সময়ের কাহন-১/ অনুপা দেওয়ানজী

ধারাবাহিক রচনা

সময়ের কাহন-১/ অনুপা দেওয়ানজী

 ১৯৬৮ সন।

দক্ষিণ বাংলার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম। এই  বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ব্যাচের ছাত্রী আমি । 

শহর থেকে বাইশ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি সমতল ভূমির ওপরে সবেমাত্র গড়ে ওঠা ছবির মতো  সুন্দর     এই বিশ্ববিদ্যালয়টির চারপাশে রয়েছে পায়ে চলা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। অজস্র সোনালু আর জারুল ফুলের গাছ ছাড়াও  নাম না জানা আরও নানারকম  গাছের ছায়ায় ঢাকা পথ ধরে যেতে যেতে  হঠাৎ বাদামি রঙের ছোট্ট দুটি  হরিণের চকিত লাজুক দৃষ্টি দেখে আমি মুগ্ধ ও অভিভূত হয়ে গেলাম! 

অনিন্দ্যসুন্দর এই বিশ্ববিদ্যালয়টির বাংলা বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হবো বলে সিলেট থেকে তাড়াহুড়ো করে যখন এসে পৌঁছলাম তখন শুনি ভর্তি  পরীক্ষা  আগেই হয়ে গেছে। 

বাংলা  বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন তখন প্রখ্যাত সাহিত্যিক সৈয়দ আলী আহ্সান। উপাচার্য ছিলেন ড. এ আর মল্লিক।

এস,এস সি আর এইচ,এস,সিতে বাংলায় প্রাপ্ত নম্বর আমার খুব ভালো থাকলেও ডিগ্রীর নম্বর আশানুরুপ  ছিল না। তাতে আবার ভর্তি পরীক্ষাও দিতে পারিনি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির বয়স তখন সবেমাত্র বছরখানেক হয়েছে। তাই ভর্তি পরীক্ষার তেমন কড়াকড়ি ছিলো না। 

লিখিত পরীক্ষা না দিয়েও আমি তাই সাহস করে বসে রইলাম স্যারের সাথে দেখা করবো বলে।

সাথে  আমার কর্তা আর দু’বছরের মেয়ে বিপাশা। ভয়ে বুক দুরুদুরু করছে। পরীক্ষাই যেখানে দিইনি সেখানে আমি ভর্তি হতে পারবো কিনা তাও জানি না।

না জানি এজন্যে স্যার কী প্রশ্ন করবেন আমাকে?

বাইরে বসে অপেক্ষা করছি কখন আমার ডাক পড়বে এই প্রতীক্ষায়। 

অপেক্ষা করতে করতে এক সময়ে আমার ডাক এলো।

দুরু দুরু বুকে স্যারের রুমে ঢুকেই দেখি স্যার গম্ভীরমুখে নিজের চেয়ারে বসে রবীন্দ্রনাথ পড়ছেন। 

আমি স্যারকে সালাম দিলে স্যার আমাকে বসতে বললেন। 

 বসলাম বটে কিন্তু স্যারের এমন গম্ভীর মুখ দেখে আমার আত্মারাম তখন খাঁচাছাড়া! 

মনে মনে ভাবছিলাম লিখিত পরীক্ষা না দিয়ে কোন সাহসে আমি স্যারের রুমে ঢুকলাম!

ভয়ে আমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগলো! 

আমার মুখ দেখেই হয়তো স্যার আমাকে দু’একটি কুশল প্রশ্ন করে  জিজ্ঞেস করলেন। কেন আমি লিখিত পরীক্ষা দিইনি?

আমি সত্যি কথাই বললাম, “স্যার আমি সিলেটের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে  থাকি। ছোট বাচ্চা নিয়ে সময়মতো আসতে পারিনি”।

স্যার আমার কাগজপত্র দেখে জিজ্ঞেস করলেন, বাংলা পড়তে এসেছেন কিন্তু  ডিগ্রিতে বাংলায় এত কম নম্বর পেলেন কেন?

চুপ করে রইলাম। সাংসারিক কাজকর্ম সেরে, ছোট্ট বাচ্চা সামলে কী কষ্ট করে যে একজন গৃহবধুকে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হয় তা স্যারকে কী করে বলি?

 স্যারের এই প্রশ্নে  মনে মনে ভাবলাম সত্যিই তো কোন সাহসে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আশা নিয়ে এসেছি? একে নম্বর কম তাতে আবার ভর্তি পরীক্ষাও দিইনি। 

স্যার আমার কাগজ দেখতে দেখতেই বললেন, “সংস্কৃতে তো খুব ভালো নম্বর পেয়েছেন দেখছি”।

এরপরে সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,” বলুন তো মানসী রবীন্দ্রনাথের কী ধরণের গ্রন্থ”?

আমার গলা তখন শুকিয়ে কাঠ। স্যারের চোখে চোখ রেখেই খুব ভয়ে ভয়ে কোনরকমে ঢোঁক গিলে বললাম, ” রবীন্দ্রনাথের বাক্য স্যার”।

স্যার আমার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠে জিজ্ঞেস করলেন, “বাক্য? নাকি কাব্য”?

আমি ততক্ষণে নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জায় আর নেই!

মনে মনে বললাম এত বড় ভুলের পরে আমার মাস্টার্স পড়ার আর কোন আশাই নেই।

 স্যার কী বুঝলেন  জানি না, আমাকে অবাক করে দিয়ে  বাংলা বিভাগে  ভর্তির অনুমতি দিয়ে দিলেন। 

কিছু না পেরেও সেদিন আমি  বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে গেলাম। হয়তো ডিভিশন ভালো আর সংস্কৃতে খুব ভালো নম্বরের জন্যে সেই যাত্রায় আমি বৈতরণী পার হতে পেরেছিলাম।

 

ভীষণ  খুশিমনে ভর্তি হয়ে যখন বাবার বাড়ি এলাম,বাবা তো শুনে অবাক। পরীক্ষা,টরীক্ষা ছাড়া আমি  কিভাবে ভর্তি হয়ে গেলাম?

সাথে সাথে নিজের আলমারি খুলে বইয়ের গাদা থেকে  টেনে বের করে আনলেন নিজের ছাত্রজীবনে পড়া  চর্যাপদ আর কৃষ্ণকীর্তন বই দুটি। 

তারপর বললেন,”নে বই দুটি রাখ।তোর কাজে লাগবে”।

 

বাবার দেয়া বই দুটি হাতে নিয়ে আমি হঠাৎ কোথায় যেন হারিয়ে গেলাম।

মনে মনে ভাবছিলাম এই বই আমার অধ্যাপক বাবা একদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ছাত্রজীবনে পড়েছিলেন।আজ নিজের হাতে তুলে দিলেন তাঁর মেয়েকে পড়বার জন্য।

অপরিসীম এক আনন্দে আমার চোখ দুটি ভিজে গেলো।

 মূলত এস,এস,সি পাশ করার পরে আমার লেখাপড়া  খুব একটা মসৃণ গতিতে এগোয়নি। কলেজে ওঠার এক বছরের মধ্যেই আমার বাবা মা আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলেন তাও কিনা বড় বোনের আগে।

সেই  অভিমান মা’র ওপর  থেকে আমার কখনোই  যায়নি।যাবেও না।

বাবার ইচ্ছে না থাকলেও সংসারে  মা’র   কথার ওপরে কারুরই প্রতিবাদ চলতো না।

বাবার সীমিত আয় আর আমরা পাঁচ বোন ছিলাম বলে মা হয়তো আমার বিয়ের প্রস্তাব আসার সাথে সাথে আর দেরি না করে বড় বোনের আগেই আমাকে ষোল বছরেই বিয়ে দিয়ে দিলেন।

 শুধু তাই নয় বিয়ের এক বছরের মধ্যেই মা হলাম।  মেয়ে বিপাশাকে নিয়ে  কখনো বাবার বাড়ি, কখনো  শ্বশুরবাড়ি, আবার কখনো বা স্বামীর কর্মস্থলে আসা যাওয়ার ভেতর দিয়ে অনেক কষ্ট সয়ে আমাকে লেখাপড়া করতে হয়েছে। 

গ্রাজুয়েশন করার পরে তাই আর পড়তে ইচ্ছে হয়নি। কিন্তু আমার কর্তার প্রবল ইচ্ছা আমাকে মাস্টার্স করতেই হবে। কর্তার ইচ্ছার  কাছে আমাকে তাই হার মানতে হল।

ভর্তি হলাম বটে কিন্তু  থাকবো কোথায়? 

 কর্তা  তখন থাকে পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের ছোট্ট একটা গ্যাসফিল্ড, শ্রীহট্ট জেলার ছাতকের টেংরা  গ্যাসফিল্ডে।

 বাবার বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি দুটোই ভার্সিটি থেকে বহুদূরে। সেখান থেকে ভার্সিটি  আসা যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।

 

বিয়ের পরে বাবার বাড়িতে থেকেই লেখাপড়া করেছি।বাবা ছিলেন আমাদের কলেজের অধ্যাপক (পরে অধ্যক্ষ)। তাই লেখাপড়া করতে তেমন অসুবিধে হয়নি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তখন  সবেমাত্র তার যাত্রা শুরু করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে বইয়ের সংখ্যাই তখন মাত্র তিনশ। আমাদের বাড়িতেই এর চেয়ে দশগুন বেশি বই।

মেয়েদের জন্যে  হোস্টেলও তখনো নির্মিত হয়নি। আর হলেই বা কী? আমার মেয়ে বিপাশা তখন এতই ছোট যে,ওইটুকু মেয়েকে ছেড়ে হোস্টেলে থাকাও আমার পক্ষে সম্ভব হত না।

আমার বড় ভাশুর তখন শহরের আগ্রাবাদে ছোট্ট একটা ভাড়া বাড়িতে থাকতেন।শেষ পর্যন্ত ঠিক হল সেই বাড়িতেই  আমারও থাকার ব্যবস্থা করা হবে। সাথে থাকবেন আমার শাশুড়ি। 

অগত্যা একদিন সিলেট থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বড় ভাশুরের বাড়িতেই উঠে এলাম। দু’একবার সেই বাড়িতে বেড়াতে  এলেও কখনোই  থাকিনি। বাড়িতে ঢুকেই আমার মন খারাপ হয়ে গেলো।

বাড়িটাকে ঠিক বসতবাড়ি বলা যায় না। অনেকটা মেসবাড়ির মতো টানা, লম্বা একটা ঘর। ঘরটাকে আবার বেড়ার পার্টিশন দিয়ে  তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

পাশেই ছোট্ট একটা রান্নাঘর ।রান্নাঘরটা মূল ঘর থেকে আলাদা, রান্নাঘরের পাশেই কলতলা।কলতলায় রয়েছে চাপকল। পাশেই ছোট্ট একটা বাথরুম আর সবচেয় জঘন্য ব্যাপার হলো বাথরুমের পাশেই ব্রিটিশ আমলের মতো খাটা পায়খানা।মেথর রোজ এসে ময়লা নিয়ে যায়।

এই বাসায় থেকে লেখাপড়া করতে হবে শুনে আমার কান্না পেয়ে গেলো। 

এমন পরিবেশে থাকার কথা আমি কখনোই কল্পনা করিনি। বিয়ের পরে যত কষ্টই হোক  যেভাবে লেখাপড়া করে এসেছি সে তো এর চেয়ে ঢের ভালো ছিলো।

কোথায় সিলেটে পাহাড়ের কোলে  ড্রাইভার, বাবুর্চি,দারোয়ান, মালিসহ সুসজ্জিত কর্তার বাংলো! কোথায় আমার বাবার কোয়ার্টার, কোথায় খোলামেলা শ্বশুরবাড়ি আর কোথায় মেসবাড়ির মতো এঁদো এক মেসবাড়ি!

শুধু তাই নয় চট্টগ্রাম ভার্সিটির অবস্থান  ফতেয়াবাদে । আর আমার ভাশুরের বাসা  আগ্রাবাদে।

 অর্থাৎ শহরের এপ্রান্ত আর ওপ্রান্ত।

অনুপা দেওয়ানজী 
অনুপা দেওয়ানজী
%d bloggers like this: