সনজীদা খাতুন: নিবেদিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী/ আফরোজা পারভীন

সনজীদা খাতুন: নিবেদিত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী/ আফরোজা পারভীন

সনজীদা খাতুন (জন্ম: ৪ এপ্রিল, ১৯৩৩) বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। তিনি একাধারে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, লেখক, গবেষক, সংগঠক, সঙ্গীতজ্ঞ এবং শিক্ষক। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং বর্তমানে সভাপতি। এছাড়া তিনি জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদেরও প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। প্রচলিত ধারার বাইরে ভিন্নধর্মী একটি শিশুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নালন্দা-র সভাপতি।

 তাঁর পিতা ড. কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন বিখ্যাত পন্ডিত ব্যক্তি ও জাতীয় অধ্যাপক। বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব ড. কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন অত্যন্ত উদার স্বভাবের। ছিলেন রবীন্দ্রভক্ত।  ফলে বাবার কাছ থেকে উৎসাহের অভাব ছিল না কন্যা সনজীদার।  রবীন্দ্র সংগীত শিখেছেন, গেয়েছেন। পরবর্তীকালে শিখিয়েছেন, গড়ে তুলেছেন ‘ছায়ানট’ প্রতিষ্ঠান। অল্প বয়স থেকেই অনুষ্ঠানে গান করেছেন সনজীদা। পঞ্চাশ দশকের একটি অনুষ্ঠানের কথা তিনি  স্মরণ করেছেন এক সাক্ষাৎকারে এভাবে, ‘‘পঞ্চাশ দশকে একবার – আমার খুব ভাল করে মনে আছে – কার্জন হলে একটা অনুষ্ঠান হচ্ছিলো। আমাকে গান গাইতে বলা হয়েছিল। আমি খুব বিস্মিত হয়ে গেলাম গান গাইতে। কী গান গাইবো? এমন সময় দেখা গেল সেখানে বঙ্গবন্ধু। তখন তো তাঁকে কেউ বঙ্গবন্ধু বলে না – শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি লোক দিয়ে আমাকে বলে পাঠালেন আমি যেন ‘সোনার বাংলা’ গানটা গাই – ‘আমার সোনার বাংলা’। আমি খুব ঘাবড়ে গেলাম। এত লম্বা একটা গান। তখন তো আর এটা জাতীয় সংগীত নয়। পুরো গানটা আমি কেমন করে শোনাবো? আমি তখন চেষ্টা করে গীতবিতান সংগ্রহ করে সে গান গেয়েছিলাম কোনমতে। জানি না কতটা শুদ্ধ গেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি এইভাবে গান শুনতে চাওয়ার একটা কারণ ছিল। তিনি যে অনুষ্ঠান করছিলেন, সেখানে পাকিস্তানিরাও ছিল। তিনি দেখাতে চেষ্টা করছিলেন তাদেরকে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ কথাটা আমরা কত সুন্দর করে উচ্চারণ করি। এই সমস্ত  গানটার ভিতরে যে অনুভূতি সেটা তিনি তাদের কাছে পৌঁছাবার চেষ্টা করেছিলেন। এবং আমার তো মনে হয় তখনই তাঁর মনে বোধহয় এটাকে জাতীয় সংগীত করবার কথা মনে এসেছিল। বায়ান্ন সালে যখন আমরা রবীন্দ্র সংগীত চর্চা করি তখন কিন্তু ঐ বায়ান্নর পরে পরে শহীদ মিনারে প্রভাতফেরিতে আমরা রবীন্দ্র সংগীত গাইতাম। এবং এইভাবে রবীন্দ্র সংগীত কিন্তু তখন বেশ চলেছে। আরো পরে কেমন যেন একটা অলিখিত বাধা এলো। পাকিস্তান আমলের পরে রবীন্দ্র সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ যখন জাতীয় সংগীত হল, তার কিছুকাল পরে দেখা গেল – নানা ধরনের ওঠাপড়া চলছিল তো – সেই সময় গানটা না করে শুধু বাজনা বাজাবার একটা রেয়াজ শুরু হয়। আমার মনে হয় এর মধ্যে সেই পাকিস্তানি মনোভাবটা কাজ করেছে।”

 সনজীদা খাতুন কাজী আনোয়ার হোসেনের বোন এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশেষজ্ঞ ওয়াহিদুল হকের স্ত্রী। তিনি ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সম্মানসহ স্নাতক এবং ১৯৫৫ সালে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

সনজীদা খাতুনের কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষক হিসেবে। শান্তিনিকেতন থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক হন। দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে অবসরগ্রহণ করেন। তিনি ছায়ানটেরও অধ্যক্ষ।

কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বহু পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য – একুশে পদক, বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার, রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত), দেশিকোত্তম পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)। এছাড়া কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট ১৯৮৮ সালে তাঁকে ‘রবীন্দ্র তত্ত্বাচার্য’ উপাধি, ২০১৯ সালে ‘নজরুল মানস’ প্রবন্ধ গ্রন্থের জন্য ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করে।

তিনি মোট ১৬টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাবসম্পদ, ধ্বনি থেকে কবিতা, অতীত দিনের স্মৃতি,রবীন্দ্রনাথ: বিবিধ সন্ধান, ধ্বনির কথা আবৃত্তির কথা, স্বাধীনতার অভিযাত্রা, সাহিত্য কথা সংস্কৃতি কথা, জননী জন্মভূমি, রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথ, তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে।

সম্পাদনা: স্মরণ ( যৌথ ১৯৬৬); সঙ্গীত সংস্কৃতি (১৯৮১); আপনজনদের স্মৃতিকথা (১৯৯৭)।

বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চার গোড়া থেকেই এর প্রতিটি পর্যায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছেন সনজীদা খাতুন – শিল্পী, প্রশিক্ষক, অধ্যাপক এবং সংগঠনকারী হিসেবে। এক আলাপচারিতায় সানজীদা খাতুন বলেন, ‘৪৭ সালে পাকিস্তান হবার পরপর আব্দুল আহাদ ( প্রখ্যাত সংগীতকার) ঢাকায় আসেন। তিনি শান্তিনিকেতনে শিক্ষিত। তিনি এসে রেডিওতে কাজ আরম্ভ করেন। রেডিওতে উনি রবীন্দ্র সংগীত শেখাতেন। অতি সুন্দর করে ভাব বিশ্লেষণ করে শেখাতেন। আমরা খুব আনন্দের সাথে গান শিখতাম। তাছাড়া আব্দুল আহাদ যখনই রবীন্দ্র জন্মবর্ষে বা মৃত্যুদিনে অনুষ্ঠান করতেন, যারা ঢাকায় রবীন্দ্র সংগীত গাইতেন তাদের সবাইকে ডেকে খুব সুন্দর করে অনুষ্ঠানগুলো করতেন। উনি রেডিওতে যে মান বজায় রেখেছিলেন সেটা ছিল খুবই ভাল। কিন্তু ক্রমে ক্রমে একটা সময় এল যখন আমরা দেখতে পেলাম পাকিস্তান সরকার ঠিক চাইছেনা যে রবীন্দ্র সংগীত এখানে প্রচার হোক। রেডিওতে শুধু না, বাইরেও গাওয়া হোক এটা তারা চাইছিল না। কিন্তু সেটা যে তারা খুব স্পষ্ট করে বলতো এমনও নয়। কিন্তু বুঝতে পারতাম যে মানুষের মধ্যেও একটা অন্য চাহিদা এসেছিল। বড় জোর গিটারে রবীন্দ্র সংগীত বাজালে লোকে শুনত। কিন্তু আমাদের গান গাইবার সুযোগ খুব একটা মিলত না।”

১৯৬১ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষপূর্তির উৎসব পালন করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানিদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে থমথমে পরিবেশে একত্রিত হয়েছিলেন বেশ কিছু বাঙালি। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তখন অস্বীকার করেছিল কবিগুরুকে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কিছু রবীন্দ্র অনুরাগী রবীন্দ্রসংগীত ও রবীন্দ্রভাবনা অবলম্বন থেকে পরিবর্তন করেননি নিজেদের অবস্থান। সেবার রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর সেই আয়োজন বাংলার এ প্রান্তের সংস্কৃতি-সচেতন মানুষের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। এই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একজন হচ্ছেন সনজীদা খাতুন।

ষাটের দশকে রমনার বটমূলে ছায়ানটের পয়লা  বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ শুরু হয়েছিল ১৯৬৭ সাল থেকে। তার চার বছর আগে, মানে ১৯৬৩ সালে ছায়ানট সংগীতবিদ্যায়তন চালু হয়েছিল। প্রথম প্রথম পয়লা  বৈশাখের মঞ্চে বিদ্যায়তনের উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের প্রায় সবাইকেই জায়গা দেওয়া চলত। আর একক গানের জন্য শিল্পীদের সংগ্রহ করতে হত বাইরে থেকে। কলিম শরাফী, বিলকিস নাসিরুদ্দিন, মালেকা আজিম খান, ফাহমিদা খাতুন, জাহানারা ইসলাম, মাহমুদা খাতুন, চৌধুরী আবদুর রহিম, পাকিস্তানের শেষদিকে আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত সরকারের বিরাগভাজন আমলা শামসুর রহমানের পত্নী আফসারি খানমসহ আরও কতজন! তবে প্রথমে রমনার বটমূলে অনুষ্ঠান শুরু হয় বটমূলের গোড়ায় বাঁধানো একটু বেদিতে । পরে চৌকি জুড়ে  জায়গা খানিকটা বাড়িয়ে নেওয়া হত। প্রথম দু’বারের অনুষ্ঠানে গাছ থেকে শুঁয়োপোকা ঝরে পড়েছে যত্রতত্র। গুরুজনদের ভয়ে শিক্ষার্থীরা বসে থেকেছে মাথা গুঁজে। দ্বিতীয়বার ছাত্রছাত্রীদের হাতে পোকা সরানোর জন্য এক একটা কাঠি ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কারও কারও ঘাড়ে পোকা লেগে লাল চাকা বেঁধে গিয়েছিল। রমানার বটমূলে এই অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনাও ছিল সানজীদা খাতুনের। আর এইসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সে অনুষ্ঠান আজকের পর্যায়ে এসেছে।

২০০১ সালে রমনায় বোমা বিস্ফোরণে মারা যেতে পারতেন তিনি। কিন্তু তিনি থামেননি। রবীন্দনাথের চর্চার মাধ্যমে জাতিকে এগিয়ে নেবার ব্রত নিয়েছেন। তিনি মনে করেন রবীন্দ্রনাথের গানের সুরে এমন কিছু আছে, এমন লোক উপাদান আছে এবং আরও কিছু আছে, তাঁর ভাষা এত সরল যে সাধারণ মানুষ তা নিতে পারে। তাই গান হওয়া দরকার, গাওয়া দরকার, গানের বাণী বোঝা দরকার।  তবে শুধু গায়ক গয়িকার দল ভারী হলে হবে না, গানের মানটাও থাকতে হবে। জানতে হবে, আমাদের সংস্কৃতিটা কী! সবার আগে বাঙালি হতে হবে। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই। 

 

তথ্যসূত্র:

১. বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান, সম্পাদকঃ সেলিনা হোসেন ও নূরুল ইসলাম, ২য় সংস্করণ, ২০০৩, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃ. ১১৫-১১৬

 ২। উইকিপিডিয়া

আফরোজা পারভীন
আফরোজা পারভীন