‘চিন্তা করোনা, সব ঠিক হয়ে যাবে!’। আসলেই কি ঠিক হয়ে যায়? – মর্তুজা আব্দুল্লাহ্

মর্তুজা আব্দুল্লাহ্

ছোটবেলা থেকেই ছেলেটা মায়ের পিছেলাগা। বড় হয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছে, কিন্তু এখনও লুঙ্গিটা খুঁজে পেতে মা’কে ডাকতে হয়। সেই মা হঠাৎ তাকে একা করে চলে গেলে সে যে দুঃখ পায়। পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কিছুই হতে পারে না!

 

মেয়েটা কোনোদিন বাবার আঙুল চেপে ধরে এক বিকেল হাঁটতে পারেনি। ‘আমার মা’মনিটা কইরে’ ডাক শুনে কোনোদিন তার দরজা খোলার জন্য মা’র সাথে ঝগড়া করা হয়নি। বড় হয়ে যখন সে জানতে পারে- তার জন্মদাতা এই পৃথিবীতেই বাস করে, কিন্তু ‘বাবা’ বলে চিৎকার করা তার মনের ডাক ওই মানুষটা শুনতে পায়না। কারণ সে আরেকজনের পৃথিবী সাজাতে ব্যস্ত। কোনো ভালোবাসা দিয়েই মেয়েটার এই দুঃখ ঘুচবে না!

 

মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম, অনটনের সংসারে বড় সন্তান। পুরো পরিবার তার দিকে তাকিয়ে আছে সুদিন দেখবার আশায়। যে ছেলেটা দিনে ষোলো ঘন্টা করে পড়াশুনা করে লাগাতার তিন বছর ধরে বিসিএস দিয়ে যাচ্ছে; বয়সসীমা পার হয়ে যাবার পর শেষ পরীক্ষার ফলাফল যখন ‘অকৃতকার্য’ আসে- তার এই দুঃখ মাপার ক্ষমতা পৃথিবীর আর কারো নেই! 

 

দীর্ঘ চার বছর রিলেশনশিপে থাকার পর মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড যখন তাকে জানিয়ে দেয় ‘ইট’স্ ওভার বিটুইন আস’; তার এই দুঃখের তুলনায় পৃথিবীর কোনো দুঃখই দুঃখ না!

 

স্বচ্ছ চরিত্রের অধিকারী। অনেক ধুমধাম করে বিয়ে করার কিছুদিন পর, যে ছেলেটার বৌ শারীরিক তৃপ্তি না পাওয়ার অভিযোগে তাকে ডিভোর্স দেয়; দুর্ঘটনায় স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে গেলেও সে অতটা দুঃখ পেতো না! 

 

মানুষের জীবনে কিছু সিরিয়াস টাইপের দুঃখ থাকে। ডায়েরীর প্রথম থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত ঐ দুঃখের বর্ণনা দিয়ে ভরে ফেললেও তার ওজন একটুও হালকা হয় না। কেউ যখন এজাতীয় দুঃখ পায়, যার যার অবস্থান থেকে সবাই এটাই ভাবে যে, তার দুঃখটাই পৃথিবীর সব থেকে বড় দুঃখ, এ দুঃখ জীবনেও ভোলা সম্ভব না! তাকে যদি দিনে দশবার সাইকোথেরাপির সেশনে নিয়ে ‘সব ঠিক হয়ে যাবে’র পাঠ শোনান; কোনো লাভ হবে না।

 

এমন কাউকে আপনি জানলে- ভুলেও তার দুঃখটাকে ছোট করে দেখাতে যাবেন না। তার সামনে সান্ত্বনা কিংবা উপদেশ কপচাতে যাবেন না। সে যে পরিমাণ দুঃখ বহন করছে, তার বিপরীতে আপনার সান্ত্বনা/ উপদেশ উপহাসের মতো শোনাবে। কাছাকাছি থাকলে তার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিন। অথবা তাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন- যাতে সে নির্ভরতা অনুভব করতে পারে, তার চেপে রাখা কান্নাটা বেরিয়ে আসে। দূর থেকে শুধু এইটুকু বলতে পারেন ‘তোমার কষ্টটা আমরা হয়তো তোমার মতো করে অনুভব করতে পারবো না, কিন্তু এটুকু জেনে রেখো- তুমি একা নও, আমরা তোমার পাশে আছি’। এতে সে নিজেকে দৃঢ় ভাবতে শুরু করবে এবং কষ্টটা মোকাবেলা করার সাহস পাবে।

 

না, সব ঠিক হয়ে যায় না।  কিন্তু সময়ের বিবর্তনে চাপা পড়ে যায়।  নয়তো সহ্য করার ক্ষমতা চলে আসে। দু-চার মাস/ বছর পর এই মানুষগুলোকেই আপনি দেখবেন একটা মজার কথা শুনে হো হো করে হাসছে। তাদের দেখে মনেই হবে না- কখনো না ভোলার মতো কোনো দুঃখ এদের ছিলো।

 

আশ্চর্য হবার কিছু নেই! পৃথিবীর সবচেয়ে কার্যকরী পেইনকিলার হচ্ছে ‘সময়’…

%d bloggers like this: