দুপুরচন্ডির প্রতীক্ষায় পর্ব ১
নেমে দাঁড়ালো ইথিকা। ফুলে ফুলে সাজানো কোন গাড়ি থেকে নয়, একটা রিকশা-আনকোরা নয় পুরানো লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা। সেটা থেকেই নেমে দাঁড়িয়েছে ইথিকা। ওর পরনণ সবুজ সাধারণ জর্জেট শাড়ি, মাথায় ঘোমটা। ওকে লাল বেনারসি দেয়নি কেউ। ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে যে মানুষটি দেয়নি সে-ও। দেওয়ার কথা তো তারই; দেয়নি। হয়তো বোঝেনি কিংবা ইচ্ছা করেই দেয়নি। লাল বেনারসি শুধু নয়, দেয়নি গহনাও। ইথিকার গয়ের গহনা দিয়েছে ওর বাবা। দ্বীতিয়ার চাঁদের মতো চিকচিকে সরু চেইন গলায়। হাতে চার গাছি ব্রঞ্জের ওপর সোনার জলে ধোয়া চুড়ি, কানে ছোট্ট গোলাপ ফুল, টপ। দুই হাতের চার আঙুলে আংটি। এগুলো সব সময়ই ওর সঙ্গে থাকে।
গলায় চেইন আর আংটি পরতে খুব ভাল লাগে ইথিকার; ওর ভাল লাগে কবিতা আবৃত্তি করতে, বই পড়তে। ওর হাসি সুন্দর। মেঘ ভাঙা সোনারোদের মতো উজ্জ্বল হাসিতে প্রাণের মধ্যে আনন্দ ছড়িয়ে যায় নিমেষে। সকলকে নিয়ে হৈ চৈ করে থাকতে পছন্দ করে।
ইথিকার বয়স চব্বিশ। এক নজরে চোখে পড়ে এমন সুন্দর। গায়ের রঙ ফর্সা নয়। শ্যামলা। শ্যামলা রঙে কালো উজ্জ্বল এক জোড়া বড় বড় চোখে খেলা করে সারল্য। ঘন লম্বা কোঁকড়ানো চুলের গোছা কোমর পর্যন্ত নেমেছে। সেই চুলে খোপা বাঁধেনি, ছেড়েও রাখেনি; একটি লম্বা বেণী করেছে; পিঠের ওপর দুলছে বেণীটি। সবুজ জর্জেটের ফাঁকে কালো চুলে বেণীর গোছায় পড়েছে স্ট্রীট লাইটের ম্লান আলো। ইথিকা গম্ভীর!
গতকাল ইথিকার বিয়ে হয়েছে; বাবার বাড়িতে ছিল রাতে। আজ এসেছে শশুরবাড়ি। ইথিকা বাড়ির বন্ধ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সবুজ ঘোমটার ফাঁকে এদিক ওদিক চেয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে আশাহত হয়; ভেবেছিল, দরোজায় দাঁড়িয়ে থাকবে কেউ। বিয়ের ব্যাপারে সব মানুষেরই একটা আকাঙক্ষা থাকে; ইথিকা একটি মেয়ে তাই আকাঙক্ষা আছে ইথিকারও। আকাঙক্ষা একটি পরিপূর্ণ সংসারের। শশুর শাশুড়ি দেবর ননদ নিয়ে হাসিখুশিতে ভরভরন্ত এক সংসারের কল্পনার প্রদীপ সবসময় ওর মনে প্রজ্জ্বলিত থেকেছে; আনন্দময়ী, করুণাময়ী বধু হবে সংসারে এই আকাঙক্ষা সবসময়ের। একটি মেয়ের বিয়ের সময় মনে থাকে সে যখন অন্য এক বাড়িতে যাবে তখন তাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য ফুল লতাপাতায় ঘেরা একটি গেটের সামনে থাকবে অনেক মানুষ, জ্বলবে আলো, বাজবে গান। গান না বাজুক আলো থাকবে, উজ্জ্বল থাকবে বাড়ি; আর ঐ উজ্জ্বল সংসারে দোরগোড়ায় পা রেখেই প্রবেশ করবে ঐ মেয়ে, বউ হয়ে তার আকাঙিক্ষত আনন্দ নগর-সংসারে! কিন্তু কিছুই নেই; বউ বরণ করতে না আছে বরণডালা, না আছে আলোর মালা, না আছে ফুলে ফুলে সাজানো কলাগাছ মোড়ানো গেইট, না আছে মানুষ। অন্ধকার বাড়ি, বন্ধ দরোজা, ধাক্কাতে ধাক্কাতে দরোজা খুলে দিলো এক কিশোরী!
এটা ইথিকার দ্বিতীয় বিয়ে। হোক না দ্বিতীয় বিয়ে, তাতে কি?এটাতো প্রথম বিয়েই ওর জীবনে। আগের বিয়ের দিনই তো স্বামী মারা গিয়েছে ওর! ঐ বিয়েতে ফুলে ফুলে সাজানো ছিল গাড়ি আর সেই গাড়িতে ছিল ওরা। স্বামীর পাশে বেনারসির ঘোমটায় জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল ইথিকা। হঠাৎ থেমে গেল গাড়ি। গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে তিনজন, ওরা কারা? ডাকাত বা ছিনতাইকারী নয় তো! নাকি কোন জঙ্গী? এখন তো কাগজে কাগজে কতো কি খবর থাকছে; টেলিভিশনে প্রচার হচ্ছে! সিরিজ হামলা, ছুরিকাঘাত, আগুনে পুড়িয়ে, নারী-শিশু তো নিপীড়ণের পর হত্যার শিোর হচ্ছে বেশি! এসব ভাবতে ভাবতেই ইথিকা থ’ মেরে গেল। ইথিকাকে ছুরি মেরে সব গহনা ছিনিয়ে নিতে যাওয়ায় স্বামী বাধা দিলে ওরা গুলি করে। ঘটনাস্থলেই মারা গেল স্বামী; স্বামী মারা যাওয়ার সব দায়ভার এসে পড়লো ওর ঘাড়ে। ইথিকার পেটের একপাশ দিয়ে ছুরিটা চলে যাওয়ায় বেঁচে যায় ইথিকা। কিন্তু বেঁচে গিয়ে কি হল? হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে হয়ে গেল অলক্ষী, স্বামী খাগী, অপয়া; শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এটাও বলল, ঐ লোকগুলো ওরই সাজানো! আশনাই ছিল ওর সঙ্গে! এইসব কথাবার্তায় ওর ঠাঁই হলো না স্বামীর বাড়িতে; বাবার বাড়িতে মরমে মরে বেঁচে থাকলো! এভাবেই কেটে গেল পাঁচ বছর। এক একটা বছরে এক একটা মিনার গড়ে চলেছিল ও। স্মৃতি ছিল না, ছিল শুধু নাম। সেই নামেরই মিনার গড়ে চলতে চেয়েছিল, এভাবেই থাকতে চেয়েছিল অপয়া, অলক্ষী ইথিকা। কিন্তু চার আঙুলের ব্যাপার তো কেউ বলতে পারে না, জানতেও পারে না। ইথিকাও পারেনি। তার চব্বিশ বছর বয়সে ঘুরে গেল জীবনের মোড়। তমিজের সঙ্গে হল পরিচয়। তারপর বিয়ে।
আনকোরা নতুন এক বাড়ি। যেখানে সব কিছু অপরিচিত। এখানে পরিচিত শুধু তমিজ। মনের মধ্যে এক অজানা ভয়, অজানা অনুভূতি; আনন্দ, কষ্ট, ভয়ের মিশ্রিত অনুভূতি একবার ডুবিয়ে একবার ভাসিয়ে দিচ্ছিল ওকে। দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করছিল বাড়ির অনান্য সদস্যদেজন্য; বেশ কিছুক্ষণ কাউকে না দেখে মনের আনন্দটুকু শিশিরের মতো উড়ে গিয়েছিল। আনন্দহীন বুকে এদিক ওদিক চেয়ে দেখল আবার। নাহ কেউ নেই। পথ রুদ্ধ, রুদ্ধ জীবন, রুদ্ধ বাতায়ন! এমন কি হওয়ার কথা? বাড়ির ছেলে বউ নিয়ে আসবে, হোক না বাড়ির অমতে তবুও তো বিয়ে। না থাক তোড়জোড় তবুও মানুষের এক অজানা আকাঙক্ষা থাকবে না? বাড়িতে একজন নতুন সদস্য এলে সে দেখতে কেমন, তার চলন-বলন কেমন, এসব জানার কৌতুহলও থাকবে না মানুষের? এ বাড়ির মানুষের মধ্যে এমন কোন কৌতুহল, এমন আকাঙক্ষা দেখতে পেল না ইথিকা। ইথিকার কষ্ট হল। এ যেন দূর থেকে পানি দেখে ছুটে আসা পিপাসার্ত পথিকের মরীচিকা ভ্রম! পানি নয়! নেই পানি, পানি নেই। আহত মন। তেষ্টায় ফেটে যাচ্ছে বুক। নিরুৎসাহিত শক্তি। চলৎশক্তি রহিত পা, আটকে যাচ্ছে জড়িয়ে যাচ্ছে। সাগরের অতল তলে নানান গুল্ম-লতায় আটকে আছে যেন ইথিকা! ওর চারপাশে খেলা করছে অক্টেপাশ তার আটটি কিলবিলে পা ছড়িয়ে; আর সম্মুখে দাঁড়িয়ে হাসছে একটি হাঙর! চোখে মুখে তার জ্বলন্ত কামনার শিখা আর সব ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা আর আনন্দ!
ইথিকার বুকের মধ্যে ছোট্ট হৃৎপিন্ডটা বিষাদে ছেয়ে গেল। ও আহত মন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো বন্ধ দরোজার একটু দূরে। ওকে আনতে শ্বশুর রমিজ উদ্দিন ছাড়া আর কেউ যায়নি। ও ভেবেছিল কেউ আসুক না আসুক, পথ চেয়ে নিশ্চয় আছে কেউ। কিন্তু কেউ পথ চেয়ে বসে নেই! এ বাড়িতে কি কেউ নেই? সব অন্ধকার। বাড়িতে সাজ সজ্জা না থাক, আলো তো থাকবে। রমিজ উদ্দিনের রিকশা তখনও এসে পৌঁছায়নি। বেশ কিছু সময় পার করে এসে দাঁড়ালো রিকশা। যানজটে আটকে ছিল মনে হয়। রিকশা থামতেই রমিজ উদ্দিন নেমে দাঁড়ায়। ছেলেকে বলে, ‘ভেতরে যাসনি কেন।’ তমিজ কোন কথা না বলে দরোজায় ধাক্কা দেয়। ভেতর থেকে গেট খুলে দাঁড়ায় একটি মেয়ে। পনেরো থেকে বিশের মধ্যে বয়স। কচি কলাগাছের মতো তন্বী। শ্যামলা রঙে উজ্জ্বল চোখ। সালোয়ার কামিজে মাথায় চূড়া খোপা। গরমের জন্য চুল এমন করে চূড়া করে বেঁধেছে, কৃষ্ণের মতো; ওকে দেখে এই দুঃখেও মনে হলো কৃষ্ণের কথা। ওর সব চেয়ে প্রিয় বিষয় কৃষ্ণ-রাধা।
গরম একটু বেশি। বাতাস নেই। গুমোট। আকাশে টুকরো টুকরো মেঘের খেলা অথচ বৃষ্টি নেই একফোঁটাও। গরমের জন্য, নাকি বিয়ের জন্য মেয়েটির ভাবলেশহীন মুখ। মেয়েটির ওই মুখ ইথিকাকে আরও বিষণ্ন করে তুলল। দরোজা খুলে দরোজা থেকে সরে দাঁড়ালো না মেয়েটি। এক নজরে ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নেয় ইথিকা। মেয়েটি এগিয়ে আসে না। তমিজ ডাকে ওকে। ‘কিরে টুম্পা, আয়; তোর ভাবীকে ভেতরে নিয়ে যা।’ টুম্পা আসেও না, ইথিকার সঙ্গে কথাও বলে না। ঠাঁয় দাঁড়িয়েই থাকে। বাড়ি থেকে আসার সময় কয়েক প্যাকেট মিষ্টি আর খাবার বেঁধে দিয়েছিল ইথিকার মা, রমিজ উদ্দিন সেগুলো টুম্পার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘এগুলো রেখে তোর মাকে ডাক টুম্পা।’ টুম্পা খাবারের প্যাকেটগুলো হাতে করে বাড়ির ভেতরে চলে যায়, ডাকে না ইথিকাকে। ইথিকার মনটা কষ্টে সাগর হয়ে যায়। আজ প্রথম দিন। এই দিনে যদি সকলের কাছ থেকে আশানুরূপ ব্যবহার পাওয়া না যায় তাহলে কষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক। ‘এই তমিজ বউকে নিয়ে আয়। এস বৌমা।’ ওদের ডেকে বাড়ির মধ্যে ঢোকে রমিজ উদ্দিন। ইথিকাকে ডাকে তমিজ। ঘোমটা ছাড়া নতুন বউ। কি কথা! লোকজন ছাড়া, রিসেপসন ছাড়া নতুন বউ কেমন দেখায় না! ইথিকা কথাগুলি ভাবলেও কিছু বলে না। মাথায় শাড়ির আচল তুলে দেয়। কব্জি উল্টিয়ে ঘড়ি দেখে; রাত দশটা। রাত বেশি নয়, অথচ এ বাড়িটা মনে হচ্ছে নিঝুম নীরব ঘুমন্তপুরী! ছায়াছায়া অন্ধকারে ভুতুড়ে বাড়ির মতো লাগছে। বাড়ির মধ্যে কোথাও ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে; ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। বাড়ির মধ্যে অনেকখানি জায়গা নোংরা, আগাছাপূর্ণ; পরিষ্কার করা হয়নি অনেক দিন। ওই জঙ্গলের মধ্যেই ডাকছে ঝিঁ ঝিঁ পোকা। একটানা ঝিঁ ঝিঁ ঝিঁ। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ওকে নিয়ে যায় ছেলেবেলায়। ওর ইচ্ছা করছে বদনার নল দিয়ে ঝিঁ ঝিঁ পোকার গর্তে পানি ঢালতে। গর্তে পানি ঢাললেই পোকাগুলো বের হয়ে আসে। ছোট বেলায় এভাবে কত পানি ঢেলেছে ওরা- টুসি, মিমি আরও অনেক বন্ধুরা। এটা ওদের প্রিয় খেলা। পোকাগুলো যখন গর্ত থেকে বের হতো ওদের ভীষণ আনন্দ হতো; হাততালি দিতো। কখনও মারতো না। পোকা মাকড়, পিঁপড়া প্রজাপতি কখনও মারতে পারে না ইথিকা। বুকের মধ্যে কষ্ট হয় খুব! ওর এই এক অভ্যাস। ছোটখাট কথায়, ছোট খাট অবহেলায় ওর বুক ফেটে যায়। মা বলে, ‘এসব ভাল নয়। এত ছোট কথায় কষ্ট পেলে সারাজীবনে কষ্ট পাবে অনেক।’
‘এই শোন।’ তমিজকে ডাকে ইথিকা। ‘এক বদনা পানি দাও না।’
‘কি করবে? বাথরুমে যাবে?’
‘না না ঝিঁ ঝিঁ পোকার গর্তে ঢালবো।’ এবারে তমিজ ধমকে ওঠে নিচু কন্ঠে। ‘এটা শ্বশুরবাড়ি ইথিকা। নিজের বাড়ি না যে রাত দুপুরে ঝিঁ ঝিঁ পোকার গর্তে পানি ঢালবে। তাছাড়া তোমার বয়সও তো কম না। আর আগেও তো একটা বিয়ে হয়েছিল তোমার।’
তমিজের কণ্ঠে টিটকারির সুর! ‘বিয়ে হয়েছিল। তাতে কি। এটা কি বলার কথা। তাছাড়া তুমিতো জেনেই বিয়ে করেছ, নাকী তা নয়। কিছুতো লুকাইনি । আমি তো বিয়ে করতে চাইনি। স্রেফ বন্ধুত্বকে তুমি প্রেম মনে করলে। ভালোবাসা ভেবে ভুল করে বিয়ের জন্য জিদ ধরলে, কেন? এতো তোমার ভালোবাসা নয়। যদি ভালোবাসা হতো তবে এভাবে কথা বলতে পারতে না তুমি।’ তমিজকে কথাগুলো বলতে গিয়েও বলল না কিন্তু না বললেও কথাগুলো ভেবে ইথিকার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল; চোখ ভরে গেল টলটলে জলে। কথাগুলো বলতে পারলে ভাল লাগতো ইথিকার। কিন্তু নতুন বউ, এত কথা বলা মানায় না। দুঃখ বেদনার নীল জলে ও ডুবে যায়। বুকের ভেতর থেকে কেউ একজন বলে ওঠে, ভুল করেছ ইথিকা, তুমি ভুল করেছ।
‘এ্যাই আস।’ হাত ধরে টানে তমিজ। ইথিকা তমিজের সঙ্গে এগিয়ে যায়।
বাড়িতে তিনদিকে তিন খান ঘর। একটা ইটের গাঁথনি দেওয়া, একটা টিনের এবং অন্যটা চাটাই-এর বেড়া দেওয়া। তিনদিকে তিন ঘরে যেতে উঠোনের মধ্যে সারি সারি ইট বিছানো। বৃষ্টিতে কাদা হয়ে আছে উঠোন। একটা ঘর ছাড়া সবগুলি ঘরের আলোই নেভানো। উঠানের এক কোণে একটা ষাট পাওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। এক নজর ঘরগুলোর দিকে তাকিয়ে ইথিকার মনে হয়, এদের অবস্থা ভাল নয়। এরা অস্বচ্ছল। ইথিকাকে ঘরগুলি দেখতে দেখে তমিজ তাড়াতাড়ি বলে ওঠে,
‘সামনের মাসে আমরা নতুন বাসায় উঠে যাবো। বাসা ঠিক হয়ে আছে। সকাল বেলা তোমাকে দেখিয়ে আনবো। ওই তো রাস্তার ওপারে। সব মোজাইক। বাথরুমে টাইলস.. কথার মধ্যে অহংকারের ভাব তমিজের। ওরা স্বামী-স্ত্রী। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কি অহংকার মানায়? নাকি থাকা উচিত। ইথিকা আহত, বিব্রত। আবারও ওর মন বলে, ভুল করেছ ইথিকা, ভুল করেছ তুমি।
রমিজ উদ্দিন ডাকে স্ত্রীকে। কেউ সাড়া দেয় না। কেউ আসবে না বুঝে ফেলেছে ইথিকা; নতুন বউ ইথিকা। এ বাড়িতে প্রথম পদার্পল ওর কিন্তু বরণ করতে নেই কেউ; নেই হৈ হল্লা, আলোকসজ্জা। ব্যান্ডপার্টি তো নেই-ই। কেউ নেই দরোজাতে; ডেকেও পাওয়া যাচ্ছে না কাউকে। সেই যে এক ঝলক দেখল টুম্পা নামের মেয়েটিকে সেও কোথায় কোন কোণে বসে আছে জানে না ইথিকা। বাইরের লোকজন না হয় নাই থাকলো, তাই বলে বাড়িতেও কেউ নেই! বিস্মিত ইথিকা! নিজেরা আনন্দ না করতে পারে, আনন্দ করতে ইচ্ছা না-ই হতে পারে তাই বলে একজন নতুন মানুষকে দেখে এগিয়ে আসবে না কেউ, তাই কখনও হয়; না হতে পারে! হয়তো বা এরা তা-ও আসবে না। এতটাই কৃপণ। কাউকে কিছু দিতে এদের এতই আপত্তি। এরা নিজেদের নিয়ে নিজেরা ব্যস্ত থাকতে বুঝি ভালবাসে। আর এতোই নতুন মনুষের সঙ্গে মিশতে বিরাগ! তাহলে নিয়ে এসেছে কেন ওকে! কেনই বা তমিজ বিয়ে করেছে ওকে! বিয়ে তো করতে চায়নি ইথিকা; সব ভাগ্য, নিয়তি। ওর মনে পড়ে একটি গানের লাইন।‘তুই নিয়তির খেলার পুতুল বুঝলিনা কেন বল?’
ইথিকা অনেক ভেবেও গানের অন্য লাইনগুলো মনে করতে পারে না। অথচ এটা ওর প্রিয় গানগুলোর মধ্যে একটি। এতদিন তো ভোলেনি তবে আজ ভুলে গেল! কেন? কেন ভুলে গেল! আসলে মানুষ যখন অনিশ্চিয়তায় মধ্যে থাকে তখন মানুষের অনেককিছু মনে থাকে না; মনে আসে না। ইথিকারও লাইনগুলো মনে এলো না। ও গান শেখেনি কিন্তু কণ্ঠ ভাল; তাল জ্ঞান ভাল। একবার শুনলেই গান ধরতে পারে। ওর সব গান শুনে শুনেই শেখা। ওর মা গান শেখাতে চেয়েছিল কিন্তু পারিপার্শ্বিকতার টানাপোড়নে শেখা হয়ে ওঠেনি।
‘এই চলো।’ ইথিকা চমকে ওঠে তমিজের ডাকে। ‘কি ভাবছিলে?’
‘কিছু না।’ মুখে কিছু না বললেও মনে মনে বলে এ কোন বাড়িতে নিয়ে এলে তমিজ। এ বাড়ি তো আমার জন্য নয়। আমার তো এভাবে থাকার জন্য বিয়ের প্রয়োজন ছিল না। আমি তোমাকে তো বিয়ে করতে চাইনি; চেয়েছিলাম বন্ধুত্ব; স্বামী নয় বন্ধু হবে তুমি তাই চেয়েছিলাম। রাহাত মারা যাওয়ার পর অনেক প্রলোভন এসেছে, কিন্তু পা দেইনি ফাঁদে। কিন্তু এখানে কি থেকে কি হয়ে গেল। কিছু বোঝার আগেই সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে গেল। কথার জালে আটকা পড়ে গেলাম আমি।
Facebook Comments Sync