অস্তিত্বের সন্ধানে / আফরোজা পারভীন
অস্তিত্বের সন্ধানে / আফরোজা পারভীন
অফিস ফেরত আসিফ ঘরে ঢুকল হুড়মুড় করে। উত্তেজনায় যেন ফুটছে। হাতের ব্রিফকেসটা এত জোরে রাখল যে মনে হল ছুঁড়ে ফেলল। ধপাস করে বিছানায় বসে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,
: কাল যাচ্ছি। সকাল ৭টায়
: কোথায় যাচ্ছ। এত উত্তেজনার কারণই বা কী?
: আমিও তো বুঝতে পারছি না তোমার মধ্যে উত্তেজনা নেই কেন! এতবড় একটা ব্যাপার
: কি ব্যাপার?
: আশ্চর্য মানুষ তো তুমি, কানে তুলো দিয়ে রেখেছ নাকি, নাকি চোখে দেখতে পাও না। এতদিন ধরে একই কথা হচ্ছে রোজ
এবার সিমি সত্যিই রেগে গেল। এ কেমন ভাষা। এমন ভাষায় তো কখনই কথা বলে না আসিফ। কি এমন হলো যে তার চিরদিনের চেনা ভাষাটা হারিয়ে গেল। কানে না শোনা, চোখে না দেখা এসব সস্তা ম্যানমেনে ডায়লগ দিচ্ছে আসিফ তার উদ্দেশ্যে!
উত্তেজিত কণ্ঠে সিমি বলল,
: বুঝে শুনে কথা বল। কানে শুনি না, চোখে দেখি না মানে?
: কানেই যদি শোনো তাহলে ভুললে কী করে যে কাল আমাদের পদ্মা সেতু দেখতে যাবার কথা! কদিন ধরে লাগাতার আলাপ আলোচনার পরই তো দিনটা ঠিক হলো।
ওহ্ তাহলে পদ্মা সেতু দেখতে যাবে বলে এত উত্তেজনা, এত উন্মাদনা! শুক্রবার মানে কাল পদ্মা সেতু দেখতে যাবার কথা সেটা ভোলেনি সিমি। কিন্তু তার জন্য এই মারাত্মক উত্তেজনা তাও বোঝেনি। কী আছে এমন পদ্মা সেতুতে! একটা ব্রিজ বই আর কিছু তো নয়। একসাথে গাড়ি ঘোড়া আর রেল চলবে এইত। এমন তো কত দেশেই চলে। ব্রিজটা অন্য দশটা ব্রিজের চেয়ে অনেকটা বড় আর খরস্রোতা নদীর উপর নির্মিত হয়েছে এইত কথা। তা নদী যতটুকু ব্রিজ তো আর তার চেয়ে কম হতে পারে না। একটা খরস্রোতা নদীর উপর যদি ব্রিজই না বানানো গেল তাহলে গুচ্ছের টাকা খরচ করে ইঞ্জিনিয়ার হবার দরকার কী। সিমি গম্ভীর।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন থেকেই শুরু হয়েছে মাতামাতি। পারলে সেদিনই যায় আসিফ। অনেক ভিড় ভাট্টা হবে, প্রধানমন্ত্রী যাচ্ছেন, আজ না যাওয়াই ভাল এমন অনেক কথা বলে বুঝিয়ে সেদিনের জন্য নিবৃত করেছে সিমি। কিন্তু যাবার পরিকল্পনা বদলাতে পারেনি। সাথে ইন্ধন দেবার জন্য জুটেছে তার দুই বোন রুমি আর রুনি। বোনের কাছে পাত্তা না পেয়ে সারাদিন দুলাভাইয়ের কান ভাঙানি দিচ্ছে। দুলাভাইও শালি অন্তঃপ্রাণ। অন্যসময় এটা খুব ভাল লাগলেও এবার লাগছে না। সিমির ইচ্ছে নয় একগাদা টাকা খরচা করে পদ্মা সেতু ঘুরতে যাবার। মাসের শেষ। হাতে টাকা পয়সা নেই। আর যাবার দরকারই বা কী। সেতুতে নামা যাবে না, ছবি তোলা যাবে না, দেখতে হবে গাড়িতে বসে। তাহলে কী দরকার এসব হাঙ্গামার। আসিফ-সিমির বাড়ি যখন পদ্মার ওপারে শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ি যেতে হলে তো পদ্মার উপর দিয়েই যেতে হবে। তখন দেখে নিলেই হবে। তখন না হয় রুমি, রুনিকে সাথে নেবে। এই কথাটাই আসিফকে বলেছিল সিমি। তাতে আসিফের সেকী তীব্র প্রতিক্রিয়া
: তুমি এত বেরসিক কেন? খালি টাকার চিন্তা করো। সারাদেশের মানুষ ব্রিজ দেখতে যাচ্ছে আর তুমি বসে বসে টাকার হিসাব কষছ
সিমি অসিফের ভৎর্সনা গায়ে মাখেনি। সংসারের ভালোর জন্য সব সময় সব কথা কানে নিতে নেই। ও অনেক ঘেটেঘুটে একটা পথ বের করল। একটা মাইক্রোবাস নিয়মিত পদ্মা সেতু দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে। জনপ্রতি ১০০০ টাকা। সকাল খেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাওয়া দাওয়া, পদ্মা সেতু ঘুরে দেখানো। এ বরং ভাল। কোন ঝক্কি ঝামেলা নেই। খাওয়া দাওয়ার চিন্তা নেই। আসিফকে এ কথা বলামাত্র মুহূর্ত না ভেবে নাকচ করে দিলো।
: না না অন্যের সাথে যাবো না। নিজস্ব ব্যবস্থায় যাব। গাড়ি ভাড়া করব। খরচ ওইরকমই পড়বে বা সামান্য বেশি। তবে স্বাধীনতা থাকবে।
সিমির কোনো কথাই রাখছে না আসিফ। সুতরাং সিমি গুম হয়ে থাকল কয়েকদিন। তাতে অবশ্য ওদের প্লান করতে কোনো অসুবিধা হলো না। আর সেই প্লান করে যাবার দিন কাল।
সেতু উদ্বোধনের পর অনেক কিছু ঘটে গেল। একজন মোটাসোটা মেয়ে নেচে নেচে টিকটক করল। একজন হাত দিয়ে সেতুর নাট বল্টু খুলে জেলে গেল। এক দম্পতি কেকে কেটে বিবাহবার্ষিকী করল। কয়েকজন প্রস্রাব করল, আবার বেশ কয়েকজন নামাজও পড়ল। দুজন মারাও গেল। একজন চুল ছেঁচে মাথায় পদ্মা সেতু বানালো। এর আড়ালে নাকি আরো অনেক কিছু ঘটল যা পাবলিক জানতে পারল না। এসব কথা বলে আসিফকে থামানোর চেষ্টা করল সিমি,
: তোমার আর তোমার শালিদের এখনও যাবার ইচ্ছে আছে। পায়খাানা প্রস্রাব নাচা গানা কিছুই বাদ নেই ওখানে। এর নাম বাঙালি। হাভাতেকে শাকের ক্ষেত দেকানো হয়েছে। অথচ সেতু উদ্বোধনের আগেই চিঠি জারি করেছে সরকার। সেতুর ওপর হাঁটা যাবে না, সেলফি তোলা যাবে না এমন অনেকগুলো নিয়ম কানুন। পায়খানা প্রসাবের কথা অবশ্য লেখেনি। কারণ এমনটা যে হতে পারে যারা চিঠি লিখেছে তারাও বুঝি আন্দাজ করতে পারেনি। যাবে?
: একশবার যাব। মানুষ যা করেছে সেটা তাদের অভিরুচি। তাতে তো আর সেতুর ক্ষতি বৃদ্ধি হচ্ছে না। মানুষ ওই লোকগুলোর রুচি সম্পর্কে জানল । আমরা সেতুতে নামব না, সেলফিও তুলব না।
এতকিছুর পরও পদ্মা সেতু দেখতে যাবে আসিফ। ওর যাওয়া মানে ইচ্ছে না থাকলেও সিমির যাওয়া। না গেলে জোর করবে না আসিফ। কিন্তু দেখতে খারাপ লাগবে। এতটা অশান্তি করতে চায় না সিমি।
দুই
সাতটার আগেই বাসায় হাজির হলো দুই বোন। উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে ওরা। সিমিকে আলুথালু বেশে দেখে বলল,
: কিরে এখনও তৈরি হোসনি। সাতটায় রওনা হবার কথা। মাইক্রো এসে পড়বে
: তৈরি হওয়ার কি আছে। যাবো তো সেতু দেখতে। গাড়ি থেকে নামতেও পারব না। আর যাচ্ছি তো নিজেরা নিজেরা । বাইরের কেউ তো নেই। সাজগোজ কে দেখবে?
: তা বলে ভুতের মতো যাবি। প্লিজ আপা জামাটা অন্তত বদলা। মুখে একটৃ পাওডার লাগা। আমরা তো সেতু পার হয়ে ছবি তুলব সেতুকে পেছনে রেখে। জানি তোর তেমন যাওয়ার ইচ্ছে নেই। কিন্তু আমাদের জন্য অন্তত কর।
বোনদের মুখের দিকে তাকিযে সিমির রাগ খানিকটা কমে যায়। মায়াও হয় একটু। ওরা সিমির ছোট। খানিকটা আবদার করতেই পারে। ও জামাকাপড় বদলায়। মুখে পাওডার পাফ বুলিয়ে ঠোঁটে খানিকটা লিপস্টিক লাগায়। আর তখনই শুনতে পায় মাইক্রোর হর্ন।
তিন
সামনে পদ্মা সেতু। টোল দিয়ে সেতু রাজ্যে প্রবেশ করল ওরা। সবার মনে প্রচন্ড উন্মাদনা। কখন উঠবে পদ্মা সেতুতে সেই প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে। ওরা সেতুতে উঠল। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যাচ্ছে । নিচে বয়ে চলেছে প্রমত্তা পদ্মা। সবাই মাইক্রোর জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। দুচোখ ভরে দেখতে থাকে নয়নাভিরাম সেতুটি। এই সেতু যে কোনদিন হবে বিশ বছর আগেও ভাবেনি সিমি। ছেলেবেলায় বাপের বাড়ি থেকে ঢাকায় আসতে দিন পার হয়ে যেত। আরিচা ঘাটে বসে থাকতে হত ঘন্টার পর ঘন্টা। ফেরি বিভ্রাট ছিল প্রতিদিনের ঘটনা। ঝড় হলে বা কুয়াশা বেশি পড়লেই ফেরি বন্ধ হয়ে যেত। একবার তো সারারাত ঘাটে বসে ছিল সে । বসে থাকতে থাকতে মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল। কাউকে ফোনে খবরও দিতে পারছিল না। যাত্রীদের মধ্যে হাহাকার উঠেছিল। কি খাবে, কীভাবে বাথরুমে যাবে! সে যে কী অসহনীয় অবস্থা! অথচ এখন সাড়ে তিন ঘন্টায় তাদের বাড়ি থেকে ঢাকায় আসা যাবে। সময় লাগে ঢাকা শহরের ভিতর, বাইরে না। পদ্মা সেতুর শুরুতে বিশ্বব্যাংক টাকা বন্ধ করে দেয়ায় একটা অনিশ্চয়তায় পড়েছিল দেশবাসী। তখন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন নিজস্ব অর্থায়নে হবে পদ্মা সেতু। হয়েছে। ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল সিমি। রুমি বলে,
: এই আপু ভাবছিস কি? দেখ দেখ কী সুন্দর। তুই কি এখানে ভাবুক হবার জন্য এসেছিস?
সিমি চোখ খোলে । জানালা দিয়ে সামনে পেছনে তাকায়, নিচে পদ্মা দেখে, দেখে অজস্র নৌকা। উপরে খোলা আকাশ আর ভেসে যাওয়া পাখিদল। আবার তাকায় পদ্মার দিকে। তারপর সেতুর দিকে। ওর চোখ জুড়িয়ে যায়। চেঁচিয়ে বলে
: গাড়ি থামাও, থামাও । আমি নামব
: সেকী! বলছ কি তুমি। এখানে নামা তো বারণ। সেদিন তুমিই না লোকজন নিয়ম মানছে না বলে কত কিছু বললে
সিমির কানে যেন কিছুই ঢুকছে না। ও একভাবে চেঁচাচ্ছে
: গাড়ি থামাচ্ছ না কেন? বললাম থামাও
: তুমি নিয়ম ভাঙবে?
: একে নিয়ম ভাঙা বলে না। এ হচ্ছে সুন্দরের কাছে আত্মসমর্পণ। গাড়ি থামবে, আমি নামব। রেলিং-এর পাশে দাঁড়িয়ে ব্রিজটা ছুঁয়ে দেখব তারপর আবার গাড়িতে উঠব। আশাকরি একটুকু অনিয়ম সরকার ক্ষমার দুষ্টিতে দেখবে। কী বলো?
গাড়ি থামে । হুড়মুড় করে নামে সিমি। নামে ওর সাথে আরো তিনজন। সবাই হাত রাখে সেতুর রেলিং-এ। যেন আপনজনকে ছুঁয়ে দেখে, অস্তিত্বকে স্পর্শ করে!
Facebook Comments Sync