আফরোজা পারভীন

আফরোজা পারভীন

‘আজ মম জন্মদিন’ এই লাইনটি যার অমর রচনা ২৫ বৈশাখ সে কবির জন্মদিন। জন্মদিন সে কবির যিনি প্রগাঢ় আত্মবিশ্বাসে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতুহল ভরে।’ শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে, পুরোনো হয়নি তার কবিতা, হরিয়ে যায়নি কালের গর্ভে। বরং নব রূপে প্রাণ পেয়েছে, আবিষ্কৃত হয়েছে নতুনভাবে। কবি আসে, কবি যায়, জগতের তাতে কিবা আসে যায়। শত সহস্র বর্ষে একবার জন্মায় যে কবি তাঁকে নিয়েই তো মানুষের ভাবনা। ২৫ শে বৈশাখ আমাদের সেই কবির জন্মদিন। শুভ জন্মদিন। জগৎকবির সভায় বঙ্গভূমিকে পরিচিত করালো যে জন, নোবেল জিতে নিলো  যে জন তাঁর জন্মদিন। 

রবীন্দ্রনাথের নোবেল জয় উপলক্ষে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখলেন, জগৎ কবির সভায় আমরা  তোমারই করি  হে গর্ব/ বাঙাগি আজ গানের রাজা/ বাঙগালি নহে গো খর্ব। আমাদের অতি অমায়িক কবি লিখলেন, এ মনিহার আমায় নাহি সাজে। মনিহার যে শুধুমাত্র তাঁকেই সাজে তাতো শতবর্ষ পরেও দেশে বিদেশে স্বীকৃত।পৃথিবীব্যাপী এ দেশের যা পরিচিতি তার বড় অংশ তো এক রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই। 

রবীন্দ্রনাথ কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, গীতিকার, চিত্রকর, শিল্পী একাধারে সবই ছিলেন। তাঁর সব কাজই বড়। সর্বত্রই তিনি সফল। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, ‘আমার গান, আমার ছোটগল্প আর ছবি এ তিনের মধ্যেই আমি বেঁচে থাকব।’ রবীন্দ্রনাথ কবিতার কথা বলেননি। বোধহয় কবিতা সম্পর্কে প্রগাঢ় আস্থার কারণেই বলেননি। তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে সবকিছুই। 

 জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারটি ছিল সাহিত্যচর্চার পাদপীঠ। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌক্র রবীন্দ্রনাথ। কলিকাতার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের প্রাণসলতে। রবীন্দ্রনাথের অতলস্পর্শী অলৌকিক কবি প্রতিভার সাথে যোগ হয়েছিল তাঁর কুল গৌরব। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার রাজনন্দন রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যেমন এসেছে হবুচন্দ্র রাজা, গবুচন্দ্র মন্ত্রী আর যশস্বী সম্রাট শাহজাহানের কথা, তার অধিক পরিমাণে এসেছে মুকুটহীন রাজাদের কথা। তিন বিঘা জমির উপেন, কিনু গোয়ালার গলি, সেখানকার কর্নেট বাদক কান্ত বাবু, হরিপদ কেরানীর জরিমানা দেয়া মাইনের মতো ছাতাখানা, কিংবা আলো জ্বালাবার দায় বাঁচানোর জন্য স্টেশনে সময়ক্ষেপন কিছুই তার তীক্ষ্ন দৃষ্টি থেকে বাদ পড়েনি। বাদ পড়েনি সেই ছেলেটির কথা যে ট্রামে কমলাকে দেখে যেখানে তার নামবার কথা সেখানে নামতে পারেনি। রবীন্দ্রনাথের বৈশিষ্ট্য কিংবা স্বাতন্ত্র এখানেই। তিনি যতটা না কবি তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ। আজ যখন আমরা জীবনঘনিষ্ঠতার কথা বলি, সমাজমনস্কতার কথা উচ্চরণ করি, তখন খতিয়ে দেখি, রবীন্দ্রনাথের মতো জীবনঘনিষ্ঠ সমাজমনস্ক কবি আজ অবধি  জন্মগ্রহণ করেনি। জমিদার নন্দনের লেখনী থেকে যখন বেরিয়ে আসে, ‘এই সব মূঢ় মূক গ্লান মুখে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে ভাষা/ এই সব ভগ্ন শুষ্ক বুকে জাগায়ে তুলিতে হবে আশা ’ তখন রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত না করে পারি না। 

রীন্দ্রনাথের নাটকের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা চলে । রবীন্দ্রনাথ যেমন বাল্মীকি প্রতিভা, রাজা রাণী বিসর্জনের মতো নাটক লিখেছেন, পাশাপাশি লিখেছেন অচলায়তন, শাস্তি , ডাকঘর, রক্তকরবীর মতো নাটক।

রবীন্দ্রনাথের জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তার জীবনে পথের প্রভাব অপরিসীম। জীবিকার প্রয়োজনে যেমন তিনি পথে পথে ঘুরেছেন, কোথাও তিন মাস থাকেননি, তেমনি অকারণে চঞ্চল মনের আকুতি মেটাতেও ঘুরেছেন। দেশ আর মানুষকে দেখার নেশা ছিল রবীন্দ্রনাথের। সেই নেশাই তাকে দেশ দেশান্তরে ছুটিয়ে নিয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ যে পরিমাণ দেশভ্রমণ করেছেন তাতে এক অর্থে তিনি বিশ্বপথিক। পথ থেকে কুড়িয়ে নেয়া সম্পদের কিছুমাত্র অপচয় করেননি হিসেবী রবীন্দ্রনাথ। সবই যোগ হয়েছে তার রচনার খাতায়। আর ঘুরেছেন বলেই বোধহয় তিনি সাধারণ মানুষের কাছাকাছি আসতে পেরেছেন। তাই রক্তকরবী আমরা যখন পড়ি বা দেখি তখন চোখের জল ফেলি নিন্দিনীর জন্য। যে নন্দিনী পথে পথে খুঁজছে রঞ্জনকে।  যে নন্দিনী নীলকণ্ঠ পাখির একটা ঝরাপালক দেখে এটি তার রঞ্জনের আগমনবার্তা ভেবে উৎকণ্ঠিত প্রতীক্ষায় প্রহর গুনেছে। আবার রক্তকরবী পড়লে মনে হয় রবীন্দ্রনাথই যেন বিশুপাগলা রূপে পথে পথে গান গেয়ে ফিরছে। অচলায়তনের পঞ্চকও যেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। যে পথে পথে গেয়ে ফিরছে, ‘এ পথ গেছে কোনখানে গো কোনখানে/ তা কে জানে তা  কে জানে।’ বাইরের থেকে অচলায়তনের ভেদ ঘটানো যেন পঞ্চকের কাজ । কিংবা যদি আমরা শাস্তি নাটকের কথা ধরি, মনে হয় রবীন্দ্রনাথই যেন দুখিরাম রুই, ছিদেম রুই। চন্দরা তারই স্ত্রী। ডাকঘর পড়ে কে বলবে রবীন্দ্রনাথ অমল নন। রবীন্দ্রনাথ সর্বদাই চেষ্টা করেছেন তাঁর অব্যস্ত গন্ডিবদ্ধ জীবনের বাইরের জীবন নিয়ে কাজ করতে। সে কারণেই তিনি বাঁধাপথ বাঁধা বুলির জাল ছিঁড়ে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যেতে চেয়েছেন। তাতে তিনি সফলও হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই।

গানকে রবীন্দ্রনাথ গেঁথে নিয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টিশীর জীবনের সাথে প্রগাঢ় বাঁধনে। তাই শৈশব-  কৈশোর- যৌবন থেকে জীবন সায়াহ্ন অবধি তিনি গান লিখেছেন দুহাতে। তাঁর গানে প্রাণ পেয়েছে সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা, গভীর রজনী। তাঁর গানের বাঁশিতে বেজেছে জীবনের আশা আনন্দের সুর। এসেছে না পাবার কথা, আশাভঙ্গের বেদনা। রবীন্দ্রনাথের গানের বাণীতে ভরে আছে বছরের প্রতিটি ঋতু। রবীন্দ্রনাথের প্রেম ধাবিত হয়েছে ব্যক্তি ছাড়িয়ে বিশ্বে। এমনকি ধ্যানী রবীন্দ্রনাথকেও খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর অসংখ্য গানে। ফসল কাটার গান, শূন্য মাঠের গান, পাতাঝরা  দিনের মর্মবেদনা যেমন এসেছে তার গানে তেমনি ধরা দিয়েছে মনের সূক্ষনতম তন্ত্রীতে নাড়া দেয়া আনন্দ যাতনার ইতিবৃত্ত। তারা সুখের লাগি চাহে প্রেম সুখ মেলে না, কিংবা আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে আছে দেখতে আমি পাইনি তোমায়, যিনি লিখেছেন তিনিই মধূরও বসন্ত এসেছে মধুরও মিলনও ঘটাতের মতো আশার গান লিখেছেন। এসব গানে ঋতুবদলের সাথে মনের আবেগের উত্থান প্রকাশ করতে পেরেছেন রবীন্দ্রনাথ। আবার একই রবীন্দ্রনাথ ধ্যানী যোগীর মতো লিখেছেন, ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙ্গাামাটির পথ আমার মন ভুলায়রে।’ লিখেছেন, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে।’ রবীন্দ্রনাথের গানের ডাইমেনশন এখানেই। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় ফসলের ক্ষেত থেকে শহরের ইঁট কাঠ পাথর অবধি বিস্তৃত যার গান তিনি রবীন্দ্রনাথ। ধান কাটার গানে, ছাদ পেটানোর সুরে যে ছন্দের অনুরণন শুনেছি তা রবীন্দ্রনাথের। যারা ধান কাটছে বা ছাদ পেটাচ্ছে তারা জানে না কার গান, কে লিখেছে। ভালো লাগে তাই গায়। এখানেই তার সফলতা। বর্ষার দিনে এমন দিনে তারে বলা যায় বলে কবি যা যা বলেছেন তাতে গহন গভীর বর্ষার মেঘ মেদুরতা শুধু যে শব্দায়িত হয়েছে তা নয়, সুস্পষ্ট একটা চিত্র ফুটে উঠেছে বর্ষার। কিংবা ‘আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে’র মতো গান আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায় বসন্তের মাতাল সমীরণে ভরা একটা জোছনা রাতে। 

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বলার ক্ষমতা বা স্পর্দ্ধা কোনোটাই রাখি না। তাই যেটুকু বলি ভয়ে ভয়ে বলি। তবে নির্দ্ধিধায় যে কথাটি বলা যায় তা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের রচনায় সর্বদাই ধ্বনিত  জীবনের জয়গান। স্বার্ধন্ধতা. নীচতা. হীনতা, ক্রুরতা ছাপিয়ে সবসময়ই তিনি মানবতাবোধকে সমুন্নত রেখেছেন। তাই তাঁর সমস্ত রচনায় মানবতার বাণী প্রচারিত। আর সগর্বে উচ্চারণ করতে চাই, তিনিই একমাত্র কবি যার গান দুটি দেশের জাতীয় সঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেনন, ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক/আমি তোমাদেরই  লোক / আর কিছু নয়, এই হোক শেষ পরিচয়।’ বিশ্বকবির জন্মদিনে একথাই বলছি, তোমার প্রার্থনা সফল হয়েছে। তুমি আমাদেরই লোক। এটাই তোমার শেষ পরিচয়।