প্রভাত আছে, প্রভাতফেরি কই? – আফরোজা পারভীন

আফরোজা পারভীন

আফরোজা পারভীন

প্রভাতফেরি একসময় আমাদের জীবনের অচ্ছেদ্য অংশ ছিল। ফেব্রুয়ারির  হিম হিম ভোরে খালি পায়ে গান গাইতে গাইতে যেতাম শহিদ মিনারে। কারো হাতে ফুল, কারো হাত খালি । কিন্তু বুকে ভালবাসা আর শ্রদ্ধা। ফুল  জোগাড় হতো কখনো নিজের বাগান, কখনো আশপাশের বাড়ির বাগান থেকে । অন্যদিন ফুল ছিঁড়লে রাগারাগি করলেও প্রভাতফেরির ফুল নিতে কেউ বারণ করত না। কেন করত না সেটা ছেলেবেলায় আমার কাছে বিস্ময়ের ছিল। বড় হয়ে বুঝেছি। বুঝেছি যারা প্রভাতফেরিতে অংশ নিতো না বা নিতো পারত না তাদের বুকেও ছিল বাংলার প্রতি ভালবাসা, বাঙালির প্রতি ভালবাসা, শহিদদের প্রতি ভালবাসা।  দূর থেকে যখন ভেসে আসত, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রæয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি তখন সেও আনত হত। ওই ফুল দিয়ে শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর ভাগিদার হতো। এটা আমার জন্ম নেয়া মফস্বল শহর নড়াইলের চিত্র। শুনেছিলাম ঢাকার প্রভাতফেরির কথা। স্বপ্ন দেখতাম একদিন ঢাকা গিয়ে নগ্নপায়ে বুকে কালো ব্যাজ লাগিয়ে ওই প্রভাতফেরিতে অংশ নেবো। শুনেছিলাম ঢাকা শহরের নানা প্রান্ত থেকে তরুণ-তরুণী, বয়স্ক নর-নারী মিছিল করে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গাইতে গাইতে বিভিন্ন পথ অতিক্রম করে। সে গান শুনে ঘরে ঘরে মানুষ জেগে ওঠে। এক অদ্ভুত আবহ সৃষ্টি হয় চারদিকে । ২১ ফেব্রুয়ারির স্মৃতি বর্তমান ও ভবিষ্যতের পথ আলোকিত করে। শুধু প্রভাতফেরিতে অংশগ্রহণকারীরাই নয়, সারা শহর থেকে মানুষের ঢল নামে শহিদ মিনারে। কিন্তু প্রভাতফেরিই হারিয়ে গেল হায়! এখনও ২১ ফেব্রুয়ারির সকালে মানুষের সেই ঢল নামে। তবে  দুইয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য ।

বাঙালির ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের সাথে প্রভাতফেরি জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। আন্দোলনের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসেছিল ১৯৫২-এর একুশ। সেদিন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নির্বিচারে গুলিবর্ষণে করেছিল। রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ।  শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পরের বছর চালু হয় এই ‘প্রভাতফেরি’। শব্দটির আভিধানিক অর্থ প্রভাতে উদ্বোধনী গান গেয়ে জনগণকে জাগানো। এর আগে পৃথিবীর আর কোনো দেশে ‘প্রভাতফেরি’ হয়েছে বলে আমার জানা নেই।

১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো শহিদ দিবস পালিত হয়। দিবসের সূচনা হয়েছিল প্রভাতফেরি দিয়ে। ওই দিন ঢাকার বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা খুব ভোরে ছাত্রাবাসগুলো থেকে বের হয়ে খালি পায়ে ফুল হাতে, কেউ ফুল ছাড়াই গাজীউল হকের রচিত গান, ‘ভুলবো না, ভুলবো না, একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলবো না’ গাইতে গাইতে আজিমপুর কবরস্থানে গিয়ে শহিদদের মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শহিদ মিনারের একটি  প্রতিকৃতি করা হয়েছিল। এরপর ছাত্র-ছাত্রীরা সেখানে এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রতিকৃতি করা হয়েছিল কারণ, ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র হোস্টেলের ১২ নম্বর শেডের পূর্ব প্রান্তে যে স্মৃতিস্তম্ভ বা শহিদ মিনার নির্মাণ হয়েছিল, সেটার স্থায়িত্ব ছিল মাত্র আড়াই দিন। প্রথম তৈরি ওই শহিদ মিনার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন সাংবাদিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। পাকিস্তানি সশস্ত্র পুলিশ হোস্টেল ঘেরাও করে ট্রাক নিয়ে ভেতরে ঢুকে স্তম্ভটি ভেঙে ওই স্থাপত্যের শেষ খÐটিও  ট্রাকে তুলে নিয়ে যায়। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেদিন কালো পতাকা তোলা হয়। এভাবেই প্রভাতফেরির মাধ্যমে শহিদ দিবস পালনের ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু হয়।

১৯৬০-এর দশক থেকে গাজীউল হকের গানের পরিবর্তে ২১-এর প্রভাতফেরিতে গাওয়া শুরু হয় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’ গানটি ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পরপরই লিখিত হয় ।  সুরারোপ করেন আবদুল লতিফ। পরে আলতাফ মাহমুদ নতুন করে গানটিতে সুরারোপ করেন এবং প্রভাতফেরিতে গীত হতে থাকে।

মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে রক্তে রঞ্জিত রাজপথে জুতা পায়ে হেঁটে শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া মোটেও উচিত হবে না বিবেচনায় খালি পায়ে প্রভাতফেরির প্রথা চালু হয়েছিল।

কিন্তু দুঃখজনক এবং হতাশার বিষয় এটাই যে, আমার সেই ছেলেবেলার প্রভাতফেরি এখন শুধুই স্মৃতি। এখন আর কেউ নগ্নপায়ে সারি বেঁধে একুশের গান গাইতে গাইতে শহিদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে যায় না। ও সংস্কৃতি এখন বিলুপ্ত প্রায় । চিত্র বদলে গেছে একুশে উদযাপনের। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের আনুষ্ঠানিকতা ও অবয়বে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।   এখন ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে অর্থাৎ রাত ১২টা ১ মিনিটে মহামান্য রাষ্ট্রপতির শ্রদ্ধা নিবেদন করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান উদযাপন। তারপর একে একে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও গণ্য-মান্যজনেরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সাধারণ মানুষও করেন। তবে যেন অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। শহিদ মিনারের চারপাশে পুলিশ থাকে। বাঙালির বাধভাঙা আবেগের জায়গাটায় যেন বাধ দেয়া হয়েছে। জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে যে অনুষ্ঠান সূচিত হয়েছিল, এখন তা অনেকটাই এক নিয়ন্ত্রিত অনুষ্ঠান।

কখন  থেকে এই ঘটনার শুরু হলো সে বিষয়ে নানা মত রয়েছে। তাই ওই বিতর্কে গেলাম না। তবে কথা এটাই যে, বাঙালির আবেগের জায়গাটা হারিয়ে যেতে বসেছে।

১৯৯৯ সালের পর  থেকে বিশ্বব্যাপী একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। আমরা যদি প্রভাতফেরি করি অন্যান্য দেশ সেটাই অনুসরণ করবে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে  ছড়িয়ে আছে অসংখ্য শহিদ মিনার। বিভাগ, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত অগুনতি শহিদ মিনার গড়ে উঠেছে। কেবল বাংলাদেশেই নয়, বাংলাভাষী অঞ্চল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, ঝাড়খন্ডেও আছে শহিদের স্মরণে শহিদ মিনার। এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার বাঙালি অধ্যুষিত শহরগুলোতেও  রয়েছে বাংলা ভাষার সংগ্রামের এই স্মারক।

১৯৫৩ সাল থেকে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অভিমুখে যে ‘প্রভাতফেরি’ সূচিত হয়েছিল, তার দ্যোতনা বহুমাত্রিক। বিভা জ্যোতির্ময়।  এখন একুশে অনেকটাই আনুষ্ঠানিকতা। হারিয়ে যেতে বসেছে খালি পা। খালি গলায় একুশের গানও আর নেই তেমন। এখন যান্ত্রিকভাবে গানটি বাজানো হয়। তাতে  আবেগের কমতি থাকে ।

আমরা যারা প্রভাতফেরির সঙ্গি হয়েছি, গান গেয়েছি, সেই আমরা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। সংস্কৃতির বিচ্ছিন্নতায় দীন হীন মনে হয় নিজেদের। মনে হয় আমরা যদি সংস্কৃতিকে ধারণ না করি তাহলে একদিন তো এই সংস্কৃতি হারিয়ে যাবে। তাই প্রভাতফেরিকে রক্ষা করা দরকার। ফিরিয়ে আনা দরকার সর্বত্র। আর এ জন্য সরকারের ভূমিকা আছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু  সাংস্কৃতিক অঙ্গনের লোকদেরও জোরালো ভূমিকা রাখা প্রয়োজন।