স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর: কী পেলাম, কী পেলাম না! / আফরোজা পারভীন

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর- কী পেলাম, কী পেলাম না!

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর- কী পেলাম, কী পেলাম না!

স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর: কী পেলাম, কী পেলাম না! / আফরোজা পারভীন

 

 পঞ্চাশে পা রেখেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছর এটি। বাংলাদেশের বয়স এখন অর্ধশতাব্দী। আমাদের  অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা সম্ভ্রমহানি আত্মবলিদানের বিনিময়ে অর্জন। অর্ধশতাব্দীকে কম সময় বা  নবীন বলা যাবে না কিছুতেই।

বাঙালির গঞ্জনা নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করার ইতিহাস পুরোনো। আমরা দুশো বছর ব্রিটিশের অধীনে ছিলাম। পাকিস্তানিদের অধীনে ছিলাম আমরা ২৪ বছর। হাজার মাইল দূরে বসে আমাদের টাকা পয়সা শুষে নিয়ে আমাদেরই উপ তারা ছড়ি ঘুরাতো। দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে  মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে বাংলার দামাল ছেলেরা। ৯ মাসের যুদ্ধে ৩০ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা জীবন দিয়েছে । দুই লক্ষ মা বোন সম্ভ্রম হারিয়েছে। আমরা চেয়েছিলাম একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের মালিক হতে। অপরিসীম  নির্যাতন ভোগ করেছি। নিজ দেশে পরাধীন জীবন থেকে মুক্তি চেয়ে নিজেদের মতো করে বাঁচতে চেয়েছি। চেয়েছি রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, সুশাসন ভিত্তিক সমাজ ও নিজ সংস্কৃতির সুস্থ বিকাশ। আজ সুবর্ণজয়ন্তীর পাদপ্রান্তে দাঁড়িয়ে হিসেব মেলানো দরকার আমরা কী পেলাম, কী পেলাম না, কেন পেলাম না, কার জন্য পেলাম না। আত্মতুষ্টিতে না ভুগে আত্মবিশ্লেষণের প্রয়োজন আমাদের। 

আমরা আজ স্বাধীন। ব্রিটিশরা নেই, পাকিস্তানিরা নেই, জমিদাররা নেই। আমরা পেয়েছি স্বজাতির শাসন। কিন্তু সে শাসন কতটা আমাদের চাওয়ার সাথে মিলেছে সেটাই খতিয়ে দেখার। সার্বিক অগ্রগতি ও কাঙিক্ষত উন্নয়নের তুলনা করার সময় এসেছে আজ।

 বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেক। দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। শিক্ষা স্বাস্থ্য ইনফ্রাস্ট্রাকচার মাথাপিছু আয় সবক্ষেত্রেই সাফল্য এসেছে। দৃশ্যত বিস্ময়কর উন্নয়ন হয়েছে। পাতালরেল, ফ্লাইওভারে ভরে গেছে দেশ। অবকাঠামোগত উন্নয়ন চোখ মেলে দেখার মতো।  বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে,  বৃদ্ধি পেয়েছে সম্পদ উৎপাদন ও আহরণ।

১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকার বার্ষিক বাজেট আজ পরিণত হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেটে। ১২৯ ডলার মাথাপিছ আয়ের দেশটির বর্তমান মাথাপিছু আয় ২০৬৪ ডলার। 

শেখ হাসিনার শাসনামলে আর্থ-সামাজিক খাতে  দেশ অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করে। ১৯৯৬-২০০১  মেয়াদে  শেখ হাসিনা সরকারের উল্লেখযোগ্য সাফল্যগুলো ছিল: ভারতের  সাথে ৩০ বছর  মেয়াদী গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু  সেতু নির্মাণ এবং খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। এছাড়া, তিনি কৃষকদের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক কর্মসূচি এবং ভূমিহীন, দুস্থ মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি চালু করেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: দুস্থ মহিলা ও বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্কদের জন্য শান্তি নিবাস, আশ্রয়হীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প।

২০০৯-২০১৩  মেয়াদে  শেখ হাসিনা সরকারের উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে রয়েছে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ১৩,২৬০  মেগাওয়াটে উন্নীতকরণ, গড়ে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন, ৫  কোটি মানুষকে মধ্যবিত্তে উন্নীতকরণ, ভারত ও মায়ানমারের সঙ্গে সামুদ্রিক জলসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি, প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল  সেন্টার স্থাপন, মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, কৃষকদের জন্য কৃষিকার্ড এবং ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব  খোলা, বিনা জামানতে বর্গাচাষীদের ঋণ প্রদান, চিকিৎসাসেবার জন্য সারাদেশে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কম্যুনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন, দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৩৮.৪  থেকে ২০১৩-১৪ বছরে ২৪.৩ শতাংশে হ্রাস, জাতিসংঘ কর্তৃক  শেখ হাসিনার শান্তির  মডেল গ্রহণ ইত্যাদি।

২০১৪ সালের পর এ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সাফল্যগুলোর মধ্যে রয়েছে: বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ, ভারতের পার্লামেন্ট কর্তৃক স্থল সীমানা চুক্তির অনুমোদন এবং দুই  দেশ কর্তৃক অনুসমর্থন। এর ফলে দুই  দেশের মধ্যে ৬৮ বছরের সীমানা বিরোধের অবসান হয়েছে। মাথাপিছু আয় ১,৬০২ মার্কিন ডলারে উন্নীতকরণ, দারিদ্রের হার ২২.৪ শতাংশে হ্রাস, ৩২ বিলিয়ন ডলারের উপর  বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ  অর্জন ইত্যাদি।

উত্তরবঙ্গের সাথে সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন ছিল যমুনা নদীর উপর সেতু নির্মাণ করা। তিনি পরিকল্পনাও নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হওয়ায় সেই  সেতু তিনি  দেখে  যেতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু কন্যা  শেখ হাসিনা একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালের জুন মাসে জনগণের রায়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে যমুনার উপর নির্মাণাধীন  সেতুর কাজ দ্রুুতগতিতে  শেষ করে ১৯৯৮ সালের জুন মাসে  সেতু উদ্বোধন করেন। নিজ কন্যার হাতেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ আর স্বপ্ন নয়। বিদেশী অর্থায়ন ছাড়াই নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হয়েছে পদ্মা সেতু। এখন শুধু উদ্বোধনের অপেক্ষা। এই সেতু উদ্বোধন হলে সারা দেশের সাথে কানেকটিভিটি বাড়বে। ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অভ‚তপূর্ব উন্নয়ন হবে বলে স্বপ্ন দেখছে দেশবাসী। একটি দেশের প্রকৃত সমৃদ্ধি বা অগ্রগতি নির্ভর করে কতিপয় নিয়ামকের ওপর। যার মধ্যে আছে  জনগণের জীবনযাত্রার মানের বাস্তব রূপ,  নিরাপদ খাদ্য, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, মতপ্রকাশের অধিকার, বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা, কর্মসংস্থান প্রভৃতি । 

স্বাধীনতার অর্ধশত বছরে দৃশ্যমান যে, মানুষের জীবনযাত্রার মান  বেড়েছে। মানুষ ভালো খায়, ভালো পরে, হাতে হাতে মোবাইল। কিন্তু গোটা দেশের চিত্র এটা নয়। দেশের প্রান্তিক মানুষটি দুবেলা দুমুঠো খেতে পারে কীনা, তার পোশাক আছে কীনা সে পরিসংখ্যান নেই। সম্পদের সুষম বন্টন নেই, শ্রেণিবৈষম্য প্রকটভাবে বিদ্যমান। দেশের একাংশের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন দেখে পুরো  দেশের বিচার করা যাবে না। আর সারা দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে একথাও একবাক্যে বলা যাবে না। 

দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এ কৃতিত্ব সরকার ও কৃষিবিজ্ঞানীদের। কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করলেও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা আজও সম্ভব হয়নি।  খাবার দাবার ভেজালে সয়লাব। ভেজাল খাবার খেয়ে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ক্যানসারসহ বিভিন্ন মরণব্যাধিতে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে সরকার বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ, আইন প্রণয়ন করছে বটে, কিন্তু বাস্তবায়ন ও মনিটরিং প্রথা যথাযথ নয় বলে ভেজাল দেবার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। মানুষও হতাশ হয়ে পড়ছে। কোন খাবারে ভেজাল আছে আর কোনটাতে নেই বুঝতে না পেরে মানুষ কী খাবে আর কী খাবে না এই দ্বিধা দ্ব›েদ্ব ভুগছে!

 প্রকৃত উন্নয়নের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান শিক্ষা। এটি পরিমাপের দুটি দিক রয়েছে। একটি পরিমাণগত, অন্যটি গুণগত। স্বাধীনতার পর থেকে আমরা শিক্ষার পরিমাণগত দিকটিকেই আমাদের সাফল্যের মানদন্ড ধরে নিয়ে এগিয়েছি। শিক্ষা ক্ষেত্রে স্বাধীনতার পাঁচ দশকে সবচাইতে বড় অর্জন জনগণের দীর্ঘদিনের চাহিদা জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০। দেশে প্রাথমিক শিক্ষার হার বেড়েছে, স্বাক্ষরতার হার বেড়েছে, নারী শিক্ষার হার বেড়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হয়েছে, ঝরে পড়ার হার কমেছে, সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয়েছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ বেড়েছে। উচ্চশিক্ষার সুযোগ বেড়েছে প্রকৌশল, কৃষি, মেডিকেল, বস্ত্র, চামড়া ইত্যাদি শিক্ষার ক্ষেত্রে। শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন বই সরবরাহসহ করা হচ্ছে বছরের শুরুতে। কিন্তু এত কর্মযজ্ঞ চলমান থাকার পরও মানসম্মত শিক্ষার চাহিদা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারিত আছে “জাতীয় জীবনের সর্বত্র নেতৃত্বদানের উপযোগী, বিজ্ঞানমনষ্ক, প্রগতিশীল, মানবমুখী, দূরদর্শী, অসা¤প্রদায়িক ও উদারনৈতিক সুনাগরিক সৃষ্টিই হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বমানের শিক্ষার লক্ষ্য”। কিন্তু বাস্তবিক তা হচ্ছে না। 

স্বাধীনতার সময় দেশে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬.৮ শতাংশ, যা বর্তমানে ৭৪.৭ শতাংশে পরিণত হয়েছে। স্বাক্ষরতার হার বাড়লেই আমরা খুশি হই। এখন ঘরে ঘরে এ+। ছেলে মেয়ে এ +পেলে অভিভাবকরা আনন্দে মিষ্টি বিতরণ করেন। এটা নেহাৎ মূর্খামি ছাড়া আর কিছু না। এই এ+ এর বন্যা দেশ ও জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ফলাফলমুখী এই শিক্ষায় প্রকৃত শিক্ষা মোটেই হয় না। ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে অধিকাংশ ছেলে মেয়ে উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে মুখ থুবড়ে পড়ে। ভালো স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় না। চাকরি পায় না। কারণ তারা প্রকৃত শিক্ষিত নয়। বই মুখস্থ করে এ+ পেয়েছে। 

 দেশ গবেষণা ক্ষেত্রে খুবই দুর্বল। কালেভদ্রে দুচারটি গবেষণা হলেও অভিযোগ ওঠে নকলের। আবার চাকরির বাজারের সঙ্গে পঠিত শিক্ষার অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিল না থাকায় অধীত বিদ্যা কাজেও লাগাতে পারে না শিক্ষার্থীরা।  নিয়মিত হানাহানি মারামারি চলে শিক্ষাঙ্গনে।  সহপাঠীকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে কোনো দ্বিধা জাগে না শিক্ষার্থীদের মনে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রবেশ করেছে প্রকট রাজনীতি। ছাত্র ও শিক্ষকরা জড়িত হয়ে পড়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে। ফলে দ্বন্দ-সংঘাত নিত্যকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেশনজট বাড়ছে। সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে না। নিজের ঐতিহ্য আভিজাত্যর প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি হচ্ছে না।  দেশপ্রেমের  চেতনায় উদ্দীপ্ত হচ্ছে না ছাত্রসমাজ, যা আগে ছিল।

 জীবনে শিক্ষার সুফল দ্রুত পৌছে দিতে প্রয়োজন শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন করা, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানো। প্রয়োজন দেশপ্রেমমূলক বাঙালি জাতীয়তাবোধ সম্পন্ন শিক্ষা। যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ করা দরকার। 

কর্মসংস্থান একটি দেশের উন্নয়নের অন্যতম ধারক ও বাহক। সরকারি তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৭ লাখ। এর মধ্যে শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত ২৩ লাখ ৭৭ হাজার। আর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার হিসাব অন্যরকম।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে কর্মসংস্থানের নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বেসরকারি খাতে চাকরি বেড়েছে। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যার তুলনায় তা নিতান্তই অপ্রতুল। দেশব্যাপী নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরী। কাজ না পেলে তরুণ সমাজ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে। যা স্বাধীন দেশের জন্য খুবই বেদনার।

একটি দেশের উন্নয়নের অন্যতম মাপকাঠি হল দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বিদেশি বিনিয়োগ ও বাণিজ্য, অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন, রাষ্ট্রের স্বাভাবিক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এর ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু দেশে প্রথম থেকেই চলছে বিভাজনের রাজনীতি । ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোন ঐক্যের সৃষ্টি হয়নি। যখন কোনো দল ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করে, সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা না করে ধ্বংসাত্মক রাজনীতির পথ গ্রহণ করে তারা। আবার ক্ষমতায় যখন থাকে তখন যেন বিরোধী দলকে দমন করাই হয় তাদের অন্যতম নীতি।

কিন্তু এত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও বাংলাদেশের অগ্রগতি দৃষ্টি কাড়ে। ১৯৭১ সালে দেশটি ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত, সাহায্যনির্ভর, ঋণ নির্ভর। সেই দেশটি আজ মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে। কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশ। জাতীয় আয়ের প্রধান উৎস কৃষিতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি দেশটি। উৎপাদনের কৌশল বাড়িয়ে  তৈরি পোষাক রফতানিতে সাফল্য দেখিয়েছে। সাফল্য দেখিয়েছে জনশক্তি রফতানিতে।  মানবসম্পদ উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা ও নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এর বিপরীত দিকও আছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কল্যাণে আমদানি নীতি উদার হয়েছে। ফলে বিশ্বব্যাপী বেড়েছে প্রতিযোগিতা। ফলশ্রুতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের পাশাপাশি বৃহৎ শিল্পও হুমকির মুখে পড়েছে। ঋণ খেলাপির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কালো টাকা অর্জনের প্রতিযোগিতায় বাড়ছে। ঋণ খেলাপিরা ঋণ পরিশোধ করছে না। বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকায় অমিততেজে কালো টাকার পাহাড় গড়ছেন এক  শ্রেণির মানুষ। প্রতিবছর ব্যাংক থেকে লোপাট হয়ে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা। লুটপাট চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজির ক্যাসিনো জুয়া  চলছেই। 

গ্রামীণ অর্থনীতিকে রক্ষা করা দরকার। দরকার নারী পুরুষের মজুরী  বৈষম্য নিরসন করা। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে  এনে রফতানি বাড়ানো প্রয়োজন। প্রয়োজন দেশজ শিল্পকে সমৃদ্ধ করা। কৃষির আধুনিকায়ন জরুরী। সম্পদের অসম বন্টন রোধ করা দরকার। ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। প্রয়োজন জালিয়াতি বন্ধ করা। বিনিয়োগের প্রসার ঘটিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করা, মানবসম্পদ পরিকল্পনা করে দক্ষ জনশক্তি  তৈরি করা, পরিবেশ দূষণ রোধের উদ্যোগ নেয়া। 

বলা হচ্ছে উন্নয়নের মহাসড়কে রয়েছে বাংলাদেশ। স্ব-অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। মহাসড়ক সংস্কার, মেট্রোরেল, ট্যানেল, উড়াল সেতু, ওভার ব্রিজ, ফ্লাইওভার, অসংখ্য ব্রিজ-কালভার্ট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভবন, রেল উন্নয়ন, নৌপথ উদ্ধার, নতুন রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। অনুমোদন পেয়েছে অনেকগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল। বিদ্যুৎ উৎপাদন, গ্রামীণ স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম জোরদার হয়েছে। শিক্ষানীতি, নারী উন্নয়ন নীতি, তথ্য অধিকার আইন, সড়ক নিরাপত্তা আইন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতি, শিল্প নীতি, বাণিজ্য নীতি প্রবর্তিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা বাড়ানো হয়েছে। তাদের জন্য চিকিৎসাসহ নানারকম সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাগ্য তেমন পরিবর্তন হয়নি। ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, দুর্নীতি আর  নৈরাজ্য সৃষ্টির প্রতিযোগিতার কারণে। সাধারণ মানুষ ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে এবং গার্মেন্টস শিল্পনির্ভর কর্মসংস্থানের মধ্যেই জীবন সংগ্রাম করছে।  সরকারের পক্ষ থেকে কিছু সামাজিক নিরাপত্তা বলয়  তৈরি করা হয়েছে। সে বলয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন কিছু মানুষ। সেখানেও আছে মধ্যস্বত্ব ভোগীদের হাত। স্বাধীনতাবিরোধীদের দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা যেমন আছে, তেমনি আছে সরকারি দলের কর্মীদের আধিপত্য বিস্তার প্রচেষ্টা, তাদের সীমাহীন দুর্নীতি।  এই দলীয় লোকগুলি তাদের আচরণের মাধ্যমে সরকারের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পর্দা-বালিশ- চেয়ার-বক্তৃতা কেলেংকারী চলমান। উন্নয়ন প্রকল্পগুলি নির্ধারিত সময়ে শেষ হচ্ছে না। শেয়ার বাজারে ধস ঘটছে। সিন্ডিকেট বাজার নিয়ন্ত্রণ নষ্ট করছে, আলু চাষ-পুকুর কাটা-গ্রাম উন্নয়ন প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশ ভ্রমণ চলছে, কমিশন বাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। আয়  বৈষম্য বেড়ে চলেছে। বেকারত্ব আর দারিদ্রে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি মিলছে না।একশ্রেণির মানুষ অন্যায় পথে ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতায়  ছুটে চলেছে। আর একশ্রেণির মানুষ ক্ষুধার তাড়নায় নগরমুখী হচ্ছে। 

আইনের শাসন নেই। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার দলাদলি অব্যাহত রয়েছে। এক শ্রেণির জনগণের নিয়ম মানার মানসিকতা নেই।  সাধারণ মানুষের অনেকেই এখনও  মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।

সরকারের বিভিন্নমুখী প্রচেষ্টা সত্তে¡ও এই অবস্থার প্রধানতম কারণ সর্বগ্রাসী দুনীতি। বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীন হবার পর একটি ভাষণে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘এত চোরের চোর। চোর কোথা থেকে যে পয়দা হয়েছে আমি জানি না। পাকিস্তানিরা সব নিয়ে গেছে; কিন্তু এ চোরগুলো রেখে গেছে আমার কাছে। এ চোরগুলো নিয়ে গেলে আমি বাঁচতাম।’ 

 সে চিত্র আজও বদলায়নি। অর্থ লুটপাটকারী, বিদেশে অর্থ পাচারকারী সিন্ডিকেট  যেন বিশাল জাল বিস্তার করেছে।  দিন দিন আমরা দুর্নীতির ঘেরাটোপে আটকে যাচ্ছি।

সরকারের সামনে বড় বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। এখনও আছে। সে চ্যালেঞ্জগুলি সফলভাবে মোকাবিলা করেছে সরকার। জাতির জনকের হত্যার পর অবৈধ ক্ষমতাধারীরা কুখ্যাত ‘ইনডেমনিটি বিল’ জারি করে যাতে খুনিদের বিচার করা না যায়। তারা  এই বিল আইনেও পরিণত করে। আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষতায় এসে কুখ্যাত এই বিলটি বাতিল করে। একে একে আইনের আওতায় এনে বিচার করে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারের হত্যা, জেল হত্যা, মানবতাবিরোধী হত্যাকান্ড, একুশ আগস্টের গ্রেনেড হত্যার। অনেকগুলি হত্যাকান্ডের রায়ও কার্যকর হয়েছে। দায়মুক্ত হয়েছে জাতি। এছাড়া বিডিআর বিদ্রোহ, হেফাজতী আন্দোলন, হলিআর্টিজন জঙ্গী হামলা মোকাবিলা ছিল সরকারের জন্য বড় বড় চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জ অত্যন্ত দূরদর্শিতার সাথে মোকাবিলা করেছে সরকার। মানবিক কারণে মায়ানমারের শরণার্থীদের কক্সবাজারে আশ্রয় দিয়েছিল সরকার। তাদের একাংশকে ভাসানচরে সরিয়ে আনতে পারাও সরকারের বড় সাফল্য। এসব দিকে নজর দিতে না হলে সরকার দেশ উন্নয়নের আরও অনেক সময় দিতে পারত।

 মোটা দাগে বলতে গেলে দেশের উন্নতি হয়েছে। তবে সমতাভিত্তিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। শহরকেন্দ্রিক উন্নয়নে ঝুঁকে পড়ার ফলে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বিস্তর ফারাক সৃষ্টি হয়েছে। দেশে বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই। দুর্নীতি দমন এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হলে দেশে সমতাভিত্তিক উন্নয়ন হবে-তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ডিজিটাল যুগে পদার্পণ করেছে বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে সরকারের সাফল্য অপরিসীম। ডিজিটাল বাংলাদেশের মাধ্যমে দেশ এক নতুন জীবনধারার সাথে পরিচিত হয়েছে।

 বৎসরাধিককাল ধরে বিশ্বব্যাপী মহামারীর তোপে আমরা আক্রান্ত। থমকে গিয়েছে সারা বিশ্ব। উন্নয়ন কর্মকান্ড ব্যাহত হয়েছে, হচ্ছে। তারপরও এ কঠিন দুর্যোগ সরকার ভালোভাবে মোকাবিলা করেছে, করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়াল সভার মাধ্যমে প্রতিটি বিষয়ে নিয়মিত নির্দেশ দিচ্ছেন, মনিটর করছেন। জরুরী বিষয়গুলিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী সচিব আর সংশ্লিষ্টদের এক টেবিলে বসিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে যাতে সময়ক্ষেপণ না হয়। কাজ আটকে না থাকে।   দেশে ভ্যাকসিন এসেছে। জনগণ টিকা গ্রহণ করছে। দুঃস্থ, কবি সাহিত্যিক শিল্পী সাংবাদিকসহ বিভিন্ন  শ্রেণি পেশার প্রান্তিক মানুষের জন্য খাদ্য ও অর্থের যোগান দিচ্ছে সরকার। এ সময় উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয় তাই দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছে ফসল উৎপাদন ও কাটায় অংশ নেয়ায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ চলছে। গৃহহীনদের গৃহ দিচ্ছে সরকার। সরকার কর্তৃক ঘোষণা  দেয়া হয়েছে এই মুজিব বর্ষে সবাই ঘর পাবে, কেউ গৃহহীন থাকবে না। 

সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তার সুফল আমরা পাচ্ছি। কোনো দেশের সরকার একা সবকিছু করতে পারে না। প্রয়োজন জনগণের সর্বাঙ্গীন সহযোগিতা। 

 পৃথিবী আবার স্বাভাবিক হবে, বাংলাদেশে অব্যাহত থাকবে সুস্থ উন্নয়নের গতিধারা এ কামনা রইল।

আফরোজা পারভীন
আফরোজা পারভীন
%d bloggers like this: