার জনগনের মানবিক কণ্ঠ জেগে উঠে । Guinness World Record এ বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের পাঁচটি ভয়ঙ্কর গণহত্যার অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে । এ গণহত্যা সম্পর্কে অন্যতম প্রধান পাকিস্তানি জেনারেল (Rao Farman Ali) রাও ফরমান আলি খান তার ডায়েরিতে লিখেছেন: “Green land of East Pakistan will be painted red” অর্থাৎ, তিনি বাংলার সবুজ মাঠকে রক্তবর্ণ করে দিবেন ৷ তবে পাকিস্তানপন্থী এ দেশীয় কিছু কুলাঙ্গার বাঙালি বিশ্বাসঘাতক রাজাকার, দালাল, আল বদর ও আল শামস্ বাহিনী মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাক-হানাদার বাহিনীকে সার্বিক সহযোগিতা করে এবং পাক বাহিনীর নেতৃত্বে এরা উভয়ই ভয়ানকভাবে গণহত্যা, হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে ৷ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগণ যুদ্ধের অনিবার্য পরাজয় বুঝতে পেরে বাংলাদেশকে চিরতরে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে স্বাধীনতা লাভের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে তাদের নির্দেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে রাজাকার, দালাল, আল বদর ও আল শামস্ বাহিনীর সহযোগিতায় বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান অসংখ্য বুদ্ধিজীবীদেরকে সুপরিকল্পিতভাবে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে ৷ উল্লেখ্য, ১৪ই ডিসেম্বর ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ এবং বাঙালি জাতির জীবনে আরো একটি বেদনাদায়ক দিন! দুই লক্ষাধিক মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং ত্রিশ লক্ষ প্রাণের এক মহাসাগর রক্তের বিনিময়ে বীর বাঙালি জাতি দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সম্মুখ যুদ্ধে পাক-হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে । ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ কমান্ড ‘মিত্র বাহিনী’র কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শর্তহীনভাবে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাঙালির কাঙিক্ষত “বিজয়” অর্জিত হয় ৷ মহান মুক্তিযুদ্ধে পরম বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারত আমাদেরকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে এবং বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা কূটনৈতিক উদ্যোগ নেয় ৷ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে সহায়তা প্রদান করতে গিয়ে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর ৪৩৫৩ জন ভারতীয় সৈনিক পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে নিজেদের রক্ত দিয়ে জীবন উৎসর্গ করেন ৷ বাংলাদেশের মানুষ তাদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ ৷ মহান মুক্তিযুদ্ধ বীর বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে গৌরবময় ঘটনা ৷ বিজয়ের বহ্নিশিখা । তাই, ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের মহান বিজয় এবং জাতীয় দিবস । বাঙালি জাতির সুদীর্ঘ ইতিহাসে অগ্রগণ্য অর্জন হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ । সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জিত হয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র । যার স্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমান এবং এটি তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন । আত্মপ্রত্যয়ী বীর বাঙালি জাতি অর্জন করে স্বাধীনতা, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, সংবিধান এবং বিশ্বের বুকে গর্বিত পরিচয় । ইতিহাসের পাতায় রক্তলাল অক্ষরে লিপিবদ্ধ হয় বাঙালির মুক্তির ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস এবং আত্ম-পরিচয়ের ইতিহাস । বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাঙালির মুক্তির মহানায়ক । বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে সোনার বাংলার কৃষক-শ্রমিক-কামার-কুমার-গরিব-দুঃখী-মেহনতী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল তার সারা জীবনের একমাত্র লক্ষ্য । কারণ, বাংলার আপামর মানুষকে তিনি ভালোবাসতেন, বিশ্বাস করতেন এবং তাদের ভালোবাসাই ছিল তার বড় শক্তি । তাই বাংলা, বাঙালি, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ এক অবিচ্ছেদ্য সত্তা । বাঙালির তীব্র আকাঙক্ষার মহান স্বাধীনতার ইতিহাসে জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান ৩০ লক্ষ আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদের মহাআত্মদান, দুই লক্ষাধিক মা ও বোনের সম্ভ্রমহানি-ত্যাগ-তিতিক্ষা, কোটি বাঙালির মহৎ আত্মনিবেদন এবং সংগ্রামের গৌরবগাঁথা গণবীরত্বের অগ্নিময় ইতিহাস চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে । পাশাপাশি পাক-হানাদার বাহিনীর অভিযুক্ত ঐ সকল মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী এবং এ দেশীয় নির্লজ্জ রাজাকার, দালাল, আল বদর ও আল শামস্ বাহিনীর অভিযুক্ত মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বাঙালি জাতি কোনোদিন ক্ষমা করবে না ৷ তারা ইতিহাসের আস্তাকুড়ে ঠাঁই নিয়ে চিরকাল ঘৃণিত, কলঙ্কিত এবং পরাজিত হয়ে থাকবে ৷

তথ্যসূত্র: অন্তর্জাল (The Internet) এবং উইকিপিডিয়া ৷

মুহাম্মদ আস্রাফুল আলম সোহেল
মুহাম্মদ আস্রাফুল আলম সোহেল