ইসলামে মাতৃভাষার মূল্যায়ন – ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান
মানুষের মনের অভিব্যক্তি প্রকাশের ধ্বনিকে ভাষা বলে। মানবজাতি কখন কোথায় ভাষা ব্যবহার করেছে সে ইতিহাস ভাষাতাত্ত্বিকদের অজানা। ভাষার উদ্ভব উৎস তাদেরকে অনুসন্ধানী করেছে বটে কিন্তু ভাষার আবির্ভাব তত্ত্বের কোন সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য আবিষ্কার করা যায়নি। নানা ধরনের থিওরি বা তত্ত্ব আবিষ্কারের মোদ্দা কথা হচ্ছে ভাষা আল্লাহ প্রদত্ত, এর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলা। পৃথিবীতে বহু ভাষার প্রচলন ও মানবজাতির ভাষার ভিন্নতা আল্লাহ তাআলার অপার কুদরতের একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। আল্লাহ বলেন :
‘আর তারই কুদরতের অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে নভোমন্ডল ও ভূ-মন্ডলের সৃজন এবং পৃথক হওয়া তোমাদের ভাষা ও বর্ণের। নিশ্চয়ই এতে কুদরতের নিদর্শনসমূহ রয়েছে জ্ঞানবানদের জন্যে’।
তবে যিনি যে ভাষা তার মায়ের কাছ থেকে জন্মসূত্রে লাভ করেছেন সেটাই তার মাতৃভাষা, প্রাণের ভাষা। পৃথিবীর যে কোন ভাষাভাষীর কাছে মাতৃভাষার আকর্ষণ বেশি, মাতৃভাষার মর্যাদা অতুলনীয় অনুপম। যে কারো কাছে মাতৃভাষাই শ্রেষ্ঠ এবং মাতৃভাষা চির অহঙ্কার ও গৌরবের। লাল সবুজের বাংলাদেশে আমাদের মাতৃভাষা বাংলাভাষা। প্রখ্যাত ভাষা বিজ্ঞানী মুনীর চৌধুরীকে সম্ভবত কেউ জিজ্ঞাসা করেছিলেন তাঁর মাতৃভাষা কী? তিনি তখন একটি অত্যাশ্চর্য উত্তর দিয়েছিলেন :
‘‘আমার মাতৃভাষা কী? বাংলাভাষা। সমগ্র বাংলাভাষা। বিচিত্র রূপিনী বাংলাভাষা। অভিধানে আছে ষোড়শ রমণী মাতৃ সম্বোধনীযোগ্যা। শ্মশ্রু থেকে তনয়া, গর্ভধারিণী থেকে পিতৃরমণী। ষোল নয়, আমার মাতৃভাষার ষোলশত রূপ। তারা সব পদ্মিনীর সহচরী। আমার মাতৃভাষা তিব্বতের গুহাচারী, মনসার দর্পচূর্ণকারী, আরাকানের রাজসভার মণিময় অলঙ্কার, বরেন্দ্রভূমির বাউলের উদাস আহ্বান, মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ইসলাম আমার মাতৃভাষা। আমার মাতৃভাষা বাংলাভাষা’’।
বিশ্বখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্হ-এর মতে, পৃথিবীতে ২৭৯৬টি ভাষা প্রচলিত আছে। তবে ভাষার প্রকৃত পরিসংখ্যান আজও নির্ণীত হয়নি। মাতৃভাষার প্রতি মানুষের সংরাগ চিরকালীন। বর্ণিল পৃথিবীকে আরো স্বাপ্নিক ও আলোকিত করতে বাংলাভাষার প্রতি আমাদের মমত্ববোধ যে কোন ভাষার চেয়ে বোধ করি বেশি। দেশমাতৃকার জন্য আত্মত্যাগ ও প্রাণোৎসর্গের ঘটনা জানা থাকলেও কোন জাতি তার মাতৃভাষার জন্য জীবনকে বিসর্জন দিয়ে শাহাদাতের মর্যাদা নিয়েছে এমন নজীর ইতিহাসে বে-নজীর। জাগতিক উৎকর্ষ ও নানাবিধ ব্যক্তি মোহের প্রতি কোনরূপ ভ্রুক্ষেপ না করে বাঙালি জাতি মাতৃভাষা চর্চার গুরুত্বকে অনুধাবন করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাভাষার জন্য প্রাণোৎসর্গ করেছিল। সেদিন ঢাকার পিচঢালা পথকে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রঞ্জিত করেছিল শহীদী চেতনায় উজ্জীবিত সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারের মত নাম না জানা আরো অনেক ভাষাসৈনিক। ভাষা আন্দোলন করে নিজের প্রাণকে বিলিয়ে দিয়ে তারা মাতৃভাষা বাংলাভাষার নাম বিশ্ব ইতিহাসে রক্তে লিখে গেলেন। রক্তের বন্যায় সেদিন ভাষার বিজয়কে ছিনিয়ে এনেছিল বাংলাদেশের ভাষা সৈনিকগণ। এ বিজয় আত্মত্যাগের, এ বিজয় গৌরবের। ভাষার লড়াইয়ে তাদের আত্মোৎসর্গ আজ বিশ্ববাসীর কাছে মর্যাদায় আসীন। ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদের ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে বাঙালি জাতির এ ব্যতিক্রমী ভাষার লড়াইয়ে অভূতপূর্ব বিজয়কে স্মৃতিবহ করে রাখতে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা’ দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ইউনেস্কোর কল্যাণে গোটা জাতি এখন বাংলাভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং বাঙালি জাতির ভাষা শহীদদের প্রতি মাথা অবনতশীল। ২১ ফেব্রুয়ারি সম্মান লাভ করেছে, বিশ্বে বাংলাভাষার মর্যাদাও উন্নীত হয়েছে। এ গৌরব মাতৃভাষা বাংলার, এ গৌরব বাঙালি জাতির। উল্লেখ্য, বাংলা শুধু বাংলাদেশের নয়, বিহার প্রদেশের পূর্ণায়া জেলার পূর্বাংশ, রাঁচি, হাজারিবাগ, সাঁওতাল পরগনা, সিংহভূম ও মানভূমের ভাষাও বাংলা। আসাম প্রদেশের করিমগঞ্জ, কাছাড় ও গোয়ালপাড়া জেলার ভাষা বাংলা। বার্মার আরাকানের চলিত ভাষা বাংলা। এ ভাষাভাষীর সংখ্যা হিসেবে বাংলা পৃথিবীর সপ্তম স্থানে রয়েছে।
ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। অপরিসীম গুরুত্বের সাথে মাতৃভাষাকে স্মরণ করে ইসলাম। মাতৃভাষা শিক্ষা ও বিকাশে ইসলামের রয়েছে অকুণ্ঠ সমর্থন। আল্লাহ তাআলা নবী-রাসূলদের কাছে যুগে যুগে যেসব আসমানী কিতাব প্রেরণ করেছেন, তা তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ বলেন :
‘আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার জাতির লোকদের মাতৃভাষাতেই প্রেরণ করেছি।
যেমন হযরত দাউদ (আ) এর কাছে যাবুর কিতাব তার মাতৃভাষা ইউনানী বা (আরামাইক) ভাষায়, মুসা (আ) এর কাছে তাওরাত ইবরানী বা হিব্রু ভাষায়। এটাও তার মাতৃভাষা। এভাবে ইসা (আ) এর কাছে তার মাতৃভাষা সুরিয়ানি বা সিরিয়ার ভাষায় ইনজিল কিতাব ও মুহাম্মদ (সা) এর কাছে মাতৃভাষা আরবী ভাষায় আলকুরআন প্রেরণ করা হয়। এসব আসমানী কিতাব যদি মাতৃভাষায় নাযিল না করতেন তবে এগুলো নাযিলের উদ্দেশ্য ব্যাহত হতো। হিদায়াত ও অনুধাবনের পরিবর্তে চরম শ্রদ্ধাভরে বুকসেলফে সাজানো ছাড়া আর কোন লাভ হতো না। কেননা এসব আসমানী কিতাব নাযিলের মৌল উদ্দেশ্য হচ্ছে পুণ্য হাসিলের জন্য এর মর্ম অনুধাবন করা। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে এর আলোকে জীবনব্যবস্থা কায়েম করা। কুরআনে এসেছে :
‘আর যদি আমি কুরআন অনারবদের ভাষায় নাযিল করতাম তবে তারা অবশ্যই বলত-এর আয়াতসমূহ বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয়নি কেন? এ কেমন কথা, অনারবী কিতাব এবং আরবীভাষী রাসূল! আপনি বলুন- এ কুরআন মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও ব্যাধির প্রতিকারস্বরূপ। কিন্তু যারা ঈমান আনে না তাদের কাছে রয়েছে বধিরতা এবং কুরআন তাদের জন্য অন্ধত্বস্বরূপ।
আল্লাহ অন্য একটি আয়াতে বলেন :
‘আমি তো কুরআন আরবীতে নাযিল করেছি এ জন্যে যে, তোমরা তা বুঝবে’।
যদি আল্লাহ তাআলা এভাবে নবী-রাসূলদের কাছে নিজ নিজ মাতৃভাষার মাধ্যমে কিতাব প্রেরণ না করতেন তবে দেশবাসী আসমানী কিতাবের হিদায়াত ও কল্যাণ লাভে বঞ্চিত হতো। দেশবাসী না বুঝে প্রত্যাখ্যান করতো, সাদরে গ্রহণ না করে উদ্ভট আচরণ করে নাফরমানের শামিল হতো। হাদীস থেকে জানা যায় যে, ইসলাম শুধু মাতৃভাষা নয় মাতৃভাষার আঞ্চলিক বা উপ-ভাষাও সমর্থন করে। কেননা উপ-ভাষায় মূল ভাষার ব্যত্যয় ঘটে না। রাসূল (সা) বলেন :
‘কুরআন সাতটি উপ-ভাষায় নাযিল হয়েছে’।
উপ-ভাষার মাধ্যমে কুরআন নাযিলের ঘটনা মাতৃভাষার চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং মাতৃভাষার প্রতি ইসলামের সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। রাসূল (সা) এর মাতৃভাষা ছিল আরবী। তিনি মাতৃভাষা বিশুদ্ধভাবে শিক্ষা ও চর্চার প্রতি গুরুত্বারোপ করতেন। তিনি নিজে বলতেন :
‘আনা আসাহহু মিনাল আরাব’ আমি আরবদের মাঝে সর্বাধিক বিশুদ্ধ ভাষাভাষী।
ইমাম আবু হানিফা (রা) মাতৃভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তার দেশবাসীর জন্য মাতৃভাষা ফারসি ভাষায় আলকুরআন অনুবাদ করার ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং তা নামাযে তিলাওয়াতের অভিমত প্রদান করেন। অবশ্য এই অভিমত তিনি বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের স্বার্থে প্রত্যাহার করে নেন। এ ঘটনায়ও ইসলামে মাতৃভাষা মূল্যায়নের প্রমাণ মেলে। এ ছাড়া মনের আকাক্সক্ষা কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে নিবেদন করতে হলেও মাতৃভাষা ব্যতীত সম্ভব হয় না। কেননা মাতৃভাষার মাধ্যমে মনের অভিব্যক্তি যেভাবে প্রকাশ করা যায়। অন্যভাষায় তা কোনভাবেই সম্ভব হয় না। মনের আকুতি প্রকাশ করে বিনতি পূর্বক প্রার্থনায় মন ও আত্মার মাঝে এক স্বর্গীয় অনুভূতি তৈরি হয়। বান্দার আর্তি আল্লাহর কাছে কবুল হওয়া না হওয়ার দোলায় দুলেও মাতৃভাষায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে পেরে সাময়িক জাগতিক শান্তির ছোঁয়া পায়। বঙ্গবাণী কবিতায় আবদুল হাকিম তাই যথার্থই বলেছেন :
‘যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ,
সেই বাক্য বুঝে প্রভূ আগে নিরঞ্জন’।
অনুরূপ স্বদেশী ভাষা কবিতায় রামনিধিগুপ্ত বলেছেন :
‘নানান দেশের নানান ভাষা,
বিনে স্বদেশীভাষা মিটে কী আশা’।
মাতৃভাষা মূলত মহান আল্লাহর দেয়া অপূর্ব নেয়ামতের অংশ। এই অপার নেয়ামতকে সার্থক করতে হলে মাতৃভাষাকে আমাদের জাগতিক ও পারত্রিক কল্যাণে কাজে লাগাতে হবে। মাতৃভাষার চর্চা ও গবেষণায় লেখক, গবেষক, কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের লেখা-লেখি ও জ্ঞান গবেষণায় মাতৃভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাঠ্য-পুস্তক, ইসলামী সাহিত্য ও কুরআন হাদীস বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে মাতৃভাষার ব্যাপক প্রচার-প্রসারে এগিয়ে আসতে হবে। ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্টিং মিডিয়াগুলোতে বিদগ্ধ ইসলামী স্কলারদের দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। ভাষা আন্দোলন ও ২১ ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে আলিমদের মূল্যায়ন ও অবস্থান আরো স্পষ্ট করতে হবে। কওমী মাদ্রাসায় শিক্ষিত আলিমদের বাংলা ভাষাচর্চার অনাগ্রহ দূর করতে ক্রিয়াশীল ভূমিকা নিতে হবে। বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও ভাষা আন্দোলনের গৌরবদীপ্ত ইতিহাস লালিত ভাষার উৎকর্ষ ও উন্নয়নের শপথ নিতে হবে। ২১ ফেব্রুয়ারি শুধু ভাষা শহীদদের মাজারে ফুল দেয়ার বিনিময়ে দায়িত্ব কর্তব্যের সমাপ্তি না টেনে তাদের আত্মত্যাগ ও প্রাণোৎসর্গের চেতনাকে ব্যক্তি সমাজ ও জাতীয় জীবনে দেশ গড়ার কাজে লাগাতে হবে। একটি অপ্রিয় সত্য কথার দাবি বাস্তবায়নের তীব্র আকাক্সক্ষা নিয়ে লেখার ইতি টানছি। আমরা বাংলা ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি কি ভাষা দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি পালন করার জন্য না ৮ ফাল্গুনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য?
Facebook Comments Sync