জীয়ন্ত মূর্তি ও বিদেহী মানস/ কবিতা কস্তা
জীয়ন্ত মূর্তি ও বিদেহী মানস/ কবিতা কস্তা
শর্বরীর ১০:০০ টায় স্কুল। ৪:০০টা পর্যন্ত। ভোরবেলা উঠেই দাঁত ব্রাশ করে ছোট ছই জালি দিয়ে মাছ ধরতে বের হয়। অন্যদিন মাঝে মাঝে ছোট ভাই অভিলাষকে নেয়। আজ আর সে ঘুম থেকে উঠেনি, তাই তাকে আর উঠায় না। একাই চলে মাছ ধরতে। মাছ বলতে চিংড়ি, মলা, পুটি, টেংড়া, চান্দা, বুচি, কই, শিং, কাইকা, টাকি, এইসব ছোটোমাছ।
ঘন্টাখানেক ঝাঁকা জালি চালায়, অত:পর মোটামুটি মাছ নিয়ে ফেরে সে। ফেরার পথে ছোট্ট এক ঢোরা সাপ কলার ভেলার দিকে আসতে চাইলে, লাঠি দিয়ে তাড়ায় । সাহসী সে, তবে সাপ দেখলে একটা অজানা অযৌক্তিক ভয় মনের মাঝে শিউড়ে উঠে কেন জানি। আজ যা মাছ পড়েছে মোটামুটি চলবে ভালোই, মনে মনে ভাবে শর্বরী।
বেড়ার ডেরায় ফিরতেই মা বলেন, মাচা থেকে একটু সব্জি কেটেছি। বাজারে বিক্রি করে কিছু সদাই নিয়ে আয়তো মা শবরী!
মায়ের হুকুম ফেলার ক্ষমতা নেই তার। বাধ্যগত বৃন্তের মতো দ্রুতপায়ে ছুটে চলে সোমবাজার। এসেই আবার তড়িঘরি স্কুলে ছুটতে হবে। তাড়াতাড়ি না গেলে দেরি হয়ে যাবে।।
প্রতিদিন প্রায় বাজারে যেতে যেতে একটা পরিচিতি হয়ে গেছে। পান দোকানদার মদন চাচা বলেন, কি রে ভাইঝি, আজ যে দেরি? শর্বরী কিছু বলে না, শুধু দেরি হওয়ার অপরাধটা যেনো মাথা পেতে লজ্জায় নীরব হয়!
ফটিক চাচা বলে, কি রে, আজ কি এনেছিস, দেখি? নিশ্চুপ অপরপ্রান্ত। সবাই জানে, শর্বরী কোনো কথা বলে না। শুধু চুপচাপ নিজের কাজ নিজে করে যায়। তবুও কি যেনো এক অদ্ভুত কৌতুহলে সবাই তার আসা-যাওয়া লক্ষ্য করে। মনে মনে তারা ভাবে ফিরিঙ্গি মাইয়া মানুষ বইলাই বাজারে বাজার-ঘাট করতে আসে। আমাগো মাইয়াগো তো ঘর ত্থেই বাইর অইতে দিতাম না। মনে এক মুখে আর এক ভাব মিশিয়ে অবজ্ঞার সুরে আলু পেয়াজ বিক্রেতা কালু চাচা বলেন, কিরে ছুড়ি এককেজি পুঁই শাক দিবি, দাম কমাইয়া? মদন চাচা কথা কেড়ে নেয়, অই তর কি মাথার দোষ অইছে? তুই কারে কি কস? এ অইছে “রাজার ঝি সার”। যা দাম তাতেই বেঁচবো।শর্বরীর বাবাকে সবাই এ তল্লাটে রাজা নামেই চেনে। কোন বাক-বচসা না করলেও আশেপাশের বিক্রেতারা এভাবেই নানা ধরনের কথা দিয়ে তাকে কেউ স্নেহ করে, কেউ সমীহ করে, কেউ বা বিদ্ধ করে। চুপচাপ তবুও নিজের কাজ করে যায় সে। যেনো বা কথা বললেই হবে মহা সর্বনাশ, ভীষণ ক্ষতি থেকে বাঁচতে নীরবতাই তার একক অস্ত্র।
আজ বড্ড দেরি হয়ে গেলো, ভাবছে শর্বরী। তাই জোরে জোরে পা ফেলে বাড়ির পথে। দ্রুত হাঁটতে গিয়ে আচমকা হোঁচট খায়, বিল্লু চাচার পায়ে। কোত্থেকে এসে যে এভাবে পায়ে পা লাগিয়ে হোচট খাওয়ালো লোকটা, ভেবেই পায় না সে। শুধু আরও তড়িঘড়ি চালায় পা, স্কুলের সময় মাথায় রেখে।
মাথা থেকে ঝাঁকা নামিয়ে মায়ের দেয়া চাহিদার তালিকা ধরে, গোল আলু, শুকনা মরিচ, আদার ডালি মায়ের সামনে রেখে ছোটে পুকুরে স্নান করতে। ছুটে যেতে যেতে শুনতে পায়, যা আনতে কইছি সেই শুটকীইতো আনলো না, কেমন মাইয়া অইছে!
মায়ের অভিযোগের কটুক্তি গায়ে জড়িয়ে কোনোরকম জামা, স্যান্ডেল গায়ে-পায়ে চড়িয়ে দে ছুট বিদ্যালয়ের পানে।
দ্রুত হেঁটেই সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে চলতে থাকে সে। দীর্ঘ পথের ছোটো-খাটো বিড়ম্বনাও বাদ পড়ে না। সেসব বাঁধার ঝক্কি নীরবে পর্দা ফেলে, স্কুল গেইটের কাছাকাছি পৌঁছে দেখে, ঘন্টা বেজে গেছে, সমাবেশ শুরু হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। হন্তদন্ত হয়ে লাইনের পিছনে অবস্থান নেয় চুপিচুপি শর্বরী।
ক্লাশরুমে ঢুকতেই পাইলিন অবজ্ঞার সাথে ছুড়ে দেয়, কি রে শর্বরী, তোকে বুঝি জামাটাও কেউ ধুয়ে দেয় না, ছি! এতো নোংরা! সাদা জামায় একটু নীল দিয়েওতো পরতে পারিস! ওই দেখ দেখ, জামাটা পরে ওরে আরও কালো লাগতেছে না? পাইলিনের বোন ইবলিনও সায় দেয়, হরে দিদি। বলেই বিদ্রূপের হাসি। হি হি হি হি।
শর্বরী নীরবে ধকল নেয়, কাউকে কিছু বলে না। অপরাধীর মতো লজ্জা অবনত দৃষ্টিতে কচ্ছপের মতো গুটিয়ে যায় অজান্তে! নিজের পরিধেয়টাও পরখ করতে সাহস করে না। পাছে আবারও ওরা পরিহাসে জর্জরিত করে!
আগামী সপ্তাহে বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য শর্বরী নাম দিতে চায়। খুব ইচ্ছে হয় তার পুরস্কার না পেলেও অংশগ্রহণ করতে। কিন্তু সহপাঠীদের অজানা তাচ্ছিল্যের ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয় অজান্তে। সুপ্ত ইচ্ছা গোপনেই কুরে কুরে মরে। নিজের উপস্থাপন সীমাবদ্ধতার হীনমন্যতায় ভোগে। ভাবে, আমি এমন কেন? মা- ই বা কেন নিজের যত্ন করতে শেখান না? তবে ক্ষণকাল পরেই উবে যায় চিন্তার মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। নিত্য দিনের সত্য অস্নেহ-অবজ্ঞাগুলো ক্রমে বিন্দু বিন্দু সারমেয় রূপ ধারণ করে শর্বরীকে আরও অসহায় করে দেয়। এমনটা অমূলক নয় মোটেই।
বাড়ি ফিরতে কিছুক্ষণ বড় রাস্তা ধরে শেষে একটু সংক্ষিপ্ত পথে পা বাড়ায় শবু। কোনোদিকে শারীরিক গঠনে সে অসুখী, তা নয়। খুব বেশি আলাদা কিসিমের বৈশিষ্ট্যও তার নয়। তারপরেও অদ্ভুত কিছু কারণে সহপাঠী কিংবা গ্রামের স্কুল সহযাত্রীরা তার সঙ্গে তেমন মেশেৎনা। তা-ই নিজের নিয়মেই ভাবে, নিজের পথেই চলে, নিজস্ব নিয়মেই নীরবতা সম্বল করে এগিয়ে যায়।
বাড়ি থেকে অদূরেই একটা স্থানে জটলা দেখে কাছে যেতে উদ্যত হয় শর্বরী। তফাতে থেকেই উঁকিঝুকি মেরে বুঝতে পারে বেশ হল্লা হচ্ছে। সবাই যেনো কি একটা বিষয় নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। একা এতো কাছে যেতে না পারলেও বুঝতে পারে কোনো একটি মেয়ের প্রায় অর্ধগলিত-মৃত লাশ পরে আছে ভীড় লাগা স্থানটায়। প্রথমে ভয়ে শিউড়ে উঠলেও আস্তে আস্তে গন্তব্যে হাঁটে আর চিন্তার ব্যবচ্ছেদ হয় হৃদয়ে! অসার মনে হয় পৃথিবিটা। এমন দু:খ কি ছিলো মেয়েটার যে পৃথিবীর মায়া ছাড়তে হলো? নানা ভাবনায় এগিয়ে চলা রাস্তা কখন বাঁক নিয়ে গন্তব্যে থেমে গেছে টেরই পায় না শর্বরী। অবসন্ন অবয়ব আর মনোবল নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই ছুটে আসেন মা। কি রে, এতো দেরি হলো? চুপসে যায় সে। কষ্ট বুকে পুষেই উঠে গিয়ে জামা- কাপড় পরিবর্তন করে হাত- মুখ ধোয় অন্যমনস্কভাবে। পেটের ক্ষুধাও নিমেষে উদাসীন গাঙে ডুব দেয়।
মায়ের অবিরত তাগাদায় থালায় কিছু ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে, গলাধ:করণ করতে পারে না। শুনতে পায় বাইরে কোনো নিত্য খবর বিশারদ যেন মাকে বলছে, শুনছো শর্বরীর মা, উষসীরে কারা যেনো অত্যাচার করছে, তারপরে লাশ ফালাইয়া রাইখ্যা গ্যাছে।
কী? শর্বরীর মা ভীষণ চমকান। বলেন, কি কারণে এমুন কামডা করলো?
Facebook Comments Sync