রজনীকে ফিরে দেখা/মামুন মুস্তাফা

রজনীকে ফিরে দেখা/মামুন মুস্তাফা

আহ কী প্রবল জ্যোৎসনা! জ্যোৎস্নার প্রগলভতা ছুঁয়ে গেছে দুর্বা ঘাস, গাছের কচি পাতা, খড়ের ছাদ, জানালা গলে ঘরের মেঝে,লক্ষী বউয়ের মুখ। জ্যোৎস্নাকে এভাবে অনুভব করি না কতকাল? নাকি চাঁদ দেখার সুযোগ নিভে গেছে জীবিকানিষ্ঠ একটি দিনের মাঝে? ‘রজনী’ শুধু কী বাঁচে ঘুম জড়ানো বিছানায়? অথচ রাতের আকাশ মহানগরীর ঘেমে ওঠা দরদালানের চৌহদ্দিতে এখন খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। প্রকৃতির বিষবাষ্পে রাতের চাঁদ, তারা, নীলাকাশ ক্ষয়ে গেছে, ঝরে গেছে, মরে গেছে একুশ শতকের যন্ত্রচালিত কাঠপুতুলের মানুষের মন হতে। তবুও রজনী কতভাবে কাছে আসে, সে কখনো দুহিতা, দয়িতা, প্রেমময়ী নারী, কখনো বা ছলনাময়ী, দূর মরীচিকা!

 

“যদি তুমি দীর্ঘ ও বিনিদ্র হতে, রাত্রি!/কবিরা আত্মজ্ঞ হত। ” অথচ কবিই বুনে গেছেন দীঘল রাতের কাহিনি। ঝরেছে কখনো পূর্ণিমার আলোয় সুখ-নিনাদ, কখনো বা অমাবস্যার কালো অন্ধকারে ফেলেছে কেউ ব্যর্থ জীবনের চলচ্ছবি। কবি তার সাক্ষী। হতেও পারে কবির জীবনেরই কোনো খেদ, অবসাদ, অতৃপ্তির পুনর্বিন্যাস ঘটেছে সে রাতে। রজনীকে দেখা যায় শাদা চোখেও। বালক বয়সের উৎসাহ উদ্দীপনা গভীর রাতের অলিন্দে খুঁজেছেন লেখক। রাতের আকাশ কেমন নির্ভার! সে প্রশ্ন হয়তো মনেই থেকে গেছে সবার। ধ্রুব নক্ষত্র, কালপুরুষ,? চিহ্নের মতো দূরের তারা,  প্রশ্নবোধক হয়ে রইলো চিরটাকাল! তবু রজনীকে ভালবেসে জন্ম নিলো সমস্ত সকাল।  

 

রজনীকে কে চেনে? কারাই বা জানে? তবু রজনী এসেছিল কাল। শরতের পূর্ণ আভাস ছলকে ওঠে তার সমস্ত শরীরে। না উচ্চ না মৃদু, এমন কণ্ঠে আমাকে ডেকেছিল ‘আমাকে চিনতে পারো?’ তখন মধ্য আকাশে পূর্ণিমার গোল চাঁদ বহুকাল পরে হাসছিল যেন। নাকি পূর্ণিমা দেখার সুযোগ মেলেনি এতদিনে! তবে এটুকু অনুমান করি বাঙালি মাত্রেই পূর্ণিমা দেখার ইচ্ছেটা কারো একেবারে মরে যায়নি।  

 

আমি অবশ্য রজনীকে চিনি ঘন অন্ধকারের ভেতরেই। বর্ষা আমার খুব প্রিয়, হতে পারে আষাঢ় মাসে আমার জন্ম বলে। সেই বৃষ্টির মধ্যে ঘোর অমাবস্যায় রজনীকে দেখেছি শরীর ভিজিয়ে দরজায় বসে থাকতে। অন্ধকার ঘুপচি কানা গলি পথে রজনীর বাস। সেখানে ভদ্রলোকের পা পড়ে না। তবু রজনীকে ডাকি আমরা। দিনের আলোয় দেখা কর্মচাঞ্চল্য, ক্লান্তি, অবসাদ, হাসির আড়ালে শঠতা, কূটচাল, হিংসা, দ্বেষ, স্বার্থপরতা, দুর্নীতি এ সমস্ত কিছুর মাঝে দিনযাপনের হা হা শূন্যতা ভুলে যেতে রজনীকে আমাদের চাই-ই চাই। একটু নিজের মতো করে ভাববার অবসর রজনী ছাড়া কে বা দিতে পারে।

 

আষাঢ়ে রজনী হারায়েছিল পথ। বিদ্যুৎচমকে, বিজলী রাতে রজনীর ভয় ছিল অনেক। অনেক দীর্ঘ, জটিল, বিচিত্র এবং বর্ষার সমারোহমুখর ফেলে আসা সেই রাত ভৌতিক অথচ কৌতূহল সৃষ্টি করেছিল জনে জনে। অফুরন্ত উৎস থেকে অব্যাহত উদ্যমে ছুটে গেছে আষাঢ়ের ওই কালো রাত। রজনী থিতুমুখে বসে। কুকুরের আর্তনাদ, বিড়ালের আস্ফালন, প্যাঁচার ডাক, ব্যাঙের গোঙানি প্রকৃতিকে করেছিল মূঢ়! ১৭ই আষাঢ় আমাকে পরিচয় করায় সেই রজনীর সাথে। ওই রাত্রিকথা আমিও বলেছিলাম “অনেক দিনের মৃত্যু…‘ধুলোর মধ্যে লুটিয়ে পড়া সন্ধ্যা’…রাতের সহমরণ”। 

 

আবার শীতের আকাশে দেখি কুয়াশায় পেঁচানো রাত শুধু দীর্ঘ জটিল নয়, গোপন নেপথ্যচারীও। মানবীয় অভ্যুদয়ে সর্বগ্রাসী, দুকূলপ্লাবী জোয়ার আনে শীতের দীঘল, হিম রাত্রি। তবু সেই আমার নিঃশব্দ ধ্রæবপদ। বিস্ময় ও রহস্য নিয়ে শীতের কম্পমান রজনীতে আমি দেখেছি মারমা মেয়ের দীর্ঘ ঘন কালো চুলে ভ্রমরের ঠিকানা। বাঁশখালির চা-বাগানের পথে তার ছায়াছবি। সেই রজনীর কাছে ছিল নারীর অধিক অধিকার, নিসর্গরমণ! আজ আমার অনুজ্জ্বল, ধূসর, ধূলিলিপ্ত দলিত সময়ের কাছে মারমা মেয়ের চলার পথে দুর্ভেদ্য আলোআঁধারীর রহস্যে অজ্ঞেয় হয়ে ধরা দেয় শীতের ওই দীর্ঘ একরত্তি রাতটুকু। 

 

“সারারাত হীরক জয়ন্তী নয়, সারারাত শুধু বৃষ্টি হলো!/মৃত্যু আর আশার আতশজানলা ভেদ করে”। রাতের আঁধারে ধেয়ে আসে যত ধ্বংস, তেমনি রাতেই শান্তি আর শিল্পের পটভূমি রচিত হতে দেখি। মানব মনের বিষণ্নতা, নৈঃসঙ্গ্য এবং দীর্ঘশ্বাস ধরা পড়ে রাতের অলিন্দে। আবার এই রজনী তখন তার সকল শিল্পিত সৌন্দর্য মেলে তীব্র অনুভূতিতে মানুষের প্রতি তার মমতা, জীবনের প্রতি তার ভালবাসা ব্যাখ্যা করে আগামী ভোরের অপেক্ষায়। তাই তো রজনীর দেখা মেলে ডেটল তুলো সেবিকা হাতে হাসপাতালের বেডে। আবার রাতের ভ্রমণে আকাশ আর মাটির সন্ধিক্ষণে রজনী দৃশ্যমান হয় প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিনির্মাণে।  

 

স্মৃতিকাতরতা, লোকে বলবে হয়তো একে। তবু সে নস্ট্যালজিয়া নয়, ধূসর এক অনিশ্চয়তায় ঢেকে যাওয়া অতীতের উজ্জ্বল স্মৃতি থেকে বর্তমানের পাংশু মেঘে ঢাকা আদিগন্ত রাতের আকাশ মানবিক সত্তাকে বিকীর্ণ করে বারবার। ‘সবই কি পন্ডশ্রম? অহেতুক গলদঘর্ম সব? মন্ত্রপুত ব্রতউদযাপন, বিনিদ্র জাগরণের কাব্যোৎসর্গ, এসবই কি মিথ্যে?’ আজ দেখি রাতের শরীর জুড়ে কেবলই রক্তক্ষরণ। অথচ রজনী বলেছে সে কথা, “একটি অক্ষর, একটি স্বর, একটি ধ্বনিও কি উত্তরকালের কৃপাকটাক্ষে পুনর্জীবন ধন্য হবে না? কে জানে”। অথচ ঘুম নিশীথে উদাসীনতায় সমর্পিত হতে হতে দেখেছি কী এক মগ্নচৈতন্যে আমার দরজা সুমুখে দাঁড়িয়ে একাকী রজনী।

 

জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত সকল উপলব্ধির মাঝে রজনী আবারও প্রশ্ন করে ‘আমাকে চিনতে পারো?’ রজনীকে চিনেছিলাম জগদীশ গুপ্ত’র লঘু-গুরু-তে, কখনো বিমল মিত্র’র শেষ প্রশ্নে, সবশেষে প্রেমেন্দ্র মিত্র’র সংসার সীমান্তে। তাকে চিনেছি পরম মমতার আশ্রয়ে জীবনের ক্লেদাক্ত সময়গুলো বিস্মৃত হতে দেখে। তাই বুঝি এ জগত সংসারে রজনী কোনো পুরুষের নাম নয়, কেবল নারীই তাকে ধারণ করে। আর তাই আনন্দ-বেদনা, দুঃখ-কষ্ট, আশা-নিরাশার ত্রিবেণী সঙ্গমে নারীসম রজনী কখনো প্রেমাসক্ত,  স্নেহপরায়ন আবার কখনো রুদ্র, বিপ্লবী, ভয়ঙ্করী। তবুও সংসারযাত্রার বন্ধুর পথে সেই যেন সর্বংসহা।

 

রজনী আবারও কথা কয়, ‘এক জীবনে ইচ্ছে ছিল শিল্পরসিক হবার, এখন সাধ জাগে নিজের একটি ঘর, ঊনুনে আগুন জ্বালাবার’। অনেক অন্ধকার জীবন, অনেক নষ্ট জীবন, অনেক মৃত জীবন স্বপ্নাতুর ভালবাসায় ফিরিয়ে দিয়েছে রজনী। অথচ নিজের জীবন আজও রয়ে গেছে কর্দমাক্ত পঙ্কিলতায়। যদিও জানি আমার জানালার পাশে শরতের যে পূর্ণ শশী পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অনেক যুগলকে প্রেমময় করে তুলেছে তার নিজস্ব কোনো মাহাত্ম নেই, আলো নেই। সে নিজেই অন্যের ঐশ্বর্য নিয়ে ঐশ্বর্যবান! দিনের দিবাকরের আলোয় নিজেকে সাজিয়েছে সে। মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর কবিতার ভাবানুবাদে তাকেও বলতে হয়, “আমিও যে ছিলাম শুধু এ পাথর জানে।/কেউ যদি মনে রাখে, তবে তা স্বপ্নেই।”

 

কী আশ্চর্য! রজনীকে মানুষ মনে রাখে তার স্বপ্নের ভেতরে। আমিও কী তেমনি দেখেছি রজনীকে? রজনীর কালো পাড় শাদা শাড়ি, এলোখোঁপায় শিউলি ফুলের মালা, ভ্রুযুগলের মাঝে ছোট লালটিপ জীবনের পথে একদিন ডেকেছিল কোনো এক পোড় খাওয়া পুরুষকে। সেই প্রেমের আঁচল পেতে আজও বসে আছে রজনী। এই সুরমায়, কুশিয়ারার শীর্ণ তীরে, ‘সংসার সীমান্তে’র কাছে সে যেন কাকে খুঁজে ফেরে। লামা বাজারে মণিপুরি মেয়ের দোকানে হঠাৎ দেখা তার সাথে। ‘আমাকে চিনতে পারো, কবি?’ নিজেই বলে চলে, ‘আজও আমি তাকে খুঁজি’। কার কবিতা পড়েছিলাম মনে নেই। তবু রজনীকে আশ্বস্ত করি ‘প্রকৃত প্রেমের হাত শূন্য থাকে, শূন্য থাকা ভাল’।

 

বর্ষার ঘন কালো রাত, শীতের কুয়াশায় পেঁচানো দীর্ঘ রাত কিংবা শরতের নির্মল জ্যোৎস্নাস্নাত রাত; অথবা কাশফুল, জানালা দিয়ে ঘরের মেঝেতে আছড়ে পড়া পূর্ণিমার আলো, বাংলার মৃতপ্রায় নদীবক্ষে বয়ে চলা নৌকোর মাঝির কণ্ঠে ভাটিয়ালি কিছুই আর তাড়িত করে না রজনীকে। রজনীর কাছ থেকে শোনা, যে ছেলেটি ঘর দিতে চেয়েছিল, একটি বালিশে দুটি মাথা রেখে ঘুম পড়ার স্বপ্ন জাগিয়েছিল, তার গন্তব্য রজনী এখনো খুঁজে ফেরে। আজও রজনীর বিশ্বাস লোকটি প্রতারক নয়। ‘সংসার সীমান্তে’ তার সাথে দেখা হয়েছিল। না জানি সে আজ কোন্ শিকলে বন্দী?

 

রজনী তাই আবারও ফিরে যায় আজানা নিষিদ্ধ সেই পথে। যদি সে যুবক ফিরে আসে! রজনীকে না পেয়ে সে যদি মরে যায় মনে মনে! রজনী আজও তাই বর্ষাকে ভালবাসে। অন্ধকারে লন্ঠনের কাঁপা শিখা আড়াল করে অঝোর বৃষ্টিতে নিজেকে সিক্ত করে। রজনীরা এভাবেই ফিরে গেছে অচেনা গন্তব্যে। অথচ রজনীরাই পারে কোনো কোনো জীবনকে নর্দমা থেকে তুলে আনতে। আমরা পারিনি আজো একটিও রজনীকে দিনের আলোর মুখ দেখাতে।

মামুন মুস্তাফা
মামুন মুস্তাফা
%d bloggers like this: