প্রশান্তির নিঃশ্বাস

PROSHANTIR NISSHASH

প্রশান্তির নিঃশ্বাস

আহাম্মদ আলি মশারির নিচে বসে আছে ঠিক শিকারি বিড়ালের মতো। হাতে পাঁচ ব্যাটারির একটি টর্চ লাইট। লাল বোতামে চাপ দেয়ার সাথে সাথে আলোর তীব্র ফোকাস তীরের ফলার মতো ছুটে গেলো বাঁশ ঝাঁড়ের দিকে। একটু আগেই ওখানে খসখস আওয়াজ পেয়েছিলো আলি। গতোরাতেও  ভালোমতো ঘুমাতে পারেনি সে। দশটি মুরগীর কল্লাছাড়া দেহ এখনো তার চোখের সামনে ভাসছে। আকালের দিন। এক লাখ টাকার মুরগী শেষ! গেলো শীতে পঞ্চাশ হাজার টাকার মুরগী মারা গেছে আলির। জমির মোল্লা তার জোয়ান পোলাডা মারা যাওনের পর যেমনিভাবে কেঁদেছে, আহাম্মদ আলিও উঠোনে গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদেছিলো প্রচন্ড শীতের সকালে। এখন আবার শিয়ালের উৎপাত। প্রতি রাতে মাচার নিচে এসে বাঁশের চটাগুলো ফাঁক করে মুরগীর কল্লাগুলো নিয়ে খেয়ে চলে যায় চতুর শিয়ালগুলো। গতোরাতের আগের রাতে এমন একটা আলামত দেখেছিলো আলি।

 

আজ আর তার চোখে ঘুম নেই। একটু পরপর পাঁচ ব্যাটারির টর্চ লাইটটি নিয়ে ফার্মের চারদিকে ঘুরে আসে সে। রাত প্রায় শেষের দিকে। এতোক্ষণ বাইরেই ছিলো আহাম্মদ আলি। জংলিমশার কামড়ে আর বাইরে থাকা গেলো না। তাই এখন মশারির ভিতরে থেকে মুরগী পাহারা দিচ্ছে সে।

 

মুরগীগুলোর বেশি রাওচাও নেই। চুপচাপ শুয়ে বসে সময় কাটাচ্ছে। দেশি মোরগের মতো ককর কক শব্দ নেই। এক হাজার ওয়াটের বাল্ব জ্বলছে মাথার উপর। তার ভিতরেই মশারি টাঙিয়ে বসে আছে আহাম্মদ আলি। চোখ দু’টো মোরগফুলের মতো লাল। মশারির চারপাশে মশাগুলো চক্রাকারে ঘুরছে। আহাম্মদ আলিকে খেয়ে ফেলাই যেনো তাদের লক্ষ্য।

 

ঝোঁপের ভিতর আবার খশখশ আওয়াজ পাওয়া গেলো। কানটুপিটা কানের লতি অবধি টেনে নামিয়ে গামছাটা কাঁধের উপর রেখে রাবারের জুতাটা পরে নিলো আলি। হাতে পাকনা বাঁশের লাঠি। খাঁটি সরিষার তেল মাখাতে মাখাতে লাঠিটির গা থেকে যেনো তেল বেয়ে পড়ছে। লাইটের আলোতে লাঠিটা চকচক করছে শান দেয়া তলোয়ারের মতোন।

 

আহাম্মদ আলি বিসমিল্লাহ বলে মশারি থেকে বের হলো। আলির পাওয়ের আওয়াজ পেয়ে মুরগীগুলো খকখক করে উঠলো। আলির কিছুটা রাগ চাপলো মুরগীগুলোর উপর। ছেলেবেলা যখন সে ছিপারা পড়তে যেতো মসজিদে, তখন তার স্বভাব ছিলো সবার আগে মোরগের খোঁয়াড়টা খোলা। সূর্য ওঠার আগেই সে খোঁয়াড় খুলে দিতো। এতে সবার আগেই মুরগীগুলো খুদকুড়া কুড়িয়ে খেতে পারতো। খোঁয়াড়ের কাছে আসতেই মোরগ-মুরগী আহাম্মদ আলির পায়ের আওয়াজ টের পেতো। আর কককক ককরকক শব্দে তোলপাড় করে তুলতো চারপাশ। একবার মোল্লাবাড়ির কুত্তাটা একটা মুরগীর ছাও ধরে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনটা রাতা ধাওয়া করে কুত্তাটাকে। কুত্তাটার পিঠে ঠোঁকরের পর ঠোঁকর মারতে থাকে রাতাগুলো। কিশোর আহাম্মদ আলি ও তার সহপাঠিরা মক্তব থেকে ফেরার পথে দেখতে থাকে কুত্তা-মোরগের লড়াই। ঠোঁকর খেয়ে মোরগের ছাওটা রেখে মোল্লাবাড়ির কুত্তা দৌড়ে পালিয়ে যায়। আহাম্মদ আলি আহত মুরগীর ছাওটাকে নিয়ে বাড়িতে আসে। শৈশবের কথা মনে পড়ায় আলির দেশি মোরগের প্রতি মায়া বেড়ে যায়। আর রাগ চাপে এই শব্দহীন ফার্মের মুরগীগুলোর উপর।

 

খাঁচার ভিতর মুরগীগুলো এখনও খেকখেক করে ডাকছে।

‘বজ্জাতগুলা, কককক কইরা ডাকতে পারস না? তোগো খাওন কি কম দেই? সেই নয়ার হাট থেইক্কা তোগো লাইগা বস্তা বস্তা ফিড লইয়া আহি। ডাক্তারের দোকান থেইক্কা কারিকারি টেহা খরচ কইরা মেডিসিন আনি। শীতের সম হাজার পাওয়ারি লাইট জ্বালান লাগে। মুশুরি টাঙ্গাইয়া দিতে অয়। যেন শ্বশুরবাড়ি বেড়াইতে আইছে। আর আমারে আইছস একটা আহাম্মক। রাইত ভইরা মোশার কামর খাইয়া তোগো পাহারা দেওন লাগে। শিয়াল-কুত্তা আইলে জোরে কককক কইরা উঠলেওতো আমরা টের পাই। আগেভাগে রেডি অইয়া হেগো মাতাডা ছেইচ্চা দিতে পারি। খালি পারস আজাইরা খাইয়া দামরার লাহান শইল বানাইতে। বিশ দিন গেলে এক কেজি আর মাস গেলে দুই কেজি। আর তেল মশল্লা দিলেও পেজপেজ করে। বেডারা তোগো কিলিগ্যা যে কিন্না খায়, হেই মর্মডাই বুঝলাম না। খালি বুঝি আল্লায় তোগো সহি-সালামতে বাঁচায়া রাখলে দুইডা পইসা বেশি পামু।’

অনেকক্ষণ নিজের খেদ মুরগীগুলোর উপর ঝাড়লো আলি।

 

ঝোপের পাশে কুটুর কুটুর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আলির শিরার রগগুলো রাগে লাফাতে লাগলো শেরে আলির মতো। ফিডের দাম বাড়ছে। ওষুধের দাম বাড়ছে। মুরগীর দাম সেই তুলনায় বাড়ে নাই। বিদ্যুৎতের দামও বাড়ছে ভাউয়া ব্যাঙের লাহান লাফাইয়া লাফাইয়া। হাজার হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল দিতে হয়। ফার্মের সবাই চোরা লাইন দিয়া ফার্ম চালায়। মাস শেষে দুই তিনশ টাকা বিল দেয়। মিটার রিডারের পকেটে দু একশ টাকা আর একটা মুরগী ধরায়া দিতে পারলেই তারা মহা খুশি। দেশটা সব হারামখোরে ভইরা গেছে। মনের খেদে বকবক করছে আলি। হাঁটছে আলো আঁধারির বুনোপথে। আলি এখন ঝোপটার একেবারেই কাছে। কুটুর কুটুর আওয়াজটা আরো স্পষ্ট তার কানে এসে পৌঁছে। মনে হয় কে যেন তার নিজের হাড়গোর চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। রক্ত পানি করা টাকায় এই ফার্ম গড়ে তুলেছে সে। তার শরীরের লোমগুলো খাড়া হয় সজারুর পুচ্ছের ন্যায়। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বুকের ভিতর উত্তেজনার হাতুড়ি পিটাচ্ছে যেনো কোনো কামারে।

চারদিকটা শিকারির মতো দেখে নিলো একবার। বাঁশের লাঠিটা আরো শক্ত করে ধরে। মনে মনে আল্লাহর নাম স্মরণ করে। চারপাশে বুনো পোকামাকড় আর ঝিঁঝির ডাক। ভোরের লাল আলো ফুটে উঠতে এখনো ঢের বাকি। আঁধখাওয়া চাঁদ মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে। দুনিয়ার সব মানুষ ঘুমিয়ে আছে এখন। ঘুম নেই শুধু আলির চোখে। রাত জেগে থাকতে থাকতে রাতকে এখন তার দিনের মতোই লাগে। রাতের প্রকৃতি তার বড়ই আপন।

 

একটু পর মোয়াজ্জিনের ডাকে জেগে উঠবে সবাই। মাঠ ঘাট সব সরব হয়ে উঠবে। আল্লাহর কি মহিমা। দুনিয়ার মানুষ যখন নিদ্রায় নিমগ্ন তখন রাতের প্রাণীরা জেগে ওঠে। আহাম্মদ আলির ভাবনা এখন ঝোপটাকে ঘিরেই। মাছশিকারির ট্যাটার মতো স্থির দৃষ্টি ঝোপটাতে। কান খাড়া করে আছে শব্দটাকে লক্ষ করে। আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে হাঁটছে সে।

 

লাইটটা কোমরে গুঁজে রাখলো আলি। আলো দেখলে শিয়ালটা পালিয়ে যেতে পারে। বাঁশের লাঠিটা আরো শক্ত করে ধরে। এতে বাড়তি একটা শক্তি আসে দেহে। মনের শক্তির সাথে দেহের শক্তি যোগ হলে দুনিয়ার সবকিছুই জয় করা যায়। বড়ো গাছটাকে আড়াল করে দাঁড়ালো আলি। দুইটা শিয়াল শুয়ে শুয়ে মুরগীর নরম হাড়গোড় খাচ্ছে।

‘ইতরগুলা, আমারে রাস্তায় নামাইতে চাস, না! তোগো হাড় আমি চিবাইয়া খামু আইজ।’

 

কথাগুলো চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছে করলেও আলি বলতে পারছে না। দুইটাকে একসঙ্গে মারার ফন্দি আটলো সে। মনের ভিতর যুবক বয়সটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। একটার বেশি বাড়ি দেয়া যাবে না। এক বাড়িতেই কাত করতে হবে। আলি আরেকটু বায়ে সরে আসলো। এবার মনের মতো অবস্থান তৈরি করলো সে। আর দেরি করা যাবে না। দুইটার মস্তক একসাথে চূর্ণ করতে হবে। বিসমিল্লাহ বলে লাঠিটা মাথার উপর তুললো আহাম্মদ আলি। এরপর অতিদ্রুত দুইটি কদম ফেলে আঘাত হানলো শিয়াল দু’টোর মাথায়। মোক্ষম জায়গায়ই লেগেছে। পরপর আরো দুইটা বাড়ি মারলো প্রথম শিয়ালটার মাথায়। আগে একটাকে কাবু করতে চায় সে। তারপর দ্বিতীয়টার ব্যাপারে চিন্তা করা যাবে। দ্বিতীয় শিয়ালটা মাথা কাত করে দৌড় দিয়েছে উত্তর দিকে।

 

প্রথমটা কাবু করার পর আহাম্মদ আলি দৌড়ে দ্বিতীয় শিয়ালটার পিছনের পায়ে আঘাত করলো। ব্যাঙের মতো লাফাতে লাগলো শিয়ালটা। এরপর আবার একটু সামনে গিয়ে ওটার সামনের পায়ে আঘাত করলো আলি। এটাকে জীবিত রাখতে চায় সে। ল্যাঙড়া শিয়ালটাকে ফার্মের দক্ষিণের আমগাছটায় বেঁধে রাখলে, আর কোনো শিয়াল ভয়ে আসতে চাইবে না ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা ভেবে।

 

আহাম্মদ আলির চোখে মুখে বিজয়ের চিহ্ন। মোয়াজ্জিনের মিষ্টিমধুর আজানের সুর ভেসে আসছে মসজিদ থেকে। ল্যাঙড়া শিয়ালটাকে গাছের সাথে বেঁধে সে চলেছে মসজিদের দিকে। ভোরের ঠান্ডা বাতাসে প্রশান্তির নিঃশ্বাস টানছে আলি। মুখে তার রাজ্য জয়ের হাসি।

 

 

%d bloggers like this: