পালঙ্ক পুরাণ/ দিলারা মেসবাহ

পালঙ্ক পুরাণ

পালঙ্ক পুরাণ

পালঙ্ক পুরাণ/ দিলারা মেসবাহ

 

মরাখাল! এ তল্লাটে এই নাম দীঘল এই খালটির। কত যুগ যুগান্তর যেন এই নাম আমজনতার মুখে মুখে। অথচ আশ্চর্য এই লম্বা ঝিলমিল খালটিতে সংবৎসর অন্তত: একহাঁটু কলোজল ঢল ঢল করে। বাদলার মৌসুমে প্রায় থই থই! পূব পাড়ে ভাঁট, দন্ডকলস, সন্ধ্যামনির ঝাড় কয়েক পা এগুলেই সড়ক। সর্পস্বভাবে এঁকে বেঁকে গেছে দূর দূরান্তে। উল্লাপাড়া উপজেলার কেন্দ্র বাজার হাটের গর্ভ ভেদ করে প্রকাশ্য হয়েছে এই সড়ক। অযুত কোটি নিযুত মানুষের পদাঘাত বা পদচ্ছাপ বুক পেতে আগলে নির্বিকার শুয়ে আছে। বছর কয় আগেও এই সড়ক নানা সাইজের খানা খন্দে দুস্তর ছিল। কত হাটুরে, বায়াবৃদ্ধ মানুষের পা মচকে গেছে। গোড়ালি জুড়ে জন্মের ব্যথা। চাষাভুষা মানুষের ফাটা গোড়ালি বেয়ে তাজা রক্ত ঝরেছে। রাবারের জুতাজোড়া দোফাট্টা হয়ে গেছে। এসব তামাদি বাহুল্য প্যাচাল। ছোটবেলা থেকে এইরকম দেখে আসছি।

বছর দুই বাদে দেশগাঁয়ে এই সড়ক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। যা দেখি তাই বুকের ভেতরটা খামচে ধরে। চান মিয়ার  শাপলা বস্ত্রবিতানের জেল্লা একটু বেড়েছে মনে হয়। ঐ কোনে লোকমান ভাগ্নের মনোহারি দোকানটা আরো একটু বুড়িয়ে গেছে। সোনালু গাছদুটো সোনালী ফুলের অহংকারে জ্বল জ্বল করছে। গাঢ় থকথকে দরদ বাস্তুভিটার ঘ্রাণে!

ঢাকা বেদরদী শহরে পেটের দায়ে বাস করি। ‘গাঙচিল প্রকাশনী’র নাম ডাক মন্দ নয়। ফেব্রুয়ারি না আসতেই লেগে যায় মচ্ছব। মালিকের বই বাঁধাই ঘরে ম্যানেজারি করি।

বৌ বাচ্চা নেই বলে অর্থ-কড়ি দাঁতে দাঁত চিপে কিছু জমিয়েছি। তবে সামান্যই! ঐ আমার অসামান্য! এই কার্তিক মাসে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা হৃৎপিন্ড বরাবর বুক পকেটে ভরা। কচকচা এক হাজার টাকার ত্রিশখান পাতা। একখান একলা পাঁচশ টাকার নোট। কিছু খুচরা খাচরা। চলেছি ভিটায়, মায়ের আঁচলে মুখখান মুছবো বলে। বাপধন কবেই ইন্তেকাল করেছেন। বুজুর্গ মানুষ ছিলেন। মনমেজাজমর্জি ছিল সাদা মেঘের মতো। আশ্চর্য মানুষ একটা। আমার বাপজান।

একমাত্র ছোটভাই শমশের বসত করে আধা জেল হাজতে। শ্যামলী পাড়ায় সাবু কন্টাকটারের আধাপাকা তিন কামরার ঘর। ভাড়া থাকে। ছোট বৌবিবি খাড়ে দজ্জাল। তবু রোজ রোজ ভোর বিহান থেকে খুন্তি, বেড়ি, ড্যাগ ভেগচির ঝনঝনানি, সেই সাথে হিজ মাস্টার ভয়েজ-চায়নার চিল চিৎকার। আমার ভাইয়ের কান অভ্যস্ত হয়ে গেছে আল্লাহর রহমে। এইটাও এক কিসিমের সং-সার! তারপরও এর নাম সংসার।

আমারও তো তাও নাই! বৌ বিবির ভাগ্য নাই। বিবাহের ফুল এখনও ফুটি ফুটি করছে। ফুটছে না তো। এই ফুল যতো বিলম্বে ফোটে ততই কপাল! মাঝে মধ্যে হু হু শূন্যতার কৃষ্ণকালা ভোমরা হুল ফোটায়। কান্ডজ্ঞান হারায়। সেও মিথ্যা নয়। মরাখাল দূর থেকে দেখি দূর মানে বিঘৎ হাত চারেক হবে হয়তো। ঐখানে একটা মনুষ্যমূর্তির আবছায়া! মুখটা দেখা যায় না এই ধাঁ ধাঁ দুপুরের কালে। জুম্মাবার বলে জনমানুষের জটলা নাই। জামাতে নামাজ আদায়ের তাগিদে তল্লাটের দোকান পাটের ঝাঁপ বন্ধ। কপাটকুল বিলকুল আঁটসাঁট। এমনকি পূর্বদিকে আবুল্যার ভাঁটিখানা। গাঁজা, চোলাই, দেশি, কেরু কোম্পানি দিয়ে নরক গুলজার। আবুলল্যা পশ্চিমে মাথা কোনদিন ভুল করেও ঠেকায় কিনা জানি না। তার দোকানটাও পরিপাটি ঝাঁপ বন্ধ। নামাজ পড়তে গেছে নাজানি। আচানক মন ঈষৎ কেঁপে উঠতে চাইলো। এ কোন পরিদেশ! ক্যাবা আছেন বাই?

আদ্দিন পর আলেন?

আমার দেশি কথার যাদুবাঁশি বাজে না। চেনা অচেনা মুখের ভীড় উধাও! জুম্বাবারে খাঁটি মুসুল্লির কাতারে চোর, বাটপার, নানা জাতের বদলোক জুম্মার নামাজ পড়ে। করুণাময়ের দিদারের আশায়। মন্দ নয়-কিছুটা সময় কী তারা কালো দাগের গভীর ক্ষতের চিনচিনে ব্যথা টের পায়। আর কুদরতি মলম লাগায়। হতে পারে লক্ষণ মন্দ না।

আমি পায়ে পায়ে মরাখালের নিকটবর্তী হতে থাকি। মাথার উপর ধাঁ ধাঁ দুপুরের মেজাজি রোদ। বই বাঁধাই কেরামতি দেখি, আটকা ঘরে। রোদ বৃষ্টি চালের উপর দিয়ে গড়ায়। হঠাৎ চোখে আঁধার দেখি। দেশি রোদ আমাকে বেদিশা করে ফেলে। এই সময় ঢকঢক করে দুই তিন গ্লাস ঠান্ডা পানি বা  মায়ের হাতের কাগজিলেবুর শরবত পিয়ে পিয়ে খেতে বেহুঁশ সাধ হয়। জলতেষ্টা কী নিদারুণ!

শরীর স্বাস্থ্য আমার মাশাল্লাহ মজবুত। তবু মাথাটা ধড়ের উপর ভীষণ ভারী মনে হতে থাকে। দেহঘড়ির রহস্য সবটুকু জানাবো কেমন করে। ভেতরে ভেতরে কত না রহস্যের গিঁট! মনুষ্যমূর্তিটি একজন মহিলা মানুষের। আমি হাতের সওদা ভরা ট্রাভেল ব্যাগটা কন্টিকারী, বনতুলসির ঝোপের উপর আলগেছে ছেড়ে দেই। তার লম্বা শাড়ির আঁচল লুটিয়ে পড়েছে মাথাটা দ্বিগুণ চতুর্গুন ঘূর্নিতে চক্কর দিয়ে উঠলো।

কী দেখছি। কার্তিকের এই ঝাঁঝালো রোদে, যুগ যুগান্তয়ের মরাখাল পাড়ে আমার পরম মামীমা। রাঙা মামা তাঁর জীর্ণ শীর্ণ ডান হাতটা প্রসারিত করলেন, বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন। যাত্রাপালা পাগলী। সেই পানপাতা মুখ, দুধে আলতা রঙ মৃদুভাষিনী আনিন্দ্যসুন্দরী। এ কিসের সংলাপ মরাখালের বাতাসে কাগজের নৌকার মতো ভাসিয়ে দিচ্ছেন। এতো পুরাপুরি এক উন্মাদ মানুষ। আমি আর সইতে পারি না। আমার ছাপোষা মস্তিষ্ক চূর্ণ বিচূর্ণ হতে থাকে। আমি নিজের কাছ থেকে পালাতে চাই। কোনদিকে দৌড়াবো দিশা পাই না।

ততক্ষণে মুসুল্লিরা ধীর লয়ে সন্তুষ্ট মন নিয়ে সড়ক ধরে হাঁটা ধরেছেন। বড় মসজিদের ইমাম সাহেব আলহাজ্ব  মৌলানা হাফিজউদ্দিন দিনাজপুরীও  সফেদ দাঁড়ি পাঞ্জাবির ঝুলে পবিত্র মূর্তির মতো দৃশ্যমান। পেছনে জনা কয়েক নামাজী। হজরত আলী চাচাকেও দেখলাম। এই মৃদু বেহেশতী স্রোত  দেখতে দেখতে আমি বোধহীন স্থবির এক মরাবৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। পা দুটো যেন দুইটি কংক্রিটের পিলার।

সুরেশ দাদা আর কেরামতকে দেখলাম  এগিয়ে আসছে।ওরা আমাকে কেন জানি জড়িয়ে ধরলো। আমি দাদাকে সরিয়ে এক পর্যায়ে কেরামতকে আবার বুকে জড়িয়ে ধরলাম। শুনলাম কত কাহিনি। এই দুবছরের ব্যবধানে কত কী বদলে গেছে।

আমার মামার সুবাদে পেয়েছিলাম পরম রাঙা মামীমাকে। মায়া মমতার আর সহ্যশক্তির দেবী আজ মরাখাল পাড়ে জীর্ণ আঁচল বাতাসে জড়িয়ে কঙ্কালসার দেহে কেন অনন্তের ছায়া খোঁজেন!

আমার প্রায় সমবয়সী মামীমা। মীর বাড়ির জ্যেষ্ঠ সন্তান কুলপ্রদীপ আমার গৌরবর্ণ মামার বিবাহিত স্ত্রী। ভিনগাঁ বেলকুচির হুরাসাগর নদী পাড় থেকে সম্পন্ন গেরস্ত  সাদউল্লাহ কাহারের ষোড়শী কন্যা মমতাজ মহলকে বিয়ে করে  আনলেন। আমার বালক বয়স। লুকিয়ে চুরিয়ে দেবীদর্শন করি-মাটির মানুষও এত্তো সুন্দর হয়!

সুন্দরীশ্রেষ্ঠ পরম মমতাময়ী মামীমা এখন মরাখাল পাড়ে পড়ে থাকেন। রাঘবের সন্দেশ খেতে মাঝে মধ্যে দোকানের সামনে ঘুর ঘুর করেন। অথৈ তেলের কড়াইয়ে যখন মবিনের জিলাপি ডুবসাঁতার কাটে, মমতাজ মহল  তখন আচমকা খিল খিল করে হাসেন। বাঁশের বাতার মতো  শুকনো হাত পেতে বলতেই থাকেন, দিবি বি-দি-বি একখান জিলেপি। দেনা দেনারে। খিদা লাগছে। দূ-দি-ই। তেলেভাজার পশরা নিয়ে দোকান সাজায় সেরাজুল। বিবি মমতাজ সময় সময় যেখানে জ্বল জ্বলে  চোখ করে হাত পাতে। মিল্লাত আলীর হোটেলের কাস্টমারের এঁটো ভাত মাছের কালকো কাঁটাও খুঁটে খেতে দেখা গেছে তাকে।

কয়েক ক্রোশ পথ হাঁটতে না হাঁটতেই এতোসব খবরাখবর হুড়মুড় করে আমার বুকে তোলপাড় তোলে। পরিচিত মুখগুলোর ঝিলিক দেয় অপরিমেয় কৌতুক।

মনে হয় এইতো সেদিন। ক্ষয়ে পড়া মরচে পড়া মীর বাড়ির প্রাচীন কৌলিন্য। আমাদের বনেদি ত্থুড়ি মাতামহী, গৌর বর্ণা, উন্নতনাসা মাতামহী। খানদানি ঠাঁট ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে। তবু আপ্রাণ আঁকড়ে ধরতে সচেষ্ট। আর আমার জীবিত একমাত্র মামা তার লালচে গৌবর্ণের অহমিকা আর কুলকৌলিন্যের বিলীয়মান নির্যাস টেনে টেনে বিহবল ভাব ধরে থাকেন।

আমাদের নতুন মামীমা সংসারে পদার্পণ  করলেন। নানীমা তার ফুটি কার্পাস চুলে আধ-ঘোমটা টেনে প্রাচীন রংচটা আরামকেদারায় বসতেন আর তার কর্তব্যকর্ম সুচারু সম্পাদনে মনোযোগী হয়ে উঠতেন। বধূমাতার জ্ঞাতার্থে এবং আপন আনন্দে বয়ান করতেন মীর বংশের পলাতক ঐতিহ্যগাথা। খানদানের গন্ধরাজ লেবু  কচলে কচলে নির্যাস তেতোটক করে ফেলতেন। আমিও তখন সদ্য তরুণ। টিটি পক্ষীর মতো বসে থাকতাম।আর রোয়া ওঠা কার্পেটে বুড়ো আঙুল ঘষতাম। সেই একদার কেচ্ছা সহনীয় ছিল না। মীর বাড়ির কুলকৌলিন্যে যদিও শুনছিলাম কুলাঙ্গারের কোলাহল।

মামীমার কাছটিতে ঘুর ঘুর করতাম ঐ হেরেমের রানিবিবিকে চাক্ষুষ করার অদম্য অভিলাষে। তাঁর অপরিমেয় রূপরাশি সেইদিন তাঁর পরিধেয় রক্তলাল বেনারসিকেও ব্যঙ্গ করেছিল। গলার কাছে একটা দলা পাকানো আনন্দ আর অচেনা বদুবুদ। নিশি-পাওয়া নিতান্ত এক বালক দিশেহারা। কোন রূপনগরের মহল থেকে ছিটকে এসেছে মায়াপরী।

আমার ঝুলে পড়া চোয়ালের গৌরবর্ণ মামার কুহকী ব্যক্তিত্বে কোন রঙ লেগেছিল কিনা জানি না। মোঘল সাম্রাজ্যের  ভারী ভারী মখমলের পর্দার আড়ালে নিজেকে খোজা পাহারাদারের মতো দাঁড় করাতে চেষ্টা করলাম বেভুলে। পুরনো স্মৃতি বটে, তবে ঘ্রাণটুকু এখনও পাই

ঢাকা বসে শুনেছিলাম রাঙা মামীর মাথায় কিছু সমস্যা দিন দিন বাড়তির দিকে যাচ্ছে। বছর পাঁচেক কী ছয়  হবে ঈদের ছুটিতে দেশের বাড়িতে গিয়েছিলাম। আমার বাপের ভিটাবাড়ি থেকে মামার ক্ষয়ে যাওয়া দরদালানের দূরত্ব খুব বেশি ফারাক না। এতো নোনাও ধরে ইট সুরকির ইমারতে। সে যাই হোক আপ্যায়নের এতো সুবাস। মামীমার লম্বা চুলের গোছা অমনি কোমর ছাওয়া কৃষ্ণকালো। পানপাতা মুখের লাবণ্যকথা নাইবা বলি। আমাকে দেখে কী বিবি মমতাজ আদরে মমতায় মেতে উঠলেন।

‘এতো দিন বাদে আসলেন ঢাকার মানুষ। ভাতে বলক উঠছে। এহনি ফ্যান উথলাইয়া চুলা বা যাবেনে। খারান এটটু। লাল রাতাটা আইজ জবাই দেবোনে। বাইর বাড়ি আপনের মামুজান ইয়ার দোস্ত নিয়া মনে হয় দাবার গুটি চালতাছেন। মনে করলে ঐখানে গিয়াও শরিক হইতে পারেন। এদিগ আমি পাক ঘরে গোছমিছিল করি গা।

হায়রে আমি তো যুগ যুগ মোঘল হেরেমের পথভোলা মায়াবতীর কুটনা কোটা, ব্যাঞ্জনাদি রন্ধনের কেতাকৌশল দেখে ধন্য হতে চাই। গৌরবর্ণ অহমিকা সর্বস্ব মামুজানের সাথে সাক্ষাতের কোন রকম খায়েশ মনে আসছিল না। একটা সুস্থ চার হাত পায়ের মানুষ চিরকাল বেকার থাকে কেমন করে। কেবল মীর বংশের অতীত শান-শওকত মুখস্ত বয়ান করে। এখন তো শুনি বিস্তর জমি জমার যা আয় তা গলায় ঢালেন। ইয়ার দোস্তরা শরিক হয়। দিনে রাতে বৈঠক ঘরে রুদ্ধদার মচ্ছব।

মোরগের রানে সুরুয়ায় এতো স্বাদ সাতাইশ বছর বয়সে আমি পয়লা প্রথম আবিষ্কার করলাম। মৃদুভাষিনী বিবি বেগম আচানক খানিক বাচাল হয়ে উঠলেন,

‘মানুষের ভাগ্যের চাকাখান একবার প্যাককাদায় আটকাইলে কী আর টাইনা টুইনা তোলা যায় না খায়ের ব্যাটা? যায় যায়। নেক নিয়ত থাকলে একশত বার যায়। মীর বাড়ির পালঙ্ক, ঝাড়লন্ঠন, খাঞ্চাখানা হাত্তি ঘোড়ার কেচ্ছা কাহিনি শুন্যা শুন্যা দুইডা কান ঝালা পালা হইয়া গেছে মিয়া  মাকসুদ। ব্যবসা পাতি কর না ক্যা? মামা ভাগ্নে মিল মহব্বত কইর‌্যা। ওদিক মেহেরজান, আলি আকবর কলা গাছের লাহান বাইড়া উঠতাছে। রাইতে দুই চক্ষুর পাতা এক করার পারি না। ছাতানাতা ভাবতে ভাবতে রাত ফর্সা হইয়া যায়।

আমি হলুদরাঙা গরম ভাতের নলা পাকাই। কথার  উত্তর হয় না। আড়চোখে দেখি বিবি মমতাজের পাবনাই  নীল শাড়ির আঁচলায় নিখুঁত রিফু। আমার একটু কেমন শ্বাসকষ্ট হয়। মামী নড়বড়ে জলচৌকি থেকে মোমডলা হাতখান প্রসারিত করেন। এক ডাবর গরম ভাত আমার  পাতে তুলে দেন। খাওয়া শেষ করতেই মামী আমার দিকে পোর্সেলিনের পিরিচে এক টুকুরো তালমিছরি এগিয়ে দিলেন।  মুখ মিষ্টি করেন-দুধের ফিরনি কইরাতে পারি নাই ভাগ্না।

বৈঠক ঘরে বারকয় এত্তেলা পাঠালেন মধুকে পাঠিয়ে। ওঘরে ধোঁয়ায় কুন্ডলি। মীর ফকরুল, সুজা খা, প্রদীপ সাহারা দিনে দুপুরে মজমায় মত্ত। প্রবলপ্রতাপ হাঁকডাক সর্বস্ব মামুজানের নীলরক্ত টগবগ করে এখন অবধি তাঁর আপাদমস্তক।

বালক বয়সে একবার যা দেখেছিলাম, তাতেই বুঝে নিয়েছি অনেককিছু। দরজার আড়ালে থেকে দেখেছিলাম মামু আর তার ইয়ার দোস্তরা জানা চার রঙিন শরবত চুমুকে চুমুকে টেনে যাচ্ছেন। দুজন আঁটোসাটো গড়নের মহিলাও দেখেছিলাম। তারাও কেবল ঢলে ঢলে পড়ছিল মা হঠাৎ বহকো টানে আমাকে ঘরে নিয়ে যান। মনে আছে বিরাশি ছিক্কার এক থাপ্পড় মেরে বসেছিলেন। আমি কাঁদতে ভুলে গিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, কী হইসে? হেচকা আমার সর্বংসহা মা চোখ মুছে ঝাঁঝালো গলায় বলেছিলেন, ‘এতো বুঝার কাম নাই। সয় সম্পত্তির হিসাব নিকাশ করা লাগে। বলা বাহুল্য আমি আমার মায়ের এই অদ্ভুত জবাবদিহিতায় হা করে ছিলাম।

আরেক বছরে মামীর জন্য একখানা সবুজ রঙের নক্সি পাড় ঢাকাই তাঁতের শাড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। সাহস করে মামুজানের জন্যও একখানা কারুকাজ করা পাঞ্জাবিও কিনে ফেলেছিলাম। আমার দুঃখিনী মা প্রায়শ এই দম্পতির জন্যে উৎকৃষ্ট উপহার  দেবার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিতেন।  পিতৃকুলের ঘনিষ্ঠজনের প্রতি আমার অকালবৃদ্ধ জননীর অন্ধ পক্ষপাতিত্ব লক্ষ্য করেছি শৈশব থেকেই। মামীমাকে সসঙ্কোচে তাঁতের শাড়িটা উপহার দিতেই তিনি মৃদু রিনিঝিনি বেজে উঠলেন,

‘এইডা কী করলেন মিয়া-খানের বেটা।’

আমি আমার সাহসী এবং বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপে নিজের মনে আপ্লুত হলাম। চোরাচোখে দেখলাম মামী রিফু করা শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘন পল্লব ঘেরা জোড়া আঁখির অশ্রু বিন্দু মুহূর্তে আলতো চাপে অদৃশ্য করে দিলেন।

সেবার আমি বেলকুচি গিয়েছিলাম বন্ধু হরিপদের বাড়িতে। ওখানে আমার কৈশোরিক প্রেম ভাবাপন্ন একটা অস্তিত্ব ছিল। মাসিমা নারকেলের তক্তি, চিড়ার মোয়া, মালপো খাওয়ালেন। আহারে জীবন। ভাবি, বেশিমাত্রায় ভাবাভাবি ভালো নয়। বিচিত্র চিন্তার জট আমার নিরীহ মস্তিষ্কের জন্য বিপদজ্জনক। খাও দাও সোজা সাপটা চলো দিন কেটে যাবে, নো রিক্স এট অল। জীবনটা শনপাপড়ির মতো  মোলায়েম। অথচ কত না দূরূহ দুদর্শার হাত ধরে বেড়ে  উঠতে হলো।

বাপজানের কথা বলা দরকার। তিনি ইতিহাসে পন্ডিত। সুফিবাদ চর্চা করতেন।  সুযোগ পেলেই পানিপথের যুদ্ধ, সিন্ধু  সভ্যতা, তুতেনখেমেনের ধুয়া তুলতে তিনি ছিলেন হরবোলা মানুষ একজন। আর কত ইতিহাস আর কত কৌলিন্য আর পূর্ব দাপুটে দিনের ইতিহাস।

মনে আছে স্পষ্ট। মামী ঘন দুধের এক পেয়ালা ধোঁয়া ওঠা চা দিয়েছিলেন আসন্ন বিকেলের মোহনায়। কাপটির বয়স বয়েছিল। একটা হ্যান্ডেল ভাঙ্গা। তবু খানদানি! এক শ্রাবণে ঘন বর্ষার দিনে শুনেছিলাম কোন মমতাজ মহলের কান্না জড়ানো বিহ্বল কণ্ঠস্বর, ‘চাল বাড়ন্ত। মেহেরজানের বেদম জ্বর । মোবারক ডাক্তার সাহেবের কাছে একবার যাও। ওষুধ পথ্য কিছু জোটে না আমার মেয়াটার।’ আমি যথারীতি ভড়কে যাই। মাকে হুবহু সব জানাই। তিনি  জংধরা লোহার সিন্দুক হাতড়ে কিছু টুকরা টাকরা সোনাদানা আমার হাত তুলে দিয়ে বলেন,

‘যা শ্যামল স্বর্ণকারের গয়না ঘরে। যা পাস নিয়ে আয় বাবা।’ দিন দশেক মেহেরজান ভুগলো। তারপর ভোররাতে কাউকে কিছু না বলে চলে গেল পরপারে। মামী শোক সামলাতে সপ্তাহখানেক সময় নিলেন। তারপর আবার নোনা ধরা সংসারের হাল ধরলেন।  আগেই বলেছি কিনা বেলকুচি মামীর বাপের বাড়ি। জানে আলম সম্পন্ন গৃরস্থ। এর উপর তাঁর ছিল পরী জর্দার রমরমা ব্যবসা। মামীর পিতামহ ছিলেন কবিয়াল। তার আলমারি বোঝাই নানা বিষয়ের পুস্তকাদি। আলমিয়ায় ঠাঁসা ঠাঁসা। জানে আলম নিজেও নেহায়েত জর্দা ব্যবসায়ী নয়। তাঁরও পাঠাভ্যাস ছিল।

জর্দার কৌটার গায়ে একটা টুকটুকে নীলপরী। সে ডানা মেলে উড়ছে না। পালঙ্কে মখমলের গাদিতে হেলান দিতে রাজরানির মতো বসে আছে। শৈশব থেকে মমতাজ ঐ চিত্রাবলীর নিদারুণ কাঙাল হয়ে পড়ে। সদ্য কিশোরী পালঙ্কের প্রেমে মাতোয়ালা।

ঘটক মোল্লা মফিজ প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কথাই ছিল পালঙ্ক প্রসঙ্গ। ‘মিয়াভাই মীর বাড়ির খানদান কে না জানে। এখনও পাত্রের শোয়ার ঘরে যে পালঙ্ক আছে, তা দেখলে আপনের মন সন্তুষ্ট হয়ে যাবে। ময়ূরের কী বাহারের প্যাখমখান। সিঁড়ি আছে, সেইটা বায়া পালঙ্কে ওঠা লাগে। ইয়া মোটা মোটা তাকিয়া। কইন্যা আপনের রাজরানির হালতে থাকবেনে। চার পুরুষের পালঙ্ক বলে কথা।

মন্ডলের টাকা পয়সার টানাটানি নাই সংসারে। শরাফতির দিকে মোহভাব জন্মে গেল সহজে। বিবাহের বছর দুই হতেই দরদালানের পলস্তরা পরিষ্কার পর্ব আরম্ভ করতে হয় রাঙা মামীকে। ভোর বিহানে শলার ঝাড়ু দিয়া রোজদিন খানদানের ইট সুরকি ঝাড়ু দেয় গৃহলক্ষী। হঠাৎ একদিন ভোররাতে পালঙ্কের একটা পায়া চুপিসারে খসে পড়ল। সহিষ্ণু সুন্দরী শ্রেষ্টার মনবিকলনের আলামত, মাতলা মাতাল খানদান স্বামীধনকে কী বলেন না বলেন, এই যে ভাইজান-কেমুন আছে বাত  রান্দি নাই। আগুন নাইকা হি হি। কী খাইবেন? তাইলে ছাই খান। মদনা কলা ছাতু খাইবেন? না দুদবাত? দুদও তো নাইকা। নাই……….নাই রে। কিছু নাই।’

গৌরবর্ণ তাঁর, লালচে বরণ ধরে খানিক। তেরচা চোখে তাকিয়ে থাকেন। লালপানির ঘোর কাটে নি তাঁর। মামীমা পাবনা মানসিক হাসপাতালে দেড় মাস ছিলেন। হাসপাতালের মাসিক ব্যয়টুকুনও টানতে নারাজ এবং অক্ষম মামুজান।

এরপর পাগলির স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন। পায়ে শেকল। পূবে গোয়ালের পাশের ঘরটা রইলো রাঙা মামীর আশ্রয়। ধারে কাছে কেউ পারতপক্ষে ঘেষে না। পূতিগন্ধময় ঘরের চার কোণা।

আমার মা জননী একদিন ভাইরে ফিসফিসানির মতো বলেন, ‘ভাই বৌটাতো বাঁইচ্যা মইর‌্যা আছে। একটা কোন বিহিত করা লাগে।’

খোঁকিয়ে ওঠে মীরবাদশা।

এইডা আমার কপাল লিখন। শ্বশুর  শাশুড়ি মইর‌্যা বাঁচছে। মন্ডল বংশে পাগলের অভাব নাই। ওর দাদার চাচাতো ভাই পাগল হইয়া মরছে।’

যখন পূতিগন্ধ উঠান সাঁতরে বৈঠকে পৌঁছাল, তখন পাগলিরে ঘরে বন্দি রাখার কোন যুক্তি পোক্ত হলো না। এখন বিবি মমতাজ হাটে বাজারে স্বাধীন ঘুরে বেড়ায়। পলাশ হোটেলের বাবুর্চির পিছে পিছে ঘোরে, ফকিন্নির মতো ভাত চায়।

‘মিয়াভাই কয়ডা বাত দেও না। খিদা লাগছে।’বলতে বলতে ত্যানা ত্যানা শতছিন্ন শাড়ি সরিয়ে চিমসে পেট উদাম করে দেখায়। মামীর যৌবন শেষের দেহে যেটুকু রূপের ঝিলিক লেগে ছিল, তাই বদলোকে গিলে খায়। দিনভর মীরবধূর কীর্তিকান্ড দেখে তামাশা করে। বিনি পয়সার রঙ্গ তামাশা।

মামীর হাতদুটো কী নোংরা সেই বাহু সেই চম্বক আঙুলি। কখনও কী সাধ হয়েছিল একটু ছুঁয়ে দেখতে। মামীকে মরাখাল পাড়ে এমনি করে ছেড়ে রাখা যায় না। কর্তব্যজ্ঞানে মামীমার জীর্ণ  শীর্ণ হাতখানা জোর মুঠিতে ধরে ফেললাম। ‘বাড়িত চলেন মামীমা। এইখানে থাকা লাগে না। মানুষে কী কয়, মামী গো।’

মামীর কালি পড়া চোখ দুইটা জ্বলে  ওঠে।

‘বাড়ি কোনডারে, বাড়ি কাক কয়? তুই কেডারে? একটুখানি চিনা চিনা লাগে। আইচ্ছা শোন কানে কানে একটা বুদ্ধি দেই তোক। মীর বাড়ির পালঙ্কখান জোড়া লাগায়া দে, নাহলি কেরাসিন ঢাইল্যা আগুন ধরাইদে। বলতে বলতে উবু হয়ে বসে মামীমা।

‘দেখছিস ছেড়া, আমার পায় কেডা জানি শিকল  দিছিল। ঘা হয়্যা গেছে। দেখছিস। যা যা তোর কামে যা-মীর বাড়ির ছ্যাড়া না তুই। হেই বড় পাগলে কী হরে? মেহেরজানের বাপজান। হইছে ম্যালা প্যাচাল। দে না দুই টাহা দিয়া যা আল্লাহ তোরে দিবো।’

নিচু হয়ে আমি তার দগদগে লাল ঘায়ে হাত বুলাতে চাইলাম। একটু ছুঁতেই তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন। করিস কী হারামজাদা ব্যথা পাই না? আচ্ছা কতো আমি পাগল নাকি রে? শয়তানের বাচ্চাগুলান ঢিল ছোঁড়ে, কয় পাগলি। একদিন কুতার বাচ্চাগুলাক ছিড়্যাঁ খায়্যবে ফেলবো নে। দেহিস তুই।’

আমি পরাজিত এক সৈনিকের মাতো পরীরে মরাখাল পাড়ে রেখে চলে আসি। শুনতে পাই তাঁর চিৎকার।

‘এইডা হুরা সাগর না? এই ভাইজান কতা কানে যায় না। হুরা সাগর নদী খান এমন শুকায় গেল ক্যা? নাকি জলছেনবে খ্যায়া ফেলদা? এ বাই সত্য নাকি? এ বাই——-।’

তখন দেখি ছোটখাট একটা জটলা। কেউ বিকট দাঁতগুলো বের করে অশ্লীল হাসি হাসছে। আমি পালাতে থাকি। নিজের কাছ থেকেই পালাতে থাকি।

ঠিক পরদিন ভোরবিহানে মানুষ হাজারে হাজার। ভেলকি দেখার জন্যে কাউরে দাওয়াত দেয়া লাগে না। জুটে যায় দলে দলে ঝাঁকে ঝাঁকে।

মীর বাড়ির বিবি পড়ে আছে মরাখালের পশ্চিম পাশে। ভাঁটফুল, শিয়ালকাঁটার ঝোপের উপর। লাশ-লাশটা শুয়ে আছে। হাঁটুর উপর সেই ঢাকাই রঙ জ্বলা  শাড়ি। শকুন কী খুবলে খেল অবশিষ্ট সম্ভ্রমটুকুও।

সব বিধিব্যবস্থা শরিয়ত মোতাবেক করতে হয়। গৌরবর্ণ মামুজান পূর্ব দিকের ঘরে কপাট বন্ধ করে বসে রইলেন। টেবিলে গ্লাস বহালে ছিল। স্ত্রী বিয়োগ ব্যথা ভুলতে লাল শরবতের শরণাপন্ন হওয়া  জরুরি বিধায়।

শত বছরের প্রাচীন মক্কা আউলিয়া মসজিদে মামীর জানজা পড়ানো হবে। শোনা যায়, এই মসজিদ মাটি ভেদ করে রাতারাতি দৃশ্যমান হয়েছিল। বর্তমানে পাশে নতুন মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। টি.এন.ও সাহেব পরহেজগার মানুষ। নতুন মসজিদ কমিটির দায়িত্বে আছেন। নতুন দাতব্য খাটিয়া আনা হয়েছে মাস ছয় আগে। দূর থেকে ভ্রম হয় ওটা কী পালঙ্ক জাতীয় কিছু!

রাঙা মামীমার নিথর দেহ সাদা কাফনে মোড়া। উপরে কালো মখমলের গিলাব। তাতে কলেমা শাহাদতের আরবী হরফে লেখা। আমার অন্তরে লতিয়ে উঠলো শোক নয়, শান্তি।

আমার গৌরবর্ণ মামুজান অতঃপর পুৃত্র আলি আকবরের কাঁধে হাত দিয়ে মসজিদ প্রাঙ্গনে এলেন। তিনি  আশ শ্যাওড়ার অন্ধকারের দিকে কেন যে চেয়ে রইলেন। আমি বিড়বিড় করতে লাগলাম,

মামী তুমিতো ভবসংসারের কেউ নও। তুমিই লালপরী জর্দার সেই পরী। আরো আগে চলে গেলে না কেন? কেন?

কী কান্ড! আমিও এক উন্মাদ নাকি? একজন পরম শ্রদ্ধার পাত্রীকে আমি বারবার ‘তুমি’ সম্বোধন করছি।

আজ এতো স্পর্ধা আমি কোথায় পেলাম!

দিলারা মেসবাহ
দিলারা মেসবাহ