শাকওয়ালী/ অনুপা দেওয়ানজী

অনুপা দেওয়ানজী 

অনুপা দেওয়ানজী 

হরিপুর গ্যাসফিল্ডের বাংলোর বারান্দাটায়  দাঁড়ালেই  যতদূর চোখ যায় ততদূর পর্যন্ত দেখা যায়  নিবিড় সবুজে ঢাকা বিশাল এক চায়ের বাগান। 

ঋতু বদলের সাথে সাথে সে নাকি অনন্য সব রূপ নিয়ে ধরা দেয়।

আমি তখন সবে গিয়েছি সেখানে ।

 শীত শেষ হয়ে তখন  শরৎ এসে দুয়ারে দাঁড়িয়েছে। চা বাগানের শেডট্রির ফাঁকে ফাঁকে নীল আকাশে ধবধবে সাদা মেঘের দলকে আকাশে ভেসে বেড়াতে দেখি।

মনে মনে আমি গেয়ে উঠি

 

“অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া 

দেখি নাই কভূ দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া। “

 

 বর্ষায় বাগানটি নাকি  ছায়াবীথিতলে  অবগাহন করতে থাকে সারাক্ষণ। সে অবগাহন নাকি কিছুতেই আর শেষ হতে চায় না।

আবার বসন্তে বাগানটি নাকি সবুজের বন্যা বইয়ে দেয়।

 বাংলোর বারান্দা থেকে নামলেই গ্যাসফিল্ডের   কাঁটাতারের সীমানা চলে গেছে বাংলো থেকে কিছুটা দূরে ফিল্ডের রাস্তার পাশঘেঁষে। 

সেই কাঁটাতারের সীমানা ডিঙিয়ে গ্রামের অনেক অভাবী বৌ ঝি কাঁখে কাপড়ের বোঁচকা নিয়ে টুপ করে ফিল্ডের সীমানায় ঢুকে পড়ে।

 মেইন গেট দিয়ে ওদের আসার সাহস নেই কারণ ওরা ফিল্ডের ভেতরে ঢোকার পাস পায়নি।

এক সকালে আমি বারান্দায় বসে চা খাচ্ছি। কর্তা অফিসে। এমন সময় আমাকে দেখেই একগাল হেসে  গ্রামের একটা বৌ বয়েস চব্বিশ কি পঁচিশ হবে। মুখখানা ভারি মিষ্টি। কাঁখে ফুটফুটে এক বাচ্চা আর হাতে একটা কাপড়ের বোঁচকা নিয়ে বাংলোর বারান্দায়  উঠে পড়েই আমাকে জিজ্ঞেস করলো,  ভালা আছইন নি বেগম সাব?

আপনার লাইগ্যা আইজ বাক্কা তাজা তাজা শাক আনছি। নিতাই নি?

আমি  মোটে তাকে দেখিনি তাই জিজ্ঞেস করি তুমি কাঁটাতারের সীমানা দিয়ে যে ঢুকলে সিকিওরিটি গার্ড তোমাকে দেখলেই তো তোমার বিপদ হতে পারতো।

সে একগাল হেসে উত্তর দেয়,  নাগো দেখতো নায়। লুকাইয়া আইছি। আইজকা শাকগুলি খুব ভালা বেগম সাব। নেউক্কা। নাগা মরিচও আনছি। আমার গাছর। ঘরের বেডা হাতে পয়সা দেয় না গো মা।তাই ঘর থাকিও লুকাইয়া আই বেচতে। কি এক মিনতি ঝরে পড়লো তার কণ্ঠে। 

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি শাক ওগুলো? 

সে উত্তর দিলো,  দুই রকম আনছি বেগম সাব।  বারোখাউরি আর বউপাগলি।

আমি না চিনি বারোখাউরি না চিনি বউপাগলি।

বললাম, দেখি দেখাও তো। 

বউটি খুব খুশি হয়ে তার বাচ্চাটাকে পাশে বসিয়ে  কাপড়ের পোঁটলাটা খুলে বসলো।

এর পর শাকগুলি বের করে বললো, এই হইলো বারখাউরি আর এই হইলো বউপাগলি।

আমি দেখে বুঝলাম বিভিন্ন রকম শাক একত্র করলে তার নাম বারখাউরি আর বউপাগলি মানে যে পাটশাকে তেতো নেই।

 শাকগুলি সত্যিই খুব টাটকা । সদ্য তুলে এনেছে বোঝাই যাচ্ছে। আমি তাকে ওগুলি দিতে বলে  বললাম তোমার বাচ্চাটা তো খুব সুন্দর। 

বৌটি খুব খুশি হয়ে বললো,  আমার আরও দুইটা বাচ্চা আছে।  দেখলে কইবা ইংরেজর হুরুত্তা।

এমন সময় নিচের টিলা থেকে একজন অফিসারের স্ত্রী আমার বাসায় বেড়াতে এসেই তাকে দেখে ধমকে উঠলেন,  এই তুই যে কাঁটাতারের সীমানা পেরিয়ে ফিল্ডের ভেতরে ঢুকেছিস?তোর পাস আছে?

এরপর আমাকে বললেন,  ভাবি এদের কাছ থেকে কিছু কিনবেন না। ওদের পাস নেই।  কাঁটাতারের সীমানা পেরিয়ে ওরা চুরি করে ফিল্ডে ঢুকে পড়ে। এইসব বেটিদের বাচ্চার  জন্মের ঠিক আছে নাকি?  বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আপনি  বুঝতে পারছেন না?

আমি কিছুটা অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকাতেই দেখি গ্রামের বউটি কোমরে আঁচল বেঁধে তার বাচ্চাকে কোলে টেনে নিয়ে  সিলেটি ভাষায় বলে উঠলো,  ইতা মাত মাতইন না বেগম সাব। আমার বাইচ্চার জন্মের ঠিক নাই ই কথা  আমার থাকি আপনি ভালা জানইন নি?

এরপর নিজের বাচ্চাটাকে বুকে চেপে ধরে দ্রুত বারান্দা থেকে নেমে কাঁটাতারের সীমানা পেরিয়ে চলে গেলো

আর কখনো তাকে সীমানা পেরিয়ে ফিল্ডে ঢুকতে দেখিনি । না তার পাওনা পয়সা নিতে না শাক বেচতে।