ঢাকা শহর মুরাদ কিবরিয়া 

আজ থেকে তের বছর আগে, এক পহেলা আগস্টে ঘুম ঘুম চোখে আরিচা হয়ে গাবতলী দিয়ে ঢাকা শহরে ঢুকেছিলাম। পায়ে আমার রেক্সিনের স্যান্ডেল, গায়ে সবচেয়ে ভালো জামা, পরনে সবচেয়ে ভালো প্যান্ট। আর ব্যাগ, ব্যাগের ভেতর কলেজ ভর্তি পরীক্ষার গাইড, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, গণিত। একেবারে নিচে রাখা, সতর্কতায়, যেন বড় ভাইরা দেখে না ফেলে, একটা কবিতার বই – যে জলে আগুন জ্বলে। আর ষাট টাকা দিয়ে কেনা একটা ডায়েরি। আমি যখন নিরবে এই শহরে ঢুকি, তখন ভোর – এ শহর তখনও ঘুমে। আমার চোখে ঘুম নেই। এই তবে ঢাকা ! এই তবে ঢাকা শহর!! না, যেরকম আভিজাত্যময় ভেবেছিলাম, সেরকম কিছু নয়। প্রথম দর্শনে এই শহরকে আমার ভালো লাগেনি। কিন্তু খামখেয়ালি প্রেমিকার মত এই শহর এখনো আমাকে জড়িয়ে রেখেছে। 

.

কিছুদিন যেতেই বুঝলাম এই শহর ক্ষমা করতে জানে না। ঢাকা একটি ক্ষমাহীন নিষ্ঠুর শহর। এখানে অনেক মানুষ আর মানুষের আড়ালে আবডালে আছে হরেক রকম অন্য মানুষ। তাদের চোখের ভেতর ক্রুরতা। তাদের পদক্ষেপ সাবধানী। তারা সহসা উদ্বেলিত হয় না। কুঁচকানো ভ্রুর নিচে লেপ্টে থাকা অন্ধকারকে মাঝে মাঝে সরলতা বলে বিভ্রম হতে থাকল। এবং সহসাই বুঝলাম, এই শহর কঠিনের শহর। এখানে নিজের জায়গা নিজেকে করে নিতে হবে। মধুমিতার পেছনে চা খেতে খেতে আর নায়িকার পোস্টারে সেটে থাকা স্টিকার দেখতে দেখতে কখনো কখনো যদি মনে পড়ে যেত মমতাময়ী নদীর ধার ধরে মিলিয়ে যাওয়া হাওয়ার স্বাদ, আমি চোখ চুলকে নিজেকে প্রবোধ দিতাম, আর কিছুদিন… সেই দিন আসেনি কখনো। সেই সমস্ত দিন আসলে আসে না। 

.

সেই সময় সবচেয়ে হতাশ করেছে ঢাকার মেয়েরা। ঢাকার মেয়েদের নিজের কিছু নেই বলে মনে হত। ঢাকার মেয়েরা অকারণেই টিভির মেয়েদের মত হতে চায়। আমার কলেজের পাশে হলিক্রস কলেজ। টিফিনে একের পর সিঙ্গারা খাওয়া ছাড়া যাদের আর উল্লেখযোগ্য কাজ আমার চোখে পড়েনি। তবু মাঝে মাঝে, বুকের ভেতর মোচড় দেয়া কিছু মেয়ে আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যেত। কিন্তু তারা অনেক দূরের। আমি ভাবতাম, যে মেয়েটির পারফিউম মাখা বাতাসে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি, সে মেয়েটি কি করে এত দূরের হয়! আমার নিজের কাছে পেতে রাখা প্রশ্নের উত্তর পাশ কাটিয়ে, আপন ধ্যানে মগ্ন সেই যুবককে দূরে রেখেই সেই সব মেয়েরা পারফিউমের আলোড়ন তুলত রোজ। আমি ভাবতাম, আমি কি এই শহরের হতে পারব না! 

.

তের বছর ধরে এই শহরে আছি। এই শহরের কয়েকশ কিলোমিটার হেঁটে হেঁটেও পরিব্রাজক হতে পারিনি। এই শহর বোবা বাক্সের শহর। কিউবিকলে আটকানো এই শহরের আভিজাত্য। তবু এই শহর ছাড়ল না। এত ভিড়, এত অমানুষ, এত কাঠিন্য- তবু মায়া। শুধু কঠিনের নয়, এই শহর মায়ার শহর। ফুটপাতে কঠিন মুখে বসে থাকা ভিখারির মায়া, ঝুম বৃষ্টিতে ফাঁকা রাস্তায় মাস্তানের মত হাটার মায়া, আগুন গরম চায়ের ধোঁয়ার মায়া, পার্কের বেঞ্চিতে লুকিয়ে চুমু খাওয়া প্রেমিক প্রেমিকার মায়া, সারাদিন কিছু না করে জানালায় চেয়ে থাকার মায়া, প্রকৃতিহীন খটখটে কংক্রীটের মায়া। 

.

এ শহর  রেক্সিনের স্যান্ডেল পরে আসা সে কিশোরকে ঠকায়নি। এ শহর আমাকে দু হাত ভরে দিয়েছে। মাস শেষে ব্যাঙ্কে প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা , সুন্দরী প্রেমিকা, ধোলাই করা কাপড়ে ভদ্রলোকের ঘ্রাণ, ইচ্ছে হলেই দামি রেস্তরাঁয় পার্টি- সবকিছু। আর কয়েকশ প্রেম দ্রোহ আর দুঃখের কবিতা। একখানা কবিতার বই। অজস্র গল্প- নিজের, অন্যের। তবু মাঝে মাঝে জল পিপাসায় ঘুম ভেঙ্গে গেলে মাঝরাতে, কেন যেন মনে হয়, পশুর নদীর তীর ঘেঁষে নিঃশব্দ চর ধরে এই রাতে কেউ হেঁটে যাক। উপুড় জ্যোৎস্নায় সীমানাহীন মৎসের ঘেরে, ঘোর কেটে আমাকে কেউ ডাকুক। জল পিপাসায় বেড়ে ওঠা এই অনুভুতির নাম কি? দুঃখ? একাকীত্ব? ও, বলতে ভুলে গেছি, এই শহরে দুঃখেরও শহর। এই শহর একাকীত্বেরও শহর। 

.

এই শহর শুধু দুহাত ভরে দিয়েছে, নেয়নি কি কিছুই? কি নিয়েছে? বলা বড় ভার। মফঃস্বলের রক্তিম সূর্যাস্তে স্নান করা কিশোরের কাছ থেকে কি ছিনিয়ে নিতে পারে এই শহর! এ কথা ভাষায় বলা যায় না। বোঝানো যায় না। এটা একটা অনুভুতি। মাঝে মাঝে মনে হয় – এই মেকি শহর, এই মিথ্যে ব্যাঙ্ক ব্যালান্স, এই কেতাদুরস্ত সফেদ পোশাক, এই নাগরিক প্রেমিকা, গরাদের মত এই অফিস, এই পিচঢালা দেমাগি রাজপথ, দৈত্যের জিহ্বার মত এই আলো ঝলমল ফ্লাইওভার, এই পার্টি, এই মিছিল, এই ক্ষোভ, এই অন্যায্য কলহাস্য, এই ঝকমকে সন্ধ্যা সব ছেড়ে ছুড়ে পাখি হয়ে উড়ে যাই। আকাশে, তার ওপরের আকাশে, আরো ওপরের আকাশে। এই হচ্ছে হারানোর অনুভুতি। এ শহর সব দিয়ে আমাকে নিঃস্ব করেছে। 

.

তবু ভালো থাকুক নিষ্ঠুর শহর। ভালো থাকুক ক্ষমাহীন শহর। ভালো থাকুক মায়ার শহর। ভালো থাকুক দুঃখ আর একাকীত্বের শহর। আর ভালো থাকুক দুই কোটি নিঃস্বের শহর।

মুরাদ কিবরিয়া 
মুরাদ কিবরিয়া