সিলভিয়া প্লাথ – এক  বিষাদ রাজকন্যা – আফরোজা পারভীন 

আফরোজা পারভীন

আফরোজা পারভীন

সিলভিয়া প্রতিভাময়ী কবি, ঔপন্যাসিক, মানসিক অস্থিতিশীলতার বলি এক বিষাদ রাজকন্যা।

২৭ অক্টোবর ১৯৩২ সালে জন্ম  নেয়া সিলভিয়া বরাবরই ভাল ছাত্রি।  মাত্র ৮ বছর বয়সে পিতৃহীন হয়েছিলেন। পিতৃহীন মেয়েটি আর ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারেননি। বিষাদবিধুরতা আর হতাশার সেখন থেকেই শুরু। বাবার সমাধি দেখে এসে  লিখেছিলেন, ‘ইলেকট্রা অন এজেলা পাথ।’ স্কুলের পাট চুকিয়ে স্মিথ কলেজ থেকে সর্বোচ্চ সম্মান নিয়ে স্নাতক হন। তারপর ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যান কেমব্রিজে। আর  সেখানেই প্রবলভাবে আকৃষ্ট হন টেড হিউজের কবিতার প্রতি। সিলভিয়ার আগ্রহেই তাঁদের পরিচয় ঘটে ১৯৫০ সালে। এক অদ্ভুত জটিল ভালবাসার মধ্য দিয়ে বিয়ে হয় ১৯৫৬ সালে । টেডের সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘বার্থডে  লেটার্স’ এ এই জটিল সম্পর্কের আভাস পাওয়া যায়।

‘বৃষ্টিতে বাজ’, ‘ক্রো’, ‘গডেট’, ‘দ্য আয়রন ম্যান’,  ‘টেইলস ফর ওভিদ’, ‘বার্থডে লেটারস’ টেডের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। গলব্রেইথ. হথর্নডেন, হুউটব্রেড  পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। তাঁর সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদা পেয়েছিলেন। ১৯৮৪-১৯৯৮ পর্যন্ত ব্রিটেনের রাজকবি ‘পোয়েট লরিয়েট’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন । ১৯৯৮ সালে ৬৮ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ।

সিলভিয়া- টেডের  কিছু বিখ্যাত গল্পও রয়েছে। একসময় প্রাণী নিয়ে খুব বেশি লেখালিখি শুরু করেছিলেন টেড। ‘মাথা’ গল্পটি অর্থবহ। ‘পনেরো ডলারের ঈগল’ গল্পটাও নারী মনস্তত্ব বিষয়ে চমৎকার প্রতিফলন।

সিলভিয়ার  লেখায় বার বার এসেছে নানা চিত্রকল্প, চাঁদ, রক্ত হাসপাতালের গল্প, ভ্রুণ আর করোটির কথা।  তাঁর কবিতায় ডিলান টমাস, ইয়েটস, মারিয়ান মুরের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

বিয়ের পর এই দম্পতি আমেরিকা চলে যায়। তবে ১৯৫৯ এ  আবার বিলেতে ফিরে আসে। লন্ডনের শ্যালকট স্কোয়ারে ১৯৬১ সালে আসিয়া ও ডেভিট  ওয়েভল দম্পতির কাছ থেকে একটা ফ্লাট ভাড়া নেন। একসময় সুন্দরী আসিয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়েন টেড। আর ৬২ সালের জুলাইয়ে  সিলভিয়া বুঝতে পারেন, টেডের এই আসক্তির কথা। ঐ সেপ্টেম্বরেই তিনি পৃথকভাবে বাস করতে শুরু করেন। এই দম্পতির এক পুত্র ও এক কন্যা, নিকোলাস ও ফ্রেইডা।

প্রবল হতাশা আর বিষাদময়তায় আচ্ছন্ন সিলভিয়া। কিন্তু কবিতা আসে বন্যা মতো। অথচ হতাশা সর্বক্ষণের সাথি। স্বামী চলে গেছেন অন্য নারীর সাথে। স্মিথ কলেজের মেধাবী ছাত্রি মাকে লিখলেন, ‘সারা পৃথিবী আমার পায়ের নিচে। ফেটে চৌচির। যেন পাকা রসালো তরমুজের লালিমা।’

সারাক্ষণ আত্মহত্যার প্রবণতা তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। ১৯৫৩ সালের আগস্টে একগাদা ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যু আসেনি। তিন দিন মৃতের মতো পড়ে ছিলেন। এই প্রথম আত্মহত্যার প্রচেষ্টার গল্প সিলভিয়া বলেছেন মিষ্টি মধুর ভালবাসায় সিক্ত করে। তাঁর ‘দ্য বেল জার’ এও এ গল্পের বর্ণনা আছে।  তিনি লিখলেন এভাবে, ‘আমি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করলাম আমার চারপাশের এই অতলান্ত ঘূর্ণির কাছে । যাকে ভালবেসেছিলাম এক চিরন্তন বিস্মৃতি মাত্র।’

এরপর ছয়মাস মানসিক হাসপাতালে । একটু সুস্থ হয়ে ফিরলেন পড়াশুনার জগতে। লিখছেন আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘দ্য বেল জার।’ ফ্রিডার বয়স ২, নিকোলাস ৯ মাসের। স্বচ্ছলতা নেই সংসারে। আর কী ভীষণ শীত লন্ডনে! পানি জমে বরফ। বাড়িতে দূরাভাষ নেই। হতাশা আর হতাশা। এভাবে  কতদিন বেঁচে থাকা যায়! রোজ ডাক্তার এসে দেখে যায়। কিন্তু কতদিন, আর কতদিন!

তারপর ১৯৬৩ সালের একদিন, প্লাথের মাথা গ্যাস চুল্লিতে ঢোকানো, গ্যাসের নব খোলা, কার্বন মনোক্সাইডের তীব্র বিষক্রিয়ায় মৃত্যু। বাচ্চারা অন্যঘরে, নিরাপদে।

সিলভিয়ার  মৃত্যুর পর এটা ইচ্ছামৃত্যু নাকি টেডের কারণেই এই মৃত্যুর পথ বেছে নেয়া, তা নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। নারীবাদিরা তাঁর সমাধি থেকে টেডের নামের অংশটুকু মুছে ফেলেন। সে সময় টেডকে দেখা যায় খুবই মূহ্যমান অবস্থায়। সন্তানদেও সান্ত্বনা দেবার জন্য তিনি লেখেন, ‘আয়রন ম্যান।’ মুষড়ে পড়া অবস্থায়  আরও লেখেন, ‘আমার জীবনেরও সমাপ্তি ঘটেছে এখানে, বাকিটা মরণোত্তর প্রক্রিয়া।’

কবিদের অনেক কথাই বোঝা যায় না। টেডের এ উক্তি যে কতটা সত্য তাও বোঝা যায়নি। এ সময় তার জীবনে ছিল আসিয়া । তবে মাত্র ৬ বছর পর একই প্রক্রিয়ায় গ্যাস চুল্লিতে মাথা ঢুকিয়ে আত্মহত্যা করে আসিয়া। মৃত্যর আগে চার বছরের কন্যা সারাকেও হত্যা করে । এরপর ১৯৭০ এ এক সেবিকা কেরোল অটার্ডকে বিয়ে করেন টেড। এ বিয়ে টিকে ছিল তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত।

সিলভিয়ার জীবনের বিষাদ  মৃত্যুর পরও তাঁকে ছেড়ে যায়নি। যদিও সেটা তাঁকে দেখতে হয়নি।  পুত্র নিকোলাস বিষাদময়তার কাছে পরাস্ত হয়ে ২০০৯ সালে আলাস্কায় আত্মহত্যা করে। কন্যা ফ্রেইডা ১৯৮৮ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসিত হয়ে ওখানকার নৈসর্গিক দৃশ্যের ছবি আঁকায় মগ্ন থাকে দীর্ঘকাল। ১৯৯৭ সালে টেড ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার পর বিলেতে ফিরে আসে ফ্রেইডা। হাঙ্গেরিয়ান চিত্রশিল্পী ল্যাসলো লুকার এর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ১৯৯৬ সালে।  বিয়ে টিকে ছিল ২০১০ পর্যন্ত।

সিলভিয়ার বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য কোলোসাস এন্ড আদার পোয়েমস’, অনেকটা আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘দ্য বেল জার।’ মৃত্যুুর প্রর প্রকাশিত  ‘এরিয়েল’ তাঁকে অমর করে রেখেছে। স্বীকারোক্তিমূলক কবিতাকে জনপ্রিয় করার জন্য ‘এ্যান স্যাক্সটনের’ সাথে সিলভিয়াও বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। আমেরিকার বিখ্যাত  ‘পুলিৎজার’ পুরস্কার লাভ করেন তিনি। কোন কবির সর্বপ্রথম এ মরণোত্তর পুরস্কার লাভ ।

কিন্তু এটাই কি যথেষ্ট । ৩০ পেরোনোর আগেই আত্মহনন! সব আলো পেছনে ফেলে  আঁধারকে আলিঙ্গন! কেন? জীবন কি এতটা হেলাফেলার!

পৃথিবীতে অনেক কেনরই উত্তর মেলে না। এটাও মেলেনি। উত্তর মেলেনি কেন একেবারেই অকালে পৃথিবী  থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন এই বিষাদ রাজকন্যা।

%d bloggers like this: