বনমানবী / সাহানা শিমু

বনমানবী / সাহানা শিমু

বনমানবী / সাহানা শিমু

বনমানবী / সাহানা শিমু

                                                         

    ট্রেন শ্রীমঙ্গলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা পড়ে গেলো। শেষ হেমন্তের বিকেল, হিমেল ঠান্ডা বাতাস। ভাড়া গাড়িতে উঠে বসল ওরা দুজন। রাস্তার বাতিগুলো যেন এখনও পূর্ণতা নিয়ে আলো ছড়াতে শুরু করেনি। টিমটিম করে জ্বলছে। পাতলা মিহি কুয়াশার চাদরে ঘিরে আছে চারদিক। ধূপছায়া মোহময় আলো কেটে কেটে গাড়ি এগিয়ে চলছে, জানালার গ্লাস নামানো। একটার পর একটা দৃশ্য খুব দ্রুততার সাথে পাল্টে যেতে থাকে। মিতিল জড়োসড়ো হয়ে বসে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে জানালার দিকে। ফয়সাল কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করল,

       মিতিল তোমার ঠান্ডা লাগছে? 

  মিতিল কথা না বলে,মাথা নাড়িয়ে ‘না’ জানিয়ে দিলো। 

   স্টেশন থেকে গ্রামটি খুব বেশি দূরে নয়। ট্রেন ঘন্টা দুই পরে ছেড়েছে। না হলে দিনে দিনে পৌঁছাতে পারতো। বরাবর ঢাকা শহরে থাকা মেয়েটি গ্রাম এলাকায় নতুন জায়গায় দিনের আলোতে সব দেখে শুনে নিলে হয়তো তেমন খারাপ লাগত না। বরং পছন্দ হবার মতোনই গ্রামটি। ফয়সালের চাকরির বয়স দু’বছরের কিছু বেশি। প্রত্যন্ত গ্রামে সাইট অফিসে প্রথম পোস্টিং। ফয়সাল অবশ্য এবার মিতিলকে সাথে আনতে চায়নি। গ্রামের মাঝে সারাদিন একা একা থাকতে হবে। ঢাকায় হেডঅফিসে বদলির চেষ্টা করছে। হয়তো মাস কয়েকের মধ্যে হয়ে যেতে পারে। আবার বছরও গড়াতে পারে। কিন্তু মিতিলের আগ্রহের কারণেই নিয়ে আসতে হলো। তবে বৌ ওকে ভালোবেসে ওর সাথে থাকতে চায়, ফয়সালের ভাবতেই ভালো লাগে। তাছাড়া দারোয়ান সুমন বলছিলো ওর ছোট মেয়ে সেতু ঘরদোর পরিষ্কার, রান্নাসহ সব কাজ করতে পারবে এবং সারাদিন মেমসাহেবের সাথে কাটাবে। এতেই সাহসে ভর করে মিতিলকে সাথে নিয়ে আসা। 

 

   ধীরে ধীরে গাড়ি গ্রামে প্রবেশ করল। মিতিল জানালা দিয়ে পথের পাশের প্রতি মুহূর্তের পরিবর্তিত দৃশ্য দেখছিল।

     হঠাৎ হঠাৎই আশেপাশের জায়গাটা মিতিলের খুব পরিচিত মনে হতে থাকে। বুঝতে পারে না কেন এমন মনে হচ্ছে, যেন এপথে সে বহুবার চলেছে। পথের ধারের সকল কিছুই ওর অনেক বারের দেখা। সব কিছুকে আপন লাগছে। মিতিলের জন্ম ঢাকায় সেখানেই বেড়ে উঠা এবং পড়াশুনা। তারপরই তো বিয়ে। দাদা বাড়ি জামালপুর ছাড়া ঢাকার বাইরে কোথাও কখনও যাওয়া হয় নাই। বিষয়টা ফয়সালের সাথে শেয়ার করতে যেয়ে আবার কি ভেবে চুপ করে থাকে। 

   

    সুমন আর তার মেয়ে সেতু খাবার রান্না করে,ঘর বাড়ি গুছিয়ে অপেক্ষা করছিলো। ফয়সালদের গাড়ির হর্ণ শুনে ওরা দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। গাড়ি থামতেই মিতিল স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নেমে বাসার ভেতরে প্রবেশ করল। যেন নিজের জায়গায় নিজে ফিরে এসেছে। ফয়সাল কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলেও কিছুই বলল না। রাতের খাবার খাওয়ার পর সব গোছগাছ করে বাবা মেয়ে নিজেদের বাড়ি ফিরে গেলো। 

 

 পরদিন সুমন সেতুকে মিতিলের কাছে পৌঁছে দিয়ে ফয়সালের সাথেই অফিস গেলো। সেতুকে পেয়ে মিতিল খুব খুশি। বলল,

       সেতু, আমি একটু গ্রামটা ঘুরে দেখে আসি। তুমি রান্না শেষ করো, তারপর একসাথে খাব, ক্যামন!

       তুমি কুনু চিনোনি, হারায়ে যাবা। তুমি খাড়াইয়া থাকু, রান্না শেষে একলগত যাই চলো। 

       

  মিতিল সেতুর কথা না শুনে বেরিয়ে পরে, গ্রামটা যেন ওকে ডাকছে। এলাকার পর এলাকা সবুজ ধান ক্ষেত, ক্ষেতের আল পথে হেঁটে যায় সে। খাল,বিল,হাওড় নয়ন জুড়ানো দৃশ্য। কিছু দূরে উঁচু পাহাড়। পাহাড়ের গা ঘেসে এলাকার পর এলাকা চা বাগান। সবই মিতিলের কতো চেনা। কোন পথ কোথায় মিশেছে,কোন পথে নদী, কোন পথে গভীর জংগল সবই মিতিলের জানা। চেনা পথে হেঁটে, বেড়িয়ে কিছু জংলী ফল, ফুল নিয়ে ঘর ফেরে। মিতিল আর সেঁতু দুজনে মিলে একসাথে খায়। সেতু বলেছিলো, 

   ‘তুমি খাই লও, মুই ফরে খাইউম।’  

   শোনেনি মিতিল। অগত্যা দুজনে একসাথে খেয়ে নিয়ে গল্প শুরু করে। মিতিল বিছানায় কাত হয়ে শোয়।সেতু মুখোমুখি মেঝেতে। কতো গল্প যেন দুই সই। কথক সেতু, মিতিল শ্রোতা। 

  

   ফয়সাল অফিসে যাবার পর প্রতিদিনকার রুটিন মতো মিতিল বেরিয়ে পড়ে। সেতু যেতে না করে, সাপের ভয় দেখায়। বন্য জীব জন্তুর ভয়াবহতার কথা বলে। আটকাতে পারে না মিতিলকে। প্রায় সারাদিন চষে বেড়ায় গ্রামটি। একেকদিন একেক দিকে চলে যায়। কি যেন খোঁজে! কি খোঁজে মিতিল নিজেই বুঝতে পারে না। 

তবে দিন দিন মিতিলের ফিরে আসার সময় পিছাতে থাকে। দুপুর পার করে ফেরে, তাড়াতাড়ি করে গা ধুয়ে খেতে বসে। খাওয়া শেষে রোজকার গল্প। সেতু ওদের এলাকার প্রচলিত গল্পগুলো শোনায়। যা বংশ পরম্পরায় শুনে আসছে ওরা। দাদী,নানীর কাছ থেকে বা লোক মুখে। সব গল্প মিতিলের ভালো লাগলেও ফুলমতির গল্পটা বেশি শুনতে চায়। সেতুও আনন্দ বেদনার সূতো দিয়ে গেঁথে যায় ফুলমতির দুঃখগাঁথা। বারবার শুনেও মিতিলের যেন আঁশ মেটে না। আবার শুনতে চায় ফুলমতির গল্পটি। 

      থুমি ফুলমথির গলফত খি মজা পাইছুন! এখোই গলফ কিতলাবার শুনিথে চাও! 

   মিতিল উত্তর দেয় না। চোখ বন্ধ করে চুপ করে শুয়ে থাকে। অগত্যা সেতু ফুলমতির গল্পই আবার শুরু করে।

 

   সন্ধ্যার আগে আগে উঠে পড়ে সেতু। রাতের খাবার গরম করে টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে বাড়ির পথ ধরে। মিতিল এসময়টা একা একা বারান্দায় বসে সূর্য ডোবা দেখে। খুব ইচ্ছে করে আগের মতো খোলা ধান ক্ষেতে যেয়ে সূর্য ডোবা দেখতে। গ্রামটি ডাকে, খুব ডাকে। মন চায় ছুটে বেরিয়ে পড়তে। কিন্তু নিজেকে সংবরণ করে মিতিল,

     ‘না বেলা পড়ে গেছে,ফয়সাল অফিস থেকে ফিরবার সময় হয়ে আসছে। এখন বাইরে থাকলে ফয়সাল রাগ করতে পারে।’

 

   ফয়সাল সাইট অফিসে সকলের সাথে দুপুরের খাবার খেয়ে নেয়। ফেরে সন্ধ্যা শেষ করে, রাতের খাবার দু’জনে একসাথে খায়। শ্রীমঙ্গলে আসার প্রথমদিন থেকেই মিতিলের আচরণ ফয়সালের অন্যরকম লেগেছে। ওদের বিয়ের বয়স পাঁচ মাস, এই কয়দিনে মিতিলকে যতটুকু চিনেছিলো,সেইটুকুও অচেনা লাগছে। এখন মিতিলকে স্পর্শ করলে ফয়সালের মধ্যে কোন আবেগ তৈরি হয় না, বরঞ্চ মিতিলকে ধাতব, জড় কিছু মনে হয়। কেন এমন হচ্ছে বোঝে না ফয়সাল। বিষয়টা ভাবায় ফয়সালকে।

      খুব তাড়াতাড়ি মিতিলকে ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে, ভালো কোন ডাক্তারের সাথে কথা বলতে হবে, মনের ডাক্তার। মাত্র ছুটি কাটিয়ে ফিরলো। অফিস থেকে কি এতো তাড়াতাড়ি আবার ছুটি পাওয়া যাবে! তবে সেতু সারাদিন মিতিলের সাথে আছে এটা ভেবে আসস্ত করে নিজেকে। 

                                                       দুই

 

   ফয়সাল অফিসে চলে যাবার পরপরই মিতিল বের হবার প্রস্তুতি নেয়। এই চার দেয়ালের মাঝে দম বন্ধ লাগে। কে যেন ওকে ডাকে। খোলা মাঠ,ধানক্ষেত,জঙ্গল,পাহাড়ীপথ, ঝর্না ওকে প্রবলভাবে ডাকে। এ ডাক অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা মিতিলের নেই। মিতিলের আজকের বিশেষ প্রস্তুতি সেতুর চোখ এড়ায় না,

      থুমি ফ্রতিদিন বাইরাও খেনো! এথো বাহির হওয়া বালা না। গরত থাকো। গরে থাকিলে,গরের কাম কাইজ করিলে মন বালা থাকিবে। গরত মন বসিবে, সংসারে মায়া পরিবে।

     সেতুর কথা মিতিলের ভাবনায় একটুও দাগ কাটতে পারে না। আপন মনে নিজেকে তৈরি করতে থাকে। উপায়ান্তর না দেখে সেতু আবার শুরু করে,

     থুমি এতলাই দেরি করি গরত ফিরিলে আমি বোরো স্যারের লগে মাতিবো। বোরো স্যারে থুমারে দেখিবার লাগি আমারে তুমার লগত তাকথে বলছুইন…

সেতু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো, থামিয়ে দিয়ে শুরু করল মিতিল,

     আচ্ছা আচ্ছা বড় স্যারকে কিছু বলা লাগবে না,আমি আজ তাড়াতাড়ি চলে আসব। হলো! তুমি রান্না শেষ কর, এসে খাব। 

 

    সেতুকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে জংগলের পথে মিতিল। অনেকক্ষণ যাবৎ হাঁটছে, খুব ক্লান্ত লাগছে, না থেমে হাঁটার গতি আরও বাড়িয়ে দেয়। হাঁটতে হাঁটতে গভীর জংগলের কাছে চলে আসে। মনে হয় কতো শত বছর এই পথে কোন লোক চলাচল করেনি। গাছপালাগুলো গায়ে গায়ে লেগে বেড়ে উঠেছে, হাঁটার পথটাও নেই। মিতিল পথ তৈরি করে করে এগিয়ে যাচ্ছে। বন ধীরে ধীরে আরও ঘন হয়ে উঠছে। তবুও মিতিল থামছে না খুঁজেই চলেছে। নিশি পাওয়া, ঘোর লাগা মানুষের মতোন। হঠাৎ দেখা পায় বিশাল আকৃতির জোড়া বট পাকুড়ের। ঘন জংগলের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে চারদিকে শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে। অসংখ্য গুড়ি নেমে কান্ডের মতোন মাটিতে গেড়ে বসেছে। গাছের নিচটায় দিনের বেলাও বেশ অন্ধকার। মিতিল গাছের নিচে বসে পড়ে, হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা আওয়াজ হতে থাকে। মিতিলের কন্ঠে কে যেন বহু দূর থেকে কথা বলে উঠে। কিন্তু মিতিল চমকায় না, যেন তাই হবার কথা ছিল,যা হচ্ছে।  

      এসেছ মিতিল! অনেক কষ্ট সয়ে, কতো পথ পাড়ি দিয়ে এসেছ। আমি জানতাম তুমি আসবে। তোমাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ, আধখানা। তোমার মাঝেই আমার পূর্ণতা। 

   সারা মন প্রাণ দিয়ে শুনলো মিতিল। তারপর ধীর স্বরে বলল,

      তোমার কষ্টের কথা শুনবো বলেই সব বাঁধা পেরিয়ে তোমার কাছে ছুটে এসেছি ফুলমতি। বলো ফুলমতি বলো তোমার সকল যন্ত্রণার কথা,বেদনার কথা আমাকে বলো। 

      আমার দুঃখের কথা কি বলব মিতিল! বাবার আদরের একমাত্র মেয়ে ছিলাম। দেখতে ছিলাম তোমার মতোই, ঠিক যেন পরী। গ্রাম দেশের মেয়ে তাই ছোট বয়সে বিয়ে ঠিক হলো পাশের গ্রামের আইনাল শেখের ছেলে জয়নাল শেখের সাথে। বাবা খুব ঘটা করে আমার বিয়ের আয়োজন করেন। আমাদের আশেপাশের গ্রামের মানুষ এমন বিয়ে দেখেনি। বিয়ে উপলক্ষে রাতভর চলল খাওয়া-দাওয়া,গান-বাজনা। খুব আনন্দ ফূর্তি করল গ্রামবাসী। সবই হলো কিন্তু বাবা কিছু ক্যাশ টাকা দিতে চেয়েছিলেন ছেলেপক্ষকে সেটায় টান পড়ল। এত জাঁকজমক আয়োজনের বিয়ের অনুষ্ঠানের পর বাবার হাতে তেমন টাকা অবশিষ্ট থাকেনি। বিয়ের আসরে টাকা দিতে পারে নাই। কথা দিয়েছিল অগ্রাহায়ণে ধান তুলে টাকা দিয়ে দিবে। বরপক্ষ তাতে রাজিও হয়। কিন্তু সেবার যে মরার বন্যা হলো ফসল দুই মাস পানির তলায় রইল, আর মাথা তুলতে পারলো না। বাবার হাতে টাকা নেই, গ্রামের কারো কাছে যে টাকা ধার নেবে কারও সেই অবস্থাও নেই। শ্বশুরবাড়ির লোকেরা টাকা না দেবার বিষয়টা কিছুতেই মানতে পারছিল না। তারা আমার উপর অত্যাচার শুরু করে। তারা বলে বাবার কাছ থেকে যৌতুকের টাকা নিয়ে আসতে। কিন্তু আমি তো জানি বাবার হাতে এখন টাকা নেই, টাকা থাকলে কারও বলা লাগত না। বাবা নিজে এসে টাকা দিয়ে যেতো। যত দিন যেতে থাকে অত্যাচারের মাত্রাও তত বাড়তে থাকে। যাতে আমি বাপের বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে এসে এদেরকেও দেই। কিন্তু আমি মুখ বুজে পড়ে পড়ে মার খাই। তবুও বাবা মাকে কিছু জানাই না। বিয়ের পর প্রথমদিকে স্বামী ভালোই ছিল, তেমন কিছু বলতো না। শ্বশুর আর শ্বাশুড়ীর মন্ত্রণায় কিছুদিনের মধ্যে সেও পাল্টে গেলো। উঠতে বসতে কথা শোনাতো, মারধর করতো। বিয়ের পাঁচ মাসের মাথায় ওরা আমাকে পিটাতে পিটাতে মেরে এই বট গাছের সাথে ঝুলিয়ে রেখে বলে আমি নাকি আত্মহত্যা করেছি। 

       ফুলমতি আমি তোমার কিছু কথা শুনেছি গ্রামের মানুষের কাছে। তারা শুনেছে তাদের পূর্ব পুরুষের কাছ থেকে।

   ফুলমতি বলে যেতে থাকে,

       আমি ফিরে যেতে পারিনি। থেকে গেছি এই গ্রামেই। হাওড়ে, বনবাদাড়ে, পাহাড়ে, নদীর ধারে, বট-পাকুড়ের জংগলে। বাবা কেস করেন। আমার স্বামী শ্বশুরের ফাঁসির রায় হয়। যেদিন তাদের রায় কার্যকর হয়, সেদিন আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। তবুও একটা অতৃপ্তি থেকে গিয়েছিলো। তোমাকে দেখার, কাছে পাবার, তুমি কেমন আছ জানবার। আজ তোমাকে পেয়ে আত্মাটা শান্তিতে ভরে উঠেছে। তোমার স্বামী তোমায় অনেক ভালোবাসে এটাই আমার পরম শান্তি। তুমি আমি তো আলাদা কিছু ছিলাম না কখনও। তুমি ফিরে যাও স্বামীর সাথে সুখে সংসার কর। আমিও তৃপ্ত মনে ফিরে যাই….

 

   মিতিল আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। না কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। শুনসান নিরবতা। যে কাজের জন্য এতো আগ্রহ, এতো প্রস্তুতি,এতো দৌড়াদৌড়ি আজ সব শেষ। নির্ভার লাগলেও মনে হচ্ছে বুকের এক পাশটা যেন খালি হয়ে গেলো। যে ছিলো সে আজ নেই। অতি ধীরে উঠে দাঁড়ায় মিতিল। শরীর অবশ লাগছে, হাঁটার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তবুও বাড়ির পথ ধরে।

 

                                                              তিন

  

   দুপুর গড়িয়ে বিকেল। এরপর সূর্য প্রায় ডুবতে বসেছে তবুও মিতিলের দেখা নাই। সেতু তাড়াতাড়ি বাবাকে দিয়ে বড় সাহেবের কাছে খবর পাঠায়। ফয়সাল অফিসের কাজ ফেলে দৌড়ে বাড়ির পথ ধরে। হঠাৎ নজরে আসে, ক্ষেতের আল পথে আলুথালু বেশে, এলোমেলো পায়ে হেঁটে আসছে মিতিল। দৌড়ে মিতিলকে কোলে তুলে নেয়। এভাবেই এনে বিছানায় শুইয়ে দেয়। গায়ে প্রচন্ড জ্বর, আবোল তাবোল বকছে। মাথায় পানি দিয়েও জ্বর নামছে না। ডাক্তার এলো, মিতিলকে দেখে জ্বরের ওষুধ দিয়ে বললেন,

     ভয়ের কিছু নেই, রোদে ঘোরাঘুরির জন্য হঠাৎ জ্বর এসেছে। দুই একটা ডোজ পড়লেই ঠিক হয়ে যাবে। 

   

    মিতিলের জ্বর তেমন কমছে না। তবুও সুমন, সেতুকে বাড়ি যেতে বলে ফয়সাল।

       অনেক রাত হয়ে গিয়েছ, তোমরা বাড়ি যাও। ওষুধ পড়েছে, জ্বর কমে যাবে। আমি সামলে নেবো।

   কেবল দশটা তাতেই মনে হয় গভীর রাত। গ্রামে সন্ধ্যায়ই যেন রাত নেমে যায়। ওরা আরও সময় থাকতে চায়। ফয়সাল রাজি হয় না। অগত্যা ওরা ফিরে যায়। 

   

      যত রাত বাড়ছে মিতিলের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। ডাক্তারের দেয়া ওষুধ আরেক ডোজ খাইয়ে দিল, কিন্তু অবস্থার কোন উন্নতি নাই। মাথায় পানি ঢালছে, গা স্পন্জ করে দিচ্ছে তবুও জ্বর কমছে না। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো রক্ত জবার মতো লাল হয়ে আছে। ধারেকাছে কোন হাসপাতাল নেই, কোন গাড়িও নেই। খুব অসহায় লাগছে, কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না ফয়সাল। মাথায় জলপট্টি দিয়ে যাচ্ছে, জ্বর কমার কোন লক্ষণ নাই। 

 

     ভোররাতের দিকে ফয়সালের একটু ঝিমুনিভাব হচ্ছিল, চোখ বুজে গিয়েছিলো খানিকক্ষণ। হঠাৎ অবাক হয়ে খেয়াল করে,মিতিলের গা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক ঠান্ডা, গুটিশুটি শুয়ে কাঁপছে। ফয়সালের ঘুম ঘুম ভাব পুরাপুরি ছুটে যায়। বাসায় যতগুলো লেপ কাঁথা ছিল সব এনে মিতিলের গায়ে দিয়ে নিজে মিতিলকে জাপটে চেপে ধরে রাখে। তাতেও মিতিল তিঁর তিঁর করে কাঁপছিলো। ফয়সাল মিতিলকে আরও জোড়ে জাপটে ধরে রাখে। ক্লান্তিতে একসময় ফয়সাল এভাবেই ঘুমিয়ে পড়ে। 

 

   মিতিলের ডাকে ফয়সাল ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়ে,

       আমার গরম লাগছে, গায়ে এতো লেপ কাঁথা দিয়েছ কেন!

 মিতিল খুব স্বাভাবিক গলায় কথা বলছে। যেন কিছুই হয়নি। সারারাত এতো জ্বরে ভোগার কোন ক্লান্তি নেই। বিছানা থেকে নেমে বারান্দার চেয়ারে বসল। ফয়সালও বারান্দায় এলো। ভোর হয়েছে, তবে আলো পুরোপুরি ফোটেনি। সাথে ঘন কুয়াশা, মায়াময় এক পরিবেশ। উপভোগ করার মতো ঠান্ডা। ফয়সাল মিতিলের কাছে বসে ওর হাত দু’টো নিজের হাতে নিল। মিতিল আরও কাছে এসে ফয়সালের বুকে মাথা রাখল। ফয়সাল দু’হাতে মিতিলকে জড়িয়ে ধরে আদর করছে। মিতিল ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বলতে যেয়ে পারলো না, ফয়সালের ভালোবাসায় নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলল। 

  হঠাৎ ফয়সাল খেয়াল করল, মিতিলকে আর ধাতব জড় লাগছে না। সেই প্রথমদিন মিতিলকে ছুঁয়ে যেভাবে রোমাঞ্চিত হয়েছিল,আজও তেমনি।

সাহানা শিমু
সাহানা শিমু
%d bloggers like this: