নির্ঝরা – খাতুনে জান্নাত

খাতুনে জান্নাত

খাতুনে জান্নাত

দুই চামচ নীলে আধাচামচ সাদা মেশানো নীল রঙের জমিনে সাদা শিউলি আঁকা বিশ বছর আগের সুতি শাড়িটা নির্ঝরা প্রায়ই পরে। পুরনো শাড়ির গায়ের গন্ধটা মগজে এনে দেয় সে দিনগুলোর মাদক। শাড়ির কয়েকটি জায়গায় ছেঁড়া। কেউ ডেকে বলবে না ‘ছেঁড়া শাড়িটা পরছো কেন, বল তো?’ মান অভিমানের পরত পেরিয়ে নির্ঝরিণী একা দাঁড়িয়ে আছে জীবনের পশ্চিম গগনে। আজ মধ্যরাত্রির  ঘুমহীন স্তব্ধতায় নির্ঝরা চিত্রপটের দিকে তাকিয়ে আছে। বিশ/সাতাশ ইঞ্চির ক্যানভাসে নিজের আঁকা চিত্রটি ইজেলে ভাসছে। চারটি স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো কাঠের এ ইজেলের মাঝখানে ড্রয়ার যাতে রাখা যায় রঙ আর ক্যানভাসের নিচে আড়াআড়িভাবে তুলি। একটি কাঠের পাতলা অংশ বেরিয়ে আসে একটা বোতাম টিপলে । যাতে ব্যবহৃত তুলিগুলো দাঁড় করিয়ে রাখা হয় একটা পটে। ইচ্ছে করলে একে ভাঁজ করে বাক্স বানিয়ে ব্রিফকেসের মতো নেয়া-আনা করা যায়। লন্ডনের আর্টের সরঞ্জামাদির দোকান ‘আটলান্টিস’ থেকে নব্বই পাউন্ড দিয়ে কিনেছে ইজেলটা। গত দশ বছর ধরে চলছে বিরামহীন আঁকাআঁকি। কয়েক হাজার ছবি।

বাইরে নিয়েছিল অনেকবার। টেমস নদীর পাড়ে। লন্ডন ব্রিজের কিনারা ঘেঁষে দেয়ালটা শেষ হয়েছে যেখানে। নৌকা আর নদীর ছবি ছিল সেটা। আরো মাইল্যান্ড পার্ক, কিউ গার্ডেন। কিউ গার্ডেন মানে প্রকৃতি। সাজানো অথচ সাজানো নয়। যেন খোলা প্রকৃতি অথচ পার্ক । ছিল একটা গ্রিন হাউজও। যাতে বিভিন্ন দেশের ছোট ছোট গাছ ও গুল্ম সাজানো থরে থরে। পৃথিবীর বৃহত্তর অঞ্চলগুলোর সবুজ গাছ ও তৃণলতা। এশিয়ার গ্রামের কচুশাক আর ঢেঁকিশাক আর বাগানের মাটি নির্ঝরার চোখে জল এনে দেয়। দেশের মাটিতে নাড়ি, দেশের মধ্যে প্রাণ। নয়তো চোখে জল আসে কেন! তাই তো এ ফিরে আসা মাটির গন্ধ শুঁকে স্মৃতির হরিয়াল।

‘প্রবাসী পল্লীর কাছ থেকে কেনা পাঁচ কাঠার তিন দুই অংশে করা তার বাড়িটি রূপগঞ্জের প্রকৃতির কোল। বাড়িটির পঞ্চাশ চল্লিশ ফিটের এ কক্ষটি নির্ঝরার ছবি আঁকার ঘর। আর্টিস্টগণ যাকে স্টুডিও বলেন।রাত নিঝুম হলেই ঘুমের ফাঁক গলে নির্ঝরা তার স্টুডিওতে আসে। নির্ঝরিণী-নির্ঝরা-নিঝু তিনটিই তার ডাক নাম। কারো আদুরে ডাক ছেনীর মতো বুকে বিঁধে। আহা ডাকটা থাকুক…রঙ আর তুলি, ইজেল আর ক্যানভাস। অংকন আর মগ্নতা। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষের মত ঋজু তার মনোবল। কোথাও ভাঙন নেই, রিক্তের বেদনও নয়। স্পর্শ করে ‘আমার আমি’কে। এ ঘর থেকে আকাশ দেখা যায় না। মগ্নতার গভীরে ঢোকে আকাশ স্পর্শ করে নির্ঝরা। গায়ে মাখে মেঘ-রোদ আর বৃষ্টি। ডুব দেয়। স্মৃতির গহীন থেকে তুলে আনে শাপলা-শালুক আর হিজল তমালের ছায়া। নিরিবিলি এ সময়টায় স্পর্শ করে অধরা সময় আর পেরিয়ে আসা দিনের অনুরাগ। এ ঘরের দেয়াল ও মেঝেতে ঝুলন্ত, স্তূপাকার,  আর আড়াআড়িভাবে রাখা চিত্রপটে সে-সব মনি-মুক্তো ঝলঝলে।

মগ্নতা তাকে নিয়ে যায় শহর ছেড়ে কোন দূর গ্রাম-পথ পেরিয়ে কোন এক আধভাঙা পাকা পুকুর ঘাটে। পাকা বলেই তো দুইঘরের মাঝের কাঁটা দিয়ে আটকে দেয়া পথ কষ্টে ফাঁক করে এতটা পথ পেরিয়ে এ ঘাটে আসে। শুকনো সুপুরিপাতা দিয়ে ঘাট থেকে দশ হাত দূরে বেড়া দেয়া সামনের দিকটা। ঘাটে একটি  ছেলেশিশু জল ছিটায়। সে ছেলেশিশুর পানিতে হিসি করার কারণে মেয়েশিশুটি সিঁড়ির পাশ ঘেঁষে বসে। সকালের বাসি মুখ ধুতে হবে যে। হাত দিয়ে সরায় ‘ও হিসি জল এদিকে এসো না।’ আচমকা হিসিশিশুটির ধাক্কায় পানিতে পড়ে যায় সিঁড়ির পাশঘেঁষা মেয়েশিশুটি। সাঁতার জানে না গো… পাড়ছোঁয়ানো বর্ষার ডুবোপুকুর।  শিশুটি ভাসে-ডোবে হাত বাড়ায় কিনারা চায়। ওহ! নির্ঝরা কেঁপে ওঠে!

চিত্রপটে ধাক্কায় পড়ে যেতে থাকা শিশুটিকে আঁকছে নির্ঝরা। কিছু জল ছিটকে উঠেছে চারদিকে… শুকনো হলুদ পাতার মতো ফ্রক পরা, ফুটফুটে ত্রিকোণ মুখ। থৈ থৈ জল, চারপাশে ঘন গাছ। আম, গাব, করই, মান্দার, ডুমুর, কৃষ্ণচুড়া, সোনালু কি নেই! বৃক্ষদের আদরের কোলে এ স্তব্ধ পুকুর গ্রামের বৌ-ঝিদের এ-ঘাট থেকে ও-ঘাটে গল্পের মুখরতায় মেতে থাকা বেশি সময় । মাঝে মাঝে ‘ডুব ডুব’ করে পুকুরে পড়ে আম, গাব ও টুপ করে ডুমুর। কখনো ঝপাৎ শব্দে নারিকেল। মালিকপক্ষের সাথে ছুটে আসে আরো অনেক পক্ষ ভেসে থাকা নারিকেল দেখে। নিজের গাছের সাথে মেলায়। চিত্রে পুকুরের পানিতে আধা ডোবানো একটি নারিকেল গাছ বেঁকে আধশোয়া – মাথাটা উপরের দিকে। দু’দিকে পা ঝুলিয়ে কয়েকটি বাচ্চা বসে থাকা গাছটি হতে কিশোর কিশোরীর পানিতে লাফ। সবুজ মোড়ানো পুকুরের রঙটা সবুজ হওয়া চাই। নীল আর লেবু হলুদ আর সাদা মেশালে যে সবুজ হয় অনেকটা তেমন হবে এ কিনারার জলের রঙ। পাতার রঙ করতে শুধু নীল আর লেবু হলুদ, আর বুড়ো পাতা হলে সোনালি হলুদ!

‘রঙটা একটু বেশি করে মিশ্রণ করো; না হলে পরে একই রঙ পাওয়া কঠিন হয়।’ কে কে বলছে! গল্পের রঙ মাখিয়ে কঠিন প্রশিক্ষণের বিষয়গুলোকে সহজ করার গতিময়তা! সেই যে তরুণ কাল! হ্যাঁ, বাটিক, সেলাই ম্যাডাম।  ব্লক, রঙ,তুলি, পানি, মোম, রজন, গাম…জীবন অন্বেষণ। শাড়ির পর শাড়ি, থ্রি পিচের পর থ্রিপিচ ব্লক করো, বাটিক করো ফেব্রিক্সে ব্রাশ ঘষাও।

‘প্রতি শাড়িতে ব্লক করলে একশত বিশ টাকা পাবে আর বাটিক করলে দেড়শত টাকা। করবে কি?’ কেন নয়। সংসার নুন আনতে পান্তা ফুরুবার দলে। আরও চাই তেল, সবজি; মাংস নাই হলো মাছ, ডিম তো খেতে হয়। ছোট মাছের প্রতি ভাগা পাঁচ টাকা, বড় হলে দশ। সাথে থাকে মুখ হা করা বাসা ভাড়া। বাসা নয় গো ছোট ঘর। পাখির বাসার মতো। তার ভেতর বাবুই পাখির মতো কারুকাজের শৈল্পিক যুগল-মন। ‘গুনগুনগুনকি কথা বলে সারাদিন। কারো দিকে কোনো নজর নেই পাগল জুগল।’  ফ্ল্যাটের শেষ সীমায় ছোট ঘরটিতে যেতে একে একে দুটো শোবার ঘর পার হতে হয়। কেউ শুয়ে থাকে কেউবা বসে…গম্ভীর ভারকরা মুখ। একদিন কত গান হয়েছিল একসাথে, কত গল্প, হাসি, ঠাট্রা, কত আবেদন নিবেদন। জীবন যখন পড়তির দিকে আপনজনও সে পথ ধরে হাঁটে আগে আগে।

ঘরটির ছোট জানালার সামনে বিশাল আমগাছ। টুপ করে আম পড়ে। কখনো বাদুড় আর বানরেরা খায় ও খেলা করে ছুঁড়ে মারে জানালার সামনে; ছোটবেলার কথা ছ্যাৎ করে কাঁপিয়ে দেয়। জানালা খোলা রাখলেও কেউ দেখে না। শুধু দেখে অভাব আর চেটেপুটে খায় ভালোবাসার গুঞ্জরণ। পরস্পরের আলিঙ্গন থেকে খুলে নেয় রোদ আর আবেগের মোহময়কালে মাখে কালির পোঁচ।  মৌ মক্ষিকা হয়ে ফোটাতে থাকে হুল। নির্ঝরার সংসার যেন আচমকা ঝড়ে কাদায় মুখ থুবড়ে পড়া মাছরাঙ্গা।

নির্ঝরা ব্লক করে, বাটিক করে…‘রঙের উপরে রঙ মানে ডাবল ব্লক হলে শুধু আঁচল পাড়ের কাজে পঞ্চাশ টাকা, ম্যাডাম পাবে দেড়শ টাকা। তা পাক। তার ব্লক, রঙ ও ঘর। দোকানীরা তাকেই কাজ দিয়েছে। দোকানীরা বিক্রি করবে আটশত থেকে এক হাজার টাকা। ব্যবসা তো এটাই যত ছোট তত বেশি পরিশ্রম আয় কম। রঙের মিশ্রণটা শিখে নিলে নির্ঝরা নিজেই করতে পারত এ কাজ । কিন্তু এসব কাজের আদি ইতি শিখতে লাগবে এক হাজার টাকা। বাটিকের আরো বেশি মোম, রজন, গাম, লোহার ব্লক আর শেখার চার্জ পুরো দুই হাজার টাকা।‘কাজ থেকে টাকা কেটে নিয়ে দিন না ম্যাডাম ব্লক শিখিয়ে।’ নির্ঝরার আহ্লাদী আবদার শুনে ম্যাডাম হিসাবী মাথা নাড়ে। এক হাজার টাকা হাতে দিতে হবে এক সাথে নগদ। না হলে নাকি শেখা হবে না ঠিকমতো। কাজ শেখা সোজা কথা নয়। কাজ তো এক জীবনের সম্বল আরো জীবনও যেতে পারে। নির্ঝরা কাজ করে আর শোনে ফাঁকে ফাঁকে একটু দূরের ম্যাডামের ব্লকের ক্লাশ। বিভিন্ন সময়ে শোনা ভাঙা ভাঙা শব্দ শুনতে শুনতে মেলায় সবক’টা শব্দকে, ‘এক চামচ ফিক্চার, চার চামচ নিউটেক্স, দুই চামচ বাইন্ডার, রঙ দাও চোখের আন্দাজ যেমন রঙ তুমি চাও। বাস রঙ রেডি হয়ে গেল। রঙটাকে নরম রাখার জন্য ইউরিয়া দিতে পারো। পারো দিতে কয়েকফোঁটা গ্লিসারিন। রাক্ষুসের প্রাণ ভ্রমর আবিষ্কারের মতোই ডালিমের লালের খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠে নির্ঝরা।‘পেয়ে গেছি পেয়ে গেছি।’ কাজ করতে করতে ক্যামিকেলস এর নামগুলো এমনিতেই জানা হয়ে গিয়েছিলো। আবার আওড়ায় মিশ্রণ প্রণালী। আহা উদ্ধার হয়েছে স্বপ্নের মণিকাঞ্চন!

দ্রুত কাজ শেষ করে চট থেকে রঙ তুলে, ব্রাশ ও ব্লক ধুয়ে, সবকিছু ঠিক জায়গায় রেখে কাপড়ের  টাকা নিয়ে দুপুরের কড়া রোদ,জ্যাম আর যানজটের ভেতর দিয়ে দৌড়ায় নির্ঝরা। আলু, ডিম ও তেল কেনে। আর কেনে সাত টাকা দামে একটা চকবার। মাঝে মাঝে চকবার খেয়ে তার মন থেকে অভাবের অভাবীয় বোধটা সরিয়ে ঘরে ঢোকে। লেখক হওয়ার সাধনা নিয়ে সাংবাদিকতার চাকুরি ছেড়ে আসা স্বামী ঘুমায়। চশমার আড়ালে চকচক করে শ্যামল মুখশ্রী। বই পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বইটা বুকের উপর। বই পড়ুক…একদিন লেখক হবে যে…আহা ঘুমন্ত মায়ামুখ। ইচ্ছে করছে একটি চুমু এঁকে দেয়। ‘না’- নির্ঝরা সামলে নেয় ঘুম ভেঙে যাবে। আহা ঘুমুক; আরামের ঘুম ঘুমিয়ে উঠে লিখুক কিছু। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ যাই হোক হাতের কাজ শেষ করে তার কোলে মাথা রেখে শোনে নির্ঝরা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লিখিয়েদের সাথে দেখতে পায় সে প্রিয়মুখ। তাকে লেখক বানাতে আজীবন কাজ করে যাবে একা, সহে যাবে সব বিভেদ, বেদনা আর গ্লানির নির্মম প্রদাহ।

সিঁদেল চোরের মতো খাটের নিচ থেকে এক হাতে মসলাপাতির ছোট ডালা ও অন্য হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে। আবার ঘরে গিয়ে তরকারীর পাতিল ও ছোট একটা বাটিও আনে। এ ফ্ল্যাটের সাবলেট সে নিজের সবকিছু ঘরেই রাখতে হয়।

নির্ঝরার চশমা-আঁটা চোখে এখনো খেলে বেড়ায় লাল-সবুজ মাছ। শাড়ির জমিনে কেমন এঁকেবেঁকে যায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে সে তরুণী কি সুন্দর মিলে মিশে থাকে ডাবল ব্লকে। ‘নিজের কাজ দেখে নিজেই মুগ্ধ!’ ম্যাডামের ঠাট্রা গায়ে মেখে চোখ সরায়। নতুন শাড়ি, ওড়না, থ্রিপিচ থেকে বেছে নেয় আরেকটি। ওড়নার কাজ শেষ হতেই চায় না। মেডাম একটি খাবারের বাটি এগিয়ে দেয়। গতকালের রান্নার ক্লাশে তৈরি করা পেটিস ও পেনকেক। হাত ধরে আসা, শ্বাস জোরে পড়া শরীরকে চালু করতে খাবার হাতে নেয়।

:দুইশত টাকা হলেই রঙ কিনে প্রাথমিক কাজ করা যাবে ম্যাডাম?

খাবার  প্লেটের দিকে তাকিয়ে থাকা নির্ঝরার প্রশ্নের উত্তরে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকায় ম্যাডাম। চশমার লেন্স ঘোলাট হয়ে আসে ম্যাডামের। ‘তবে কি গোপনে কাজের অর্ডার নিতে শুরু করেছে নির্ঝরা। কাজ শিখলো কার কাছ থেকে! কোন ছাত্রী নিশ্চয় কম টাকায় শিখিয়ে দিয়েছে। অথবা কাজের অর্ডার থেকে টাকা পেয়েছে গোপনে! অসহ্য মেয়েরা এইসব কেন করে ! নিজেই হাতিয়ে নেবে মনোয়ারা বেগমের ব্যবসা। না নির্ঝরাকে আর আসতে দেওয়া হবে না এ ‘উত্তরণ মহিলা সেন্টারে!’

 

‘গুড়ুম গুড়ুম’ মেঘ ডাকে। ভারী বৃষ্টি হবে। মেঘ ডাকলে চঞ্চলা হয়ে যায়। ঝড় হবে শো শো বাতাস। মট মট করে কি যেন পড়ে। ডাল ভাঙলো বুঝি! কারো বা ছাদের উপরের টিন। পা নিসপিস করে দৌড় দিতে। সেই আমবাগান, তালতলা। ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে কত সকাল বিকাল কাজে ভরে থাকত। তার এ তিনতলা ঘরের চালে টিন লাগানো। ঝমঝম বৃষ্টি শুনবে আর ভেসে যাবে শিশুকালে, কিশোরীকালে, যৌবনের আংশিক বৃষ্টি গেয়েছিল। ডুবতে ডুবতে ভাসতে ভাসতে আঁকড়ে ধরেছিল এক বুড়ো বৃক্ষের শিকড়। সে বৃক্ষটিকে একটি ক্যানভাসে তার সাথে ধরে রেখেছে সে। রঙ ও তুলিতে আটকে থাকুক জীবন গতির মুহূর্তকয়েক। এ ঘরটিতে হাজার ক্যানভাসে জমে আছে জীবনের লক্ষ টুকরো কথা। কখনো ব্যর্থ হয়েছে। অর্ধ বা পোনে অংশ সফলতা ব্যর্থতার রঙিন-কালো পোঁচে মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে। প্রুশিয়ান, একরামিন ও তেল রঙে আঁকা এসব জীবনছবি নির্ঝরার একার। এ-ঘরে ঢোকার অনুমতি নেই কারো। কিংবা কাউকে দেখানোর তাগিদও নেই। কোথাও ঢলে পড়ে আছে সাঁকো, কোথাও খুলে পড়েছে বাকল, কোথাও ঝরছে জীবনঅশ্রু, কোথাও স্নিগ্ধতা, কোথাও আবেগ, কোথাও তিক্ততা। প্রেম-প্রণয়-প্রাপ্তি ও পূর্ণতার বিশুদ্ধ ব্যাকরণ আর প্রতারণার ছোবলমাখা অবিমিশ্র খন্ডায়ন নির্ঝরা রঙে-কালিতে আঁকছে। রঙের গন্ধে যেন শ্বাস। রঙ মানে বেঁচে থাকা, অতীত থেকে স্ফুরণ নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া। স্মৃতির আমেজে ঠাঁসা বুকের তিতির তার এ ছবিগুলো কাউকে দেখায় না সেদিন থেকে যেদিন একজন তার মা ও শিশুর একটা ছবি কিনতে চেয়েছিল। তার মনে হয়েছিল তার প্রাণ কেউ কেটে নিতে চাইছে… প্রাণ কেটে টাকা আয়ের আর সময় নেই তার।

তার কক্ষটি বাদে দোতলার ছাদ যা তিন তলার উঠোন। সে উঠোনের এক পাশে উপরে ছাদওয়ালা বেশ কিছু জায়গা। সেখানে বসার বেঞ্চিতে বসে বৃষ্টির মাতলামী দেখে। বৃষ্টির উন্মাতালতা তাকে রঙতুলিতে মগ্ন থাকতে দেয় না। ‘নিঝু নিঝু’ প্রিয় কোন ডাক বুকে ছেনীর মতো বিঁধে।

…বিজন বিবশ রাতে কথা বলে কে যে!

বুকের পাশটি ছুঁয়ে কার আদৃত চোখের পাতা

কোন কালের গল্পের ভিড় পরান ডাঙার মোড়ে

আজ কার কথা মনে পড়ে!

‘ইচ্ছে করে আঁচল খুলে দিয়ে বৃষ্টি-বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে আসি নিজের নিজেকে।’ বৃষ্টিতে ভেজার বয়স এটা নয় নির্ঝরা বোঝে। ‘তুমি এত বোঝ কেন মা? বেশি বুঝে বুঝে শুধু শুধু কষ্ট বাড়াও। ’ বড়দের কত শুধু কাজ শিশুরা বোঝেই না। ছেলেমেয়েরা প্রায়ই আদরের ধমক দেয়। শিশুবেলার তার ছেলেটার পাকা কথা ‘ একটা রিকসা কিনো না মা! গাড়ি তো আমি কিনবো, বড় হলে।’ কখনো বলত,‘আমাকে মাছ কাটা শিখিয়ে দাও মা; আমি তোমার মেয়েও হবো ছেলেও হবো।’ না ছেলেটা শুধু ছেলেই হয়ে রইলো আর মেয়েটাও ছেলে হতে চায়। এ পৃথিবীটাই ছেলে হবার প্রতিযোগীতায় মেতে আছে। ছেলে মানে ক্ষমতা, ছেলে মানে বড়, ছেলে মানে আগেভাগে দৌড়ানোর কৌশলরপ্ত করতে পারার; দক্ষতা অর্জনকারী।

নিজস্ব ঘরে ঘুমুচ্ছে তার বড় হয়ে যাওয়া শিশুরা। সবাই নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখে গেছে। কাউকে নিয়ে আর রাত জাগার ক্লান্তি নেই। গলার ঘাম মুছে দেবার কসরত কিংবা ফ্যান কমানো বাড়ানোর জন্য উঠানামা নয়তো মশা। মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে হিসি করানোর সময় তো বহুদূর অতীতের ছায়ায় লুকিয়ে পড়েছে…

এখন শুধু নিজেকে পাহারা দেয়া আর বাঁচিয়ে রাখার কসরত। এখন শুধু নিজকে গুছিয়ে নেয়ার দিনরাত। সবার দরোজা ভেতর থেকে বন্ধ। শুধু নির্ঝরা খোলা রাখে দরোজা; যদি কখনো কেউ খবর নিতে এসে বন্ধ দরোজা দেখে ফেরত চলে যায়!