প্রমিত বাঙলা বানান চর্চা: প্রসঙ্গ কথা – ড. বেগম জাহান আরা
আলোকিত বাঙলাভাষী মানুষ আনুষ্ঠানিক পরিবেশে সাধারণত প্রমিত ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু লিখতে গেলে বাঙলায় ব্যবহৃত ততসম শব্দের সাত্বিক বানান ছেড়ে একচুল নড়েন না। এটা নিয়ে কথা বলছি দুই যুগ হয়ে গেলো। অবাক হতে হয়, ‘বাঙলা বানান’ লেখার ব্যাপারে প্রতিবাদীর সংখ্যা কমছে না। মানে, ততসম বানানের নির্ধারিত নিয়মই পছন্দ, এমন লোকের সংখ্যা কমছে না। বানান সংস্কারের প্রতি অযথা ভয়, অনীহা , অর্বাচীন ঐতিহ্যপ্রীতি আর লোক লজ্জা বেশি। এরই মধ্যে আশার কথা আছে, তা হলো: প্রজন্মের মধ্য থেকে কেউ কেউ খুব আধুনিক যুক্তিবাদী এবং সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে বাঙলা বানান সংস্কারের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেছে। কেউ কেউ অতি সংস্কারের পক্ষেও যেতে চায়। বোঝা যায়, ‘বাঙলা বানানে’ বাঙলাত্ব খোঁজে তারা। যেমন; ‘স’ কেনো ‘শ’ উচ্চারিত হবে, ‘য’ কেনো ‘জ’ এর সাথে আপোসবদলে ব্যাবহৃত হবে, ‘ণ” কেনো বাদ দেয়া হচ্ছে না, ঈ ও ঊ এবং তাদের কার কেনো বাদ যাচ্ছে না বাঙলা বানান থেকে, ইত্যাদি প্রশ্ন উঠছে তাদের দিক থেকে। প্রমিত বাঙলা বানান সংক্রান্ত ‘বাঙলা একাডেমির’ অতি সংক্ষিপ্ত বিধি বিধান তথা প্রেসক্রিপশনে প্রজন্মের সন্ধিতসু মন শান্ত এবং সুস্থ থাকতে পারছে না।
এক্ষেত্রে প্রজন্ম চেয়ে থাকে আলোকিত ভাষীদের দিকে। কিন্তু কোথাও কাউকে দেখতে পাওয়া যায় না, যাঁরা সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন। যাঁরা গবেষণালব্ধ তথ্য উপহার দেবেন। দিক নির্দেশনা দেবেন বানান সংস্কারের বিষয়ে। আমরা, বাঙলাভাষী আমজনতা মনে করি, বাঙলা বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী ব্যাক্তিদের সবাই বাঙলায় পন্ডিত। আর আমজনতার প্রশংসা পেতে পেতে তাঁরাও এক সময় পন্ডিত বনে যান মনে মনে। ডাক আসে সভা সমিতি রেডিও টেলিভিশন থেকে। মাঝে মাঝে দেখা যায়, মঞ্চ আলোকিত করে বসে যান তাঁরা কথা বলতে। লজ্জা সংকোচ অজ্ঞতা ঝেড়ে ফেলে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীনতা সত্বেও অনেক আবোল তাবোল কথা বলে যান। তাঁরা কথা বলেন, বাঙলা শব্দের উতপত্তি বুতপত্তি নিয়ে। সর্বনাশ বাড়ে বাঙলা ভাষার। বিভ্রান্ত হয়ে যায় সাধারণ বাঙলাভাষী প্রজন্ম। অন্যদিকে বাঙলা একাডেমির সংক্ষিপ্ত দাওয়াই, দু একটা পত্রিকার নিজস্ব বানান বিধি, সামান্য কিছু আলোকিত মানুষদের লেখা দু একটা বাঙলা বানান (শকাল, শাদা), প্রমিত বাঙলা বানানের পক্ষে বলা খুব সাদামাটা কিছু যুক্তির কথা ( যা তাঁরা নিজেরা মানেন না), নিতান্তই বাইরের ব্যাপার হয়ে থাকে। বানান সংস্কারের ধারে পাশে আসে না। বয়ে যায় কথাগুলো। ফলে ঘুরে ফিরে এক জায়গাতেই থেকে যাই আমরা।
প্রমিত বাঙলা বানান নির্মাণের কাজ এমনি ভাবেই চলছে। সংস্কারপন্থী কর্মীরা এতে হতাশ যে হন না, তা নয়। কেউ বলে বসেন, আমাদের ‘প্রমিত বাঙলা’ নামে কোনো ভাষা নেই। অথচ তাঁরা নিজেরাই কথা বলেন এবং লেখেন প্রমিত বাঙলায়। প্রশ্ন করে জেনেছি, তাঁদের মত হলো, যে বাঙলার বানানই তৈরি হয়নি এখনও, তার কি করে প্রমিত রূপ থাকে? আমার মতে, এই কথার পেছনে হয়তো হতাশা কাজ করে। কিন্তু হতাশা দিয়ে কিছু অর্জন তো সম্ভব না। বাঙলা বানান সমস্যার গভীরে যেতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে বাঙলা ভাষার আসল দেহ। ভাষা বিজ্ঞানীরা যাকে বলেন ‘ল্যাঙ্গুয়েজ করপাস’। যদি সেটা বইপত্র থেকে সংগ্রহ করা হয়, তবে বাঙলা বানানের প্রশ্ন আসবে। এলোমেলো বানান চলবে না। আর যদি সেটা মুখের শিষ্ট বাঙলা থেকে থেকে সংগ্রহ করা হয়, তাহলে উচ্চারণেরর প্রসঙ্গ আসবে। বিচিত্র আঞ্চলিক উচ্চারণ চলবে না। ‘ল্যাঙ্গুয়েজ করপাস’ সংগ্রহ করা নিয়ে আমাদের দ্বিধা দ্বন্দ্বের অন্ত নেই। মুখের ভাষা তো দুরের কথা, লিখিত বাঙলা তথা সাহিত্য থেকে ‘করপাস’ সংগ্রহ করার ক্ষেত্রেও একমত হতে পারি না আমরা। তাই কাজের কাজ হয় না কিছুই। বাঙলা বানানের মৌলিক রুপগুলো থেকেও আসে না আমাদের হাতে।
বলা হয়, বাঙলা এখন পৃথিবীর সপ্তম (?) বৃহত্তম ভাষা। পৃথিবীতে এমন দেশ কমই আছে, যেখানে বাঙলাভাষী নেই। আর বাঙলাভাষী যেখানে আছে, সেখানেই বাঙলার চর্চা আছে কম বেশি। প্রবাসে থাকা নতুন প্রজন্ম বাঙলায় কথা বলে। বাঙলাদেশের সামাজিক অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদযাপন তো করেই। কিন্তু বাঙলা লেখা বা পড়াটা হচ্ছে না নতুন প্রজন্মের। এটা চিন্তার বিষয়। তাদের বাঙলায় বিদেশি শব্দ এসে পড়ছে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। সেই বিদেশি শব্দগুলোর বাঙলা বানান লেখা নিয়েও মতান্তর আছে। কারও মতে বিদেশি শব্দ লেখার সময় ‘ণ, ষ, ছ’ লেখা যাবে না বাঙলা বানানে। কারও মতে বিদেশি শব্দ লেখার জন্য ‘নতুন বর্ণ’ চাই। একদিকে বাহুল্য গণ্য করা বর্ণ বাদ দেয়া, অন্যদিকে নতুন বর্ণ আমদানি করার প্রস্তাব, এই দুই মতের অনুকূলে প্রতিকূলে কথার কমতি নেই। সবই ঠিক হতো, যদি এই সবের মধ্য দিয়ে বানান সংস্কারের কাজ এগিয়ে যেতো কোনো সরকারি বা সরকার সমর্থিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। তা হয়নি। উপরন্তু মতান্তরের সংঘর্ষে সেদিকে যেতেই পারিনি আমরা। তাহলে আদর্শ বাঙলা ‘ভাষার দেহ’ তথা ‘করপাস’ , তা সে লিখিতই হোক আর মৌখিকই হোক, পাবো কোথা থেকে? কাজ হবে কি ভাবে?
মাঝে মাঝে মনে হয়, এই ‘না-পাই, না-পাই’ ভাবে সময় কাটানোর একটা অভ্যেস গড়ে উঠেছে আমাদের মধ্যে। আমার মতে ভাষাবিজ্ঞানের যুক্তিতে যেটুকু সত্য আমরা পাই বা বুঝতে পারি, তার ভিত্তিতে বাঙলা বানান নির্মাণের কাজ শুরু করা যায়। শব্দের রূপতাত্বিক বানান বিশ্লেষণের মাধ্যমে কিছু একটা অর্থবহ কাজ আরম্ভ করা যায়।যেমন ; ক্রিয়ারুপের বানানের কথাই ধরা যাক। অনেক বোদ্ধা লোকেও প্রশ্ন করেন, কিছু কিছু ক্রিয়ারুপের বানানে ‘ও’-কার দেয়া হয়, সেটা ঠিক না বেঠিক? কেউ আরও স্পষ্ট করেই জানতে চান, সাধারণ ভবিষ্যত কালের ক্রিয়ায় ‘করবো’ না ‘করব’ লেখা ঠিক? ফেবু-র শুবাচ (শুদ্ধ বানান চর্চা) দেয়ালেও এই প্রশ্ন অনেকবার দেখেছি। প্রায় বিশ / পঁচিশ বছর যাবত এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছি আমি। কদিন আগেও দিতে হয়েছে। অনেকের ধারণা, ‘করব’ উচ্চারণের সময় ‘বো’ শোনা গেলেও ব-এ ‘ও-কার’ দেয়ার দরকার নেই। আসলে ভবিষ্যতের প্রত্যয় হলো ‘ব’, আর ‘ও-কার’ (ও) হলো প্রথম ব্যাক্তিবাচক (প্রচলিত ব্যাকরণে ‘প্রথম ব্যাক্তি’ মানে, ‘নাম পুরুষ’) প্রত্যয়। এই বিশ্লেষণ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। আমরা অবশ্যই লেখতে পারি ‘করবো’। কিন্তু কে শোনে কার কথা? মানুষের যুক্তি হলো, এমন বানান ছিলো না আগে। তাহলে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, শরৎ, এবং আরও বহু খ্যাতনামা লেখক, এঁরা কি ভুল লেখেছেন? ফলে সন্দেহ ঘোচে না ভাষীর। নতুন বানান আর লেখা হয় না। শুদ্ধ হলেও না। ভাষাবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা থাকলেও না। মাঠে মারা যায় বাঙলা বানান নির্মাণের সমস্ত আন্তরিক প্রয়াস। মুখ থুবড়ে পড়ে ভাষাবিজ্ঞানের নিখাঁদ যুক্তি। বহুবার বলতে হয়েছে এই সব কথা।
দুই
বাঙলা ভাষার কাজ আমার অন্বিষ্ট। কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হলে বা বিরক্ত হলে আমার চলে না। কিছু বেহায়া কাঙাল থাকে না? যারা কিছুতেই কাঙিক্ষত কাজ বা বিষয়ের সঙ্গ ছাড়ে না। যেমন আমি। ঘুরে ঘুরে তাই এসেই পড়ি বাঙলাভাষা সম্পর্কিত কাজ বা কোনো আলোচনায়। তবে মাঝে মাঝে বানান নিয়ে অনেক কথার জবাব দিতে ইচ্ছে হয় না। সাধারণতম জ্ঞান না নিয়ে যারা এক লাফ দিয়ে বাঙলা বানানের মঞ্চে এসেই বলেন, শুদ্ধ বানান লিখতে হবে সবাইকে। তখন রাগ দুঃখ বিরক্তি সবই হয়। শুদ্ধ বানান বলতে তিনি কি বোঝাতে চাইছেন, এই প্রশ্নের উত্তর তাঁর নিজেরই জানা নেই। বানানের কাজে এসমস্ত আলটপকা ফোড়নে বিস্বাদ হয়ে যায় আলোচনা। লাভ কিছু হয় না। অর্বাচীন বক্তব্যের পন্ডিতিও টেকে না।
শুবাচ দেয়ালে একজন বললেন, কোলকাতায় সবাই প্রমিত বাঙলায় কথা বলেন। সেখানে বাস কনডাক্টার থেকে শুরু করে রিকশাওয়ালা ঝাড়ুদার, ফেরিওয়ালা, বাজারের দোকানদার সবাই নাকি প্রমিত বাঙলা ব্যাবহার করেন। কি করে বোঝাই যে, এটা সত্য নয়। সত্য হলো, কোলকাতার বাঙলা আঞ্চলিকতায় ভরা। শুধু গেলুম, খেলুম, আজগে, ভিকিরি নয়, মুকের কতা, গেসলুম’ও বলে তারা। রবীন্দ্রনাথ ‘গেলুম খেলুম’-কে ‘হালুম হুলুম’-এর সাথে তুলনা করেছেন। পছন্দ করেন নি তিনি এই রকম শব্দ। যদিও এমন শব্দ রবীন্দ্র সাহিত্যে পাওয়া যায় বেশ। আর ‘গেসলুম’ শব্দের যে একখানা উচ্চারণ করেন তাঁরা, সেটার উচ্চারণই শুধু সম্ভব। লিপিতে, মানে বানানে লেখা অসম্ভব। যাঁরা শুনেছেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন আমার কথার সত্যতা। কোলকাতার প্রমিত বাঙলায়, সাধারণ অতীতকালে প্রশ্নবাচক ক্রিয়ার সাথে ‘স’ যোগ করা হয়। যেমন; ‘করেছিলিস, গিয়েছিলিস’, ইত্যাদি। জোর দিয়েই বলতে চাই, এমন উচ্চারণ প্রমিত বাঙলার নয়।
কোলকাতার বাঙলাতে মহাপ্রাণতা নেই বললেই চলে। অনুরোধে তাঁরা ‘মাচের মাতা’ খেতে বলেন, ‘মাছের মাথা’ নয়। কথা-কে বলেন ‘কতা’, পেয়েছি-কে বলেন ‘পেয়েচি’, এসেছি-কে বলেন ‘এসেচি’ বা ‘এsচি’, আজকে-কে বলেন ‘আজগে’, ইত্যাদি। প্রমিত বাঙলায় এমন উচ্চারণ গ্রহণযোগ্য নয়। শুধু মুখেই না, কোলকাতার সাহিত্যেও ‘এসেচি, খেয়েচি, ধরেচি, করচিস, মারচিস’ ইত্যাদি শব্দরুপ পাওয়া যায়। শরৎ সাহত্যে রয়েই গেছে এগুলো। ইচ্ছে হলে কেউ পড়ে দেখতে পারেন। এগুলো নিন্দার কথা নয়, বাস্তবতা। একাডেমিক রিয়্যালিটি। এরপরেও যদি কেউ বলেন, কোলকাতার সবাই প্রমিত বাঙলায় কথা বলেন, তাহলে বলার কিছু থাকে না। বলতেই হয়, প্রমিত বাঙলা তাঁদের কাছে অপরিচিত।
বাঙলাদেশে যাঁরা প্রমিত বাঙলায় কথা বলেন, তাঁদের বাঙলা উচ্চারণ প্রশংসনীয়। যাঁরা বলতে পারেন না, তাঁদের কথা আলাদা। তাই ঢালাওভাবে বলা যায় না কিছু। বাঙলাদেশের প্রমিত বাঙলায় আঞ্চলিক ভাষার গন্ধ থাকবে, এমন একটা কথা শহীদ মুনীর চৌধুরী বলেছিলেন অনেক আগেই। সৈয়দ মুজতবা আলীর সিলেটি শুনে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘তোর মুখ থেকে কমলা নেবুর গন্ধ বেরুচ্চে’। সেই গন্ধটা যখন প্রায় দুর্গন্ধে পৌঁছে যায়, তখন সচেতন প্রমিত বাঙলাভাষীর কানে এবং মনে ধাক্কা দেয়। ভাল মন্দের কথা না, এটাও বাস্তব তথ্য। ফলে আমরা যখন উচ্চারণানুগ বানানের কথা বলি, তখন সমস্যা গাঢ় হয়। সংকীর্ণ হয় কাজের উদ্যম।
প্রথমেই প্রশ্ন, কোন অঞ্চলের বাঙলা উচ্চারণ গ্রহণ করা হবে? কেউ কি নিজের অঞ্চলের দাবি ছাড়তে চান? কেউ বলেন, আমরা ‘খেয়েচি’ না বলে ‘খাইসি’ বলি। ‘খেয়েছি’ বলার মানুষ খুব কম। ‘করচিস’ না বলে উচ্চারণ করি ‘করতাসস(SOS)’। ‘বলছি’ না বলে ‘বলতেসি’। বোঝাতো যায়। তাঁদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করি, আঞ্চলিক ভাষার বোধগম্যতা সব অঞ্চলে সমান নয়। কথা আছে, এক অঞ্চলের বুলি, অন্য অঞ্চলের গালি’। কিন্তু প্রমিত বাঙলা সবার কাছে বোধগম্য। এই ভাষা শেখার বিষয়।
আমাদের সমস্যা আছে ‘চ-বর্গিয় বর্ণগুলোর উচ্চারণ নিয়ে।। আঞ্চলিক বাঙলায় সাধারণত চ-বর্গিয় ধ্বনির ঘর্ষণজাত উচ্চারণ পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় দন্ত-চ/ছ/জ/ঝ-এর উচ্চারণ। সাহিত্যে সেটা আসেনি বটে, তবে সিনেমার সংলাপে এসেছে। নাটকে তো আঞ্চলিক বাঙলার নহর বয়ে যায়। তথাকথিত পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে প্রাদেশিক রাজধানী নগর ঢাকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বহু অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। তখন বহু শিল্পী বাচিক এবং উপস্থাপকের চাহিদা দেখা দেয়। ধরেই নেয়া হয়েছিলো, প্রমিত বাঙলাভাষীরাই আসবেন পরিশীলিত অনুষ্ঠানাদির অঙ্গনে। সেটা হয়নি। তবু চাহিদার কারণে অ-প্রমিত ভাষীরাদেরও সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে গ্রহণ করতে হয়েছে। সেই আপোসের ফলে প্রমিত বাঙলার পরিশীলিত ভূবনে পর্যাপ্ত আঞ্চলিকতা অনুপ্রবেশ করে। চাহিদা এবং সরবরাহে সমতা না থাকার কারণেই হয়েছিলো তা। কেমন করে সব যেনো আয়ত্বের বাইরে চলে যেতে থাকে। চোখের সামনেই দেখেছি, রেডিও প্রোগ্রামে অতি উচ্চ শিক্ষিত মানুষের স্খলিত উচ্চারণও মেনে নেয়া হয়েছে।
কোলকাতার প্রমিত বাঙলায় ‘ছ’ হলো ‘চ’, আর আমাদের আঞ্চলিক বাঙলা উচ্চারণে ‘ছ’ হলো ‘স/S’। কিন্তু প্রমিত বাঙলার চর্চা যাঁরা করেন তাঁরা ‘ছ’-ই বলেন। আর এমন উচ্চারণ চর্চাকারির সংখ্যা নেহাত কম নয়। হতাশ হওয়ার কিছু নেই আমাদের। যেটা প্রয়োজন আমাদের, তা হলো, সচেতনতা এবং প্রশিক্ষণ। প্রয়োজন, বাঙলা ভাষা পড়ানোর জন্য প্রশিক্ষিত মানুষ। মাতৃভাষা হলেই যে সবাই শিষ্ট তথা প্রমিত বাঙলা বলতে পারবেন, তা নয়। মাতৃভাষা হলো মায়ের স মুখের ভাষা। মায়ের কোলে শুয়ে বসে খেলে হেসে শিশু প্রপ্তহম যে ভাষাটা শেখে, সেটাই তার মাতৃভাষা। তা সেটা যে কোনো অঞ্চলের ভাষা হতে পারে। কিন্তু প্রমিত বাঙলা হলো, সচেতন কষ্টে অর্জিত ভাষা। একটা মায়ের শাড়ির কোমল আঁচল। অন্যটা দোকানের ঝকঝকে নিপাট ভাঁজের তোয়ালে। ভিন্ন পরিবেশ পরিস্থিতিতে দুটোতেই হাত মোছা যায়। এই ছোট্ট কথাটা মনে রাখলে আঞ্চলিক ভাষাকে ‘প্রমিত বাঙলা’ ভাষার মর্যাদা দেয়ার জন্য অবুঝের মতো আবদার বা দাবি বা জিদ করবেন না কেউ।
তিন
দেশে এখন তিরিশের ওপর টিভি চ্যানেল। প্রত্যেক চ্যানেলে প্রতিদিন একাধিক অনুষ্ঠানে আসেন উপস্থাপক । ধরেই নেয়া যায়, প্রায় শ-খানেক উপস্থাপক প্রতিদিন নিজেদের সুচারু বাকসক্ষমতা নিয়ে টেলিভিশনের পর্দায় দেখা দেন। এই ক্ষত্রে কেউ যদি আঞ্চলিক ভাষায় উপস্থাপনা করার দাবি জানান, তবে কি হবে? যদিনা সেটা কমেডি অনুষ্ঠান হয়? উত্তরটা আমি জানি। কিন্তু দেবো না। আঞ্চলিক ভাষাকে যাঁরা প্রমিত ভাষার সমকক্ষ হিসেবে দাবি করেন, তারা দেবেন। আর উত্তর দিতে পারেন চ্যানেলগুলোর পরিচালনায় যাঁরা থাকেন, তাঁরা।
আমরা জানি, দেশের নানা জায়গায় আবৃত্তি প্রশিক্ষণের দোকান (?) আছে। সেখানে আছে অনেক ক্রেতা (?)। অনেক দুঃখে এই রকম শব্দ ব্যবহার করলাম। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, কিছু প্রশিক্ষণের জায়গা আমি দেখেছি। সেখানে উচ্চারণ শেখানোর ক্লাসও নেয়া হয়। আমিও অনেক জায়গায় আমন্ত্রণক্রমে গিয়েছি। এরপর আর কিছু না বলাই ভালো। প্রজন্মের অনেক ছেলেমেয়ে দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে কি আকুপাঁকু করে প্রমিত বাঙলার উচ্চারণ শেখার জন্য! চাহিদার কতটুকু পায় তারা সেখানে? সপ্তায় একদিন বা দুদিন কয়েক ঘন্টার ক্লাস নিয়ে দুতিন মাসের কোর্সে কি শেখে তারা? উচ্চারণের ক্লাস কমপক্ষে একবছরের হলে কিছুটা শেখানো যায় বলে মনে করি। একবার ‘জবস ডট কম’ এই ধরনের একটা দোকান গড়ে উঠলো। আমার প্রমিত বাঙলা উচ্চারণের ক্যাসেট এবং ‘ প্রমিত বাঙলা উচ্চারণ বিধি ও রীতি’ বই তারা ব্যবহার করতো।সেখানে তিন মাসের কোর্সে মাতা পিছু দশ হাজার টাকা নেয়া হতো (বিশ্বস্ত সূত্রে শোনা কথা)। তারপরেও তারা নাকি বলেছে, কিছুই শেখা হয়নি। মানে, সবটাই বাণিজ্য।
এটিএন বাঙলায় একবার ৬/৭ মাস সংবাদ পাঠকদের উচ্চারণ প্রশিক্ষণের কাজ করেছিলাম। টিভি রিপোর্টিং-এর ছেলে মেয়েরাও আসতো ক্লাসে। তখন বাঙলা সংবাদ পাঠকদের উচ্চারণের কিছু কিছু বিষয় চিহ্নিত করে দিয়েছিলাম। প্রশিক্ষণ শেষে টাইপ করে কয়েকশো শব্দের একটা তালিকাও করে দিয়েছলাম চ্যানেলের ‘সি ই ও’ কে। সেখানে বাঙলায় এবং রোমান হরফে লেখে দিয়েছিলাম উচ্চারণগুলো। একই সাথে, এটিএন বাঙলার ‘আমরা করবো জয়’ অনুষ্ঠানের কিশোরদের জন্য সপ্তায় একদিন করে উচ্চারণের ক্লাস নিতাম। ছেলেমেয়েরা শব্দগুলো লেখে নিয়ে আসতো। সেগুলো নিয়েই হতো আমাদের আলোচনা। তখন এটিএন বাঙলায় ‘প্রমিত বাঙলা’ নামে একটা অনুষ্ঠান সাপ্তাহিক উপস্থাপনা করতাম। প্রমিত বাঙলা উচ্চারণ এবং বানানের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনার জন্য শতাধিক খ্যাতিমান ভাষী অংশ নিয়েছেন সেই অনুষ্ঠানে। তাদের মধ্যে ছিলেন, ভাষাবিজ্ঞানী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাহিত্যিক, নাট্যশিল্পী, সাংবাদিক, সংবাদ পাঠক, উপস্থাপক এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ছাত্র। প্রায় তিন বছরব্যাপী ‘প্রমিত বাঙলা’ অনুষ্ঠান চলেছিলো। অজ্ঞাত কারণে তা বন্ধ করে দেয়া হয় একেবারে একুশের মাসেই।
প্রমিত বাঙলা উচ্চারণ এবং বানান নিয়ে আমাদের সমস্যাটা ব্যাপক। তাই কিছু কিছু চ্যানেলের পক্ষ থেকে যদি আঞ্চলিক বাঙলা, সাধু বাঙলা, প্রমিত বাঙলা, প্রায়োগিক বাঙলা, ইত্যাদি বিষয়ে রীতিমতো শিক্ষাধর্মী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, তাহলে আমরা সবাই উপকৃত হবো। শুধু আমাদের জন্য নয়, প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্যও এমন অনুষ্ঠানের পর্ব সাজানো সম্ভব। বাঙলা ভাষার জ্ঞানচর্চা এবং প্রয়োগ চর্চাকে বাড়িয়ে তোলার দায়িত্ব আমাদেরই।
পরিশেষে, স্কুলের পাঠ্যবইতে বাঙলা বিষয়কে আরও অনেক বেশি পরিকল্পনা করে সাজাতে হবে। একই সাথে প্রচলিত বাঙলা ব্যাকরণের অনেক বাহুল্য বিষয় তথা সংস্কৃতলগ্ন পাঠ, যেগুলো বর্জন করার সময় পার হয়ে গেছে অনেক আগেই, সেই বিষয়গুলো নিয়ে বসতে হবে বাঙলা একাডেমিসহ পন্ডিত ব্যাক্তিদেরকে। আমাদের ছেলেমেয়েরা তথাকথিত ‘বাঙলাবিদ’(?) হোক আপত্তি নেই। কিন্তু বাঙলা ভাষাকে চিনতে, জানতে, বুঝতে এবং গর্বের সাথে চর্চা করতে শিখুক। আন্তরিকভাবে এটাই চাই। প্রমিত বাঙলা সম্বন্ধে এতো কথা সে জন্যই বলে যাই।
Facebook Comments Sync