সময়ের কাহন -১৩/ অনুপা দেওয়ানজী
ধারাবাহিক স্মৃতিকথা
সময়ের কাহন -১৩/ অনুপা দেওয়ানজী
এদিকে অফিসারদের জন্যে নতুন বাংলোর নির্মাণ কাজ তখন শেষ হয়ে গেছে । মেয়ের বাবা অফিস থেকে এসে একদিন বললো, অনেকদিন তোফাজ্জল সাহেবের বাংলোটা দখল করে আছি, এবারে নিজেদের বাংলোতে যাবার জন্যে সব কিছু গুছিয়ে নাও।
আমরা চলে যাবো শুনে বুড়ো মালি আর আল্লারাখার মন খুব খারাপ হয়ে গেলো। বাংলোটা যদিও খুব বেশি দূরে নয়, তারপরেও মেহমুদাদের আর তোফাজ্জ্বল সাহেবের মনও খারাপ হয়ে গেলো।
তিনি নিজে আমার কর্তাকে বললেন,” দেওয়ানজী কী দরকার নতুন বাংলোতে যাবার? এখানে থাকতে কি তোমাদের কষ্ট হচ্ছে? তোমরা আছো বলে বাড়িটাতে একটা প্রাণের স্পর্শ ছিলো।
আমার কর্তা তাঁর কথায় চুপ করে থাকলেও আমাকে পরে বললো,” না তা হয় না।আমাদের জন্যে বেচারা পুরো বাংলোটা ছেড়ে দিয়ে নিজে শুধুমাত্র একটা ঘরেই সময় কাটান”।
নির্দিষ্ট দিনে আমরা নুতন বাংলোতে চলে এলাম। আল্লারাখা ছাগলের দুধ খেতে ভালোবাসে বলে ছাগলটা আমি তাকেই উপহার দিয়ে এলাম।
বুড়ো মালি এটা জানতে পেরে একটু মন খারাপ করেছে মনে হলো!
আসার আগের দিন সে আমার মেয়েকে তাই আদর করে ফুটফুটে একটা খরগোশের ছানা উপহার দিয়ে গেলো।
তোফাজ্জল সাহেবের বাংলো থেকে দূরে না হলেও নূতন বাংলোতে এসে আমার মনটাতেও যেন বিষণ্নতা এসে ভর করলো।
ছোটোবেলা থেকেই প্রকৃতির সাথে নিবিড় এক সম্পর্কের মধ্যে আমি বড় হয়েছি।
নিজেদের বাড়ি, মামাবাড়ি, আমাদের কোয়ার্টার, স্কুল,কলেজ সব কিছু এই শীতের সময়ে সেজে উঠতো হলিহক, কসমস, গাঁদা, পিটুনিয়া,সূর্যমুখী, ডালিয়া,ফ্লক্স, জিনিয়া ছাড়া আরও কত যে নানা রঙের ফুলে। সব্জীর বাগান ভরে উঠতো নানা রকমের কপি,টোম্যাটো,শাক,সিম,বেগুন,মূলা,ধনেপাতা আরো কত কি? বড়দের দেখাদেখি আমরাও ফুলের চারা বা কপির চারা লাগিয়ে রোদের আঁচ থেকে চারাগুলিকে বাঁচানোর জন্যে কলাগাছের বাকলের ছোট ছোট টুকরো দিয়ে ঢেকে দিতাম।
যে জায়গায় এসেছি সেখানে একে তো নেই সবুজের ছিঁটেফোঁটা তাতে আবার তোফাজ্জল সাহেবের বাগানে এক আধটু যাও বা সবুজের ছোঁয়া পেতাম তাও নেই।
বাগানই এখনও গড়ে ওঠেনি। যদিও লনের জন্যে কাটা ছকে সবেমাত্র দুর্বাঘাসের কচি কচি আগাগুলি মাটি ফুঁড়ে উঁকি দিতে শুরু করেছে। গোলাপের চারাও লাগানো হয়েছে একধারে । সব্জী বা অন্যান্য গাছ কিছুই লাগানো হয়নি। বাগান ঘিরে সবুজ পাতার ঝোপালো বেড়াও নেই বলে বারান্দায় দাঁড়ালে ধু ধু এক খোলা প্রান্তর ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। সেদিকে তাকালে বুকটা কেমন জানি খাঁ খাঁ করে।
যেদিন এসেছি বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে তখন। পশ্চিম আকাশের দিকে চোখ পড়তেই দেখি বালু আর পাথুরে পাহাড়ের দিগন্ত জুড়ে কেউ যেন ডিমের কুসুম ভেঙে তুলির টানে অপার্থিব এক নৈসর্গিক আভা রচনা করে চলেছে। সেই আভারই প্রতিফলন ঘটেছে পাহাড়ের চূড়াতেও। কিছুক্ষণের জন্যে সব ভুলে আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, কে সেই শিল্পী? যিনি সবুজ ছাড়াও এমন পটভূমির সৃষ্টি করতে পারেন! মাথা আপনা থেকেই নত হয়ে আসলো।
পরদিন সকালে নূতন বাংলোর মালিটা এসে সালাম দিল। দশাসই সেই পাঠানের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো, আরব্য উপন্যাসের পাতা থেকে বুঝি কোন দৈত্য উঠে এলো। আমার মেয়ে তো তাকে দেখেই ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। যাই হোক নূতন জায়গায় নূতন করে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বসলাম।
তবে নূতন বাংলোতে আসার পরে দুপুরবেলায় অনেক প্রতিবেশি আমার বাসায় আড্ডা দিতে চলে আসেন। কখনো তারা আবদার ধরেন পূর্ব বাংলার মেয়েরা কিভাবে চুল বাঁধে তা শিখিয়ে দেবার জন্যে,কখনো বলেন মাছ বা মিষ্টি রান্না শিখিয়ে দেবার জন্য।
উর্দু তখন আমার বেশ ভালোই রপ্ত হয়ে গেছে। অনেকেই বলেন,” মজুমদার ভাবী বা রিনা ভাবী অনেকদিন ধরে এখানে আছে কিন্তু তাদের গ্রামার এখনো তেমন ঠিক হয়নি। আপনার উচ্চারণ আর গ্রামার দুটোই ভালো”।
এইরকম এক আড্ডার সময়ে হঠাৎ একদিন আমার নামে একটা পার্শেল এলো। আমি পার্শেলটা হাতে নিয়েই বুঝলাম, মা আমার জন্যে শাড়ি পাঠিয়েছেন। সুতির শাড়ি পাওয়া যায় না বলে কিছুদিন আগে মা’র কাছে লিখেছিলাম কয়েকটা শাড়ি পাঠাতে। এ কথা ওদের সামনে বলতেই ওরা শাড়িগুলি দেখার আবদার ধরলো।
মিহি সুতির মোলায়েম সেইব শাড়ি দেখে তো ওরা অবাক। শাড়িগুলি হাতে নিয়ে একে অন্যকে বলতে লাগলো, “কটন কি শাড়ি ভি এতনা পাতলা অর আচ্ছা হোতে?”
আসলে পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানের মতো সুতি শাড়ি পাওয়াই যেতো না। ওদের ধারণা সুতির শাড়ি অনেক মোটা হয়।
আরেকদিন এইরকম এক আড্ডার সময়ে দেখি কর্তার অফিসের এক লোক বিরাট একটা চিতল মাছ এনে হাজির।
আমাকে সে বললো,” সাহেব এটা পাঠিয়েছেন কোথায় রাখবো মেমসাব”?
আমি কোর্টইয়ার্ডের কলের নিচে রাখতে বললে সে মাছটা কলের নিচে রেখে চলে গেলো।
বাসায় যারা এতক্ষণ আড্ডা দিচ্ছিলো তারা তো সে মাছ দেখে ভয়ে অস্থির হয়ে একে অন্যকে বলতে লাগলো ,ও কি সাপ! নাকি সত্যি সত্যি মাছ?
তাদের কথা শুনে মনে মনে আমি গাল পাড়ি তাদের। খোট্টার দেশ। না চেনে মাছ আর না চেনে সাপ।
আমি তাদের কথা শুনে বললাম, সাপ হতে যাবে কেন? সাপ আমরা খাই না। এটা মাছ। এর নাম চিতল। খুব টেস্টি মাছ তবে কাঁটা আছে প্রচুর।
আমি মাছ বলার পরেও ওরা একে অন্যের দিকে কেমন একটা ভয়ে ভয়ে তাকাতে লাগলো।
এরপর আড্ডাটা আর তেমন জমলো না।
মনে হলো ওরা দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে যেন নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলো!
ওরা চলে যাবার পর একটা ছুরি নিয়ে আমি মাছটার আঁশ ছাড়াতে বসলাম। বাংলোটাতে আসার পরে আমার ঘরে যে ছোট ছেলেটাকে কাজের জন্যে রেখেছি তার নাম সফদর। ছেলেটা বেলুচ। অবাক চোখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে সে মাছের আঁশ ছাড়ানো দেখতে লাগলো। মাছটা কেটেকুটে সবে ফ্রিজে তুলে রেখেছি এমন সময় আমার কর্তা অফিস থেকে এসে বললো,” মাছটা কোথায়? কাশ্মির থেকে একজনকে দিয়ে ওটা আনিয়েছি। এত বড় মাছ তুমি একা একা কাটতে পারবে না। চিন্তা কোর না। আমি তোমাকে সাহায্য করবো”।
আমি বললাম ওটা আমি কেটেকুটে অলরেডি ফ্রিজে তুলে রেখেছি।
সে তো অবাক। এত বড় মাছ আমি একাই ছুরি দিয়ে কিভাবে কাটলাম?
ছোটোবেলা থেকেই আমি মাকে দেখেছি মোটামুটি সব কাজ কারুর সাহায্য না নিয়ে একা একাই করতে। যা আমার জীবনের উত্থান পতনে আমাকে ভীষণভাবে সাহস জুগিয়েছে।
পরদিন আমরা চার বাঙালি পরিবার সেই চিতল মাছের গাদা দিয়ে মুইঠ্যা আর পেটি দিয়ে ঝোল রান্না করে খেয়েছিলাম।
কিছুদিন পরে এক সকালে ড্রয়িংরুমের দরজা খুলে বারান্দায় পা দিয়েই বিস্ময়ে আমার দু চোখ কপালে উঠে গেলো। দেখি আমাদের লনে দশ বারোটা গাধা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।মনে মনে ভাবতে লাগলাম, গাধাগুলি কাদের? এলোই বা কোত্থেকে? চুপচাপ ওরা দাঁড়িয়ে আছে তো দাঁড়িয়েই আছে। আমি ভীষণ ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে কর্তাকে ডেকে তুললাম । সে উঠে এসে গাধাগুলিকে দেখে বললো, “ওরা পোষা গাধা না পাহাড়ী গাধা। পাহাড় থেকে নেমে এসেছে। এরপর মজুমদার ভাইকে ফোন করতেই তিনি বললেন, ওরা পাহাড়ি গাধা। তবে ভয়ের কিছু নেই ওরা কারও ক্ষতি করে না। আপনাদের বাগান খালি পেয়ে ওখানে এসে দাঁড়িয়েছে। দুদিন পরে আপনাআপনি চলে যাবে। কিছুক্ষণ পরে মালি এসেও তাই বললো। তিনদিন না খেয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে গাধাগুলি সত্যিই একসময় পাহাড়েই আবার ফিরে গেলো।
গাধাদের যদি কথা বলার ক্ষমতা থাকতো তাহলে আমি জিজ্ঞেস করতাম, এটা কি তাদের কোন মৌন প্রতিবাদ? এই প্রতিবাদ তারা কেন আর কি কারণে করছে? নিশ্চয় এর কোন অর্থ আছে যা আমরা জানতে পারিনি।
বাংলোতে আসার কয়েকমাস পরেই শুনি মজুমদার ভাইকে সিলেটে ট্রান্সফার করা হয়েছে। দীর্ঘ বছর ধরে তাঁরা স্যুইতে আছেন। কোম্পানি ফ্রি ফার্নিশড কোয়ার্টার দিলেও তার নিজের শখের বাসনকোসন এত জমেছে যে তা প্যাক করতে করতে মজুমদার ভাবী বললেন,” এই দেশীরাই ভালো। তাদের এক তাওয়া আর এক হাণ্ডিতেই কাজ চলে যায়। আমাদের মতো এত বাসনকোসনের ধার ধারে না।
ওরা চলে গেলে একজন বাঙালি কমে গেলো বলে আমাদের মন খারাপ হয়ে গেলো। কিছুদিন পর শুনি চৌধুরী সাহেব আর কাসেম সাহেবকেও ট্রান্সফার করা হয়েছে। সংখ্যায় আমরা আরও কমে গেলাম।
নূতন বাংলোতে আসবো বলে শংকর ভাটিয়া আর তাঁর স্ত্রীকে নিমন্ত্রণ করার সময় পাচ্ছিলাম না। বাংলোতে এসেই তাঁদের নিমন্ত্রণ করলাম। যেদিন তারা এলেন সেদিন ভাবী ঘরে ঢুকেই আমার হাতে একটা উপহার তুলে দিলেন যাতে ছিল রেশমি সুতায় অপূর্ব সুক্ষ সুতার কাজ করা সিল্কের দুটি বেলুচ কুর্তা। একটা মেয়ের জন্যে আর আরেকটা আমার জন্যে। সেই সাথে দিলেন কামিজের দুটো ইয়োক আর কর্তার জন্যে হাতে তৈরি বালুচ টুপি। এছাড়া আরও নিয়ে এলেন ঘরে তৈরি মেওয়ার লাড্ডু ।
বেলুচ মেয়েদের হাতের সেই কাজ দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আসলে প্রতিটি জায়গার ঐতিহ্যবাহী হাতের কাজগুলি যার যার নিজস্বতায় অনন্য এক ভূমিকা পালন করে।
খেতে বসে আমার হাতের রান্না করা মাছ খেয়ে তাদের দুজনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা আর ধরে না। মাছের এমন প্রিপারেশন নাকি তারা আর দেখেন নি। খান নি তো বটেই। আমি মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বললাম, হতেই হবে। এ যে পূর্ব বাংলার মেয়ের হাতের রান্না!
শংকর ভাটিয়ার মায়ের কাছ থেকে হিংলাজের কথা শোনার পর থেকেই আমার কল্পনায় তখন সারাক্ষণ ঘুরে ফিরে শুধু হিংলাজ ঘুরছে।
তিনি বলেছিলেন,” তুমলোক হিংলাজ মাতাকি ডেরা ছোড়কে আয়া লেকিন হিংলাজ দর্শন নেহি কিয়া”?
পরে বুঝেছি করাচি থেকে মাত্র আড়াইশো কিলোমিটার দূরে হিংলাজ আর আমরা পেরিয়ে এসেছি ছয়শ কিলোমিটার।
খেতে বসে তাই আমি আবার হিংলাজের প্রসঙ্গ তুললে শংকর ভাটিয়া বললেন, “ভাবি মাকরান পাহাড়ের এক গুহার ভেতরে হিংলাজ মাতার মন্দির। অনেকটা হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়।
আপনি হয়তো জানেন সতীর পিতা দক্ষ যখন যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন অথচ সেই যজ্ঞে সব দেবতাকে আমন্ত্রণ জানালেও জামাতা মহাদেবকেই তিনি আমন্ত্রণ করেন নি। স্বামীর অপমান সইতে না পেরে সতী তখন দেহত্যাগ করেছিলেন। মহাদেব সেই সময়ে ক্ষুব্ধ হয়ে সতীকে মাথায় তুলে যে প্রলয়নাচ নেচেছিলেন সেই প্রলয়নাচ যখন কেউ থামাতে পারছিলেন না নারায়ণ তখন বাধ্য হয়ে সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ বিচ্ছিন্ন করেছিলেন আর তাতে সতীর দেহ একান্নটা জায়গায় ছিটকে পড়ে”।
আমি বললাম, হ্যাঁ জানি।
তিনি বললেন, “সতীর দেহ যেসব জায়গায় পড়েছিলো যেসব জায়গায় এর ফলে যে সব তীর্থস্থানের সৃষ্টি হয় তার মধ্যে হিংলাজ হলো শ্রেষ্ঠ তীর্থ।
সতীর হিঙুল বা মাথা এখানে পড়েছিলো আর তা থেকেই এই মন্দির সৃষ্টি হয়েছে।
ইসলাম ধর্মের লোকের কাছেও হিংলাজ এক পবিত্র তীর্থ।
তারা হিংলাজকে বলেন নানী কি হজ। এটা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তারাই পালন করে থাকেন”।
আমি রুই মাছের কালিয়া তার পাতে তুলে দিতে দিতে সাগ্রহে শুনছিলাম তার কথা।
জিজ্ঞেস করলাম, দেবীমূর্তিটি দেখতে কেমন?
তিনি বললেন,” মন্দিরে যে মূল পূজা করা হয় আসলে তা ছোট একটা পাথর। পাথরটির গায়ে হিঙুল মাখিয়ে করা হয়। এই বলে তিনি একটি মন্ত্র উচ্চারণ করলেন।
এই মন্ত্র নাকি দধীচি মুনি হিঙলাজের উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করেছিলেন।
মন্ত্রটা আমি তার কাছ থেকে শিখে নিলাম।
“হিঙুলে, পরমহিঙুলে, অমৃতরুপিনী তনুমন শিবশ্রী হিঙুলায় স্বাহা।”
এর অর্থ হলো, এই সেই হিঙুলা দেবী, যাঁর অমৃত ভক্তের ঝুলিতে যায় আর সেই ক্ষমতার বলে তিনি শিবের সাথে একাত্ম হয়ে যান।
আমি আমার শ্রদ্ধা আর নৈবেদ্য সেই দেবীকে নিবেদন করছি।
এরপরে বললেন, হিঙুলের আর এক অর্থ যে সিঁদুর এটা জানেন তো?
আমি বললাম, না এটা তো জানতাম না।
তিনি বললেন, আসলে মানুষ তো সব কিছুর পেছনেই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খোঁজে।
তাই এর ব্যাখ্যা যদি খোঁজেন তাহলে বলতে হয়, হিঙুল বা সিঁদুর ছিলো সেই সময়ে প্রাচীন ভারতের এক মহৌষধ । যে ঔষধ বিষাক্ত নিরাময়ের কাজে ব্যবহার করা হত। বিশেষত এসব জায়গায় একসময়ে বিষাক্ত সাপের খুব উৎপাত ছিলো । তখন সেই বিষ নিরাময়ের জন্যে সিঁদুর ব্যবহার করা হত আর তা থেকেই পাথরে সিঁদুর মাখিয়ে এই পূজার রীতি বা প্রচলন শুরু হয়েছিলো।
আমার এত আগ্রহ দেখে তিনি বললেন, ” আমি বলার চেয়েও আপনি মাকরানের গুহায় গিয়ে নিজের চোখে যখন দেখবেন তখন আরো ভালো লাগবে।
তবে যাওয়া খুব একটা সহজ না ভাবি। উটের পিঠে চড়ে যেতে হবে। যদিও নবরাত্রিতে সেখানে হাজার হাজার ভক্তের আগমন হয়। কুণ্ডে তখন প্রচুর নারকেলও চড়ানো হয়। সে এক দেখবার মতো ব্যাপার। তবে তখন যাওয়া ভারি হাঙ্গামা। থাকার জায়গা পাওয়া যায় না।
তিনি এসব বলার সাথে সাথে আমার চোখের সামনে অবধূতের বইয়ে পড়া সেই কুণ্ডে থিরুমলের ডুবে যাওয়া ভাসতে লাগলো। আমি তাকে সেই গল্পের কথা বললে তিনি বললেন,” কুণ্ডটা আসলে একটা মাড ভলকেনো ছাড়া আর কিছুই না। আর বেলুচিস্তানের মাটির নিচে তো গ্যাসের খনি। গ্যাসের জন্যেই কুণ্ডে সারাক্ষণ গরম কাদা ফুটছে”।
তার এই কথায় আমার তখন হরিপুরের জ্বলে যাওয়া ফিল্ডের জলের কুণ্ডটার কথা মনে পড়লো। সেই কুণ্ডের জলও আমি ফুটতে দেখেছি। সেখানেও আগুন নেয়া নিষেধ। অনেকের মুখে শুনেছি গভীর রাতে নাকি সেই কুণ্ডে সোনার পদ্মফুল ভাসে।পরীরা এসে খেলা করে। সবাই তা দেখে না।
মানুষের মুখে মুখে কত কল্পকাহিনী যে এভাবে ডালপালা মেলতে থাকে তার কোনও শেষ নেই।
খেতে খেতে কর্তা আর তিনি দেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি নিয়ে আলাপ করছিলেন। রাজনীতি আমাকে তেমন আকর্ষণ করে না। বোঝার চেষ্টা ও করি না। আমার আছে শুধু দেশের জন্যে এক বুক ভালোবাসা।
তাও আবার আমি ছিলাম পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যন্ত সংরক্ষিত একটি জায়গায়। পশ্চিমা জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক চিন্তার রূপটি যে কী তা ওই সংরক্ষিত এলাকায় তা আমি পাইনি।
এজন্যে আমার জানারও তাই অনেক কিছু বাকি ছিলো আর যখন জেনেছি তখন তা এমন নগ্নভাবেই জেনেছি যে বিস্ময়ে হতবাক আর বাকরুদ্ধ হয়েছি! হতবাক হয়েছে দেশ আর দেশের পরিধি ছাড়িয়ে গোটা বিশ্ব।
মানুষ যে কত ভয়ংকর হতে পারে তা শুধু শোনা নয়, দেখা নয় যাকে বলে একবারে মর্মে মর্মে বুঝেছি।
গল্প করতে করতে এক সময় আমার কর্তা বললো, “পূর্ব পাকিস্তানে তো শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা কর্মসূচি বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দেশের শাসকগোষ্ঠীর কাছে এখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেলো যে সামরিক শাসন আবার চালু করা একরকম অসম্ভব ব্যাপার।বলতে গেলে জাস্ট ইম্পসিবল”।
শংকর ভাটিয়া খুব উৎসাহের সাথে জিজ্ঞেস করলেন,”আপনি কি মনে করেন সাধারণ নির্বাচনের জন্যে গণদাবীর যে জোয়ার উঠেছে শাসকগোষ্ঠী তা মেনে নেবে? কর্তা বললেন,” অফ কোর্স মানতে হবে।পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে না মেনে তাদের আর উপায় নেই”।
আমার বুকে যেন আনন্দের একটা ঢেউ খেলে গেলো। কল্পনায় কত কিছু যে ভেবে চলি। পূর্ব পাকিস্তানের ওপরে দীর্ঘকালের অর্থনৈতিক শোষণ আর রাজনৈতিক নিপীড়নের দিন সত্যিই তবে শেষ হতে চলেছে।
রাত ক্রমশ বাড়ছে। গল্প তবুও যেন ফুরাতে চাইছিল না।
যাবার আগে দুজনেই বলে গেলেন শীত শেষ হলেই আমরা সবাই মিলে মহেঞ্জোদারো আর হিংলাজ ঘুরতে যাবো।
দেখতে দেখতে হাড়কাঁপানো শীত একসময় বিদায় নিলো। আবহাওয়াও বেশ ভালো ।
যদিও হিংলাজযাত্রীরা আমাদের বাংলা মাসের হিসেবে আষাঢ় মাসেই যাত্রা শুরু করে কিন্তু তখন খুব ভিড় থাকে তাই শংকর ভাটিয়া খবর পাঠালেন এক সপ্তাহের মধ্যেই আমরা প্রথমে হিংলাজ দর্শনে যাবো আর এর পরেই মহেঞ্জোদারো।
একথা শুনে আমি তো খুব খুশি। সেই কবে থেকে দিন গুনছি হিংলাজ আর মহেঞ্জোদারো যাবো বলে।
আমরাও এক সপ্তাহের জন্যে সবকিছু গুছিয়ে সেইভাবে যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে নিলাম।
কিন্তু যাওয়ার দুদিন আগে আচমকা তার বাড়ি থেকে এমনই এক মর্মান্তিক খবর এলো যা আমরা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি! শংকর ভাই রাতে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমাতে গিয়ে সেই ঘুমের মধ্যেই নাকি দিব্যি সুস্থ মানুষটা হার্টফেল করে মারা গেছেন! খবরটা শোনামাত্র আমাদের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো!
এমন হাসিখুশি আর প্রাণবন্ত মানুষটা মারা গেছে! এই বয়সে? খবরটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কর্তা আর আমি সাথে সাথে ছুটে গেলাম তার বাড়িতে।
চোখের সামনে তার মৃতদেহ দেখেও কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না তার মৃত্যু হয়েছে। মাত্র কয়েকদিন আগেই যিনি কিনা আমার সিঁথিতে সিঁদুর দেখে আমাদের সাথে পরিচিত হবার জন্যে খুঁজে খুঁজে আমাদের বাড়িতে এলেন, আমার মার সিঁথিতে সিঁদুর পরা ছবিটা নিয়ে গেলেন আর নিজের স্ত্রীর সিঁথির সিঁদুরটাই মুছে দিয়ে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন?
বউটার যে খুব শখ ছিলো বাঙালি বউদের মতো ঢাকাই জামদানি পরে ঢাকার সোনার বালা হাতে দিয়ে সিঁদুরের টিপ পরে আমার সাথে একটা ছবি তোলার। তা বুঝি আর হলো না। আমার নিজেরও যে খুব শখ ছিলো গায়ে কাদা মেখে হিঙ্গুল নদীতে স্নান করে, নদীর ধার ঘেঁষে উটের পিঠে চড়ে, সেখানকার পার্বত্য এলাকা পেরিয়ে, মাকরান পর্বতের গুহায় যাওয়ার? বড় ইচ্ছে ছিল হিংলাজ মন্দিরের বর্ষপ্রাচীন সেই সিঁদুর মাখা পবিত্র পাথরের গা থেকে একটু সিঁদুর নিয়ে মাথায় ছোঁয়াবার? তাও বুঝি আর দেখা হলো না!
গভীর এক বিষাদে মনটা ভারি হয়ে গেলো সেই সাথে ইচ্ছেটাও যেন মরে গেলো!
পরে শুনেছি আর দেখেছিও ওই মরুভূমিতে অসুখ বিসুখে ভোগার চেয়ে এভাবেই মানুষের মৃত্যু বেশি হয়।
হিংলাজের কথা মনে হলেই চোখের সামনে দূর প্রবাসে আমার সেই পাতানো ভাই শংকর ভাটিয়া যেন হাস্যোজ্জ্বল মুখে আমার সামনে দাঁড়িয়ে উদার স্বরে আমাকে বলেন,” ভাবি ম্যায় আপ কো হিংলাজ দর্শন মে লে যাউংগা।”
Facebook Comments Sync