চন্দনের গন্ধ (পর্ব ২)/ আফরোজা অদিতি

আফরোজা অদিতি

আফরোজা অদিতি

 

পর্ব ২

 

ওরা বেড়াতে বের হয়।

নির্দিষ্ট কোন জায়গা নেই। ‘কোথায় যাবে বল?’ ঘর থেকে বের হতে হতে বলে তিমির। তিসু

বলল, ‘চলো যাই কোথাও! পাবলিক লাইব্রেরীতেও যাওয়া যেতে পারে।’ ‘ঠিক আছে চল।’ মায়ের  ঘরে গিয়ে মাকে বলে ওরা বেরিয়ে যায়। পাবলিক লাইব্রেরীর সিঁড়িতে বসে থাকে কিছুক্ষণ;

গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। হলরূমের ভেতর থেকে কথা ভেসে আসছে। কোন অনুষ্ঠান হচ্ছে মনে হয়। ওরা কথা বলছে , সামনে এসে দাঁড়ায় তিসুর ক্লাসমেট, ওর সঙ্গে ওর বান্ধবী।

 ‘আরে তিসমিয়া যে, কী করছো?’ বলে ছেলেটি। ছেলেটির কথার উত্তরে বলে, ‘বসে আছি।’

ছেলেটির নাম রোকন আর মেয়েটি রোকসানা। ওদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় তিমিরের। ওরা কিছুক্ষণ কথা বলে চলে যায়। তিসু আর তিমির হলরূমে ঢুকে যায়। কিছুক্ষণ কবিতা-গান শুনে বাইরে এসে ক্যান্টিনে ঢুকে চা আর সিঙাড়া খেয়ে আবার বাড়ির পথ ধরে। রিকশা করে যেতে চায় তিসু; ওর কথায় রিকশা নেয় তিমির। রিকশা আসতে আসতে তিসু আবার গন্ধটা পায়;

গন্ধের সঙ্গে বাঁশীর সুর! মন বিবশ হয়ে যাচ্ছে; অন্যমনস্ক তিসু; কিছুক্ষণ পর তিমিরের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায়। অবাক হয় তিমির! কিন্তু ডেকেও জাগাতে পারে না! বাসার কাছকাছি এসে হঠাৎই যেমন ঘুমিয়ে পড়েছিল তেমনি জেগে ওঠে।

পরদিন সকাল বেলা।

তিসু ইউনিভার্সিটি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। আজ নয়ন যাবে না। প্রতিদিন দুজনে একসঙ্গে ইউনিভার্সিটি যায়। একই ক্লাস একই বিষয়ে লেখাপড়া করে। অসুবিধা হয় না যাওয়া-আসায়। আগামীকাল নয়নের জন্য পাত্রপক্ষ আসবে তাই নয়ন যাবে না। শাশুড়ি বলেছে

আজ বের হতে নেই। তিসু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়িয়ে ক্লিপ লাগাচ্ছিল।

আয়নায় শাশুড়ির ছায়া দেখে ঘুরে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে, ‘কিছু বলবেন মা?’

‘তুমি ভার্সিটি যাচ্ছো মা?’

‘জী, মা। কিছু বলবেন।’

‘কাল তো নয়নকে আশির্বাদ করতে আসবে মা, তাই কিছু কেনাকাটা করার দরকার ছিল।

ভাবছিলাম কেনাকাটা শেষ করে রাখলে ভালো হতো। নয়নকে বললাম, নয়ন যাবে না, মাথা ধরেছে। আর বড়োবউ ওর মাকে দেখতে যাবে। ওর মায়ের শরীরটা খারাপ। তুমি যদি যেতে তাহলে ভালো হতো।’

তিসু বাধ্য মেয়ের মতো শাশুড়ির কথাগুলো শুনে বললো, ‘ঠিক আছে মা, কখন যাবেন?’

‘বিকেলে।’

‘আমি তার আগেই ফিরে আসবো মা।’

তিসুর একমাত্র ননদ নয়ন। বাবা-মায়ের প্রিয় মেয়ে, ভাইদের সুপ্রিয় বোন। আর তিসুর প্রাণপ্রিয় সখি। দুধে-আলতা রঙ। দেখতে সুন্দর তবে মাথায় চুল নেই বলে বব করে রেখেছে।

রোগা পাতলা গড়নের মেয়ে বব-কাটে ভালোই লাগে, বব-কাট চুল যেন ওর মুখে মিষ্টতা এনে দিয়েছে বেশি। শ্বশুর মশাই রিটায়ার্ড। এমনিতেই বেশিরভাগ মানুষের ধারণা বাবা রিটায়ার্ড করলে অবিবাহিত মেয়ের পছন্দসই পাত্র আসে না! শ্বশুর মশাই-শাশুড়ি মা তাই বিশ্বাস করেন। এই জন্য এই পাত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে পাকা করে ফেলেছে। কয়েকদিন আগে খাবার টেবিলে তিসুর শ্বশুর তিসুকে ডেকে বলছিল, ‘বুঝলে না মা, আমার তো দিন শেষ; এখন তো এক পা কবরে

তাই…।’একটু- ক্ষণ চুপ থেকে বলেছিল, ‘তাছাড়া এই তো শেষ কাজ…।’ কথাটা তিনি আর শেষ করতে পারেননি। কাশতে কাশতে বুক চেপে শুতে চলে গিয়েছিলেন।

তিসু ইউনিভার্সিটি যেতে যেতে ভাবছে আজ আবার একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। আগামীকাল বের হতে পারবে না। লোকজন আসবে! তাছাড়া আজ আবার মার্কেটে যেতে হবে। ইদানিং বাসায় ফিরতে ইচ্ছা করে না তিসুর! নয়নকে ছাড়া বাড়ির কাউকে সহ্য করতে পারে না তিসু! এই বাড়ির মানুষগুলো যে খারাপ তা নয়; ওরা যথেষ্ট আদর করে ওকে! শ্বশুর তো বউমা বলতে ওকেই বুঝেন। মা ছাড়া কথা বলেন না শাশুড়ি। তিসু এ-বাড়ির বড়ো বউ নয় তবুও বড়ো বউয়ের সম্মান দেয় সকলে। সব কাজেই পরামর্শ নেয়, মতামত নেয় তিসুর। এই বাড়িতে ননদ ছাড়াও ভালো লাগে বিপুলকে। বিপুল, ওর ভাসুরের ছেলে। বিপুলের মা, রায়না বড়োলোক বাবার একমাত্র মেয়ে! ছেলেকে কাছে রাখতে চায় না। তাছাড়া ভাসুর ব্যবসার খাতিরে এখানে ওখানে যাওয়ায় এই বাড়িতে আর থাকা হয়ে ওঠে না রায়নার। রায়না নিজেও থাকতে চায় না। রায়নাকে

দেখে মনে হয়, ও যেন এ বাড়ির কেউ নয়! কোনো যোগাযোগ যেন নেই এ বাড়ির সঙ্গে। আর শ্বশুর-শাশুড়িও সব কাজকর্মে রায়নাকে না

ডেকে ডাকে ওকেই।পরামর্শ করে ওর সঙ্গে মতামতও নেয় ওর।

তিসু ভাবনাতে এমন বিভোর ছিল যে কখন চারটে ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে ওর রিকশার সামনে। ‘অ্যাই কী আছে দিয়ে দাও।’ ওদের কন্ঠস্বরে চমকে ওঠে। রিকশাতে বসে এতো অন্যমনস্ক হওয়া ঠিক হয়নি। দিনকাল খুব খারাপ। ‘কই দাও।’ ধারালো ছোরাটা বুকের কাছে ধরে খোঁচা মারার ভঙ্গিতে বলে একজন। ঐটাই বুঝি দলনেতা। তিসু ঘাড় ঘুরিয়ে আর তিনজনকে দেখে নেয়।

তারপর খুলে দেয় আংটি, দুল।

‘টাকা দাও।’ দলের নেতা বলে। তিসু ব্যাগ থেকে পঞ্চাশ টাকা আর কিছু খুচরা ছিল বের করে দেয়।

‘ব্যাগটা দাও।’ ওদের একজন বলে। তিসু বিনা বাক্য ব্যয়ে ব্যাগ বাড়িয়ে ধরে। কিছুক্ষণ ব্যাগ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে ফিরিয়ে দেয় ব্যাগ। ওরা চলে যায়। ওদের পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর চোখে জল এসে যায়। ওর মনে ঘুরপাক খায়, ওরা তো স্বাধীন দেশের নাগরিক; বাস করে

স্বাধীন দেশে তবে ওরা কেন লেখাপড়া করে না? কেন ওদের হাতে অস্ত্র? কেন ড্রাগ নেয়? কেন ছিনতাই করে? কেন? কেন? এই স্বাধীনতা কী চেয়েছিল ওরা। এই স্বাধীনতা এসেছে রক্ত আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে। এই স্বাধীনতা কী চেয়েছিল? এই নতুন প্রজন্ম, ওরা কোন অন্ধকারে তলিয়ে

যাচ্ছে! ওদের ভালো করার জন্য, ওদের ভালো পথে আনার জন্য কিছু তো করা প্রয়োজন; কিন্তু কে করবে? কে থাকবে ওর পাশে। কতটুকু শক্তি ওর একার? দেশের ভালোমানুষেরা তোমরা এগিয়ে এসে

না হলে দেশটা যে রসাতলে যাবে! তিসুর বয়স কম। তবুও এই পঁচিশ বছরের জীবনের থলিতে অজ্ঞিতার মূল্যবান পাথর কম নয়। তিসু দেখেছে একজন বেকার যে ভালো ক্লাস নিয়ে পাশ করেছে,

বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ ডিগ্রি পেয়েছে তাঁর চাকরি নেই; চাকরি না পেয়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। মনে তাঁর জীবনের প্রতি ধিক্কার জন্মেছে। কারণ বাবা-মা যারা কষ্ট করে তাঁদের জীবনের সকল সুখের বিনিময়ে লেখাপড়া শিখিয়েছে তাঁদের জন্য ও কিছুই করতে পারছে না। তাঁদের

কোন সুখ দিতে পারেনি, পারছে না বলেই ধীরে ধীরে এই অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। আরও দেখেছে বিদেশ যাবার জন্য জমি-জিরাত বিক্রি করে টাকা দিয়ে যেতে পারেনি; পড়েছে দালালের খপ্পরে।

তিসু আরও দেখেছে ধনীগৃহে বাবা-মা থাকে কাজের লোকের মতো! কেউ বা তাঁদের বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়েছে! কিন্তু কেন? অবশ্য এর উলোটা যে দেখেনি তিসু তা নয় তবে খারাপের তুলনায় ভালোত্ব কম! অনেক সন্তান আছে যারা বাবা-মাকে মাথায় তুলে রাখে, দেবতাজ্ঞানে পূজা করে।

‘আপা, যামু।’ রিকশাওয়ালা কথা ভুলেই গিয়েছিল তিসু। ওর ডাকে চমকে ওঠে। রিকশাওয়ালা এতক্ষণ ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিল। ওরা চলে যেতেই কথার-খই ফোটে ওর মুখে। বকবক করতে থাকে।

‘কী আর কমু আপা। দ্যাশটার যে কি হইল। যখন-তখন খুন, হাইজ্যাক। মা- বোনগো নিরাপত্তা নাইক্কা। রাস্তায় বাইর হওনের যো নাইক্কা।’

 তিসু বলে, ‘ভাই, ওদিকে আর যাব না, এদিকে যাও।’

তিসুর মন এলোমেলো ভাবনাতে ডুবে যাচ্ছে। কয়েকদিন খবরের কাগজগুলো পড়তে পারছে না!

ফেসবুকে চোখ রাখতে পারছে না! মানুষগুলো এত নিম্নগামী কেন হলো কিছুতেই বুঝতে পারছে না। এখন ইউনিভার্সিটি যেতে ভালো লাগছে না। বাড়ি ফিরে যায়। বাড়ি ফিরতেই শাশুড়ি জিজ্ঞেস করে। ‘এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে বউমা, শরীর খারাপ?’ তিসুর শাশুড়ি বারান্দার রোদে শ্বশুরের বুকে গরম তেল মালিশ করছিল। শ্বশুরের হাঁপানির টান বেড়েছে। শাশুড়ির কথায় বলে, ‘না মা! কিছু হয়নি, এমনি ফিরে এলাম।’ তিসু ঘরে যেতে যেতে শুনলো শাশুড়ি বলছে ‘নয়ন দেখতো বউমার কিছু হলো কিনা।’ তিসু ঘর থেকে টাকা নিয়ে রিকশার ভাড়া মিটিয়ে

ঘরে এসে দেখে বসে আছে নয়ন। ওকে দেখেই প্রশ্ন করে নয়ন। ‘ভাবী, কী খবর ফিরে এলে?’

একটু হেসে তিসু বলে, ‘ওগো ননদীনি, তোমার টানে ফিরে এলাম।’ ‘কি রকম?’ নয়ন ওর বড়ো বড়ো চোখ মেলে তাকায়। ওর দিকে তাকিয়ে চিবুকে একটু আদর করে বলে, ‘কেনাকাটা করবো গো, তোমার নাকি মাথা ধরেছে! তা কে ধরেছে গো!’ বলেই হেসে গড়িয়ে পড়ে তিসু। নয়ন লজ্জা পায়। বলে, ‘যাও ভাবী, ভালো হবে না।’ ‘তোকে কি বলেছি কিছু।’ কথা বলে ওর চিবুক তুলে নয়নের লজ্জারাঙা রক্তিম মুখের দিকে চেয়ে থাকে। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষে কেনা-কাটা করতে বের হয় শাশুড়ি-বউমা। বাসায় ফিরে রাতের রান্নার সাহায্য করে শাশুড়িকে। নিজেররান্নাও সেরে ফেলে।