সারপ্রাইজ /নাহারফরিদ খান
চাকুরীর ইন্টারভিউ দিতে গিয়েই কুসুমের সাথে পরিচয় আকাশের । খুব নার্ভাস হয়ে বসেছিল কুসুম । হাসিমুখে রিলাক্সড মুডে সবার সাথে আলাপচারিতায় ব্যাস্ত আকাশ । ঈশান বিরসমুখে ইন্টারভিউ দিয়ে বের হয়ে কর্নারে রাখা ফিল্টার থেকে এক গ্লাস পানি পান করলো । কয়েকজন ওকে ঘিরে ধরলো কি প্রশ্ন করেছিল তা জানার কৌতুহলে । কুসুমও এসে দাঁড়াল শোনার আগ্রহে । কুসুম এক গ্লাস পানি পান করলো । আকাশ বলে উঠলো “ রিলাক্সড ফ্রেন্ড যুদ্ধের ময়দান নয় , চাকুরীর সোনার হরিণ । পেলে পাবে না পেলে নাই । হেথা নয় হোথা অন্য কোন খানে “ । অনেকেই ওর এই রসিকতায় সায় দেয়নি । আকাশের স্বভাবটাই এমন । কোন কিছুতেই তেমন সিরিয়াস নয় । টগবগে প্রাণোচ্ছল তারুণ্য ওর মধ্যে। কিন্ত কাজের সময় খুব সিরিয়াস । বিত্তশালী পরিবারের ছেলে বলেও হয়তো জীবনের প্রতি একটু ভিন্নমাত্রা যোগ করতে আগ্রহী ।
ব্যাংকের চাকুরীটা আকাশ রহমান আর কুসুম সিকদারই পায় । দুজনেই মেধাবী । ওরা একই ব্রাঞ্চে কাজ করে । লা্ঞ্চব্রেকে ওরা কাছেই কফিশপে যায় , ছুটির শেষে অফিসের উল্টোদিকে লেকের ধারে বসে আড্ডা দেয় । দিন পনেরো পরে আড্ডায় যোগ দেয় ওদের একটু সিনিয়ার মঈন ভাই । উদার মনের মানুষ । বসগিরি একেবারেই নেই । তাই ওদের কেমিস্ট্রটা ভালোই জমে । লেকের পাড়ে আড্ডায় সমসাময়িক রাজনীতি,বিশ্ব কড়চা থেকে শুরু করে নজরুল,রবীন্দ্রনাথ ,লালন,জেনিফার লোপেজ কেউই বাদ যায় না । জীবনানন্দ এবং বিদেশী কিছু কবিতার পংক্তিও আকাশের কন্ঠে শোনা যায় । অনুরোধে কুসুমও রবীন্দ্র সঙ্গীত ভাজে দু,চার লাইন । মঈন স্বল্পভাষী ।ভীষণ উপভোগ করে সবকিছু । একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞেস করে মঈন “ তা ব্রো তোমার গার্লফ্রেন্ড ক,জন ! “ আকাশ আতকে ওঠার ভঙ্গিতে বলে “ ক,জন ! তা ছিটেফোটা একজন ছিল তা ইউনিতেই ব্রেক আপ হয়ে গেছে “ কুসুম বলে ওঠে “ আহারে বেচারা “ । হেসে ওঠে সবাই অকারণে । মঈনকে জিজ্ঞেস করে আকাশ “ মঈন ভাই আপনার কাহিনীটা একটু শুনি “ “ এইতো আমারও ছিটেফোটা , টুকটাক । মনের মানুষ খুঁজছি । এখনো পাইনি “ মঈন এবার কুসুমকে “ তা ম্যডাম আপনার অভিজ্ঞতা কি । আপাততঃ কেউ নেই তাতো বুঝতে পারছি “ “ কি ভাবে বুঝলেন ! “ “ তাহলে কি এই অধমদের সময় দিতেন ! “ হেসে বললো কুসুম “মঈন ভাই আমার একজনকে পছন্দ ছিল । তার নাম হিমাদ্রি । যখন তাকে প্রেম নিবেদন করবো ঠিক তখনই জানলাম তার প্রেমিকার নাম নন্দিনী । তাই রণে ভঙ্গ দিলাম । গোপন প্রেম গোপনেই রহিয়া গেল।”
হাসির তুফান ছুটলো । আকাশ আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো “ আমাদের সকলের মনের দুয়ার খোলা ঐ আকাশের মতো । “ “ যাগগে এবার ওঠা যাক । আমার তাড়া আছে “।
মাস তিনেক পরে কুসুমকে বদলী করা হলো অন্য ব্রাঞ্চে । দু অফিসের দুরত্ব তেমন বেশী ছিলনা । আড্ডাটা ঝিমিয়ে গিয়েছিল । মাঝে মধ্যে দেখা হতো। মোবাইলে কথা হতো । আকাশ বছরখানেক ধরে দেশের বাইরে যাবার চেষ্টা করছিল । মঈনও অন্য একটা ব্যাঙ্কে আরএকটু উচু পদে যোগ দিল । কুসুমকে আকাশের ভললাগে । ভাললাগার চেয়েও হয়তো বেশী কিছু । কুসুম দেখতে অপরূপা । চোখতো নয় টলটলে দীঘি যেন । রংটা র্ফসা না হলেও উজ্বল গৌর বর্ণ ।ফিগারটা খু্বই আর্কষণীয়। শাড়ি পরলে দারুণ লাগে । আকাশ ইদানিং কুসুমকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে সিরিয়াসলি । এবার বোধহয় খোলাখুলি বলা প্রয়োজন ।কুসুম আকাশকে পছন্দ করে সেটা আকাশ বুঝতে পারে কিন্ত পছন্দটা বন্ধু হিসেবে না প্রেমিক হিসেবে সেটা জানা প্রয়োজন । আকাশ মজা করে কথা বলে , কুসুম শুনে প্রাণ খুলে হাসে সে কথা শুনে । আকাশ দশদিনের ছুটি নিয়েছে । গত চারদিন জ্বর ছিল । আজ দুদিন জ্বর নেই । আজ কুসুম আর মঈন এসেছিল আকাশকে দেখতে । কুসুমের হাতে ছিল একগুচ্ছ চন্দ্রমল্লিকা । কুসুমকে দারুণ সুন্দর লাগছিল । নীলরঙের ফতুয়া জিন্স,গলায় সাদা র্স্কাফ ঝোলানো । সাদা স্যান্ডেল সংগে সাদা ব্যাগ ।কানে ছোট্ট মুক্তোর দুল । খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো আকাশ । হঠাৎ যেন নতুন করে আবিষ্কার করলো কুসুমকে । কুসুম সুন্দর জানতো কিন্ত এতো সুন্দর এতোদিন কেন বোঝেনি ! ওরা চলে গেল । রাতে আকাশ কুসুমকে ফোনে বললো “ কাল লেকের ধারে এসো । সারপ্রাইজ দেবো তোমাকে “।কুসুমও হেসে বললো “ অনেক কথা জমা আছে তোমাকে বলার জন্য । তোমার জন্য আমারও একটা সারপ্রাইজ আছে “ আকাশ ভাবলো কুসুমও ওর মনের কথা মানে আকাশকে ভালবাসার কথা হয়তো জানাবে । আকাশ পরদিন বিকেলে ওর বাদামী রঙের টির্শাটটা পরে ,কুলওয়াটার পারফিউমটা এমনভাবে গায়ে মাখে যেন অনেকক্ষণ তা থাকে । আসার পথে গাড়ি থামিয়ে স্যানেলের একটা পাফিউম কেনে ।গাড়িতে রেখে দেয়। আজ কুসুমকে নিয়ে যখন জাপানিজ রেষ্টেুরেন্টে খেতে যাবে তখন গিফটটা দেবে । সুন্দর করে র্র্যাপিং করিয়ে নেয় । একটু আগেই পৌঁছে গেল আকাশ । সিগ্রেট ধরিয়ে অপেক্ষা করছে ।কুসুম আসছে । দূর থেকে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ে । আজ কুসুম পরেছে গোলাপী রঙের ফতুয়া ,সাদা প্যান্ট সাদা র্স্কাফ গলায় । কুসুমের চলায় বলায় অনেক পরিবর্তন এসেছে । সেই প্রথম দেখা নার্ভাস মেয়েটি এখন আর নেই । বেশ কনফিডেন্ট,র্স্মাট, স্টাইলিস অন্য এক কুসুম । এমন কুসুমই আকাশের পছন্দ । আকাশ আর কুসুম একই বেঞ্চিতে বসলো । কুলওয়াটার পারফিইমের গন্ধটা লাগছে নাকে। কুসুমও এই পারফিউমটা ব্যবহার করে । কুসুম জানে আকাশের খুব পছন্দের পারফিউম এটা । আকাশ দুষ্টু চোখে তাকিয়ে বলে “ ব্যাপারটা কি বলোতো ! দিনে দিনে কুসুমের মতো বিকশিত হচ্ছো ।” “ তুমিও কম কিসে ! “ আকাশ তোমার সারপ্রাইজটা শুনি এবার “ “ বলবো বলবো ,এতো তাড়া কিসের ! “ “ আগে তোমারটা শুনি “ কুসুম ওর উড়ুউড়ু খুচরো চুলগুলো কপালের উপর থেকে সরাতে হাত তুলতেই পড়ন্ত বিকেলের রোদে ওর অনামিকায় ছোট্ট হীরের আটিংটি জ্বলজ্বল করে উঠলো্ । আকাশ ওর হাতটি ধরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে থাকায় । কুসুম বলে ওঠে “ এটাইতো আমার সারপ্রাইস । মঈন আর আমার একটা ঘরোয়া এনগেজমেন্ট হয়েছে পাঁচদিন আগে হঠাৎ করেই । আমরা তোমাকে কালই জানাতাম ।মঈন আর আমার এমনই প্লান ছিল । ডিসেম্বরে আমাদের বিয়ে “ । আকাশ স্তম্ভিত , বাকরুদ্ধ । অন্যদিকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় । কুসুম বলে চলে “ জানি আকাশ তুমি রাগ করবে, কেন আগে বলিনি তোমাকে । আফটারঅল তুমি আমার বেষ্টফ্রেন্ড । আসলে মঈন যে আমাকে পছন্দ করতো তাতো জানতাম না। হঠাৎ করেই প্রপোজ করলো । পাত্র হিসেবেতো মন্দ নয় । তাই আমিও মতটা দিয়েই দিলাম “। আকাশ উঠে দাড়াল ।হাঁটতে শুরু করলো গেটের দিকে । কুসুম অবাক হয়ে পেছন পেছন যেতে যেতে “ আকাশ মানছি আমার না বলাটা অন্যায় হয়েছে ।তোমার সারপ্রাইটা বলে যাও “। পেছন ফেরে না আকাশ । কুসুম দাঁড়িয়ে থাকে । আকাশের এতো তেজ কুসুমের ভাল লাগে না । কতদিন কুসুম অপেক্ষা করেছে আকাশের মুখ থেকে একটি কথা শোনার অপেক্ষায় । কই বলেনিতো আকাশ ! তিনমাস পরে আকাশ চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যায় । কুসুম মনে মনে ভাবে তাহলে এই ছিল আকাশের সারপ্রাইস ।
Facebook Comments Sync