করোনা দিনের প্রার্থনা – আফরোজা পারভীন

আফরোজা পারভীন

আফরোজা পারভীন

 

করোনা ছড়িয়ে গেছে সারাদেশে। একের পর এক লকডাউন হচ্ছে জেলাগুলো।  এখন সর্বোচ্চ ঝঁকিতে আছে দেশ। মৃতের হার বাড়ছে। করোনা এখন আর বয়স্কদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সব বয়সের নারী পুরুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। শিশুও বাদ যাচ্ছে না। জানি না ভবিতব্য আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে!

করোনা আতঙ্কে কাঁপছে সারা পৃথিবী । চীনের উহান প্রদেশ থেকে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে  গোটা পৃথিবীতে। চীন এখন অনেকটাই সামাল দিয়েছে। তারা লকডাউন খুলে দিয়েছে। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসছে জীবনযাত্রা। কিন্তু সামাল দিতে প্রাণান্ত ইউরোপ আমেরিকা ইতালিসহ উন্নত দেশগুলো।  প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে লাশের বহর। আমেরিকার অবস্থা নাজুক। একের পর এক লকডাইন হচ্ছে একের পর এক শহর। একের পর এক দেশ। বলতে গেলে গোটা পৃথিবীই এখন বিচ্ছিন্ন।

 এ রোগে মৃত্যু ভয়ানক মর্মান্তিক। আপনজন কাউকেই রোগির কাছে যেতে দেয়া হয় না। এমনকি মৃত্যুর পর মৃতদেহ আত্মীয়-স্বজনকে হস্তান্তর করা হয় না ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে। এমন করুণ আর অবহেলিত অসহায় মৃত্যু কারো কাম্য নয়, কারোই নয়। 

এ ভাইরাস প্রতিকারের জন্য নানান সতর্কতার কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে প্রধান নিয়ম মেনে বারে বারে স্যানিটাইজার বা সাবান দিয়ে হাত ধোয়া । হাঁচি কাশি থেকে দূরে থাকা। নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা। যতদূর সম্ভব ঘরে থাকে। মানুষের সাহচর্যে না যাওয়া, হ্যান্ডশেক না করা, জড়িয়ে না ধরা, কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে না যাওয়া। যতদূর সম্ভব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা। লিফট-এর বাটন, দরজার ছিটকেনি হ্যান্ডেল পরিষ্কার রাখা। ওগুলো স্পর্শ করার পর হাত ধোয়া। গণপরিবহন যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা। প্রবাসীদের থেকে দূরে থাকা। 

কিন্তু মানুষ এসব কঠোরভাবে মানছেন না। অকারণে বাজার ঘাটে ঘোরাঘুরি করছেন। এখনই যেন মানুষের ভালো মন্দ খাবার ইচ্ছে বেড়েছে। অন্তত শবেবরাতের আগের দিন কারওয়ান বাজারের চিত্র দেখে সেটাই মনে হলো। শুধু কি তাই, এই করোনার মধ্যে মানুষ বিয়ে করছে। ইতালি ফেরত একজন আসার সাথে সাথেই বিয়ে করে ফেলেছেন। আরেক সরকারি কর্মকর্তা বিয়ে করে চাকুরি খুইয়েছেন। আর একজন প্রশাসনের ভয়ে বিয়ের আসর থেকে পালিয়েছেন। তাকে জরিমানা করা হয়েছে।  আমি নিশ্চিত এমন অনেক বিয়েই হচ্ছে গোপনে গোপনে। সব খবর তো আর প্রশাসনের কানে আসে না। 

করোনা ভাইরাসের কোন ওষুধ নেই। যে  রোগের ওষুধ নেই সে ব্যাপারে তো সতর্ক থাকাই উচিত। ঘনবসতিপূর্ণ দেশ আমাদের। প্রধানত বিদেশ থেকে আগত প্রবাসীদের দ্বারা ছড়িয়ে পড়েছে এ ভাইরাস। ইতালি   থেকে অনেক প্রবাসী এসেছে দেশে। দেশে ফিরে এদেশের ১৭ কোটি মানুষের কথা না ভেবে বাড়ি গিয়েছে। পরিবার পরিজনের কথা পর্যন্ত এরা ভাবেনি। 

এর মাঝে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল নির্বাচন।  অদম্য নির্বাচন কমিশন! কেন এই নির্বাচন হতেই হলো জানি না। স্বরস্বতী পুজোর জন্য নির্বাচন পিছিয়ে দেয়া হয়েছিল। অথচ এই মরণঘাতী ব্যাধির প্রকোপ থাকার পরও পেছানো হলো না। না পিছিয়ে কি ফায়দা হলো কমিশনের কে জানে। হ্যাঁ বিজয়ী প্রার্থীর লাভ হলো। তিনি নিজেও জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে নির্বাচন পিছানোর আবেদন করলেন না। পরাজিত প্রার্থীও না। এরাই আমাদের জনপ্রতিনিধি! ইতিহাস এই নির্বাচন কমিশনকে আর এই প্রার্থীদের কীভাবে মূল্যায়ন করবে তা সহজেই অনুমেয়।

খালেদা জিয়াও ছাড়া পেলেন এ সময়ে। পিজি হাসপাতাল থেকে শুরু করে তার গুলশানের বাসা পর্যন্ত যে জনযট সৃষ্টি হলো তা দেখে শিউরে উঠলাম। ঘটনাটি করোনার আগে ঘটতে পারত, ঘটতে পারত পরে, কিন্তু ঘটল করোনার মধ্যেই।

রুবানা হক আর পোশাক মালিকরা দরিদ্র পোশাক শ্রমিকদের পায়ে হাঁটিয়ে ঢাকায় এনে তাদের ক্ষমতার বহর দেখালেন। তারা এলো হাঁচড়ে চিপড়ে। থুতু কাশি মাখতে মাখতে। জানি না এর ফলাফল কি। 

স্কুল কলেজের ছুটি দেয়া হলো ঘরে থাকার জন্য। ছুটি পেয়ে কক্সবাজার রাঙ্গামাটি বান্দরবান চলে গেল সবাই পরিবার পরিজন নিয়ে ছুটির আনন্দে। সরকারি ছুটি ঘোষণা হলো ঢাকা লকডাউন না করে। ছুটি কাটানোর আমেজে ট্রেনে বাসে লঞ্চে নাকের ওপর নাক নিয়ে কাঁধের উপর কাঁধ ঠেকিয়ে অসংখ্য মানুষ চলে গেলো নিজ নিজ গন্তব্যে। একজন গেলো আরেকজনের গায়ের উপর চড়ে। এই অসচেতন জাতিকে ঠেকাতে আগেই তো বন্ধ করা যেত পরিবহন! 

আর এই করোনারাজ্যে দেখা গেল মানুষের মানবতার বহরও। গরিবের হাতে এককেজি চাল ধরিয়ে দিয়ে পোস্ট দিচ্ছেন অনেকেই। নাম কামাবার লোভ সম্বরণ করতে পারছেন না। একটা মাস্ক দিচ্ছেন তিরিশজন মিলে। 

কানাডার প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীকে ঘরে থাকার আহ্বান জানিয়ে ঘরে ঘরে খাদ্যদ্রব্য পৌছে দেবার ঘোষণা দিয়েছেন। তার মর্মস্পর্শী ভাষণ আর চোখের জল নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। উন্নত অনুন্নত সব দেশ নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি নিয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আর তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জী করোনা মোকাবিলায় একযোগে কাজ করছেন।

 মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘মন্ত্রী, এমপি, জেলা উপজেলা, ইউনিয়ম পরিষদ চেয়ারম্যান সাহেবরা ভোটের সময় মানুষের দরজায় গিয়েছেন, এবার মানুষের দরজায় খাবার  পৌঁছে দিন।’ তাঁর নির্দেশ মেনে জনপ্রতিনিধিরা দোরে দোরে যাচ্ছেন বলে শুনিনি। বরং শুনেছি একজন ওয়ার্ড কমিশনার পেশীশক্তি দেখিয়ে হাসপাতাল নির্মাণে বাধা দিয়েছেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিদিন জেলাগুলোর সাথে ভিডিও কনফারেন্স করছেন। পরিস্থিতি সর্বক্ষণিক তদারক করছেন। ত্রাণ চুরির ব্যাপারে কঠোর হূঁশিয়ারি দিয়েছেন। তারপরও চুরি হচ্ছে। সতেরো কোটি মানুষের দেশ আমাদের। প্রান্তিক মানুষের সংখ্যা বেশি । দেশের এই যে সব খেটে খাওয়া মানুষ এরা যদি কাজে না যায় এদের দিন চলবে না। এর মাঝে যদি  ত্রাণও না পায় এরা তো না খেয়ে মারা যাবে। বাঁচার জন্য খাদ্য দরকার। 

করোনার কথা জানাজানি হবার সাথে সাথেই নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সাধারণের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে।  জনগণ দেদার কিনে গুদোম ভরে ফেলছে। যার পাঁচ কেজি দরকার সে কিনছে পঞ্চাশ কেজি। যার পয়সা নেই সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। 

করোনারাজ্যে কিন্তু অন্যায় অবিচার কমেনি। প্রতিদিনই ধর্ষণের খবর পাচ্ছি আমরা। খবর পাচ্ছি চাল গম চুরির। আমি অবাক হয়ে ভাবি, যারা চুরি করছেন তারা কীভাবে নিশ্চিন্ত হলেন করোনায় আক্রান্ত হবেন না। বেঁচে থাকবেন, এই ত্রাণসামগ্রি তাদের ভোগে লাগবে। আশ্চর্য সাহস এদের। মৃত্যুভয় পর্যন্ত নেই।

অবে আশার কথা,  শুধু সরকার নয়, এই দুঃসময়ে এগিয়ে এসেছে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।  এগিয়ে এসেছে শিল্পপতিরা। তারা ত্রাণ তহবিলে দান করছেন, চিকিৎসাসামগ্রী দিচ্ছেন। এমনকি ব্যক্তি পর্যায়ে অনেকেই করোনা মোকাবিলায় সাধ্যমতো অবদান রাখছেন। 

সবশেষে অনুরোধ, সচেতন হন, নিজে সাবধান থাকুন, অন্যকে সাবধান থাকতে বলুন। কাজে চিন্তায় আচরণে মানবিক হোন। মনে রাখবেন মানবিকতাই  আপনার মনে শান্তির বারি বর্ষণ করতে পারে, অর্থ নয়, বিত্ত নয়, ক্ষমতা নয়। করোনা দিনে প্রার্থনা করি, আর যেন কেউ নতুন করে আক্রান্ত না হন, প্রার্থনা করি রোগমুক্ত নতুন দিনের।